somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পত্রিকার স্মৃতি :: সাপ্তাহিক বিচিত্রা

৩১ শে মার্চ, ২০১২ রাত ১২:৩৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আমার বর্ণশিক্ষার বয়স আর পত্রিকা পড়ার বয়স মোটামুটি কাছাকাছি।

সময়টা তাহলে ৮৮ কি ৮৯ ই হবে। বাংলা পত্রিকা নামক জিনিসটা দুর্লভই ছিল বৈকি।ইরানে বাংলাদেশের পত্রিকা যেত না, আর না যাওয়াটাই স্বাভাবিক।ইরাক সীমান্তবর্তী ইরানের ঐ অংশে সব মিলিয়ে বাংলাদেশী ১০/১২ জন ডাক্তার ছিলেন। বছরে গড়ে তিন/চারজন দেশ ঘুরে যেতেন, যাবার সময় লাগেজে ভরে কিছু পত্রিকা নিতেন। সেই পত্রিকা এরপর হাতে হাতে বদল হত হাজার হাজার বর্গ কিলোমিটার। কতবার করে পড়া হত তার ইয়ত্তা নেই। ছয় মাস কি এক বছরের পুরনোর পত্রিকারও আবেদন কমত না এতটুকু।

পত্রিকা বলতে তখন একটা পত্রিকাই চিনতাম- বিচিত্রা। সম্ভবত সে সময়কার সবচেয়ে জনপ্রিয় সাপ্তাহিক। অন্তত ডাক্তার আংকেলরা বিচিত্রাই সাথে নিতেন। পত্রিকার সব পড়ার বয়স আমার তখন হয়নি, তবুও খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে যতটা পারি পড়তাম। কাভার পেজ উল্টালেই চোখে পড়ত রনবী'র টোকাই। টোকাইয়ের দু'টো ডায়ালগ পড়ার জন্য কখনও বা অপেক্ষা করতে হত মাসের পর মাস। সেসব ডায়ালগের মর্মার্থ বুঝতাম যে তা না , তার চেয়ে বরং কার্টুনটাই দেখতাম। টোকাই ছিল মূলত স্যাটায়ার বেইজড কার্টুন, সমাজের অসংগতিগুলো তীক্ষ্ণ ফলায় বিদ্ধ করত সে একটা বাক্যে। সেই টোকাইয়ের দেখা পাই না অনেকদিন , টোকাই কি বেঁচে আছে?

আরেকটা কার্টুন থাকত শেষ পাতার পুরোটা জুড়ে , ভীষণ মজার কার্টুন। এ কার্টুনের চরিত্রগুলো টোকাইয়ের মত ভারী ভারী কথা বলত না। মিষ্টি মিষ্টি কথায় ভরা থাকত। হ্যাঁ, আসলেই মিষ্টি , আলাউদ্দিন সুইটসের মিষ্টান্ন। এখন বুঝতে পারি , পাতা জুড়ে কার্টুন ছিল আসলে আলাউদ্দিন সুইটমিটসের বিজ্ঞাপন। দেশে যখন ফিরেছি আলাউদ্দিন সুইটমিটসের জৌলুস নিভতে শুরু করেছে , কিন্তু সেই কার্টুনগুলোর স্মৃতিতে ভর করে একটা সময়কার তাদের তোলা ঝড় অনুভর করি। বেঁচে আছে আলাউদ্দিন সুইটমিটস? শেষ কবে কে কে গিয়েছেন?

টোকাইয়ের সাথে একই পাতায় থাকত সম্পাদকীয়। সে পাতা উল্টালে শিরোনামে থাকত "প্রেসিডেন্ট"। সপ্তাহের প্রেসিডেন্টের প্রধান কর্মকান্ড সম্বলিত সংরক্ষিত রিপোর্ট বা ফিচার। রাজনীতির খটোমটো কথা বুঝার বয়স তখন আমার হয়নি, আমি শুধু প্রেসিডেন্ট এরশাদের ছবি দেখেই সে পাতা থেকে বিদায় নিতাম। যতটা মনে পড়ে, প্রেসিডেন্টের জনসভার ছবিই বেশির ভাগ সপ্তাহে থাকত সেখানে।

বিচিত্রার একটু গভীরে ঢুকলে সাক্ষাৎকার চোখে পড়ত। সেসব বুঝার মত বয়সও হয়নি, তাই পড়তাম না কখনোই। রাজনীতি নামে সম্ভবত আলাদা একটা পাতাও ছিল, সংঘাত কিংবা হরতালের খবরের কথা আবছাভাবে মনে পড়ে।

পত্রিকা তো দূরের কথা, ইন্টারনেটবিহীন, টেলিফোনবিহীন সে সময়ে বাংলাদেশী পরিবারগুলোর একমাত্র ভরসা তখন বিবিসি বাংলা সার্ভিস। আমার আব্বাকে দেখতাম তুমুল সংগ্রাম করে হাজার চ্যানেলের কিচিরমিচির থেকে বিবিসি খুঁজতে। এমন অনেকদিন গেছে , চ্যানেল ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয়নি , খবরও জানা হয়নি।

শেখ হাসিনার ছবি বিচিত্রার পাতা জুড়ে খুব বেশি করে দেখতাম। ৯১ এ নির্বাচন হবে , সবার কাছে শুনলাম শেখ হাসিনা জয়ী হতে চলেছে, ডঃ কামাল হোসেন হবেন প্রেসিডেন্ট। আমিও তাই জানি , হঠাৎ করে বিবিসি শুনে আমার আব্বা বললেন -- "খালেদা জিয়া জিতে গেছে"। কথাটা এখনও কানে বাজে।

খালেদা জিয়ার নামও ততদিনে কম শুনিনি।ইরানীদের কাছে প্রেসিডেন্ট জিয়া বেশ পরিচিত ছিলেন, বাংলাদেশ সম্পর্কে দু'টো কথাই মনে হতে তারা জানে , এক, বাংলাদেশ ডাক্তারে ভর্তি , দুই, জিয়া বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। আমার কাছে খালেদা জিয়া তখনও জিয়ার বউ, এর চেয়ে বেশি কিছু ছিল না। তবে সবচেয়ে অবাক ব্যাপার হল, খালেদার কোন চেহারাই আমি মনে করতে পারলাম না। কখনও কোথাও , এমনকি বিচিত্রার পাতায় তার ছবি দেখেছি এমনটাও মনে পড়ল না।

সেই খালেদা জিয়াকে প্রথম দেখলাম ৯৩ এর জানুয়ারীতে , এক ডাক্তার আংকেলের নিয়ে যাওয়া বিচিত্রার কাভার পেজে। পত্রিকার শিরোনাম ছিল -- গাছ লাগান, পরিবেশ বাঁচান। ব্যাকগ্রাউন্ডে সবুজ মাঠ, মাঝে সাদা শাড়ি পড়া খালেদা জিয়া। সম্ভবত প্রধানমন্ত্রীর বৃক্ষরোপন অভিযানকে নিয়েই কাভার স্টোরি ছিল।

বিচিত্রার খুব জনপ্রিয় একটি অংশ ছিল প্রবাসীদের পাঠানো চিঠি বা লেখা। বলতে গেলে ঐ অংশটুকুই ভীষণ মনযোগ দিয়ে পড়তাম। বেশিরভাগ চিঠি যেত মধ্যপ্রাচ্য কিংবা যুক্তরাষ্ট্র/যুক্তরাজ্য/জাপান থেকে। খুব মনযোগ দিয়ে খেয়াল করতাম কে কোথা থেকে লিখেছে। প্রবাসী মানুষগুলোর দুঃখ-কষ্ট-আনন্দের পরিস্কার একটা ছবি দেখতাম লেখার মাঝে। অনেকে প্রবাসীদের সংস্কৃতি , জীবন-যাপনের স্বাচ্ছন্দ্য, প্রযুক্তি নিয়েও লিখতেন।

খেলার খবরের জন্য বরাদ্দ থাকত সাধারণত দু'পৃষ্ঠা। অবধারিতভাবেই সেটা দখল করে রাখত ঢাকার ফুটবল মাঠ, আরও স্পষ্ট করে বললে- মোহামেডান আবাহনী। এর ব্যতিক্রম দেখেছিলাম বিশ্বকাপের সময়, আর্জেন্টিনা কিংবা ক্যামেরুনকে নিয়ে উন্মাদনা নিয়ে।

চলচ্চিত্র নিয়ে যে দু'টো পাতা থাকত , সে অংশ নিয়ে রয়েছে মজার স্মৃতি। আপ্রাণ চেষ্টা করতাম , সে পাতাগুলোর দিকে চোখ না দিতে। নায়ক-নায়িকা একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে আছে, এমন খারাপ কাজের কথা ভাবতেই পারতাম না। অবাক হচ্ছেন? আসলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। ইরানের কুর্দিস্তানে যে সমাজ-ব্যবস্থায় বড় হয়েছি সেখানে এমন কিছু আসলেই ছিল কল্পনাতীত। তবুও দু'একজন নায়ক নায়িকার নাম মনে করতে পারি যারা একটু বেশিই আমাকে বিব্রত করত - নতুন, রাণী, সুনেত্রা, অঞ্জু ঘোষ, রুবেল , মান্না।

বিচিত্রার পেছনের পাতায় একটা বিজ্ঞাপনের কথা খুব বেশি মনে পড়ে। ভাঁজ করে রাখা হাঁটুতে মাথা ঠেকিয়ে পেছনে তাকিয়ে আছে ভারী অলংকার পড়া একটি মেয়ে। সম্ভবত আমিন জুয়েলার্সের বিজ্ঞাপন ছিল সেটি। যতটা মনে পড়ে আমার শৈশবের বিচিত্রা-পর্বের পুরোটা সময় জুড়েই সে বিজ্ঞাপনটি প্রকাশিত হত। এর বাইরে মনে পড়ে ব্যাক কাভারে ম্যানোলা ক্রিমের বিজ্ঞাপনের কথা ।

"পত্রিকা" শব্দটা আমি তখন জানতাম কিনা মনে পড়ে না, সম্ভবত পত্রিকাকে আমি "বিচিত্রা" নামেই প্রথম চিনেছি। বিচিত্রাও হারিয়ে গেছে , হারিয়ে গেছে ছোটবেলার বিচিত্র সেসব দিন। শুকনো পাতার মত কয়েকটা স্মৃতি কেবল রয়ে গেছে
৩৩টি মন্তব্য ২৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×