somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

অন্য আজম খান

১৩ ই জানুয়ারি, ২০১৩ ভোর ৪:৫৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


আজম খানকে যেমন করে চেনে, আমি সেভাবে চিনিনি।

ঠিক ১৯ বছর আগের কথা । আমার গল্পগুলো যেমন করে শুরু হয় , এটার শুরুটাও তেমন। আমি প্রাইমারী স্কুলের ছাত্র , সবে মাত্র বাংলাদেশে এসেছি। রামপুরা টিভি সেন্টারের পাশে রোজ ভোরে বন্ধু রুমিকে নিয়ে দাঁড়িয়ে হাঁক দেই --"এই রিকশা যাবেন? মতিঝিল কলোনী?"

মতিঝিল কলোনীর মতিঝিল মডেল স্কুলে তখন আমরা সবে মাত্র ভর্তিযুদ্ধ জয় করেছি। রিকশায় যাবার পথটা বেশ দীর্ঘ , হাজিপাড়া ,রেলগেট, মৌচাক , মালিবাগ , রাজারবাগ তারপর মতিঝিল। এত অল্প বয়েসি আর কেউ বাবা-মা ছাড়া এতটা পথ পাড়ি দেয় না বলে মনে মনে বেশ গর্বও হয় ।যাত্রাপথে চারপাশে যাকেই দেখি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকি , যা পাই বানান করে পড়ে ফেলি।

লাখো মানুষের এই শহরে প্রতিদিন ফোকাসে ধরা হাজারো অচেনা মুখ স্মৃতিতে জমা হয়ে ফ্যাকাশে হয়ে যায় , সেখানে আসে নতুন মুখ । এর মাঝেই প্রথম দেখা মেলে অন্যরকম কেউ একজনের।

ঠিক স্কুল ছু'টির সময়টায় ওপাশের জসিমউদ্দিন রোডের দিক থেকে স্কুলের দিকে একজনকে হেঁটে আসতে দেখি । ফর্সা , একহারা গড়ন, মাথার চুল ছোট করে ছাঁটা , চেহারায় প্রশস্তি। খাকি প্যান্ট আর সাদা শার্টে ভীষণ পরিপাটি লাগে । কারও দিকে না তাকিয়ে একমনে হেঁটে স্কুল পেরিয়ে কলোনীর আরেকটু ভেতরে ঢুকে যান । আর দশটা মুখ ভুলে গেলেও তার শান্ত সৌম্য মুখ আর তালপাতার সেপাই মার্কা দেহের গড়নটা মাথায় শক্ত করে এঁটে যায় , কোথায় যেন ভীষণ রকম আলাদা।

এভাবেই চলতে থাকে দিনের পর দিন , লোকটা হেঁটে আসে , তারপর ধীরে ধীরে হারিয়ে যায়। রুমিকে একদিন জিজ্ঞেস করি , "এই লোকটা প্রতিদিন হেঁটে যায় ....."। কথাটার কোন অর্থ দাঁড়ায় না, আসলে হয়ত জিজ্ঞেস করতে চাই "লোকটা কে? কোথায় যায় প্রতিদিন?" । কিন্তু সে প্রশ্ন অবান্তর বলে করা হয় না, অচেনা একটা লোককে রুমি চিনবেই বা কি করে? আমাকে অবাক করে দিয়ে রুমির কন্ঠে উচ্ছাস ঝরে , "চিনোস না ? সত্যিই ? এ তো আজম খান"। আজম খান বলেই রুমির দায়িত্ব শেষ মনে করে, আর এগোয় না।

এরপর আবার অনেকগুলো দিন চলে যায়। এখন রুমি মাঝে মাঝেই দেখলে বলে উঠে , "আজম খান , আজম খান"। আমি ভাবি , আজম খান লোকটার নাম, তারপর ? রুমি কি করে চেনে ? আর আজম খান হলেই বা কি ?

কৌতুহল মেটাতে আবার কোন একদিন আজম খান প্রসংগের অবতারণা করি। রুমি এবারও অদ্ভূত জওয়াব দেয় , আজম খানের বিয়ে বিষয়ে। আজম খানকে সেদিনই তার মেয়ের হাত ধরে উল্টো পথে হাঁটতে দেখি, এবার কলোনীর ভেতর থেকে মডেল স্কুলের দিকে। মেয়েটা মতিঝিল মডেল কিংবা আইডিয়ালের ইউনিফর্ম পড়ে আছে(এখন ভাল করে মনে পড়ে না) , রুমির কথা তাই বিশ্বাস হয় না।

পরের বছর নতুন ক্লাশে উঠে , রুমিকে নিয়ে স্কুলের এক টিচারের খোঁজে কমলাপুর জসিমউদ্দিন রোডে যাই । খানিকটা ভেতরে ঢুকেই দেয়ালে অনেক গ্রাফিটি চোখে পড়ে , সাদাকালো সেসব গ্রাফিটিতে দাড়িওয়ালা কেউ একজনকে গিটার ধরে রাখতে দেখা যায়, দাড়িওয়ালা সে লোকটিকে দেখে চেনা কারও কথা মাথায় আসে না । গলির আরও খানিকটা ভেতরে গেলে গ্রাফিটির মিছিল গাঢ় হয় , সাথে নানান লেখা/লিরিকস চোখে পড়ে, এরমাঝে "আজম খান ফ্যান ক্লাব" লেখা দেখে বেশ থমকে যাই।

শুধু আজম খান বলেই রুমি কেন ক্ষান্ত দিত , সে ব্যাপারটি নিয়ে প্রথমবারের মত কিঞ্চিত ধোঁয়াশা কাটে। আজম খান নিশ্চয়ই ভয়াবহ বিখ্যাত কেউ হবেন , নামেই তাকে চেনার কথা। আমি তখন মাত্র ১ বছর বাংলাদেশে , বয়স সবে দু'অংক ছুঁয়েছে , পপ-ব্যান্ড নিয়ে বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই, আর এলআরবি , মাইলসের আড়ালে আজম খানের একক অবস্থানও ততদিনে চাপা পড়ে গেছে । সব মিলিয়ে এতদিন পর যখন ভাবি , নিজেকে আর দোষ দিতে পারি না।

এখনকার মত চাইলেই তখন কারও গান ডাউনলোড করে শোনা যায় না , টিফিনের টাকা জমিয়ে ক্যাসেট কিনতে চাইলেও ভুখা থাকতে হয় পুরো মাস। সে কারণে আজম খানের প্রথম গান শুনতে আমাকে বেশ খানিকটা অপেক্ষা করতে হয়। বিটিভিতে সম্ভবত ইত্যাদিতে প্রথম তার গান শুনে প্রচন্ড হতাশ হই । ব্যান্ড গুরু, পথিকৃত ব্যাপারগুলো বুঝার মত বয়স তখন আমার হয়নি , বিখ্যাত গায়কের বলতে আমি কেবল বুঝি শ্রুতিমধুর বা হৃদয়গ্রাহী কিছু । প্রত্যাশার বিপরীতে যে গানটি শুনি , সেটি যথেষ্ট কৌতুকপ্রদ লাগে।

আরও চমক তখনও অপেক্ষা করে থাকে। সে বছর শেষে বার্ষিক পরীক্ষার পর ছুটিতে নানাবাড়িতে "একাত্তরের দিনগুলি" সহ মুক্তিযুদ্ধের ঘটনা সম্বলিত কয়েকটি বই পড়ার সুযোগ হয় । আজম খান নামটি সেখানে দেখে চমকে উঠি । মুক্তিযুদ্ধ এখন আমার কাছে এখন যতটা দূরবর্তী অতীতের মনে হয় , ছোটবেলায় তার চেয়েও অনেক বেশি অতীতের মনে হত (বড়দের মুখে কেবল শুনতাম বলে হয়ত , কিংবা ছোটবেলায় অতীতকে বেশি অতীত মনে হয়)। যে আজম খানকে স্কুলের সামনে আমি দেখি , তার চেহারায় বয়সের কোন ছাপ নেই , মাথায় কোন পাক চুল নেই ,বয়স ৩০ এর বলে কিছুতেই মনে হয় না, সে কি করে মুক্তিযুদ্ধ করল সে হিসাব কিছুতেই মেলাতে পারি না।

সম্ভবত সে ডিসেম্বরেই পত্রিকায় বিজয় দিবস সংখ্যায় বুড়ো খোকার (তৎকালীন এমপি এবং মন্ত্রী সাদেক হোসেন খোকা) স্মৃতিচারণে আজম খানের কথা আসে , আমার বিস্ময় আকাশ ছোঁয়।

অষ্টম শ্রেণীতে যখন আমি, আপাত কৌতুকপ্রদ আজম খানের সংগীতাঙ্গনে পথিকৃতের ভূমিকা , আর চিরনবীন শিল্পীর মুক্তিযুদ্ধে ঢাকায় অপারেশনগুলোর কথা ততদিনে বেশিরভাগই জানা ।রোজ রোজ তাকে তখনও দেখি , কিন্তু অন্য দৃষ্টিতে । চুলে একটু একটু পাক ধরছে কেবল , শরীরটা অবশ্য রয়ে গেছে আগের মতই। এমন বীরকে দেখলেই ভাল লাগে , কিন্তু সংকোচের কারণে কাছে গিয়ে কথা বলা হয়ে ওঠেনা।

সে বছরটি সাথে করে নিয়ে আসে নতুন চমক । ৯৯ এ বাংলাদেশ বিশ্বকাপ ক্রিকেট খেলবে , চারদিকে সাজ সাজ রব। বিশ্বকাপের ৭/৮ মাস আগে ক্রীড়া ম্যাগাজিনের পাতা ওল্টাতে গিয়ে চোখ প্রায় বিস্ফোরিত হয় হয়। আজম খানের সাক্ষাৎকার "বিশ্বকাপ দলে জায়গা পেতে রাতদিন প্র্যাকটিস করছি-- আজম খান"। একে তো স্যাটায়ারের কনসেপ্টটা তখনও সেভাবে চালু হয়নি , তার উপর পুরো নিউজটাই যতটা না সিরিয়াস , তার চেয়েও সিরিয়াস আজম খান নিজে। ৫০ বছর বয়েসি আজম খানের ইচ্ছা জেনে আমি হতভম্ব হয়ে বসে থাকি। পরে অবশ্য শিল্পীদের খেয়ালী মনের কথা ভেবে ব্যাপারটা মনে মনে উড়িয়ে দিই।

জসিমউদ্দিন রোডে আজম খানের প্রতিবেশি তখন আমার এক দুঃসম্পর্কের চাচা । তাকে খবরটার কথা বলতেই চাচা জানান , আজম খান দারুণ খেলেন , জায়গা পেয়েও যেতে পারেন !! মনে পড়ে , এরপর আজম খান কোন ক্লাবে খেলেন , সেটা নিয়েও খোঁজ খবর করি।

মতিঝিল মডেল থেকে মতিঝিল আইডিয়ালে চলে আসার পর আজম খানকে আর রোজ রোজ চোখে পড়ে না। এসএসসির পর নটরডেম কলেজ ভর্তি হই, আবার দেখা মিলতে শুরু করে তার। চামড়ায় সামান্য একটু ভাঁজ আর কিছু পাকা চুল ছাড়া ৫০ বছর বয়েসি লোকটিকে তখনও রীতিমত তরুণ লাগে।

কলেজ ছু'টির পর ছেলেরা দল বেঁধে কলোনীর মাঠে কখনও কখনও যায় ক্রিকেট খেলতে। তাদের মুখে একদিন শুনি আজম খানের গল্প , আজম খান তাদের সাথে ক্রিকেট খেলে। অভিষেক টেস্টের পর টেস্ট খেলার জোয়ার তখন দেশে, ছেলেরা তিনদিন খেলা মিলিয়ে নিজেদের মত করে টেস্ট বানিয়ে নিয়েছে । সেখানে আজম খানের দলের অবস্থা খারাপ, কিন্তু আজম খান আউট হচ্ছেন না।

পরের দিন আজম খানের খেলা দেখতে আমিও হাজির হই , চারপাশে সুকান্তের ১৮ বছর বয়েসি নটরডেমের ২১ ছেলের দলটির মাঝে সবার চেয়ে উঁচুতে দাঁড়িয়ে সবচেয়ে তরুণ আজম খান। অদ্ভূত ব্যাপার , বলের পর বল ব্লক করে যাচ্ছেন তো যাচ্ছেনই , গতি , স্পিন , আর্ম বল সব বলেই নিখুঁতভাবে কেতাবী ঢংয়ে ঠেকিয়ে যাচ্ছেন, আউট হওয়ার নাম নেই, মাঝে মাঝে ওভারের শেষ বলটায় সিংগেলস নিয়ে স্ট্রাইক নিজের হাতে রাখছেন। এক পর্যায়ে মনে হয় তার নিজের দলও একটু হতভম্ব । বিপক্ষ তো মহাবিরক্ত, রাগে গজরায় ফিল্ডাররা , "খাইস্টার মত ব্যাট করতেসে, রানও নাই , আউটও নাই"। আজম খানের বিকার নেই , দিনের খেলা শেষ হয় , আজম খান দাঁড়িয়ে থাকেন

তারপর মতিঝিল পাড়া ছেড়ে চলে আসি একদিন , তাকে ঘিরে স্মৃতিগুলো জমাট বেঁধে যায় শৈশব হয়ে , সে স্মৃতি আর বাড়ে না
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই জানুয়ারি, ২০১৩ সকাল ১০:২২
১২টি মন্তব্য ১১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ডালাসবাসীর নিউ ইয়র্ক ভ্রমণ

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ২:৪৪

গত পাঁচ ছয় বছর ধরেই নানান কারণে প্রতিবছর আমার নিউইয়র্ক যাওয়া হয়। বিশ্ব অর্থনীতির রাজধানী, ব্রডওয়ে থিয়েটারের রাজধানী ইত্যাদি নানান পরিচয় থাকলেও আমার কাছে নিউইয়র্ককে আমার মত করেই ভাল ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×