somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ইবনে বতুতার বাঙলা, শায়েস্তা খাঁ ও ঢাকা পশ্চিম গেট

০১ লা জুন, ২০১৯ সন্ধ্যা ৭:৩৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



সত্তরের দশকের শেষে আমি যখন কেবল স্কুলে ভর্তি হয়েছি তখন একটা গান শুনেছিলাম -'এই যে বাজার , দশ টাকা সের পুটি ১০০ টাকা এও তো আমার ব্যাগ ভরল না, কেন ভরল না, ওরে মদনা, তুইই বল না। ' । তখনো বাজারে যাওয়া শুরু করি নি, কাজেই গায়কের ব্যাগ না ভরার এর দুঃখ বা মদনার দায়বদ্ধতার সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা গড়ে ওঠেনি।

চলে যাই সাড়ে ছ্শ বছর পিছনে । বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা তখন চাটগাঁ হয়ে বাংলায় প্রবেশ করেছেন, উদ্দেশ্য বিখ্যাত সাধক শাহ জালাল রহমতুল্লাহি আলাইহি এর সঙ্গে সাক্ষাৎ। ইবনে বতুতার বর্ণনায় সেই সময়ের আসাম, সিলেট, খাসিয়া এলাকা, চট্টগ্রাম সোনারগাঁ সহ বাংলার বিভিন্ন এলাকার অর্থনৈতিক সামাজিক জীবনের খুব ভালো বর্ণনা পাওয়া যায় ( টিকা ১) । তবে তার টাকায় আট মণ চালের বর্ণনার অংশটুকুই আমাদের কাছে বেশি পরিচিত। আমরা সচেতন বা অচেতন যে কারনেই হোক না কেন, এই বর্ণনার পরের লাইনটুকু এড়িয়ে যাই যেখানে ইবনে বতুতা বলেছেন ওই সময় ১০ টাকায় ১৬ বছরের সুন্দরী যুবতী মেয়ে বাজারে ক্রীতদাস হিসেবে বিক্রি হতো । অনেক বাম ঘেষা অর্থনীতিবিদ আবার বলে থাকেন দ্রব্য মূল্য কম থাকাটা অর্থনীতির জন্য ভালো না। ঐ সময়ে বাঙলার শাসক ছিলেন ফখরুদ্দিন মোবারক শাহ। ওই সময়ের রুপার টাকার বর্তমান দাম ৫০০ টাকা ধরলে (টিকা ২) সেই সময়ে বিভিন্ন দ্রব্যের বাজারদর নিচের মত হবেঃ

১)চাল প্রতি মণ ৫৫ টাকা
২) ধান প্রতি মণ ১৫ টাকা*
৩)গুড় প্রতি মন ৭ টাকা
৪) ঘি প্রতি মন ৭ টাকা
৫) মিহি কাপড় (সবচেয়ে দামি) প্রতি গজ ৬৫ টাকা,
৬)একটি হৃষ্টপুষ্ট গরু ১৫০০ টাকা
৭) একটি ভেড়া ১২৫ টাকা ইত্যাদি ।


( ইবনে বতুতার দেখা বাঙলার বাজার দর -উৎস: এইচ এ আর গিব এর অনুবাদ:Ibn Battuta Travels In Asia And Africa 1325-1354 । পৃষ্ঠা ২৬৭ পাবলিশারঃ রুলেজ এন্ড কেগান, লন্ডন, প্রথম প্রিন্ট ১৯২৯ ।)


ফিরে যাই প্রায় ৩০০ বছর পর, শায়েস্তা খাঁর আমলে। ঢাকা তখন বাংলার রাজধানি। । শয়েস্তা খাঁর সুশাসন এর ফলে ঢাকায় তখন দ্রব্যমূল্য আবার কম। চালের দাম আবার ২ আনা প্রতি মন । ঢাকা পশ্চিম তোরণ বন্ধ করে একটি ফলক লাগিয়ে শায়েস্তা খান তাতে লিখে দিলেন- যে শাসক পুনরায় ঢাকার লোককে টাকায় ৮ মণ চাল খাওয়াতে পারবে শুধু সেই এই গেট দিয়ে প্রবেশের অধিকার রাখে। শায়েস্তা খানের এক টাকার বর্তমান বাজার মূল্য আনুমানিক পাঁচশ টাকা ( টিকা ২)।

বর্তমান সময়ে ফিরে আসি। কিছু দিন আগে সরকারের এক অপরিহার্য মন্ত্রী দেশে এক টাকা বা দুই টাকার কয়েন চালু আছে এটা জানায় বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন। এই বিস্ময় প্রকাশ খুবই স্বাভাবিক। কানাডা কে ছাড়িয়ে যাওয়া বাংলাদেশের জনগণের এখন জনপ্রতি গড় আয় ১৮২৭ ডলার (সূত্রঃhttps://www.ceicdata.com/en/indicator/bangladesh/gdp-per-capita) যা টাকায় এক লক্ষ চুয়ান্ন হাজার টাকার কিছু বেশি। একটি পরিবারে জনসংখ্যা ৬ জন ধরলে (গত বেতন স্কেল প্রনয়ণ করার সময় দেশের একটি পরিবারের সাইজ বাবা,মা, দুই সন্তান-স্বামী-স্ত্রী সহ ৬ জন ধরা হয়েছে) পরিবার প্রতি আয় দাঁড়ায় মাসে সাতাত্তর হাজার টাকার উপর। । ফখরুদ্দিন মোবারক শাহ বা শায়েস্তা খাঁর আমলে এক টাকা উপার্জন কিন্তু খুব সহজ ছিল না। পাঁচশত টাকার মতো বড় নোটের কথা বাদ দেই। দেখা যাক ১০০ টাকার একটি কাগুজে নোট দিয়ে বর্তমান বাজারে কি কি কেনা সম্ভব।
১) ১০ জনের ঐতিহ্যবাহী নাস্তা
২) ১২ আঁটি পাট শাক
৩) ৪ কেজি আটা
৪) ৫ কেজি ঢ্যাড়স
৫) ২ কেজি মসুরের ডাল।
৬) দেড় কেজি চিনি।
৭) সাড়ে ৬ কেজি আলু।
৮) একজোড়া স্পঞ্জের স্যান্ডেল।
৯) ১ ১/২ লিটার দুধ
১০) আড়াই কেজি খেসারির ডাল।
১১) আড়াইশো গ্রাম মলা মাছ।
১২) ১৮০ গ্রাম গরুর গোস্ত।
১৩) তিন জনের ইফতার
১৪) ১০ কেজি ধান

যে গান দিয়ে শুরু করেছিলাম তার গায়ক নিশ্চয়ই বাজারের ব্যাগ বলতে বিশালাকারের বস্তা বুঝিয়েছিলেন।

(আলু, চিনি, দুধ, মাছ, মাংস ইত্যাদির মূল্য স্বপ্ন সুপার স্টোর থেকে নেয়া। মসুর ডাল, আটা, খেসারির ডাল রাস্তার পাশের ন্যায্য মূল্যের ট্রাক থেকে নেয়া (আমি এখান থেকেই কিনি)। ইফতারের দর লন্ডনি রাজপুত্রের পারিষদের দেয়া বাজার দর থেকে )


শায়েস্তা খানের বন্ধ করা পশ্চিম গেট চিরকাল বন্ধ থাকেনি। সরফরাজ খাঁর আমলে (১৭৩৯-১৭৪০ সাল) পুনরায় ঢাকায় টাকায় ৮মণ চাল পাওয়া গিয়েছিল। সফরাজ খাঁন এই গেট দিয়ে প্রবেশ করেছিলেন (সূত্রঃ Dacca: Eastern Bengal District Gazetteers- 1912- Basil Copleston Allen)। ঢাকা দক্ষিণের মাননীয় মেয়র সাঈদ খানের এখন থেকে প্রস্তুতি নেওয়া দরকার। ২০২১ সাল নাগাদ মানবতার মাতা , গরিবের বন্ধু , মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওই গেট দিয়ে পুনরায় প্রবেশ করবেন বলে আশা করছি।
..................................................................................................................................................................................
টিকা ১) ১৩৩৪ সালে সুলতান মুহাম্মদ তুঘলকের আমলে ইবনে বতুতা দিল্লি আসেন। অনেক জায়গা ঘুরে অবশেষে চাটগা হয়ে সেই সময়ের বাঙলায় প্রবেশ করেন ১৩৪৬ সালে । তিনি দুই মাসের কাছাকাছি বাংলায় ছিলেন। সেই সময়ে বাংলার শাসক ছিলেন ফখরুদ্দিন মুবারক শাহ। ঐ সময়ে বাংলার রাজধানি ছিল সোনারগাঁ। ইবনে বতুতা বাঙলা থেকে জাভা হয়ে ১৩৫২ সালে জন্মস্থান মরক্কোয় ফিরে যান। মরক্কোর সুলতান তখন আবু ইনান ফারিস। তার নির্দেশ ও অর্থায়নে সুলতানের কর্মচারি ইবনে জুজাই ইবনে বতুতার ২৯ বছরের পর্যটনের কাহিনী লিপিবদ্ধ করেন যার কাজ ১৩৫২ তে শুরু হয়ে ১৩৫৫তে শেষ হয়। ১৮২৯ সালে ডঃ স্যামুয়েল লী এর আংশিক অনুবাদ প্রকাশ করলে তা পশ্চিমা জগতের নজরে আসে। বাংলাদেশে যা অনুবাদ পাওয়া যায় আমার জানা মতে তা সব ১৯২৯ সালে এইচ এ আর গিব এর অনুবাদের অনুবাদ। অনেক ইতিহাস বিদ তার বর্ননা নিয়ে বিভিন্ন তামাশা করলেও অধিকাংশ ইতিহাসবিদের মতে তার বর্ননা নিরপেক্ষ যা ঐ সময়ে দূর্লভ ছিল।

টিকা ২) ইবনে বতুতার বর্ননায় এসেছে আরবি দিরহাম (স্বর্নমুদ্রা) ও দিনার (রৌপ্যমুদ্রা)র কথা। ১ দিনার সমান দিল্লির ১ রুপার টাকা ছিল (প্রায়) বাংলার রুপার টাকা আর দিল্লির রূপার টাকার মান সমান ছিল। ঐ রোপার টাকার বর্তমান মুল্য নিরূপন করা সম্ভব না। আমরা মেটাল ভ্যালু ধরতে পারি। রূপার টাকায় ঐ সময়ে ১১.২-১১.৪ গ্রাম অশোধিত রূপা থাকতো। শায়েস্ত খাঁর আমলের টাকায়ও তাই ছিল। বর্তমান বাজারে সমপরিমান ৯৯% পিওর রূপার দাম ৪৮০ টাকার কাছাকাছি (অশোধিত রূপার দাম কিছু কম হবে)। তবে মেটাল ভ্যালু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলায়। যেমন জাকাতের নিসাব হিসাবে ধরা হয় সাড়ে সাত তোলা সোনা বা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপা, কারন সে সময়ে সাড়ে সাত তোলা সোনা এবং সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপার দাম সমান ছিল, যা একন নেই । কাজেই এই ভাবে বের করা দাম প্রামান্য হিসাবে ধরা ঠিক হবে না। তবে আরো জটিল ভাবে হিসাব করলেও তা সর্বজন গ্রাহ্য হবে না। কাজেই আপাতত এটাই থাক।



সর্বশেষ এডিট : ০১ লা জুন, ২০১৯ রাত ৯:৫৪
১৫টি মন্তব্য ১৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছবির গল্প, গল্পের ছবি

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৩:১৫



সজিনা বিক্রি করছে ছোট্ট বিক্রেতা। এতো ছোট বিক্রেতা ও আমাদের ক্যামেরা দেখে যখন আশেপাশের মানুষ জমা হয়েছিল তখন বাচ্চাটি খুবই লজ্জায় পড়ে যায়। পরে আমরা তাকে আর বিরক্ত না করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে লীগ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে জামাত

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৪৬


বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪৩

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

চা বাগানের ছবি কৃতজ্ঞতা: http://www.peakpx.com এর প্রতি।

আমাদের সময় একাডেমিক পড়াশোনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চয়নিকা বইয়ের গল্পগুলো বেশ আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, চাষীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×