somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

নজরুলের চিকিৎসা সংক্রান্ত তথ্য

০২ রা আগস্ট, ২০১২ ভোর ৬:৫৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬ইং) আকস্মিকভাবে বাকরুদ্ধ হন ১৯৪২ সালের ১০ জুলাই। অসুস্থ নজরুলকে বিশ্রাম ও চিকিৎসার জন্য ১৯৪২ সালের ২০ জুলাই নাগাদ বিহার প্রদেশের মধুপুরে নিয়ে যাওয়া হয়, কিন্তু সেখানে উন্নতির কোনো লক্ষণ দেখা দেয় নাই। পরে ৬৪ দিন পরে নজরুল পরিবারসহ কলকাতায় নিজ গৃহে ফিরে আসেন।
সওগাত সম্পাদক নাসির উদ্দীন তার আত্মকথায় নজরুলের অসুস্থতার কথা উল্লেখ করে বলেছেন, ‘নজরুলের শেষ লেখাটিও ছাপা হয়েছিল সওগাতেই। এ সময় এ কে ফজলুল হক (১৮৭৩-১৯৬২ইং) একটা পত্রিকা বের করার সিদ্ধান্ত নেন। সম্পাদক হিসেবে সবাই নজরুলের নাম প্রস্তাব করেন। তিনি রাজীও হয়ে যান। কিন্তু এ সময়ে তার অসুখ শুরু হয়ে যায়। ফজলুল হক সাহেবকে তার শাশুড়ি জানালেন, ‘জামাই' কে (নজরুল) তো এখন আর বাইরে যেতে দেই না। কারণ রাতেও ঘুমায় না। শুধু গুন গুন করে গান গায়। ভালো লক্ষণ মনে হচ্ছে না। আপনি যখন এসেছেন নিয়ে যান। হক সাহেবের ওখানে আর কাগজ চালাতে পারেন নাই নজরুল। এভাবেই উচ্ছবল নজরুল নীরব হয়ে যান। সম্পূর্ণ বাকরুদ্ধ হয়ে যান।' এভাবেই সুদীর্ঘ ৩৪টি বছর ধরে (১৯৪২-১৯৭৬ইং) আয়ত নয়নে কবি শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থেকেছেন। কোনো কথা বলতে পারেন নাই। ফুলের জলসায় চিরকালের মতই কবি একেবারে নীরব হয়ে গেলেন।
নজরুল ইসলাম সম্পর্কে অনেক গবেষণা হয়েছে। অনেক হচ্ছে। ভবিষ্যতে হবে এটাও নিঃসন্দেহে বলা যায়। কিন্তু নজরুলের অসুস্থ জীবনের গোড়ার কথা সম্পর্কে ড. আশোকবাগচী যে কথা বলেছেন তা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। তার কথাগুলো নবীন নজরুল গবেষকদের অত্যন্ত কাজে লাগবে বলে বিশ্বাস করি। ড. বাগচীর অসুস্থ নজরুল সম্পর্কের কথা এখানে তার ভাষায় হুবহু তুলে ধরা হলো।
‘‘নজরুলের অসুস্থতার লক্ষণ যখন প্রথম প্রকাশ পায় তখন বিষয়টিকে খুব একটা গুরুত্ব দেয়া হয় নাই। বিশেষ করে তার স্ত্রী প্রমিলা নজরুল যখন অসুস্থ হয়ে পড়েন (১৯৩৭ইং) তখন দেখা যায় নজরুল হঠাৎ ‘কালী সাধনা' শুরু করেছেন। অনেকেই এটাকে ধরে নেন তার মানসিক বৈকল্য হিসাবে। গেরুয়া পোশাক আর মাথায় গেরুয়া টুপি ছিল তার তখনকার পরিধেয় বস্ত্র।সেই সময় তিনি মাঝে মাঝে গ্রামোফোন কোম্পানিতে গান গাওয়ার সময় একটু আধটু বেসুরো হতে থাকেন। অবশ্য ধরিয়ে দিলে ভুল বোঝেন এবং সংশোধনের চেষ্টাও করেন। কিন্তু পুরোপুরি অসুস্থ হবার পর (১৯৪২ইং) তিনি সব কিছুর বাইরে চলে যান। কোনো কিছুই আর ঠিকমত ধরে রাখতে পারেন না। এরূপ লক্ষণ তার সে সময় প্রকাশ পায়। ড. অশোক বাগচী আরো বলেছেন, বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলাম অসুস্থ ও বাকশক্তি রুদ্ধ হবার পর হতে কোনো চশমাধারী লোককে কখনই সহ্য করতে পারতেন না। চমশাধারী লোক তার সম্মুখে উপস্থিত হলে তৎক্ষণাৎ উত্তেজিত ও অস্বস্তি বোধ করতেন। ড. অশোক বাগচীর ধারণা নিশ্চয়ই কোনো চশমাধারী লোকই সে সময় তার বড় ধরনের ক্ষতি করে দিয়েছিল। যা তার মস্তিষ্কের মধ্যে স্থায়ীভাবে দাগ কেটে দেয়। ড. বাগচী নজরুলের অসুস্থতার অন্য সমস্ত কারণকে অস্বীকার করে একথা বলেছেন যে, কবির ‘স্নায়ুবিক বৈকল্য' সম্পর্কে ডা. বিধান চন্দ্র রায়ের চিকিৎসার মতামতটাই যথার্থ ছিলো বলে তিনি মনে করেন। তখন তাকে ভারতের রাচী ও বিহারের মধুপুরে পাঠানো এবং অন্যান্য মানসিক চিকিৎসা ব্যবস্থা প্রয়োগ তার অসুস্থতাকে বাড়তেই সাহায্য করেছে বলে তিনি মনে করেন।
যে ভদ্রলোক নজরুলের অসুস্থতা সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ এই কথাগুলো বলেছেন তিনি হলেন এই উপমহাদেশের চিকিৎসাশাস্ত্রের এক অত্যন্ত পরিচিত ব্যক্তিত্ব, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন নিউরো সার্জন ড. অশোক কুমার বাগচী। ইনি সর্বপ্রথম নজরুলের অসুস্থ জীবন সম্পর্কে চিকিৎসা বিজ্ঞানের আলোকে নজরুলের কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দাখিল করেছেন। যে কথা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে এবং বেশ একটা বড় সময় যিনি নজরুল পরিবারের সান্নিধ্যে ছিলেন।
ড. বাগচী জন্মগ্রহণ করেন আমাদের উত্তরবঙ্গের এই রংপুর জেলায় ১৯২৫ সালে। তিনি আমাদের এই উত্তরবঙ্গের কৃতী সন্তান। যিনি সে সময়ে নজরুলের চিকিৎসার পথ প্রদর্শক ছিলেন। পিতা ও পিতামহ উভয়েই সেকালের নাম করা ডাক্তার ছিলেন। কলেজ জীবন তার কাটে পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে। তারপর কলকাতায় ডাক্তারী পড়া। ১৯৪৮ সালে কলকাতা মেডিকেল কলেজ থেকে কৃতিত্বের সাথে ডাক্তারী পাস করেন। সবকটি বিষয়ে প্রথম। ৫টি বিষয়ে অনার্স। ১৯টি মেডেল এবং ডাক্তারীতে স্কলারশীপ নিয়ে লেখাপড়া শেষ করে নিউরো সার্জারী পড়ার জন্য অস্ট্রীয়ার রাজধানী ভিয়েনায় যান। ভিয়েনায় অসাধারণ রেজাল্ট করে ১৯৫২ সালে মাস্টারশীপ পাস করেন। এ জন্য তাকে ভিয়েনায় দেখা হয় ‘ম্যাগনা কাম লাউডে সার্টিফিকেট'। অচিরেই তিনি জগৎবিখ্যাত নিউরোসার্জন হয়ে ওঠেন। এই সময়ে ১৯৫২ইং সালেই তিনি কলকাতায় অকস্মাৎ প্রত্যাবর্তন করেন এবং নিবিড়ভাবে কবি পরিবারের সাহচর্যে আসেন। এর এক বছর পরই ১৯৫৩ সালে তিনি বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলামকে চিকিৎসার জন্য ভিয়েনায় নিয়ে যান। নজরুলের মস্তিষ্কের প্রথম আধুনিক পরীক্ষা করানোর ব্যাপারে তার উদ্যোগ ছিল সবচেয়ে বেশি। সেই ১৯৫৩ সালে ভিয়েনার যে বিশ্ববিখ্যাত চিকিৎসকবৃন্দ যৌথভাবে নজরুলের মস্তিষ্ক পরীক্ষা করেছিলেন তাদের মধ্যে ছিলেন ভিয়েনার বিখ্যাত নিউরোলজিস্ট স্যার রাশেল ব্রেইন, নিউরো সার্জন ড. ওয়েলি ম্যাকিসক এবং বিখ্যাত মনোবিজ্ঞানী ড. উইলিয়াম সার্জেন্ট। ড. অশোক বাগচীও ছিলেন যৌথভাবে তাদের সঙ্গে। ঐ পরীক্ষাতেই ধরা পড়ে নজরুলের ব্যাধি মানসিক বৈকল্য নয়। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে ১৯৪২ সালের ১০ জুলাই নজরুল প্রথম বাকশক্তি হারান। এরপর থেকে তার যত রকমের চিকিৎসা করা হয়েছে সব চিকিৎসাই ছিল ভুল ও ব্যর্থ। একমাত্র ডা. বিধান চন্দ্র রায়ই আশঙ্কা করেছিলেন নজরুল ‘স্নায়ু বৈকল্যে' আক্রান্ত হয়েছেন যার অনিবার্য পরিণতি হচ্ছে আল-ঝেইমার্স। কিন্তু নজরুলের জন্য সে সময় গঠিত মেডিকেল বোর্ড ডা. বিধান চন্দ্রের সুপারিশ কোনোক্রমেই গ্রহণ করেন নাই। ড. অশোক বাগচীর মতে ১৯৩৯ সালে নজরুলের মধ্যে যখন প্রাথমিকভাবে এই রোগের লক্ষণ ধরা পড়ে তখন সেই সময়ে যদি তাৎক্ষণিকভাবে চিকিৎসার সুব্যবস্থা গ্রহণ করা হতো তাহলে নজরুলের সম্ভবত এই করুণ পরিণতি হতো না। ভিয়েনার ডাক্তারগণ যৌথভাবে মত প্রকাশ করেন নজরুলের চিকিৎসার আর সময় নেই। অনেক বিলম্ব হয়ে গেছে।
তাই নজরুলের চিকিৎসার এই অজানা অধ্যায় চিরকালের মতো রহস্যাবৃত্ত, দুর্ভেদ্য, পর্দার অন্তরালে দেশবাসীর কাছে অজানাই থেকে গেলো।
৪টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

গরমান্ত দুপুরের আলাপ

লিখেছেন কালো যাদুকর, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৫৯




মাঝে মাঝে মনে হয় ব্লগে কেন আসি? সোজা উত্তর- আড্ডা দেয়ার জন্য। এই যে ২০/২৫ জন ব্লগারদের নাম দেখা যাচ্ছে, অথচ একজন আরেক জনের সাথে সরাসরি কথা... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাজীব নূর কোথায়?

লিখেছেন অধীতি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:২৪

আমি ব্লগে আসার পর প্রথম যাদের মন্তব্য পাই এবং যাদেরকে ব্লগে নিয়মিত দেখি তাদের মধ্যে রাজীব নূর অন্যতম। ব্যস্ততার মধ্যে ব্লগে কম আসা হয় তাই খোঁজ-খবর জানিনা। হঠাৎ দু'একদিন ধরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৃষ্টির জন্য নামাজ পড়তে চায়।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৮



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বৃষ্টি নামানোর জন্য ইসতিসকার নামাজ পড়বে তার অনুমতি নিতে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটির অনুমতি দেয়নি, যার জন্য তারা সোশ্যাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

=তুমি সুলতান সুলেমান-আমি হুররাম=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৩৬



©কাজী ফাতেমা ছবি

মন প্রাসাদের রাজা তুমি, রাণী তোমার আমি
সোনার প্রাসাদ নাই বা গড়লে, প্রেমের প্রাসাদ দামী।

হও সুলেমান তুমি আমার , হুররাম আমি হবো
মন হেরেমে সংগোপনে, তুমি আমি রবো।

ছোট্ট প্রাসাদ দেবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মৃত্যুর আগে ইবলিশ ঈমান নিয়ে টানাটানি করে

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:০২



ইউটিউব হুজুর বললেন, মৃত্যুর আগে ইবলিশ ঈমান নিয়ে টানাটানি করে। তখন নাকি নিজ যোগ্যতায় ঈমান রক্ষা করতে হয়। আল্লাহ নাকি তখন মুমিনের সহায়তায় এগিয়ে আসেন না। তাই শুনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×