আমি একসময় বাজার করতে খুব পছন্দ করতাম। বাজার করাটা আমার কছে খুব ডাইনামিক আর চ্যালেঞ্জিং বলে মনে হত। অনেক আইটেমের ভিড়ে ভালো ও সতেজ জিনিস দামাদামি করে কিনতে পারাটা আমার কাছে এক ধরনের দক্ষতা বলে মনে হয়। বেশিরভাগ বিক্রেতারা দেখা যায় ভালো যে কোন জিনিসের সাথে খারাপ জিনিস দেবার তালে থাকে। আরও কত ধরনের যে রঙ্গ হয় বাজারে তা যারা বাজার করেন, কম বেশি সবারই টুকটাক অভিজ্ঞতা আছে।
ছোটবেলায় আব্বা বাজার থেকে আসার পরেই মোটামুটি প্রতিদিনই বাসায় ঝামেলা লেগে যেত। কারন আর কিছু না, আব্বা বাজার করেছেন আর অর্ধেক বাজার ফেলে দিতে হয়নি এমনটা কখনও ঘটে নি। আমার মা বেশ চুপচাপ শান্ত স্বভাবের মানুষ, কিন্তু আব্বার বাজার প্রায়ই উনার ধৈর্যচ্যুতি ঘটাত। আমার কিছুতেই মাথায় আসত না যে এতো পচা জিনিস আব্বা কি কখনও দেখে আনে না? ছোট থাকতে আব্বার সাথে প্রায় শুক্রবার সকালে আমি অথবা ভাইয়া যেতাম বাজার করতে বা দেখতে। বাজার শেষে তালমিসরি নামক আমার এক পছন্দের মিষ্টান্ন হাতে করে বাসায় ফিরতাম। আহ! মিষ্টি খুব পছন্দ করতাম ছোটবেলায়, এখন একদম খেতে পারি না। যাই হোক, একটু বড় হয়ে ধরতে পারলাম আব্বা কেন এতো খারাপ আর পচা জিনিস নিয়ে আসতেন বাজার থেকে। উনার দর্শন খুব সিম্পল ছিল, আমি কাউকে ঠকাবো না, আমাকেও কেউ ঠকাবে না। বাজে মাল গছিয়ে দেবার জন্যে শতভাগ আদর্শ একজন মানুষ। একটু “এলাকার মুরুব্বী” টাইপের মানুষ ছিল তো, বিক্রেতারা ডেকে এনে মোটামুটি জোর করে যা লাগবে না তাও বাজারদরের থেকে বেশি দামে গছিয়ে দিত, অবশ্যই বাজে মাল সহ। একদিন আমার খুব গায়ে লাগলো, বিক্রেতার সাথে বেঁধে গেলো, ফলশ্রুতিতে বাজারে যাওয়া বন্ধ। যাই হোক, আমার রিপোর্ট পেয়ে আব্বারও বাজারে যাওয়া বন্ধ হল, সেই যে বন্ধ হল কয়েক দশকে উনার আর বাজারে যাওয়া হয় নি। উনি অবশ্য এতে মোটেও দুঃখিত হন নি, বাজার করাটা উনার একদম পছন্দের কিছু ছিল না, হাঁপ ছেড়ে বেচেছেন। এত বছর পর এখনও যদি কখনও আমাদের ব্যস্ততা বা অন্য কোন কারনে বাজারে যাবার নিতান্তই দরকার পড়ে তাও উনি এড়িয়ে যান।
আব্বার বাজার বন্ধ হবার পর ভাইয়ার কাধে চাপে এই দায়িত্ব। সম্ভবত তখন ভাইয়া পঞ্চম/ষষ্ঠ শ্রেণীতে পরতেন, আমরা পিঠাপিঠি ছিলাম। বাসায় বাজার নিয়ে স্বস্তি ফিরে এলো। ভাইয়া খুবই ভালো বাজার করতেন এবং যথেষ্ট কম দামেই ভালো জিনিস নিয়ে আসতেন। সবচেয়ে ভালো যেটা করতেন সেটা হচ্ছে মাছ, দেশের সব পচা মাছ বাসায় নিয়ে আসার ক্ষেত্রে আব্বার যে সুনাম ছিল, ভাইয়া সেখানে আশ্চর্যজনকভাবে তাজা মাছ নিয়ে আসতেন। বড় হবার পর আমার মনে হয়েছে হয়ত ছোট দেখে কেউ ভাইয়াকে ঠকায়নি, বা হয়ত উনি আসলেই ভালো জিনিস চিনতেন। যাই হোক, কিছুদিন যেতে না যেতেই নতুন সমস্যার সূচনা হল। ভালো বাজার করলেও উনি আসলে তো ছোট ছিলেন, বাজার উনার ইন্টারেস্টের জায়গা হবার কথা না। তাতেই হয়ত বাজারের প্রেশার যখন বাড়তে থাকলো বা আইটেম বেশি থাকলে উনি ভুল করতে লাগলেন। ভুল বলতে, তাঁর কি কি আনতে হবে সেটা মনে থাকত না! দেখা যেত আলু, পিয়াজ,মরিচ, শাক, কোন একটা মাছ আনতে বলা হয়েছে, উনি আলু, রসুন, কুমড়া আর অন্য কোন একটা মাছ এনেছেন। মরিচ ছাড়া তো আর রান্না হবে না, তাই আবার বাজারে যাবার দরকার হত। দ্বিতীয়বার আর ভাইয়া বাজারে যেতে চাইত না। বাধ্য হয়ে দেখা যেত মাকে “ম্যানেজ” করতে হত। যাই হোক অনেক চিন্তা-ভাবনার পর একটা সমাধান বের করা হল, বাজারের ফর্দ বানাতে হবে। আমার মাথা থেকে এই বুদ্ধি আসলো, বাজারে দেখেছিলাম অনেককে। আমার কাধেই ফর্দ তৈরির দায়িত্ব পড়লো। আমি তো খুব খুশি, বড় বড় করে ফর্দ লিখতাম, আর ভাইয়া আসার পর সব বাজার বের করে ফর্দের সাথে মিলাতাম। স্কুলের শিক্ষকদের মতো করে টিক মার্ক দিতাম। আহ! ভালো ভাব চলে এসেছিলো, কোন ভুল পেলে তো মাটির এক বিঘত উপর দিয়ে হাঁটতাম ভাবের ঠেলায়।
যাই হোক কিছুদিন পরেই আরেকটু বড় হলে বাজার করার ভার আমার কাধে চলে আসে। ভাইয়ার মত আমার ভাগ্য আমার প্রতি অত সদয় হয়নি! বাজার যে কতটা কঠিন সেটা আমি হাড়ে হাড়ে ততদিনে টের পেয়ে গেছি। এতো গ্যাঞ্জামে আমার অস্থির লাগতো। সবচেয়ে বড় সমস্যা হতে লাগলো আমাকে ঠকানোটা আমি একদমই পছন্দ করতাম না। যতই বেছে নেই না কেন, দেখা যেত কোন এক ফাঁকে একটা দুইটা বাজে জিনিস ঠিকই ঢুকিয়ে দেবার চেষ্টা করেছে বা দিয়েছেও। দিশেহারা বোধ করতাম প্রায়ই। একসময় এমন হতে লাগলো, যে বিক্রেতা আমাকে একবার ধোঁকা দিয়েছে তাঁর কাছ থেকে দ্বিতীয়বার কিছু কেনা বন্ধ করে দিতে লাগলাম! মজার বিষয় হচ্ছে বাদ দিতে দিতে বছরখানেক পর বাজার করার মত অপশন আমার কমে গেলো। ভিষন বিপদে পড়ে গেলাম, ভাবছিলাম দূরে কোথাও থেকে বাজার করে আনবো। কিন্তু সেটা তো আসলে ফিজিবল অপশন ছিল না, তাই অন্য কোথাও আর যাওয়া হয়নি। তাই বাস্তবতা মেনে নিয়ে কৌশল পরিবর্তন করলাম। বেশ কিছুদিন বাজারে যাওয়ায় আমার ভালোই ধারণা ছিল বাজারে বিক্রেতাদের বিভিন্ন ক্লাস আছে, কেউ কেউ আছে তুলনামূলক ভালো পন্য রাখে, কেউ একদামে বিক্রি করে, কারো কাছে মিক্সড কোয়ালিটি থাকে, কোথাও দরদাম করে বাছাই করে আনার সুযোগ থাকে, কেউ একদম বাছতে দেয় না, কেউ আছে পুরোই অসৎ, যতই দাম দিন না কেন খারাপটা দিবেই। যেহেতু মধ্যবিত্ত পরিবারে বড় হয়েছি, টাকা একটা বড় ফ্যাক্টর ছিল, তাই একদম অসৎ দোকানগুলো বাদ দিয়ে শুধু পন্যের কোয়ালিটি আর দাম ব্যালান্স করে বাজার করা শুরু করলাম। মজার বিষয় হল, বাজার করতে করতে আমার একটা পরিচিতি দাঁড়িয়ে গিয়েছিলো যে আমি সবসময় ভালো জিনিস নেই, দরকার হলে একটু বেশি দামও দিব কিন্তু খারাপ কিছু দিলে আমি আর আসবো না। এমনও হয় যে আমি ফোন দিলে সব প্যাকেট করে রাখে শুধু এসে আমি নিয়ে যাই, বা অনেক সময় রিক্সায় করেও পাঠিয়ে দিয়েছে। শুধু নিজের বাসায় না, বাজার করার আমার এত নামডাক ছিল যে অনেক বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়স্বজনদের বিভিন্ন উৎসবে আমার ডাক পরত বাজারের জন্যে! হাহাহা!
যাই হোক, অনেক বেলা গড়িয়ে গেছে, সম্প্রতি করোনার মধ্যে বাসা পরিবর্তন করতে হয়েছে, বিশাল একটা দুর্যোগের মধ্য দিয়ে গিয়েছিলাম মহামারির মধ্যে। নতুন জায়গায় বাজার খুব বেশি বড় না, তবে বেশ ফ্রেশ সবজি পাওয়া যায়, কাছাকাছি কোন গ্রাম থেকে আসে সম্ভবত। বাজার করতে ভালোই লাগত, নির্ঝঞ্ঝাটেই চলছিলো এতদিন। কিন্তু ইদানীং আবার সমস্যায় পড়ছি। করোনায় অর্থনৈতিকভাবে বেশ বড়সড় একটা ধাক্কা খাওয়া আমি খেয়াল করেছিলাম ছোট ছোট ব্যবসায়ীরা ও শ্রমিকরাও বেশ ভালোই বিপদে ছিলেন। তাই চেষ্টা করতাম বাজার বা অন্য যেকোনো ছোট বিক্রেতাকে তাঁর দ্রব্যের মুল্য থেকে সামান্য কিছু বেশি দেবার জন্যে, পকেটে যা থাকতো আর কি। তো আমার এখানে মোটামুটি এরকম একটা ইমেজ দাঁড়িয়ে গিয়েছিলো যে আমি লোক ভালো, আর কোন দামাদামি করি না, উপরন্তু বখশিশও দেই। করোনার প্রকোপ তো কমে গেছে, কিন্তু ইদানীং দেখি আমাকে কেউ দাম ছাড়ছে না। কিছুটা বিরক্ত হয়ে গিয়েছিলাম, কারন এখন দাম যেটাই হোক কেউ তো আর আগের মত বিপদে নাই। আর যত যাই কিছুই হোক, বাংলাদেশে বাজার একদাম হয়ে যাওয়ার মত পরিস্থিতি এখনও হয় নি। একদিন বাজারে গিয়েছি রুই মাছ কিনতে, যাওয়ার পথে পরিচিত একজনের কাছে শুনলাম ৩২০ টাকা কেজি নিয়েছে। বাজারে গিয়ে দেখি আমার কাছে ৪০০ টাকা চাচ্ছে, কোন বিক্রেতাই দাম ছাড়ছে না। শেষে বিরক্ত হয়ে বাজার থেকে বের হয়ে একটা সুপার শপে ঢুকলাম, ওখানে দেখি একই সাইজের রুই ৩০০ টাকা কেজি বিক্রি করছে। আমার বেশ মন খারাপ হল, মাছের অর্ডার দিলাম সুপারশপে। দেখি বাজারের এক মাছওয়ালা সুপারশপে চলে এসেছে, এসে আমাকে ৩৮০ টাকা দরে মাছ নেবার জন্যে জোরাজুরি করছে। বিরক্ত হয়ে বললাম আমি মাছ কিনে ফেলেছি এখান থেকে। বের হয়ে দেখি, সুপারশপের সামনে আরেকজন মাছওয়ালা দাঁড়িয়ে আছে, সে ৩৫০ টাকায় বেচবে!!
সবজিওয়ালাদেরও একই অবস্থা। এখন বিরক্ত হয়ে বাজারে যাওয়া ছেড়ে দিয়েছি, যা লাগে সুপারশপ থেকেই কিনি, কোন দাম দরের ঝামেলা নাই, জিনিস খারাপ থাকলে পাল্টায়ে নেই, কোন কথাবার্তা বলার দরকারও পড়ে না। পেমেন্ট সব কার্ডে হয়ে যায়, রিকশাও তারাই ঠিক করে দেয় প্রায়ই। হঠাত মাঝে মধ্যে খুব বেশি বাজারে যাবার দরকার পড়লে যাই, নিয়ে আসি; কত দাম সেটা ছাড়া আর একটাও কথা বলি না। প্রায়ই অনেকে আমার রাগ ভাঙ্গানোর চেষ্টা করে, কিন্তু আমি আসলে তো রাগ করিনি, হাল ছেড়ে দিয়েছি। তবে মাঝে মধ্যে পুরনো দিন, বাজারের বিশাল আয়োজন, ভালো জিনিস কেনার চ্যালেঞ্জ খুব মিস করি।
ছবিসুত্রঃ গুগল
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে মার্চ, ২০২১ রাত ১০:০১