somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

দুরাশার মৃত্যু

২৬ শে আগস্ট, ২০১৯ রাত ১:১৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

পিচ্চি মেয়েটা মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছে, বাকি পুলাপান আগ্রহ নিয়ে দেখছে কিন্তু ওর সাথে গড়াগড়ি খেতে পারছে না।কারণ ওদের মা শক্তকরে হাত ধরে আছে।মেয়েটার মাও কিছুটা বিব্রত।পরনে একটা জীর্ণ লাল-হলুদ লতাপাতা আকা শাড়ি, মাথায় একটা নোংরা সাদা ওড়না, মহিলা মেয়েকে কিছু বলছে না।খেলুক না নিজের মত।
কিছুক্ষণের মধ্যেই বাকি পুলাপান যাদের গায়ে উত্তরার নামকরা সব স্কুলের ড্রেস তারাও মেয়েটার সাথে মিশে গেল।তারা লুকোচুরি খেলছে।আমি অভিভূত, সরকারি কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালের সর্বোচ্চ ব্যবহার হচ্ছে!

মেয়েটা কোনভাবে 'Use me' লেখা একটা পাত্রে লুকিয়ে গেল।কেউ খুজে পাচ্ছে না।আমি মেয়ের বুদ্ধি দেখে আরেকবার অভিভূত হলাম।
মেয়েটা পাত্র নিয়ে হুড়োহুড়িয়ে পড়ে গেল।ময়লায় মেঝেতে ছড়াছড়ি, রক্তিম ব্যান্ডেজ, ব্যবহৃত কনডম, সিরিঞ্জ,ট্যাবলেটের খোসা,ভাঙা ওষুধের শিশি, আরও কত কি!
এতক্ষণ যারা তাকে পাত্তাই দিচ্ছিলো না,তারা সবাই দৌড়ে এল।মোটা মতন আয়া মেয়েটার একটা চড় দিয়ে বসল।মহিলাকে শাসিয়ে বললো,"বান্দর মাইয়া।এইযে!এই ময়লা এখন তুমি পরিষ্কার করবা।আমি পারমু না।" এতক্ষণ যে পুলাপানের দল একসাথে খেলছিল তারা মায়ের কাছে ফিরে গিয়েছে। তারা মেয়েটাকে দেখছে একমুহূর্তের জন্যেও চোখ সরিয়ে নেয়নি।দুএকজন মায়ের হাত থেকে ছোটার চেষ্টা করছে, মা কিছুতেই ছাড়ছে না।

মহিলা ভীত চোখে ময়লাগুলো পাত্রে ওঠাচ্ছেন। আমিও সাহায্য করতে গেলাম।এতে উনি আরও বিব্রত হলেন।মেয়েটা বলছে,"আম্মু, তোমার হাতে রক্ত লাগছে।আম্মু, দেখে কাজ কর।এখানে সুই আছে, কাচ আছে।আম্মু, দেখে কাজ কর।"
ছেড়া গেঞ্জির হাফপ্যান্ট পরা, খালি গায়ের মেয়েটার মায়ের প্রতি কি ভালোবাসা! মহিলাটি ময়লা উঠিয়েই চলে গেলেন, যেন এই জায়গা তার জন্য না; যেন তার চিকিৎসার দরকার নেই।

আমি আগের মতই ২২১ নাম্বার রুমে সিরিয়ালে দাঁড়িয়ে গেলাম।ডাক্তার হাসিমুখে কারও সাথে মোবাইলে কথা বলছেন, হাসতে হাসতে টেবিলে মাথা রাখছেন আবার ঠিক হয়ে বসছেন, কি কথা হচ্ছে?প্রায় আধাঘন্টা ধরে কথা চলছে। বিরক্ত হচ্ছি, কিন্তু কিছু করার নেই!দশটাকা দিয়ে চিকিৎসা করাতে আসছি, এতটুকু কষ্ট করতেই হবে।এর মাঝেই লাইনের সামনে আরও দুজন ঢুকে গেল।কম্পাউন্ডার দাঁত কেলিয়ে বললো,"হেরা আগেই টিকেট কাটছে, নিচে চা খাইতে গেছিল।" একজনতো টিকেট কাটার লাইনেই আমার পিছনে ছিল।আমি জানি দশ-বিশ টাকা দিলে আমিও লাইনে এগিয়ে যেতে পারি, কিন্তু ডা. সাহেবের কথা আজ শেষ হবে বলে মনে হচ্ছে না!

ডাক্তারকে কফি দেয়া হল।কফিতে চুমুক দিয়ে তিনি টেবিলে পা উঠিয়ে দিলেন, নতুন উদ্যমে কথা শুরু করলেন। লাইনে দাঁড়িয়ে উশখুশ করছি, ঘামছি।
কেউ পিছনে শার্ট ধরে টানলো, রেগেই ফিরে তাকালাম। দেখি পিচ্ছি মেয়েটা পিছনে দাঁড়িয়ে আছে।
"আপনার মোবাইলে আমারে গেম খেলতে দিবেন, আম্মু ডাক্তার দেখাবে, আমি দুষ্টামি করবো না।বসে বসে গেম খেলবো।" দেখে মনে হচ্ছে বস্তিতে থাকে, বস্তির বাচ্চারা এমন শুদ্ধভাবে কথা বলতে পারে না।
আমি জিজ্ঞেস করবো, তোর মা কই? তখনি মহিলা হন্তদন্ত হয়ে এলেন।
"আপনি কিছু মনে করবেন না।" মেয়েকে কষে একটা চড় দিলেন।হাত ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন, আর মেয়েটা বলছে,"আম্মু তুমি আমাকে মারলে কেন?মামা আমাকে মোবাইল দিলে আমি খেলতাম, তুমি ডাক্তার দেখাতে।কোন ঝামেলা নেই।"

পিচ্চি শিশির ২২১ এবং ২২২ নাম্বার রুমের মাঝখানের দেয়ালে হেলান দিয়ে আমার মোবাইলে টেম্পল রান খেলছে।ওর মা ২২২ নাম্বার রুমের লাইনে দাঁড়িয়ে আছে।ঐ লাইন ছোট, ৩ জনের লাইন।

২২১ এবং ২২২ নাম্বার রুমের মাঝখানে বড় করে লিখা "চর্ম ও যৌন রোগ বিশেষজ্ঞ"। ২২১ নাম্বার রুমের সামনে ছেলেদের লাইন বেশ লম্বা, বোঝাই যাচ্ছে ছেলেদের যৌনরোগ বেশি হয়।তবে আমার চর্মরোগ, কবজি থেকে কনুই পর্যন্ত লালচে ফুস্কুড়ি ঊঠে ভরে গেছে।শিশিরের মাও মনে হয়, আমার মতই চর্মরোগের চিকিৎসা করাতে এসেছেন। তার হাতে আবার বড়সড় একটা খাম, মনে হয় রিপোর্ট।তিনি আমার দিকে তাকিয়েই ডাক্তারের রুমে ঢুকে গেলেন। শিশির মনোযোগ দিয়ে গেম খেলছে। আমার সামনে এখনো দশজন, একটুপর অবশ্য ডাক্তার লাঞ্চব্রেক নিবেন। দরজায় বড় করে লিখা "২ঃ০০- ৩ঃ০০ লাঞ্চব্রেক"।

শিশিরের মা ছলছল চোখে ডাক্তারের রুম থেকে বের হয়ে এলেন।আমাকে মোবাইল ফিরিয়ে দিয়ে শিশিরকে নিয়ে চলে যাচ্ছেন।শিশির বলছে," কি হল, এত তাড়াতাড়ি কিসের?আরেকটু গেম খেলতাম।" মেয়েটা "আমি যাবো না, আমি যাবো না" বলে কাদতে লাগলো। ওর মা রেগে গিয়ে মারছে।তাকে বাচানোর জন্যই কাছে গেলাম।

শিশির কান্না থামিয়ে বললো,"আম্মু, আজ আমার জন্মদিন। তুমিতো কেক বানিয়েছ, বিরিয়ানি রান্না করেছ।মামাকে আমাদের বাসায় নিয়ে চল।আব্বুতো এবারও আসবে না।আম্মু তুমি মামাকে নিয়ে চল।মামাকে নিয়ে চল!"
মেয়েটা আমার হাত ধরে টানাটানি করতে লাগলো।তার কান্না থামানোর জন্যই রাজি হলাম।দেখা গেল, আমাকে যেতেই হবে।ওর মাও উৎসুক চোখে তাকিয়ে রইল।

শিশির আমার হাত ধরে আছে, আমরা টঙ্গী রেলব্রিজের বামপাশ দিয়ে যে চিপা গলি আছে ওর মাঝখানে হাটছি।রাস্তার দুপাশে মুখে অতিরিক্ত পাউডার মেখে কিছু মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে, আমিতো জানি এরা রাতে দাঁড়িয়ে থাকে।এরা নিশিকন্যা, কিন্তু এখনতো দিন!

বেশ গোছালো ঘর,বিছানায় লাল চাদর, দেয়ালে সুন্দর একটা পোর্ট্রেট।বোঝা যাচ্ছে, শিশিরের আম্মুর। তিনি বেশ সুন্দরী ছিলেন, তবে এখন কি হয়েছে?তার বয়সতো বেশি না।
কেক কাটা হল।আমি আর শিশির বিছানায় বসে আছি। ওর মা প্লেটে বিরিয়ানি বেরে দিচ্ছেন।আমি আগ্রহ করে জিজ্ঞেস করলাম,"শিশিরের বাবা কোথায়?"

উনি আমার দিকে না থাকিয়েই বললেন,"অনেক আগে আমাকে এখানে রেখে চলে গেছে।বুঝতেই পারছেন, এখানে.........।" উনি কথা শেষ করতে পারলেন না।তিনজন সাজুগুজু করা মেয়ে ঘরে উঁকি দিয়ে খিলখিল করে হেসে চলে গেল।
"আপনি চলে গেলেন না কেন?"
"কোথায় যাবো? কলেজ থেকে তার সাথে পালিয়ে এসেছি, বাড়ি ফিরে যাবার মুখ আমার নেই।"

"তবু চলে যেতেন।আপনার বাবা-মা আপনাকে ফেলে দিত না।"
"উনি আমার সাথে ১ মাস থাকলেন।তারপর চলে গেলেন। আর দেখা নেই, আমাকে এখানে বেচে দিয়েছেন।বড় আম্মা অনেক ভালো, আমাকে শিশিরের জন্ম পর্যন্ত সময় দিয়েছিলেন। থাক সে কথা, আপনি খান।আমার মেয়েটা আপনাকে বিপদে ফেলে দিয়েছে। আমি দুঃখিত!"

এখন বোঝা গেল কেন শিশিরের ভাষা এত ভালো। আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম,"আচ্ছা, আপনার শরীরের এই অবস্থা কেন?"
"আমি অসুস্থ। আমি মারা যাচ্ছি,বেশিদিন নেই।কষ্ট একটাই, আমার মেয়েটাও এই খারাপ পাড়ায় থাকবে সাজুগুজু করে খদ্দের ধরার প্রতিযোগিতা করবে!"
শিশির আমাদের কথা শুনছে, কিছু বুঝতে পারছে না।

আমি ওদের বাসা থেকে ফিরছি। মন খারাপ, একটা কথা বলতে চাইছিলাম। সাহস করে পারছি না। একজন মহিলা আমার হাত ধরে বললো,"লাবণ্যরে খাইয়া কি মজা পাইলেন, অর এইডস।আমার ঘরে আহেন,আমার মধুও খাইয়া দেহেন।মজাই মজা।" আমি হাত ছাড়িয়ে নিলাম।পেছনে ফিরে তাকালাম, লাবণ্য আর শিশির এখনো আমার দিকেই তাকিয়ে আছে।

আমি হাটতে হাটতে রেলব্রিজের উপর চলে এলাম।বারবার পিছনে তাকাই যদি শিশির বা লাবণ্যকে দেখা যায়।অটো রিকশাতে চড়েছি, বাসায় যাবো। অটো ছেড়ে দিয়েছে, কেউ পিছনে মামা বলে ডাকছে।দেখি লাবণ্য আর শিশির পিছনে দৌড়াচ্ছে।আমি লাফ দিয়ে নেমে গেলাম।

লাবণ্য আমার হাতে শিশিরকে দিয়ে বললো,"আপনি শিশিরকে নিয়ে যান।রাখতে না চাইলে ওর বাবার মত অন্য পাড়ায় বেচে দিবেন।তবু নিজেকে সান্ত্বনা দিতে পারবো, আমার মেয়েটা এই পাড়া থেকে বেড়িয়ে গেছে।মেয়েটা জীবনে দ্বিতীয় সুযোগ পেয়েছে।" আমিও এটাই বলতে চাচ্ছিলাম, সাহস হয়নি।

এটা অনেক আগের ঘটনা। তবে এখনো আমার কাছে বারবার স্বপ্ন হয়ে ফিরে আসে।আমার তন্দ্রা কাটলো শিশিরের ডাকে।
"বাবা, তুমি এখনো ঘুমাচ্ছ!তোমাকে না বললাম, আজ আমার মেডিকেল ক্যাম্প পরেছে টঙ্গী রেলব্রিজের ডানপাশের কোন একটা যৌনপল্লীতে।ডাক্তার হবার কি যন্ত্রণা দেখেছ।আমার ভয় লাগে, তুমিও আমার সাথে যাবে।উঠ তাড়াতাড়ি।"
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে আগস্ট, ২০১৯ রাত ১:১৯
২টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। গানডুদের গল্প

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:২৮




তীব্র দাবদাহের কারণে দুবছর আগে আকাশে ড্রোন পাঠিয়ে চীন কৃত্রিম বৃষ্টি নামিয়েছিলো। চীনের খরা কবলিত শিচুয়ান প্রদেশে এই বৃষ্টিপাত চলেছিলো টানা ৪ ঘন্টাব্যাপী। চীনে কৃত্রিম বৃষ্টি নামানোর প্রক্রিয়া সেবারই প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতকে জানতে হবে কোথায় তার থামতে হবে

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৪৫


ইন্ডিয়াকে স্বপ্ন দেখানো ব্যাক্তিটি একজন মুসলমান এবং উদার চিন্তার ব্যাক্তি তিনি হলেন এপিজে আবুল কালাম। সেই স্বপ্নের উপর ভর করে দেশটি এত বেপরোয়া হবে কেউ চিন্তা করেনি। উনি দেখিয়েছেন ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×