[জনৈক ব্যক্তি আমায় শুধালো এসএসসি পরীক্ষা নিয়ে ইতিবাচকতার ইতি টানিয়া কেন নেতিবাচকতার জোয়াল টানিতেছি ।তারই পরিপ্রেক্ষিতে শুরু হইলো এই ইতিবাচকতার সন্ধান]
মাত্র পাঁচমাস আগের ঘটনা ।আমার বাল্যবন্ধু খোকন আসিয়া পড়ার ঘরে পিছনদিক হইতে আমার চোখ টিপিয়া ধরিল । কথা বলিতে বলিতে আমার খাতায় সে একটি মস্তবড় প্রশ্নবোধক চিহ্ন আঁকিল , নীচে লিখিয়া দিল---
"তোমার খাতার প্রথম পাতায় এঁকে দিলাম আলপনা
আমার ছবি কইবে কথা যখন আমি থাকবো না"
লিখিয়াই আমাকে দেখাইলো । আমি জানি খোকনের জীবনটাই একটা মস্তবড় চিহ্ন । আব্বাকে হারাইয়াছে পাঁচ বছর বয়সে । বিধবা মা প্রাইমারী স্কুলে মাস্টারি করিয়া যা পান , তাতে দু'জনের সংসার চলে না । সেইজন্য খোকন সকাল বিকাল দু'টি ছেলেকে অক্ষর পরিচয় শিখাইয়া পাঁচটি টাকা পায় ।এই করিয়া সে খুব ভালো ফল করে নাই।ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার আর মাত্র ১৫/২০ দিন আছে। খোকনকে কিছুটা বিচলিত দেখিলাম ।
পরীক্ষার শেষের তিনমাস বেশ আমোদেই কেটে গেল।এর ফাঁকেও খোকনের মুখে আমি দেখিয়াছি আসন্ন মেঘ ।অবশেষে সেই দিন আসিল। আমরা পত্রিকার খোঁজে রেল স্টেশনে গিয়া ভিড় করিলাম। সত্যিই অঘটন ঘটিল । আমার রোল নং দ্বিতীয় বিভাগে দেখিতে পাইলাম ।পত্রিকার কোথাও খোকনের রোল নং খুঁজে পাওয়া গেল না , খোকনকে সান্ত্বনা দেয় কার সাধ্য । মনে হইতেছিল আমি পাস না করিয়া যদি খোকন পাস করিত তাহা হইলে বিধবা মায়ের মুখের হাসি দেখিয়া আমার প্রাণ জুড়াইত ।
কাক না ডাকিতেই লোকের গন্ডগোলে জাগিয়া উঠিলাম । সুইসাইড ---- খোকন সুইসাইড করিয়াছে ।শেষ রাতে খোকন রেললাইনে মাথা দিয়া আত্মহত্যা করিয়াছে , চিৎকার করিয়া আমি কাঁদিয়া উঠিলাম ।
চুপে চুপে একদিন খোকনের একদিন খোকনের রক্তরঞ্জিত তৃণের উপর পলাশের চারা রোপন করিয়া আসিয়াছি , এককালে লোকেরা বলিবে "কি চমৎকার" । আমি জানি এ রক্তপলাশ খোকনের বুকের রক্তে রাঙ্গা ---- আমি জানি এ বসন্তের মাধুরী । ------ (আমার জীবনের স্মরণীয় স্মৃতি রচনাটির ভাবার্থ অনুকরণ করিয়া লিখিত)
১......
না , আমার খাতায় কেউ প্রশ্নচিহ্ন আঁকিয়া দেয়নি , পরীক্ষার খাতায় কোনদিন খোকনের কথা আমায় লিখিতেও হয়নি ।আমার বয়সকাঁটা যখন ৯ এ আঁটা , এমনতর রচনা পঠন বিষন্নতার মেঘে আকীর্ন হইয়াছিল আমার মানসপট, হাহাকারে, অস্ফূট কান্নায় ঝরিয়াছিল অদৃশ্য অশ্রু। দশকের পর দশক কত সহস্র অজানা খোকনের দেহের বা হৃদয়ের প্রয়াণ হইয়াছে , আকুঞ্চিত হয়েছে কত স্বপ্ন ।
খোকন বড় অসময়ে জন্ম নিয়েছিলে তুমি । সেদিনগুলো কেবলই স্মৃতি। বিগত অর্ধযুগ ধরিয়া মেট্রিক/ইন্টারমিডিয়েটের রেজাল্টের প্রহরগুলো খোকনের জন্ম দেয় না , সব ভেদাভেদের বেড়াজাল বিলীন করিয়া সবচেয়ে পেছনের খোকন আর সবচেয়ে সামনের সুমনের পুনর্জন্ম ঘটে একই (এ+ )সত্ত্বার মাঝে।
রক্তপলাশের গাছটা অনেক বড় হইয়াছে , বসন্তাগমনে সে গাছের ক্রন্দন শুনি,
চোখ খোলো খোকন , চেয়ে দেখো , এখন আর কোন প্রাণের অপচয় হয়না , লক্ষ্ মেধাবীর সাফল্যে আজ হাসির মেলা।
২.......
বিগত সহস্রাব্দের শেষ ৫ টি বছর রাজধানীর শ্রেষ্ঠ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে ছাত্র হিসেবে খুব কাছে থেকে দেখিয়াছি। শিক্ষাবোর্ডে ২/১ টি স্থান পাওয়াই সে সময়টায় বিরাট সাফল্য হিসেবে যেখানে পরিগণিত হইত ,সেখানে আইডিয়াল স্কুলের ডজনে ডজনে মেধাতালিকায় স্থান প্রাপ্তিতে অসম্ভব রকমের গর্ব অনুভব করিতাম । কিন্তু সে গর্বের বাহ্যিক কোন অনুবাদ হইয়াছে , এমনটি মনে পড়ে না । রেজাল্টের সময়গুলোতে স্কুল সাড়াশব্দহীন থাকিতো , অবশ্য দেড় ক্রোশ দূরে আকাশী ইউনিফর্মের মেয়েদের স্কুলটির নৃত্য সহকারে বাদ্য বাজানোর খবর ছাড়া আর অন্য কোথাও সাড়াশব্দ মিলিতো না ।
নবসহস্রাব্দের প্রথম বর্ষ তথা পুরনো অকেজো স্টার/স্ট্যান্ড পদ্ধতির গোধুলি লগনে আমার ডাক আসিলো । ফলাফলে দেখিলাম আমি দাঁড়াইয়াও নির্বিকার রহিয়া গিয়াছি ।বছর বছর সারা দেশের মাঝে বিপুল ব্যবধানে প্রথম হওয়ার এমন সাফল্যে কেন নির্বাক রহিয়া যাইতে হয় ,হাতে কলমে সে প্রশ্নের জবাব অবশ্য মিলিলো ।
দিন বদলাইয়া যায় ,দেড় ক্রোশ দূরের বিদ্যালয়টির সাথে সাথে আমাদের বিদ্যায়তনেও এখন বাদ্য বাজিয়া উঠে । ৮৪০ জন পরীক্ষার্থীর মাঝে ৭৮০ জন প্রথম আর বাকি ৬০ জন যখন দ্বিতীয় হয় , তখন আমি তৃতীয়কে খুঁজিয়া মরি ।
বড্ড বেশি পুরনো আমি , এখন আর কেউ তৃতীয় হয়না।