এভাটার চলচ্চিত্রের মূল কাহিনী লিখেছেন জেমস কেমেরন নিজেই। এই কাহিনী তিনি লিখেছিলেন অনেক আগে, চলচ্চিত্র নির্মাণের অভিপ্রায় থেকেই। তবে যে সময় তিনি এভাটার মুভির মূল কাহিনী লিখে শেষ করলেন তখন বুঝতে পারলেন, তা চলচ্চিত্রে রূপ দেওয়ার মতো প্রযুক্তি চলচ্চিত্র জগতে তখনও আসেনি। তাই লিখিত কাহিনীকে বাস্তব জগতে অর্থাৎ ক্যামেরার ফ্রেমে আনতে পারেন নি কেমেরন। তবে বর্তমানে থ্রিডি প্রযুক্তির কল্যাণে শেষপর্যন্ত নির্মাণ করলেন তার স্বপ্নের ছবি ‘এভাটার’। এভাটার (আধঃধৎ) শব্দটি কেমেরন নিয়েছেন মহাভারতের অবতার শব্দ থেকেই। ‘এভাটার’ই হল হলিউডের প্রথম পূর্ণাঙ্গ থ্রিডি চলচ্চিত্র।
‘এভেটর’ মূলত একটি সায়েন্স ফিকশন চলচ্চিত্র। সাযেন্স ফিকশন হলেও এর কাহিনী ও নির্মাণ শৈলীতে কেমেরন সুক্ষভাবেই তুলে ধরেছেন বিশ্বব্যাপি সাম্রজ্যবাদী রাজনীতির আগ্রাসনকে। মার্কিণ সাম্রাজ্যবাদের আধিপত্য ও আগ্রাসনের স্বরূপ উন্মোচন করেছেন বলেও অনেক চলচ্চিত্রবোদ্ধা, সমালোচক ও রাজনীতিবিদ মনে করছেন। পাশাপাশি সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন, আধিপত্যের বিপরিতে সাম্য-সংগ্রাম এবং সাহসকে বিজয়ী হিসেবে দেখিয়েছেন।
যদিও এভাটারের কাহিনী ২১৫৪ সালের পটভূমিতে রচিত। তখন ২১৫৪ সালে পৃথিবী নামক গ্রহটা প্রায় মৃত একটি গ্রহে পরিণত হবে। পৃথিবীর শক্তি ও সম্পদের সকল উৎস শেষ হয়ে আসবে। পৃথিবী থেকে ৪.৩ আলোকবর্ষ দুরে ‘প্যান্ডোরা’। এই গ্রহেই পৃথিবীর মানুষের উপনিবেশ গড়তে যাওয়ার গল্প নিয়ে ‘অবতার’। মুনাফার অঙ্কে চলচ্চিত্রের গত সব রেকর্ড ভেঙে দেওয়া এই চলচ্চিত্রটির নির্মাণ কৌশল, চোখ ধাঁদানো ভিস্যুয়াল এফেক্টের আলোচনাকে অতিক্রম করে শুরু হয়েছে নতুন বিতর্ক।
অবতার কি তাহলে সাম্রাজ্যবাদী বা ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে জীবনপণ লড়ে যাওয়া মানুষের কাহিনী? অবতারের মাধ্যমে কেমেরেন কী বার্তা দিতে চাইলেন? সেটা বোঝার আগে চলচ্চিত্রটির গল্পের প্লটটা দেখে নেয়া যাক।
অ্যাভাটার চলচ্চিত্রের সময়কাল হচ্ছে ২১৫৪ সাল। সূর্যের নিকটতম নক্ষত্র আলফা সেঞ্চুরি নক্ষত্রের একটি চাঁদ প্যানডোরাতে ছবির পটভূমি। প্যানডোরা হচ্ছে পৃথিবীর মতো পরিবেশ ধারণকারী একটি গ্রহ। এখানে বসবাস করে বিভিন্ন ধরনের প্রাণী। এই প্রাণীগুলো পৃথিবীর প্রাণীগুলোর মতোই, তবে বেশ ভিন্নতাও রয়েছে তাদের মধ্যে। যেমন এই প্রাণীগুলো অ্যামোনিয়া গ্রহণ করে জীবনধারণ করে। প্যানডোরার প্রাণীগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে মানুষের মতো দেখতে হিউমানয়েড জাতীয় প্রাণী না’ভি। এই না’ভিরা হচ্ছে নীলাভ রঙের। তারা সাধারণ মানুষের চেয়ে কিছুটা লম্বা এবং শক্তিশালী। না’ভিরা প্রকৃতির এবং প্যানডোরার অন্য প্রাণীদের সঙ্গে সুন্দর সহাবস্থান করে বসবাস করে। এদিকে পৃথিবীর মানুষ প্যানডোরাতে একটি প্রজেক্ট চালাচ্ছে। প্রজেক্টের কাজটি করছে আরডিএ করপোরেশন নামে একটি কোম্পানি। কোম্পানিটির প্রশাসক পার্কার সেলফ্রিডজ চান প্যানডোরার মাটির নিচে থাকা অত্যন্ত মূল্যবান পদার্থ আনোবটানিয়াম সংগ্রহ করতে। এ জন্য তাকে দায়িত্ব দিয়ে প্যানডোরাতে পাঠানো হয়েছে। ছবির অন্যতম খরনায়ক হচ্ছে এই পার্কার। কোম্পানি ও প্রশাসক পার্কারের আদর্শ হচ্ছে যে কোনো কিছুর বিনিময়ে মুনাফা গড়া । এই প্রজেক্টে নিরাপত্তার জন্য আরডিএ কোম্পানির রয়েছে নিরাপত্তা বাহিনী। এই নিরাপত্তা সামরিক বাহিনীর প্রধান কলোনেল মাইল। এই মাইল হচ্ছে ছবির প্রধান খলনায়ক। এদের পাশাপাশি ছবিতে রয়েছে বিজ্ঞানীদের একটি দল। এই দলের প্রধান গ্রেস অগাস্টিন। গ্রেস অগাস্টিন ও আরো কিছু বিজ্ঞানী মিলে চালাচ্ছেন অ্যাভাটার প্রোগ্রাম। এই প্রোগ্রামের উদ্দেশ্য হচ্ছে প্যানডোরার পরিবেশ ও না’ভি জাতিদের সম্পর্কে জানা। কিন্তু কীভাবে এটি সম্ভব? এ জন্য বিজ্ঞানীরা না’ভিদের ডিএনএ আর মানুষের ডিএনএর সংমিশ্রণ ঘটিয়ে সৃষ্টি করলেন মডিফাইড জীব অ্যাভাটার। এ জন্য অ্যাভাটারের মূল মানুষটিকে একটি নিউর্যাল ডিভাইসের সঙ্গে সংযুক্ত থাকতে হয়। এই নিউর্যাল ডিভাইসের সঙ্গে সংযুক্ত থাকা অবস্থায় একটি দারুণ ব্যাপার ঘটে। সেটা হচ্ছে যখন অ্যাভাটারের মূল মনুষ্য রূপটি ঘুমে অচেতন হয়, তখন আত্মা বা চেতনা এর অ্যাভাটার রূপে থাকে। আর যখন অ্যাভাটার অচেতন থাকে, তখন চেতনা বা আত্মা মূল মানুষটির মাঝে থাকে। এই অ্যাভাটার বানানো হয় বিজ্ঞানী গ্রেস, বিজ্ঞানী নর্ম আর নায়ক জ্যাক সুলির ডিএনএর সাহায্যে। এই তিন অ্যাভাটারকে এক পর্যায়ে পাঠানো হয় প্যানডোরার বনে। সেখানে এক শিকারি পশুর আক্রমণের শিকার হলে দল ভেঙে যায়। অ্যাভাটার জেক আলাদা হয়ে পড়ে। পশুর আক্রমণ থেকে জেককে বাঁচায় না’ভি জাতির ওমাতসায়া গোত্রের প্রিন্সেস নেয়েত্তি। নেয়েত্তি অ্যাভাটার জেককে নিয়ে আসে ওদের আবাসস্থলে। সেখানে পরিচয় হয় নেয়েত্তির মা মোয়াতের সঙ্গে এবং ওর বাবার সঙ্গে। অ্যাভাটার জেকের সঙ্গে প্রিন্সেস নেয়েত্তির প্রনয়ভাব গড়ে উঠে। এই ভাব আর নৈতিক বোধের কারণে জেক আরডিএ করপোরেশনের ধ্বংসাত্মক খনন কাজের বিপক্ষে যায়। গল্পের শেষ পর্যায়ে আরডিএ করপোরেশ ও সামরিক বাহিনীর সাথে অসম যুদ্ধ বাঁধে না’ভিদের। না’ভিরা গ্রহের সব প্রাণিক’লকে সঙ্গে নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলে এবং পাল্টা আক্রমণ করে। ফলে কোম্পানি ও তার সামরিক বাহিনী বাধ্য হয় খনন কাজ থামিয়ে প্যানডোরা ছেড়ে যেতে। প্যানডোরাতে না’ভিদের কাছে থেকে যায় বিজ্ঞানীরা আর অ্যাভাটার জেক।
যেনতেনভাবে মুনাফা গড়তে যেয়ে পুঁজিবাদীরা পৃতিবীটাকেই বিপন্ন করে তুলছে প্রতিনিয়ত। এটা এখন আর তত্ত্বকথা নয়। কিয়োটা থেকে কোপেনহেগেন, পরিবেশ নিয়ে দেশে দেশে আতঙ্কিত মানুষের অভিব্যক্তিই আজ তার স্পষ্ট প্রমাণ। পুঁজিবাদী ব্যবস্থার সীমাহীন লোভ আর দখলদাদের আগ্রাসনে পৃথিবীর জল-স্থল-অন্তরিক্ষ আজ বিপর্যস্ত। তারপরও পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখতে হলে সবখানেই তার অর্থনৈতিক আধিপত্য টিকিেিয় রাখতে হবে।
‘প্যান্ডোরা’ নামের গ্রহটিতে ‘আনোবটরিয়াম’ নামক জ্বালানী খনিজ দখল নেয়ার জন্য মার্কিন কোম্পানিটির যে কৌশল ও চরিত্রটি ফুটিয়ে তুলেছেন কেমেরন তা যে কোনো সচেতন দর্শক সহজেই মিলিয়ে নিতে পারবেন, গ্যাস-তেলের দখল নিতে ইরাক, আফগানিস্তান, লাতিন আমেরিকা ও আফ্রিকার দেশে দেশে মার্কিণ সেনা আর কর্পোরেটদের আগ্রাসনের সাথে। এদের গণ-বিধ্বংসী অস্ত্র কিভাবে নিমিষেই ধ্বংস করেছে অসংখ্য জনপদ।
নির্মাণ কুশলতায় ক্রমশ টান টান এগিয়ে গেছে অবতারের কাহিনী। তবে কেমেরনের এই চলচ্চিত্রটির যে বিষয়টি নিয়ে সবচেয়ে সমালোচনা বা বিতর্ক হচ্ছে, তা হলো আনোবটরিয়াম নামক খনিজ লুট করতে আসা কোম্পানি ও সামরিক বাহিনী এবং না’ভিদের মধ্যে যুদ্ধের বিষয়টি। দুরের কোনো গ্রহ তো দুরের কথা, পৃথিবীর মানুষই নিজেদের আবাসস্থল রক্ষা করতে যুগ যুগ ধরে লড়েছে। মরেছে। আমেরিকায় কলম্বাসের পা রাখার মধ্যদিয়ে কাযৃত শুরু হয়ে গিয়েছিল মার্কিণ ভূ-খন্ডে প্রকৃত আদিবাসীদের সঙ্গে ঔপনিবেশিক ইউরোপিয়ান লড়াই। পরবর্তিতে এশিয়া, আফ্রিকাতেও এর ব্যাতিক্রম হয় নি।
বিষাক্ত তীর শত্রুর বুকে গেঁথে দিয়ে শেষপর্যন্ত নেয়েত্রি নিজেদের ও নিজের গ্রহটিকে রক্ষা করে। কিন্তু কেমেরনের ছবির এই বিজয় কিন্তু বাস্তবতা নয়। দশকের পর দশক ধরে দুনিয়ার আদিম জনগোষ্ঠীর মানুষ খনিজ উত্তোলক, পরিবেশ ধ্বংসকারী সংস্থার বিরুদ্ধে লড়াই করেছে এখনো করছে। কেমেরন যেমন দেখিয়েছেন ঠিক সেভাবেই দেশে দেশে পুঁজিবাদী সরকারগুলো এদের সমর্থন দিয়েছে। অদূনা মাগুরছড়া, টেংরাটিলা গ্যাস ফিল্ডে আগুন। হাজার-হাজার কোটি টাকার গ্যাস নষ্ট, পরিবেশ ধ্বংস এবং সরকারের নিরব ভূমিকাই কি এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ নয়? তবে ফুবাড়ি ও কানসাটের বিজয়ের সাথে কিছুটা সাদৃশ্য পাওয়া যায় অবতারের কাহিনীর । তারপরও বন্দুকের নলের মুখে অবাধে লুঠ হয়েছে প্রাকৃতিক সম্পদ। আদিবাসীদের জঙ্গল, পাহাড় থেকে উচ্ছেদ করতে বৃহৎ কর্পোরেটদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে সরকারের বাহিনী। সেনা-পুলিশ। অগুনতি হত্যা ঘটিয়েছে পুঁজিবাদী দানবরা। পেরু কিংবা ইকুয়েডরের মতো বাংলাদেশেও এমন ঘটনা কম ঘটে নি।
ভিন গ্রহের বাসিন্দাদের অস্তিত্ব রক্ষার কাহিনীর মধ্যদিয়ে পৃথিবীর সাম্রাজ্যবাদী, ঔপনিবেশিক শক্তির আগ্রাসনের বিভৎসতা ও তার বিরুদ্ধে মানুষের লড়াইকেই তুলে ধরেছেন বলে অনেকের অভিমত। তাঁরা মনে করেন এই চলচ্চিত্রটি পুঁজিবাদ বিরোধী মানবতা ও পরিবেশ রক্ষার পক্ষে। এ ছাড়াও অবতারে ক্যামেরন ন্যা’ভিদের এমন এক সমাজের চিত্র তুলে ধরেছেন যা কিনা শ্রেণী-বৈসম্যহীন সাম্যবাদী সমাজের সাথেই তুলনা করা যায় বলে বোদ্ধা ও সমালোচকদের অভিমত।
দুনিয়াজুড়ে গভীর সঙ্কটে পুঁজিবাদ। সাম্রাজ্যবাদের চূড়ামণি আমেরিকার হাল সবচেয়ে খারাপ। বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাবে উন্নত পুঁজিবাদী, শিল্পোন্নত দেশের সীমা অতিক্রম করে উন্নয়নশীল এবং অনুন্নত তৃতীয় বিশ্বের দেশেও গভীর প্রভাব ফেলেছে। এই অর্থনৈতিক মন্দা সৃষ্টি করেছে গভীর সামাজিক সঙ্কট। উন্নত পুঁজিবাদী ব্যবস্থার চকচকে পলেস্তারা খসে বেড়িয়ে পড়েছে হাড় কঙ্কাল। ফলে এই ব্যবস্তার বিরুদ্ধে সৃষ্টি হচ্ছে ক্ষোভ, বিরক্তি আর আক্রোশ। মানুষের এই যন্ত্রণাকেই পুঁজি করেছেন ক্যামেরন।
বহুজাতিক কোম্পানির সীমাহীন লোভের শিকার তৃতীয় বিশ্বের মানুষ। রঙিন পর্দায় অসাম্যের এই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে ন্যা’ভিদের বিজয় দেখিয়ে ক্যামেরন যে স্বস্তি অনুভব করেছেন তাতে কারে সন্দেহ নেই।
দশকের পর দশক ধরে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের শোষণে নিষ্পেসিত পেরুর খাদান শ্রমিক তদাই উদ্বেলিত ‘অবতার’ দেখে। শুধু কি শ্রমিক ? স্বয়ং বলিভিয়ার প্রেসিডেন্ট মোরালেসতো বলেই ফেলেছেন, ‘এতো বলিভিয়ার মানুষের লড়াই’।
তীব্র অর্থনৈতিক মন্দার জালে আটকে থাকা হলিউড মুনাফার জন্য না হয় ঐপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে মানুষের বিজয়কেই পর্দায় হাজির করলো। মুনাফার জন্য সব করা যায়। মুনাফাইতো সব। যেখানে বিপুল সফল ক্যামেরন। কিন্তু পুঁজিবাদের জীবনে নৈতিকতার কোনো স্থান নেই বলে তিনি নিজেই তো জানিয়েছেন ‘অবতার’-এ।
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই মার্চ, ২০১১ রাত ৩:৫৫

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




