somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পরশ পাথর

০৪ ঠা সেপ্টেম্বর, ২০১৯ দুপুর ১:২৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

কাধে কালো শার্ট, পরনে নোংরা নীলচে লুঙ্গি, গায়ের রং কুচকুচে কালো লোকটা জিজ্ঞেস করলো,"বাইজান, এদিগে একটা মহিলা দেকছেন?শইল ধলা, নাল শাড়ি পরা, আপনের মত চশমা পরে।" তার চোখে বিষাদাতঙ্ক।আমি উত্তর দিলাম,"না দেখিনি।এদিকে আসেনি।" লোকটি হনহন করে চলে গেল।

আমি মিথ্যা বলেছি, নিশ্চয়ই কেরামান কাতেবিন আমলনামায় লিখে ফেলেছেন। এখন সন্ধ্যা হব হব করছে। আল্লাহ'তালা মাগরিবের ওয়াক্তে প্রথম আসমানে নেমে আসেন, তিনি অবশ্যই বিরক্ত হলেন; তার নিকৃষ্ট বান্দা এই সময়েও অযথা মিথ্যাচার করলো।

ভদ্রমহিলা হাসিহাসি মুখে আড়াল থেকে বেড়িয়ে এলেন।গোধূলিবেলায় বিবাহযোগ্যা কন্যাদের আরও সুন্দর দেখায়; গোধূলির একটু আভা এই বুড়ি মহিলাটির মুখেও পরেছে, তাকে সুন্দর লাগছে। তার বয়স অনেক কমে গেছে।তিনি হেসে বললেন,"ভালা করছেন,হারামজাদা খুইজা মরুক।বিয়া কইরা বেটা ছাওয়াল হয় বলদা, আর আমারটা হইছে রাম বলদা।তয় আমারে আদর করে, দেহেন না পাগলের মত খুজে।না পাইয়া খুজতেই থাকবো।বাড়ি গিয়া বৌরে পিটাইবো।অতি মা ভক্ত ছেলে।তয় বৌরেও ভালাবাসে।"
একটানা কথা শুনে বিরক্ত হচ্ছিলাম, শেষ লাইনটা মন ভালো করেদিল।

বুড়ির মুখে দাত নেই,গাল ভেঙে ভেতরে ঢুকে গেছে।এমনি মুখ নিয়ে বুড়ি হেসে কুটিকুটি! কতদিন এমন হাসি দেখিনি।দেখেছি ছাত্রের মায়ের হতাশ-অখুশি মুখ আর আমার মায়ের ক্লান্ত অসহায় মুখ।কবে এমন প্রাণ খুলে হেসেছি, মনে নেই।

বুড়ি কথা বলেই যাচ্ছে,"পান খাইবেন?নেন খাইয়া দেহেন।" আমি পান খাইনা, তবুও নিলাম।ছয়টায় একটা টিউশনি আছে, যেতে ইচ্ছে করছে না।এরচে একজন সুখী মায়ের কাছে ছেলের গল্প শুনি।আমি ঘাসের উপর পা মুড়িয়ে বসলাম,তিনি আগ্রহ নিয়ে গল্প করছেন।

"আমার বয়স তখন বেশি না, বৌচি খেলতাছিলাম।কাকায় হাত ধরে টাইনা আইন্না বিয়া দিয়া দিল।আব্বায় কিচ্ছু কইল না,আম্মায় একটু কাচুমাচু করছে,বলছে,আমায় মাইয়া বেজায় ছুডু। মাইয়া মাইনশের কথার দাম আছেনি!

পায়ে আলতা, হাতে মেন্দি দিয়া বাবলার বাপের বাইত্তে আইছি।রাইতে হেয় ঘরে ঢুকলো, এমন জোয়ান বেডা।দেইখা কান্দন শুরু করলাম, হেয় বুঝবার পারলো। হেয় একটা বছর আমারে কিছু করলো না।বুঝছেন?আমার শইল ছানাছানি করলো না। হের পর যা শুরু করলো। আমিতো সোজা হইয়া হাটতই পারি না।হিহি....
আর অহন বেডারা মাইয়া কি,পোলার সাদা ঢেং দেখলেই নিজেরে থামাইতে পারে না।"
"ছিঃআপনি নোংরা কথা বলছেন।"

"হ, আমরা গরীব মানুষ। আমরার পিড়িতি ভালাবাসা মানেই শইল ছানাছানি।এতে লইজ্জার কিছুতো নাই।আর এগুলা না কইলে বুঝবেন কেমনে আমারে কত ভালাবাসতো!

যেইদিন গঞ্জে যাইত আমার লেইগা কিছুনা কিছু আনতোই।নাল,লীল, কইলজা রঙ, সব রঙের ফিতা আমার আছিল।
রাইতে সাইজা হের কাছে গেলে খুব খুশি অইতো।
আমি পোয়াতি হইলাম।
হেয় কইলো," ও বৌ, তর পোলা হইলে তোরে মাদুলি বানাইয়া দিমু।গঞ্জে বাইস্কুপ দেখতে লইয়া যামুনে।
বৌ হুন, মাইয়া হইলেও কষ্ট নাই।তয় মাইনশের বাড়ি যাইবোগা, হের জন্যই মাইয়া চাই না।মাইয়া হইলে নাম রাখুম বাবলি আর পুলা হইলে বাবলা।"
আমি মিটমিটাইয়া হাসি।কি যে ভালা মানুষ!

আমিতো জানতামই পুলা হইব, বুজানও কইল।ফেলানি তর পেটে যে আজর আছে, হেয় পুলা না হইয়া পারে না!
বাবলারে পেটে লইয়া হেরে কম জ্বালাই নাই!মাঝ রাইতে কইছি,"হুনছেন, চাইলতা খাইতে মন চায়। পাকা গাব, করমচা, ডাব, ডাসা পেয়ারা খাইতে মন চয়।"
যেমনে পারছে আইনা দিছে।
আমার নামই ফেলানি, হগলে আমারে ফালাইয়া যায়গা।বাবলার বাপেও হুট কইরা গেছেগা।আমার কষ্ট নাই।আমার বাবলা ভালা পোলা, আমারে আদর করে।

হুনেন ঘটনা, একদিন কালা পেত্নী একটা মাইয়া আইনা কইল,"মায়া, এইটারে আমি শাদি করবার চাই।মায়া,তুমি কি কও।"
পোলা আমারে খুব মানে।আমি কইলাম,"বাপজান, এই মাইয়া বিয়া কইরা রাখবা কই? আংগর ঘরতো একটাই।"
আসল কতা, এই কালা পেত্নীরে বিয়া করলে নাতিনাতকুর কালা অইব না!
পোলায় মাইন্না লইল। তয় কাইল্লা মাগীডা শুরু করলো কান্দন!"
"আপনি আবার নোংরা কথা বলছেন।শুনতে খারাপ লাগে।"

"আরে হুনই না।এইডাই মজা!
আমার হাতে পায়ে ধইরা কি কান্দন। পুলার দিকে চাইলাম, হের মত আছে।আর দ্বিমত করলাম না।হেইদিনই কাজি ডাইক্কা বিয়া অইয়া গেল।
আর আমার পুড়লো কপাল!
একটাই ছাপড়া ঘর।জোয়ান পুলা, ডবকা যুবতী বৌ;হেগর কি আর লজ্জা আছে!রাইতে আমারে ঘরে থুইয়াই........।"
"আপনি চুপ করেন।ছিঃঅমন করে কেউ বলে।"

"তুংগরে নিয়া যত জ্বালা, কাম করতে পারবা, কইলেই ফালানি খারাপ।
আমার পুলা মায়রে খুব বুজে।হেয় পাশেই আরেকটা ছাপড়া তুললো। আমি থাহি বড় ঘরে, হেরা ঐ ঘরে গেলগা।
হেরপর আমার হইল এক নাতি, আয়াত।
হেয়ও আমার ভক্ত।এই বেলায় কাইন্দা কাইট্টা বাড়ি মাথায় করছে মনে অয়।"
"বাহ!আপনার নাতির নামটা সুন্দর।আয়াত!"

"হয়, কাইল্লা মাগীটা স্কুলে গেছে কয় দিন।গেলেই দেখবেন শুইদ্ধ ভাষায় কতা কয়।নাম হেয় রাখছে।
তয় আমারে খুব মানে।
আমার লেইগা এইযে মাইর খায়, টু শব্দও করে না।
আমি পুলারে বানাইয়া বানাইয়া এইডা হেইডা কই, হেয় এইডাও কয় না যে আমি মিছা কই।মাগীর চ্যাত নাই।"
"আপনি দেখা যায় দারুণ অভিনয় জানেন!আপনি বেশ খারাপ মানুষতো, মিথ্যে বলার কি দরকার?"

"আপনে কি বুঝবেন?পুতের বৌরে টাইট দিয়া রাহি।বুড়া অইলে একটুআধটু অবিনয় করা লাগে, নইলে দাম পাওয়া যায় না!বুড়া অইলে অনেক জ্বালা, বুইড়া অইলে বুঝবেন।"
তার কন্ঠে আক্ষেপ ঝরছে।আমি চুপ করে রইলাম। তিনি চশমা মুছে চোখ পরলেন।

মাগরিবের আযান দিয়েছে একটু আগেই।চারপাশে গাঢ় অন্ধকার জমে যাচ্ছে।
মসজিদের মাইকে ঘোষণা করা হল,"একজন বয়স্ক মহিলা, গায়ের রঙ ফরশা, পরনে লাল শাড়ি আজ বাড়ি থেকে রাগ করে বেড়িয়ে গেছেন।তিনি চোখে চশমা পরেন, কোন সহৃদয় ব্যক্তি যদি........."

উনি হাসলেন। বললেন,"এইবার শিক্ষা হইছে।এবার বাইতে যাই।না গেলে আবার মাইডারে মারতেই থাকবো, ফিরানির তো কেউ নাই।শইলে দাগ পইরা যাইবো, মাইয়াবেটির শইলে দাগ বহুত খারাপ দেহায়!"
"আচ্ছা, আপনি যান তাহলে।"

"বাবাজি আপনে কই যান?আমারে একটু বাইতে দিয়া আহেন।আইন্ধার অইলে চৌক্ষে দেহি না।"

মসজিদের পাশেই টিনের একচালা ঘর, পাশে ছোট একটা পলিথিনের ছাউনি।আর যাইহোক এটাকে ঘর বলা যায় না, এখানেই নিশ্চয়ই স্বামী স্ত্রী থাকেন। ঢাকায় এখনো এমন ঘর আছে দেখে বেশ অবাক হলাম।

খোলা আকাশের নিচে রান্না চড়িয়েছে তার ছেলের বৌ।চুলার আগুন বাতাসের সাথে পাল্লা দিয়ে পারছে না,বারবার নিভে যাচ্ছে। উনি বারবার নিচু হয়ে ফু দিচ্ছেন, আগুন জ্বলছে না।বুক টানতে চাইছে ছোট শিশুটি, মা খুব নড়ছে।তাই সুবিধা করতে না পেরে সে তারস্বরে কাদছে।পাশেই একমনে পড়ছে পিচ্চি আয়াত।
"দুই এক্কে দুই, দুই দুগুনে চার, তিন দুগুনে......"

আমাদের শব্দ শুনেই ফিরে তাকালো আয়াত আর তার মা।মেয়েটি মোটেই কালো না, ডানগালে স্পষ্ট চার আগুলের দাগ,খোলা পিঠে লম্বা লাল দাগ,চুল এলোমেলো; হয়তো আয়াতের বাবা মেরেছে। মনে হচ্ছে, গালে দিয়েছেন লাল আবীর। দেখতে বেশ লাগছে।আয়াত বলছে,"আম্মু দেখ, বুবু আসছে।আম্মু খাওন দেও।আব্বারে ডাকতে যামুনি?"
মেয়েটি আয়াতের দিকে তাকাতেই আয়াত কথা ঠিক করে বললো,"আম্মু খাবার হয়েছে?বুবুকে খেতে দাও, আমি কি বাবাকে ডাকতে যাবো?আম্মু বৌ-খুদি হয় নাই?আমার খিদে পেয়েছে।"
নেপলিয়ন নিশ্চয় এমন শিক্ষিত মা চেয়েছিলেন!

বুড়ি যেন কিছুই হয়নি এমনভাবে বললো,"বৌ আরাফরে আমার কাছে দেও।তাড়াতাড়ি রান্ধন শেষ কর।আমি বাইতে নাই, সারা দিন করলাডা কি?
বাবাজি রাইতে আংগর লগে খাইবো।"
মেয়েটি আমার দিকে চোখ তুলে তাকালো, বললো,"ভাইজান বসেন, আয়াতের বাবা এই আসলো বলে।আসলে খাবার দেই।উনি মাকে ছাড়া খেতে পারেন না।"

ভদ্রলোক একটু পরেই ফিরে এলেন।মায়ের পায়ের কাছে বসে বলছেন,"মায়া, তুমি কই গেছিলা?আয়াতের মা দুই গেন্দা লইয়া এত কাম করবার পারেনি।হেয় মিয়া বাড়িত কাম লইছে, হুনছ না।তুমারে কই কই খুজিনাই!দেহ, সারা শইল ঘাইমা গেছে।"
"আমি বেড়াইতে বাইর অইছি।আর আমি তর ঘরের কামের বেডি না, তর গেন্দা আমি রাখতাম ক্যা!খবরদার আমারে কামের কতা কইবি না।"

ভদ্রলোক লজ্জা পেলেন, এমনভাবে তাকাচ্ছেন যেন বিরাট অপরাধ করে ফেলেছেন।
একটা লোক মাকে এত ভালোবাসতে পারে! আমিতো তার সাথে শান্তভাবে কথাই বলতে পারি না।
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা সেপ্টেম্বর, ২০১৯ দুপুর ১:২৭
৮টি মন্তব্য ৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আপনি কি পথখাবার খান? তাহলে এই লেখাটি আপনার জন্য

লিখেছেন মিশু মিলন, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১০:৩৪

আগে যখন মাঝে মাঝে বিকেল-সন্ধ্যায় বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতাম, তখন খাবার নিয়ে আমার জন্য ওরা বেশ বিড়ম্বনায় পড়ত। আমি পথখাবার খাই না। ফলে সোরওয়ার্দী উদ্যানে আড্ডা দিতে দিতে ক্ষিধে পেলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

কষ্ট থেকে আত্মরক্ষা করতে চাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৯



দেহটা মনের সাথে দৌড়ে পারে না
মন উড়ে চলে যায় বহু দূর স্থানে
ক্লান্ত দেহ পড়ে থাকে বিশ্রামে
একরাশ হতাশায় মন দেহে ফিরে।

সময়ের চাকা ঘুরতে থাকে অবিরত
কি অর্জন হলো হিসাব... ...বাকিটুকু পড়ুন

রম্য : মদ্যপান !

লিখেছেন গেছো দাদা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫৩

প্রখ্যাত শায়র মীর্জা গালিব একদিন তাঁর বোতল নিয়ে মসজিদে বসে মদ্যপান করছিলেন। বেশ মৌতাতে রয়েছেন তিনি। এদিকে মুসল্লিদের নজরে পড়েছে এই ঘটনা। তখন মুসল্লীরা রে রে করে এসে তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

= নিরস জীবনের প্রতিচ্ছবি=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৪১



এখন সময় নেই আর ভালোবাসার
ব্যস্ততার ঘাড়ে পা ঝুলিয়ে নিথর বসেছি,
চাইলেও ফেরত আসা যাবে না এখানে
সময় অল্প, গুছাতে হবে জমে যাওয়া কাজ।

বাতাসে সময় কুঁড়িয়েছি মুঠো ভরে
অবসরের বুকে শুয়ে বসে... ...বাকিটুকু পড়ুন

Instrumentation & Control (INC) সাবজেক্ট বাংলাদেশে নেই

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৫




শিক্ষা ব্যবস্থার মান যে বাংলাদেশে এক্কেবারেই খারাপ তা বলার কোনো সুযোগ নেই। সারাদিন শিক্ষার মান নিয়ে চেঁচামেচি করলেও বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরাই বিশ্বের অনেক উন্নত দেশে সার্ভিস দিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×