somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

দাঁড় কাকের সংসার

২৮ শে আগস্ট, ২০১৯ বিকাল ৫:১৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ভদ্রলোকের কোমড়ে দড়ি বাধা থাকলেও দেখতে খারাপ লাগতো না।কিন্তু কোমড়ে দড়ির সাথে দুটি শিশুবাধা, শিশুকন্যা।একজন সাইকেল চালাচ্ছে, অন্যজন হাসিহাসি মুখে পিছনে বসে আছে আর ভদ্রলোক পিছনে পিছনে দৌড়াচ্ছেন।শুধু আমি না, আশেপাশের সবাই তাকিয়ে আছে।সবার চোখে একই প্রশ্ন 'হায় আল্লাহ, বেটায় মাইয়া দুইটারে বাইন্ধা রাখছে কেন?'

আমি উত্তরা শান্তা মরিয়ম ইউনিভার্সিটি অব ক্রিয়েটিভ টেকনোলজি'র নিচে কেয়ার জন্য অপেক্ষা করছি।ভোর ছয়টা থেকে অপেক্ষা করছি।কেয়া বলেছে সাড়ে ছয়টার মধ্যে চলে আসবে, এখন সাতটা বাজে। এখনো আসছে না, এমন হবার কথা না।আমি ভাবছি অন্যকথা,কাল রাত থেকেই মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে__
"তোমাদের মস্তিষ্কে বীর্য
আর মগজ অণ্ডকোষে"
এর মানে কি?মানে হতে পারে, আমরা সবকিছু সেক্স দিয়ে বিবেচনা করি।তা কিন্তু না।যেমন ধরুন, আপনি আপনার স্ত্রী,কন্যা আর মাকে অতি আবেগে জড়িয়ে ধরলেন, চুমু খেলেন।তিনক্ষেত্রেই কি সেক্স কাজ করবে, শরীরের প্রতিটি নিউরনে সাড়া পরবে?না, তা হবে না।তাহলে এই লাইন দুটো অবশ্যই মিথ্যে!

ভদ্রলোক এখনো মেয়েদের নিয়ে দৌড়াচ্ছেন।মেয়েদুটি জমজ, এদের এক লাইনে বর্ণনা করা যায়।এরা দেখতে অবিকল Frozen মুভির এনা আর এলছা'র মত।একজনের পরনে লাল জামা, আরেকজনের পরনে নীল জামা।এতক্ষণ যে মেয়েটা পিছনে বসে ছিল, সে সাইকেলে চালাচ্ছে।একটু জোরেই চালাচ্ছে, শান্তা মরিয়ামের সামনে থেকে উত্তরা পৌরসভা কার্যালয়ের সামনে দিয়ে LPS স্কুলের সামনে যাচ্ছে আবার ফিরে আসছে।ভদ্রলোক একটু হাপিয়ে গেছেন, বলছেন,"মা, একটু আস্তে চালাও।পরে যাবেতো।" মেয়েটা খিলখিল করে হাসছে, গতি কমাচ্ছে না।পিছনে তার বোন বিরক্ত মুখে বসে আছে।

আমি অভিভূত হয়ে বাপ মেয়েদের খেলা দেখছিলাম। এই আনন্দের জন্যই হয়তো মানুষগুলো খুব ঝামেলা জানার পরও বিয়ে করে,সংসার করে। কেয়া কখন এসে পিছনে দাঁড়িয়েছে দেখতেই পাইনি।
কেয়া বললো,"আশ্চর্য!লোকটা অমন সুন্দরী কন্যাদের বেধে রেখেছে কেন?মেয়ে দুটাতো গরু না যে বেধে রাখতে হবে। আর ওরাতো বড়ও হয়নি যে মানুষ উঠিয়ে নিয়ে যাবে!মুহিব, তুমি যাও বাজে লোকটাকে বল, এখনি যেন মেয়ে দুটার দড়ির বাধন খুলে দেয়।মন চাইলে তিনি নিজের গলায় দড়ি বেধে ঘাস খাক, বাচ্চা দুটোলে বেধে রেখেছে কেন?যাও, মুহিব।দাঁড়িয়ে আছো কেন?"

আমাকে যেত হল না।ভদ্রলোক নিজেই এলেন।কোমড়ের দড়িখুলে ফুটপাতে বসে বড়বড় শ্বাস নিচ্ছেন। দুই মেয়ের একজন বিরক্ত মুখে তাকিয়ে, অন্যজনের মুখ হাসিহাসি। তিনি তিনটা ডাব কাটতে বললেন। আমরাও দুটা ডাবের কথা বললাম। কেয়া একমনে কথা বলে যাচ্ছে কেন তার দেরি হয়েছে।আমি কিন্তু তাকে আগেই মাফ করে দিয়েছি।
"মুহিব শোন কি হয়েছে, ঘুম থেকে উঠে গোসল করবো দেখি গিজারে পানি গরম হচ্ছে না।কফি খেতে গিয়ে জামায় ফেলে দিলাম।গাড়ি বের করতে বললাম, দেখা গেল গাড়িতে তেল নেই।বল কেমন লাগে!এজন্য দেরি হয়ে গেল।"

আমি খুব আগ্রহ নিয়ে শুনছি।সুন্দরীদের সব কথা মনোযোগ দিয়ে শুনতে হয়, আগ্রহ না থাকলেও আগ্রহের অভিনয় করতে হয়।আর কেয়া কথা শুনেও আমি সারাজীবন কাটিয়ে দিতে পারবো। মাঝে মাঝে মনে হয়, কেয়াকে বলে দেই "কেয়া, আমি তোমায় অনেক ভালোবাসি। যেদিন তোমার সাথে দেখা হয় না, আমার কেমন জানি লাগে।তোমায় বলে বোঝাতে পারবো না।"
কিন্তু শেষ পর্যন্ত বলতে ইচ্ছে করে না।ও যতক্ষণ বাইরে থাকে ওর সাথে থাকে একটা জাগুয়ার, যেটার একদিনের তেল কেনার টাকাও আমার কাছে নেই।কোনদিন হবে সে আশাও ক্ষীণ। আমি এখন পর্যন্ত চারটা চাকরিতে আবেদন করেছি, আমার রেজাল্ট এলএলবি'তে ৩.৮৫, এলএলএম'এ ৩.৯২ থাকার পরও আমাকে ডাকেনি!শুধুশুধু এই মেয়েটাকে বিপদে ফেলে দেয়ার মানে হয় না, আমি অনেকবার ভেবেছি কেয়ার সাথে আর দেখা করবো না।কিন্তু পারি না।

ডাব কাটা শেষ, আমি চুমুক দিলাম।ভদ্রলোক উদ্বিগ্ন চোখে আমাকে প্রশ্ন করলেন,"আমার মেয়ে দুটোকে দেখেছেন?" কি আশ্চর্য মেয়ে দুটো এখানেই ছিল।কোথায় গেল? আমি, কেয়া, ভদ্রলোক, ডাব বেচা মামা, সবাই আছেন কেবল মেয়ে দুটো নেই।আছে হয়তো ধারে কাছেই সাইকেল চালাচ্ছে।

না, তাদের পাওয়া গেল না।আমি, কেয়া, ডাব বিক্রেতা, শান্তা মরিয়মের একদল শিক্ষার্থী সবাই খুজছি।পাওয়া যাচ্ছে না। ইউনিয়ন পরিষদ ভবন, LPS স্কুল, BNCC ভবনের ভিতর, কুয়েত মৈত্রী হাসপাতাল, স্বপ্ন সুপার সপ, কোথায় খোজা হয়নি?সব দেখা শেষ, তাদের পাওয়া গেল না।কেয়া ভদ্রলোকের কলার ধরে বললো,"আপনি একটা রাম বলদ।আপনি কেন, মেয়ে দুটার কোমড়ে বাধন খুলে দিলেন? আপনি জানেন না, মেয়েদের জন্য এই শহর কত ভয়ংকর?" ভদ্রলোক, কেয়া কাঁদছে।

এর মধ্যেই একজন মহিলা এসে ভদ্রলোকের গালে দুটো চড় বসিয়ে দিলেন,"তুই এখন আমার মেয়ে দুটোকে এনে দে।আমি কতবার বললাম, আমার মেয়ে দুটো খুব কৌতূহলী। তাদের নিয়ে বাইরে যেও না।তুমি জানো, মেয়েদের জন্য কৌতূহল কত ভয়াবহ। না, সে মেয়েদের এই নোংরা সমাজে টিকে থাকার জন্য প্রস্তুত করবে। যাও এখন কর প্রস্তুত, দাও টিকে থাকার ট্রেনিং।আমি জানি না, আমি আমার মেয়ে দুটোকে চাই।হাসান, আমার মেয়ে দুটোর কোন ক্ষতি হলে আমি তোমায় খুন করবো।"

বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রগুলো আবার নতুন উদ্যমে একই জায়গা আবার খোজা শুরু করলো। বাচ্চা মেয়েদুটো যাবে কোথায়?একটা ছেলে কোনভাবে একটা হাত মাইক জুটিয়ে ফেলেছে, সে ডাকছে,"ইলা, ইরা তোমরা যেখানেই থাকো।ফিরে এসো।তোমাদের বাবা-মা তোমাদের জন্য কাঁদছে।
ফিরে এসো ইলা, ইরা।"

আমি LPS স্কুলের পাশে যে চারতলা কাচা বাজার আছে সেখানে খুজছি।খুজতে খুজতে ছাদে চলে এলাম, ছাদটা রক্তাক্ত। এখানে সেখানে তাজা রক্তের দাগ,পাশেই পরে আছে এক টুকরো লালচে কাপড়।মনটা অজানা সন্দেহ দুলে উঠলো, মেয়ে দুটার সাথে খারাপ কিছু হয়নিতো?হতে পারে মেয়েদুটোকে অত্যাচার করে ছাদ থেকে নিচে ফেলে দেয়া হয়েছে। আমি উৎকণ্ঠা নিয়ে ছাদ থেকে নিচে তাকালাম। ভয়াবহ দৃশ্য দেখলাম!

রেললাইনের পাশে একটা ময়লার ডিবি, তাতে একটা পাখির বাসা। দাঁড়কাকের বাসা, কাক মাথার উপর কা...কা করছে। ময়লার মাঝে একটি লালপরী, একটি লালপরী বসে আছে। তারা কাকের বাচ্চার গায়ে হাত বুলাচ্ছে,মুখে খাবার তুলে দিচ্ছে।কোন কারনে কাকের বাচ্চাটির বাবা-মা এটা পছন্দ করছে না।তারা কা..কা করে অপছন্দের জানান দিচ্ছে।
লালপরীটা নীলপরীকে বলছে,"ইলা, চল ফিরে যাই।শোন মাইকে আমাদের ডাকছে।চল যাই, বাবা আমাদের জন্য কাঁদছে।অনেকক্ষণ হয়েছে, আম্মু কিন্তু আমাদের মারবে।"

পরীদুটো একসাথে আমার দিকে ফিরে তাকালো।নীলপরীটা বললো,"তুমি কি মেয়েধরা? আমাদের ধরে নিয়ে মেরে ফেলবে?"
"তুই চুপ করতো, দেখছিস না তিনি কাঁদছেন।মেয়েধরা কি কখনো কাঁদে নাকি?"

ভদ্রলোক, উনার স্ত্রী মেয়েদের জড়িয়ে ময়লার উপরে পা ছড়িয়ে বসে কাঁদছেন।দেখতে খারাপ লাগছে।আর কান্না সংক্রামক, অতি দ্রুত বাকিদের মধ্যে ছড়িয়ে গেল।শিক্ষার্থী, ডাব বিক্রেতা মামা, পথচারী সবার চোখ ছলছল করছে।অনেকে কৌতূহল নিয়ে প্রশ্ন করছে,"এরা ময়লায় বইসা কান্দে কেন?" "বড় লোকের বেটার মাথা খারাপ হইছেনি?" "ভাই এইখানে কি শুটিং চলে?"

মাথার উপর কাকের সংখ্যা বেড়েই চলছে।তারা আশ্চর্য, মানুষ কখনো এই নোংরা পরিবেশে আসে না।দু'একজন লোক এসে ময়লা ফেলেই চলে যায়।আজ কেন এই ময়লার উপর এত মানুষ জড় হয়েছে?নিশ্চয়ই তার ছোট বাচ্চাটাকে ধরে নিয়ে যাবে, রান্না করে খেয়ে ফেলবে।মানুষ জাতি সর্বভূক, এরা ছোট বাচ্চা থেকে শুরু করে বড় মানুষ সব খেয়ে ফেলতে চায়! দাঁড়কাকের দল উদ্বিগ্ন। বাচ্চাটাও এখন কা..কা করে নিজের ভয় জানান দিচ্ছে।

আমি কেয়ার হাত ধরে ভীড় ঠেলে বেড়িয়ে এসেছি।কেয়া কাঁদছে, কাঁদতে কাঁদতে হেচকির মত উঠে যাচ্ছে।কেয়া শক্তকরে আমার হাত ধরে বললো,"মুহিব শোনো, আমাদের মেয়েদের সবসময় শেকল দিয়ে বেধে রাখবো। একমুহূর্ত আড়াল হতে দেব না।"
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে আগস্ট, ২০১৯ বিকাল ৫:১৮
৩টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতিঃ ব্যাঙের বিয়েতে নামবে বৃষ্টি ...

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:০০



অনেক দিন আগে একটা গল্প পড়েছিলাম। গল্পটা ছিল অনেক এই রকম যে চারিদিকে প্রচন্ড গরম। বৃষ্টির নাম নিশানা নেই। ফসলের মাঠ পানি নেই খাল বিল শুকিয়ে যাচ্ছে। এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশি ভাবনা ও একটা সত্য ঘটনা

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:১৭


আমার জীবনের একাংশ জুড়ে আছে; আমি চলচ্চিত্রাভিনেতা। বাংলাদেশেই প্রায় ৩০০-র মত ছবিতে অভিনয় করেছি। আমি খুব বেছে বেছে ভাল গল্পের ভাল ছবিতে কাজ করার চেষ্টা করতাম। বাংলাদেশের প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাকি চাহিয়া লজ্জা দিবেন না ********************

লিখেছেন মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:৩৫

যখন প্রথম পড়তে শিখেছি তখন যেখানেই কোন লেখা পেতাম পড়ার চেষ্টা করতাম। সেই সময় দোকানে কোন কিছু কিনতে গেলে সেই দোকানের লেখাগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়তাম। সচরাচর দোকানে যে তিনটি বাক্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

=এই গরমে সবুজে রাখুন চোখ=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১

০১।



চোখ তোমার জ্বলে যায় রোদের আগুনে?
তুমি চোখ রাখো সবুজে এবেলা
আমায় নিয়ে ঘুরে আসো সবুজ অরণ্যে, সবুজ মাঠে;
না বলো না আজ, ফিরিয়ো না মুখ উল্টো।
====================================
এই গরমে একটু সবুজ ছবি দেয়ার চেষ্টা... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×