১...
একদল কুকুর ঘিরে আছে মাত্র একটা কুকুরীকে! কেউ তাকে অভিভূত করতে পারছে না।কেউ কুকুরীর গা শুকছে, কেউ গায়ে আলতো কামড় দিচ্ছে, কেউ মাটিতে অহেতুক গড়াগড়ি খাচ্ছে,কেউবা দু'পা উঠিয়ে দিচ্ছে কুকুরীর গায়ে। তাতে কি? কুকুরীর মন গলছে না, সে লেজ দিয়ে ঢেকে রেখেছে নিজের সম্ভ্রম!
নিম্ন প্রানিকূলে জবরদস্তি নেই, নয়তো এরা সবাইকে কুকুরীকে শেয়ার করতো।
এই কুকুরের দলের পাশেই চারজনের একটা দল একটা মেয়েকে ঘিরে রেখেছে। মেয়েটার অবস্থা কুকুরীর চেয়েও খারাপ। কুকুরগুলোর মত কেউ তাকে অভিভূত করার চেষ্টা করছে না, মতামত চাচ্ছে না। এরা ঝগড়া করছে, কে আগে যাবে!
মেয়েটি কাঁদছে!ওর গায়ের কাপড় হয়তো ছেড়া, আমি দেখতে পাচ্ছি না। ওরা ওকে ঘিরে রেখেছে। আজ ওর নিস্তার নেই।
মেয়েটি আমাকে ডাকলো,"এই ভাইয়া, এই যে চশমাওয়ালা ভাইয়া। আমাকে বাচান, এরা আমার সাথে খারাপ কাজ করবে। ভাইয়া, আমাকে বাচান!"
মেয়েটি শব্দ করে কাঁদতে লাগলো।
একটা ছেলে বেশ জোর দিয়েই বললো,"ও আমার জিএফ। তাই আমি আগে করবো, পরে তোরা।"
২...
আমি মেয়েটির ডাক এড়িয়ে গেলাম। আমার অত সব খেয়াল করার সময় নেই। আমি লালন সাই'র গানে বিমোহিত।
"গোপনে যে বেশ্যার ভাত খায়
তাতে ধর্মের কি ক্ষতি হয়?
লালন বলে, জাত কারে কয়?
সে ভ্রম তো গেল না,না...."
আহা! কি শুদ্ধ চিন্তা।
সত্যিই ধর্ম, সৃষ্টিকর্তা বলে কিছু নেই? যদি থাকে, তবে তার কাছে গিয়ে কি জবাব দিবো? যদি হিন্দু ধর্ম সত্যি হয়, মুসলিমদের কি হবে? একই কথা খাটে হিন্দু, খ্রিস্টান, জৈন, বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের ক্ষেত্রেও।যদি অন্যের ধর্ম সত্য হয়?
সহনশীল হলে তো তবু বলতে পারবো,"হে সৃষ্টিকর্তা, আমি আপনার পথ অনুসরণ করিনি। কিন্তু যারা অনুসরণ করেছে তাদের কষ্ট দেইনি, সমস্যা করিনি।আমায় ক্ষমা করুন!"
আমাদের মাঝে সে সহনশীলতা কই!আমরা মসজিদ জ্বালিয়ে দেই, প্রতিমা পুড়িয়ে দেই, গির্জায় তালা লাগিয়ে দেই।
একটা কথা আছে না 'পথ বলে আমিই সব, মানুষ বলে সব, মূর্তি বলে আমিই সব, হাসে অন্তর্যামী।'
কুকুরের দল ডেকে উঠলো। ওরা কুকুরীকে ভোলাতে না পেরে কিছুটা ক্লান্ত। ওরা পাশের ছেলের দলটার দিকে তাকিয়ে ঘেউ ঘেউ করছে।
তাতে ছেলের দল ভয় পেল না। ওরা মেয়েটাকে টেনে প্রাইমারি স্কুলের পিছনে নিয়ে যাচ্ছে।মেয়েটি কাঁদছে, আমি শুনতে পাচ্ছি!
কুকুরগুলো ঘেউ ঘেউ করে ওদের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। কুকুরীর দিকে কেউ মনোযোগ দিচ্ছে না। সে কিছুটা আশাহত!
মানুষ কুকুরকে ভয় পায় না, ভয় পায় সাপকে। অথচ সাপের চেয়ে কুকুর হিংস্র। সাপ তো মানুষ দেখলেই দৌড়ে পালায়!
আশ্চর্য! একটা জিনিস মিলে গেল। সেদিনও আমি লালনের এই গানটাই শুনছিলাম।প্রকৃতি রহস্যময়! সেদিনের মত একই পরিস্থিতি তৈরি করেছে।
৩...
সেদিন কানে গোজা ইয়ারফোনে লালনের "জাত গেল" গানটাই চলছিল। আমি যাচ্ছিলাম দিয়াকে পড়াতে। মূল রাস্তা ছেড়ে প্রাইমারি স্কুলে ঢোকার গেট সেখানে দাঁড়িয়ে আছে মারুফ, আশিক আর ফাহিম আর নাম না জানা একটা ছেলে। এদের আমি কোচিংএ পড়িয়েছি।
এরা আমাকে দেখে পথ ছেড়ে দিলো।
আমি অনেক দ্রুত হাটি।আমার পেছনে একটা মেয়ে প্রায় দৌড়ে এল। আমার সাথে সাথেই প্রাইমারি স্কুল পাড় হয়ে দ্রুত চলে গেল।
পরেরদিন একই ঘটনা। মেয়েটি পথে দাঁড়িয়ে ছিল। আমি কাছাকাছি গেলে আমার সাথে ঐ পথ টুকু পার হল। ছেলেগুলোর মাঝে স্পষ্ট অস্বস্তি।
কয়েকদিন এইভাবেই কেটে গেল। মেয়েটি আমার জন্য অপেক্ষা করে, আমি গেলেই আমার সাথে পথটুকু যায়।
একদিন ছেলেগুলো আর ধৈর্য্য ধরতে পারলো না। মেয়েটির ব্যাগ টেনে ধরলো। মেয়েটি আমাকে ডেকেছে, আমি শুনতে পাইনি। লালনের গান শুনছিলাম। প্রাইমারি স্কুল গেট পেড়িয়ে দেখি মেয়েটি আমার পেছনে নেই।
আমি পেছনে ফিরে আসি। দেখি মারুফ মেয়েটির হাত ধরে আছে।
মেয়েটি ছোটানোর চেষ্টা করছে। পারছে না।
আমাকে দেখেই মারুফ হাত ছেড়ে দিল। মেয়েটি আমার পেছনে লুকিয়ে গেল।
অচেনা ছেলেটি বলল,"আপনে নিজের কামে যান, এইখানে কি?"
মারুফ, আশিক, ফাহিম ওর দিকে তাকাতেই ছেলেটি দমে গেল।
আমি ওদের বেশ বকা দিলাম,"পড়াশোনা নাই, রাস্তায় রাস্তায় মেয়েদের বিরক্ত করা। লজ্জা করে না? তোমাদের বাবা-মাকে বিচার দিয়ে আসবো।" আর যত বকা, জ্ঞ্যানের কথা বলা যায়।
এরপরে অনেকদিন আমি ওদের আর মেয়েটিকে দেখিনি।
৪...
হটাৎ একদিন খেয়াল করলাম, ঐযে বড় আমগাছটার নিচে একটা কারেন্টের খাম্বা শোয়ানো যেখানে আমি প্রায়ই বসে লিখি; ওখানে মারুফ আর মেয়েটা বসে আছে!
মারুফ আমাকে দেখে হাসলো। এই হাসি বিজয়ের হাসি, আমাকে হারিয়ে দেবার হাসি! যার অর্থ, দেখুন, সেদিনতো খুব হিরো সেজেছিলেন। আজকে মেয়েটার সাথে প্রেম করছি। এখন পারলে ঠেকান!
ওর তিন সাঙ্গপাঙ্গও একটু দূরেই দাঁড়িয়ে আছে।
মারুফ মেয়েটিকে ডান হাতে কোমড়ে জড়িয়ে কাছে টেনে নিলো, গালে ছোঁয়ালো ঠোঁট। মেয়েটিও বাধা দিল না। আমাকে দেখেও এতটুকু লজ্জা পেল না! মেয়েটি মারুফের কাধে মাথা রেখে চোখ বুজল।
আমি বুঝতে পারছিলাম না, আমার লজ্জা পাওয়া উচিত কিনা?
এর কিছুদিন পর আবার দেখলাম ওদের প্রাইমারি স্কুলের ভেতরে। মেয়েটি দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।মারুফ দেয়ালে হাত দিয়ে গল্প করছে।
তখনি বুঝতে পারলাম, গেটের কাছে দাঁড়িয়ে থাকা আশিক, ফাহিম আর নাম অজানা ছেলেটি আমাকে দেখে কেন একসাথে শিশ বাজিয়েছ।
আমাকে দেখেই মারুফ, মেয়েটি আর তার মাঝের দূরত্ব কমিয়ে ফেলল। দুজনের শরীর মিলে একাকার!
এই জায়গাটা যে খুন নির্জন তা না, প্রায়ই লোকজন যায়। এর মাঝেও এরা এমনভাবে প্রেম করতে পারে। পার্কগুলোতেও একই চিত্র দেখা যায়। ঢাকার প্রেমিক-প্রেমিকা যুগলের মাঝে প্রেম থাকতে পারে, কিন্ত লজ্জা নেই!
তবে আমি ঠিকই লজ্জা পেলাম। ছোটবেলায় দেখেছি বড়রা প্রেম করে, বড় হয়ে দেখি ছোটরা প্রেম করে। আমাকে দিয়ে কিছুই হল না!
৫...
আজকে আবার ওদের সাথে দেখা হয়ে গেল। আমার খারাপ লাগছে না। সবসময় মজা মারুফই নিবে; আশিক, ফাহিম, নাম না জানা ছেলেটা দাঁড়িয়ে দেখবে বা পাহারা দিবে। এটা কেমন কথা। আমি সমানাধিকারে বিশ্বাসী!
আমি কি মনে করে আস্তে আস্তে প্রাইমারি স্কুলের নতুন বিল্ডিংয়ের পিছনে গেলাম। ঐদিকটা অন্ধকার, জঙ্গলে ভরা।মানুষ কখনো ওদিকে যায় না।
ফ্লাশ লাইটের আলোয় চারটি আতঙ্কিত মুখ দেখলাম। মেয়েটি এখনো বশ মানেনি, নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করেই যাচ্ছে।
লতাপাতা, ঘাসের উপর মেয়েটির ওড়না বিছিয়ে বিছানার মত তৈরি করা হয়েছে। সামনেই পরে আছে বেলুনের প্যাকেট, একটা খোলা হয়েছে। যাইহোক, ছেলেগুলোর এলেম আছে, স্বীকার করতে হবেই।
নাম না জানা ছেলেটা দুই হাত; আশিক, ফাহিম দুজন দুই পা ধরে আছে। মারুফ মেয়েটির উপর চড়ে আছে। ওর প্যান্ট হাটু পর্যন্ত নামানো।
ও মেয়েটির পাজামা খুলতে পারেনি। তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে হয়তো গিট পাকিয়ে ফেলেছে।
আমাকে দেখেই, তিনজন চট করে আমার দিকে তিনটা খুর এগিয়ে ধরলো, চকচকে খুর। আরেকবার ছেলেগুলোর বুদ্ধিতে আমি অভিভূত হলাম। এরা সব প্রস্তুতি আগেই নিয়ে রেখেছে!
"মারুফ, আপনার জিনিসটাতো খুব ছোট!"
"তাতে কি? এইটা ছোট বড় দিয়া পুরুষ মানুষ বিবেচনা করা যায় না।"
"এইটা না থাকলে মানুষ আর পুরুষও থাকে না।"
মেয়েটি ততক্ষণে নিজেকে সামলে নিয়েছে।
নাম না জানা ছেলেটা অস্থির হয়ে গেল, বললো,"আপনে চান কি? চইলা যান। নইলে দিবো এইটা পেটে ঢুকাইয়া।"
খুর উঁচিয়ে ধরে আমার দিকে।
"আরে মিয়া রাগ করো কেন? ডিজিটাল বাংলাদেশে এই আনন্দের মুহুর্ত ভিডিও না করলে হবে? তোমাদের মোবাইলে নিশ্চয়ই ফ্লাশ নাই।তোমরা অন্ধকারে কাজ করছো।"
আমার মোবাইলের ফ্লাশ দেখে ওরা আশ্বস্ত হয়, কথা বলে না।
আমি কথা চালিয়ে যাই,"মনে কর, ভিডিও করে রাখলাম পরে দেখতে পারলা। চাইলে সারা দুনিয়াই ছড়িয়ে দিলা, কিছু ওয়েবসাইটে এইসব ভিডিও দিলে নাকি টাকাও দেয়। পরে ভিডিওর ভয় দেখিয়ে মেয়েটার কাছে টাকা নিতে পারবে, আবার তাকে ডেকেও নিয়ে পারবে..."
ওদের চোখ চকচক করতে থাকে!
মেয়েটি একদলা থুতু ফেলে বলে,"আমি আপনাকে সেদিন ভালো লোক মনে করেছিলাম।"
"আমিও তোমাকে সেদিন ভালো মেয়ে মনে করেছিলাম। ভালোয় ভালোয় কাটাকাটি, তুমিও খারাপ আমিও খারাপ!"
"আমি আপনার বোনের মত।"
"বোনের মত, বোন তো না।আমার বোন খারাপ ছেলেদের সাথে প্রেম করে বেড়ায় না...."
আমার কথা কেড়ে নেয় আশিক,"সবাই বোন হইলে মজা নিবো কার লগে!"
চারজন একসাথে হেসে ঊঠে।আমিও যোগ দেই ওদের সাথে।
৬...
আনন্দময় পরিবেশ! ওরা চুল, শার্ট ঠিক করতে থাকে। ভিডিওতে চেহারা ভালো দেখানো চাই!
মারুফ আবার মেয়েটির দিকে এগিয়ে যায়। একটু ধস্তাধস্তি করতে থাকে, বাকি তিনজন আগের রোল প্লে করে হাসিহাসি মুখে।
আমি মারুফকে থামাই।মারুফ বিরক্ত হয়, বলে,"কি হইল? আপনি ভিডিও করেন, আমারে আটকান কেন?"
"একটা ঝামেলা হয়ে গেছে।আপনি ভিডিও করেন, আমি আগে কাজটা করবো।"
মারুফ রাগান্বিত চোখে আমার দিকে তাকায়।
"মারুফ, শুনুন আমি যতটুকু ভিডিও করেছি তাতেই দণ্ডবিধি ৫১১ ধারায় ধর্ষণের পদক্ষেপ নেয়ার অপরাধে আপনার ৭ বছরের জেল আর বাকিদের সাহায্য করার জন্য কমপক্ষে ৩ বছরের জেল হয়ে যাবে।আপনিতো জানেন, আমি উকালতি পড়াশোনা করেছি।"
মারুফ আর কথা বাড়ায় না। বাকিরাও চুপ থাকে।
নাম না জানা ছেলেটা তাচ্ছিল্যের স্বরে বলে,"ঠিক আছে। তাড়াতাড়ি কইরেন।যান, আপনেই আগে করেন। দেন, মুবাইল আমারে দেন। আমি ভিডিও করি।"
"আমি এখানে করবো না। আমি তোমাদের মত নিচু লোক নাকি! আমি একে বাসায় নিয়ে যাবো। বিছানায় ফেলে আরাম করে....। তারপর গেটের বাইরে বের করে দিবো, তোমরা ধরে নিয়ে এসো।"
আমি মেয়েটার হাত ধরে টেনে গেটের বাইরে নিয়ে আসি। মারুফ, আশিক, ফাহিম আর নাম না জানা ছেলেটাও একটি দুরত্ব রেখে আমার পিছনে আসতে থাকে।
মেয়েটি আর হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করছে না। নিজেকে নিয়তির হাতে ছেড়ে দিয়েছে হয়তো।
আমি বললাম," শোনো মেয়ে, এক দৌড়ে বাসায় চলে যাও। বাসায় যাবার আগপর্যন্ত থামবে না, পিছনে ফিরে তাকাবেও না।"
মেয়েটি আমার কথা বুঝতে পারে না। আমি ধমক দিতেই ঝেড়ে দৌড় দেয়।
একটু দূরেই ধুপ করে পরে যায়, আমি ওকে উঠাতে এগিয়ে যাই না। আমি জানি, ও একাই আবার দাড়াতে পারবে!
আমি হেঁটে ফিরে আসি। আমার সামনে পিছনে দু'দল হিংস্র কুকুর। পেছনের দল একনাগাড়ে ঘেউ ঘেউ করছে। সামনের দলের হাতে তিনটা খুর ফ্লাশ লাইটের আলোয় চকচক করছে। এরা রাগতেই পারে, আমি আজ এদের বিরক্তের চুড়ান্ত করেছি!
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই মার্চ, ২০২০ বিকাল ৪:৩৭