somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মানসিক সমস্যা ও করণীয়......।

৩০ শে মার্চ, ২০১২ রাত ১১:৫৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সময় ও সভ্যতা কোনটাই থেমে থাকছে না। থেমে থাকছে না মানুষের এই পথচলা। ক্রমাগত মানুষ পার হয়ে যাচ্ছে সময়ের সমুদ্র আর সভ্যতার প্রান্তর। কিন্তু সময় ও সভ্যতা সত্যি কি মানুষকে দিতে পেরেছে সুখের সন্ধান অথবা শান্তির আশ্বাস? শহরে অথবা শহর থেকে দূরে কোথাও”! ক্রমবর্ধমান চাহিদার ভিড়ে জীবন ও জীবিকার তাগিদে মানুষের পেশায় এবং দৈনন্দিন জীবনে যোগ হয় ভিন্নমাত্রা, শুরু হয় মানুষের অন্তহীন পদযাত্রা। দৃশ্যপট পাল্টাতে থাকে প্রতিনিয়ত। ক্রমবর্ধমান চাহিদা আর প্রাপ্তিতে ঘটে বিস্তর ফারাক। শুরু হয় মানসিক যাতনা। এই মানসিক যাতনা থেকে তৈরি হয় উদ্বেগ, হতাশা, বিষণœতা। ছোটখাট হতাশা উদ্বেগগুলো ধীরে ধীরে জমা হতে হতে নাগরিক জীবনের ভিতকে নাড়িয়ে দেয়। মানুষ হারিয়ে ফেলে নিজের প্রতি বিশ্বাস। ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক অতঃপর নাগরিক জীবনের ওপর প্রভাব বিস্তার করে। সুখী হওয়া তাদের পক্ষে দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে।
আধুনিক যুগে নানা সমস্যার মধ্যে “সূক্ষ্ম যন্ত্রণাবোধ” অন্যতম। নীরব ঘাতকের মত সেই উদ্বেগ আমাদের মনকে আচ্ছন্ন রাখে যা প্রকাশ করা যায় না। এই সূক্ষ্ম যন্ত্রণাবোধের হাত থেকে রেহাই নেই কারোরই। নারী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধ, তরুণ-তরুণীর মনে যেকোন বয়সে, যেকোন সময়ে, যেকোন অবস্থার প্রেক্ষিতে উদ্বেগ, হতাশা, বিস্তার করে সমানতালে। সবক্ষেত্রে সাধারণ কিছু দৈহিক উপসর্গ থাকে। মনের উপসর্গগুলোর পরিস্কুট হয় চিন্তা, আবেগ ও লাইফস্টাইলে। যেকোন সমস্যায় মানসিক চাপের সৃষ্টি হয়। এই চাপের ফলে মনে নেতিবাচক ধারণার সৃষ্টি হয়। কোন কাজে বারবার ব্যর্থ হলে এই নেতিবাচক ধারণা স্থায়ী রূপ পায়। তখন মনে হয় “আমি কিছুই পারব না” “আমাকে দিয়ে কিছুই হবে না”। পরবর্তীতে সকলের কাছ থেকে এই নেতিবাচক আচরণ, উক্তিতে তার মন বিষিয়ে যায়। তার কাজকর্ম ব্যাহত হয়। কোন কাজে সে আগ্রহ খুঁজে পায় না। তার চলার গতি রুদ্ধ হয়।
উদ্বেগ বা হতাশা স্বাভাবিক জীবনের একটি অংশ। উদ্বেগ বা হতাশা মনের তীব্র অদৃশ্যমান এবং অস্বস্তিকর অনুভূতি। সাধারণত সমস্যার অপ্রত্যাশিত আশঙ্কা থেকেই উদ্বেগ বা হতাশা তৈরি হয়। এই অনুভূতি কখনো কখনো মানুষকে আতংকিত, অসুখী ও বেপরোয়া করে তোলে। অত্যধিক হতাশা বা উদ্বেগ যখন দৈনন্দিন, সামাজিক, ব্যক্তিগত কাজকে বাধাগ্রস্ত করে তখন বিষণœতা রোগ হয়েছে বলে ধরা হয়। দেহের যেমন বিভিন্ন রোগ হয়, বিষণœতা মনের একটি রোগ।
জীবন বড় কঠিন জায়গা। এখানে সহযোগিতার চেয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা বেশি, আপোসের চেয়ে সংঘাত বেশি। দুঃখ-যাতনায় ভুগে মানুষের মন থাকে ভারাক্রান্ত। স্বাভাবিক, সুন্দর চলার গতিতে আসে ছন্দপতন। ক্রমাগত পরাজয়, হতাশা, উদ্বেগ না পাওয়ায় এই নেতিবাচক দিকটির ভাবনা তার মনে প্রকটভাবে আন্দোলিত করে। এরকম দীর্ঘমেয়াদি মানসিক চাপের কারণে মস্তিষ্কে সেরোটনিন কমে গিয়ে বিষণœতা রোগের সৃষ্টি হয়। বর্তমানে প্রতিযোগিতাপূর্ণ বিশ্বই বিষণœতাকে উসকে দেয়ার প্রধান কারণ হিসেবে মনে করছেন মনোবিজ্ঞানীগণ। এছাড়াও দারিদ্র্য, আর্থ-সামাজিক অবস্থা, জেনেটিক ফ্যাক্টর ও বিষণœতার কারণ হিসেবে চিহ্নিত।
তীব্র উদ্বেগ বা হতাশা থেকে সৃষ্ট বিষণœতা রোগীর দৈহিক ও মানসিক গতি কমিয়ে দেয়। দীর্ঘমেয়াদী মানসিক চাপ শারীরিক কিছু উপসর্গের সৃষ্টি করে। যেমন, স্থায়ী অসুখী অনুভূতি, স্বাভাবিক কাজ করার অনাগ্রহ, অনুভূতি বা আবেগের ওপর নিয়ন্ত্রণহীনতা, স্থায়ী ক্লান্তিবোধ করা, মাথাব্যথা, চোখজ্বালা, শরীরে জ্বালাপোড়া, অনিদ্রা, বুক ধড়ফড় করা, অস্বাভাবিক হৃদস্পন্দন, খিটখিটে মেজাজ প্রভৃতি।
আমাদের দেশে প্রতিনিয়ত এই মানসিক রোগীর সংখ্যা বেড়ে চলছে। মোট জনসংখ্যার প্রায় সাত ভাগ মানুষ মানসিক রোগে ভুগছে। সমগ্র জনগোষ্ঠীর, প্রায় দশ লাখেরও অধিক মানুষ এ মানসিক রোগের শিকার। একটি পরীক্ষায় দেখা যায় সর্বমোট ১৩০৮০ জনের মধ্যে পরীক্ষা চালিয়ে ২১০০ জনকে মানসিক রোগী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এই হিসেবে বাংলাদেশে মানসিক রোগের হার ১৬.০৫% (১৬০.৫/১০০০ জনগোষ্ঠী)। মৃদু মানসিক রোগ, গুরুতর বিষণœতা রোগ এবং বড় ধরনের মানসিক রোগের হার যথাক্রমে ৮.৩৯% (৮৩.৯/১০০০), ৪.৬১% (৪৬.১/১০০০) এবং ১.০৭% (১০.৭/১০০০)। পুরুষের তুলনায় নারীদের মানসিক রোগের হার বেশি। এ অনুপাত (নারী ঃ পুরুষ ২:১)।
প্রত্যেকের জীবনই সমস্যাপূর্ণ। তবে মোকাবিলা করার কৌশল একেকজনের একেকরকম। আর সমস্যার তীব্রতাও কেউ গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করেন, কেউ কেউ গুরুত্বকে প্রধান্য দেন না। তবে আত্মপ্রত্যয়ী হয়ে, নিজের প্রতি বিশ্বাস রেখে, নেতিবাচক চিন্তা পরিহার করে, সমস্যার মোকাবিলায় কৌশলী হওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। উচ্চাশা বা অনিয়ন্ত্রিত ইচ্ছাকে পরিহার করতে হবে। সব সময় উচ্চাশা বা “সুপার ইগো” মনে ধারণ করলে বিষণœতা এমনিতেই আলিঙ্গন করবে। মানুষ সবসময় এক অবস্থানে থাকে না। উত্থান ও পতনের মধ্যদিয়েই তার জীবন। প্রতিটি অবস্থানেই তাকে সজাগ ও সন্তুষ্টি বোধ থাকতে হবে। মানুষ ভুল থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে। ভুলটিকে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতে নেয়া ভাল। ভুলকে নেতিবাচক সৃষ্টিতে বিচার করলে মনে স্থবিরতা আসবে। বিষণœতা পেয়ে বসবে। আধুনিক “লাইফ স্টাইল” অর্জনে দক্ষতা ও কৌশলী হতে হবে। অতিরিক্ত রাগের কারণে পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডার দেখা দিতে পারে। যে বিষয় নিয়ে রাগ করার কোন কারণ নেই সেই বিষয়গুলো নিয়েও রাগের বিহঃপ্রকাশ ঘটে। এসব রোগী ছোটখাট বিষয় নিয়ে অস্বাভাবিক আচরণ করতে শুরু করে। এদের মধ্যে মনঃসংযোগ ক্ষমতা কমে যায় এবং অস্থিরতা বেড়ে যায়। প্রতিমুহূর্তেই রাগের নিয়ন্ত্রণ সুস্থ ও স্বাভাবিক মানসিকতারই ইঙ্গিত বহন করে।
সমস্যাপূর্ণ জীবনে প্রতিমুহূর্তেই সমস্যা থাকবে এমন চিন্তা-ভাবনা করে মনের প্রস্তুতি বা ধারণা রাখা ভাল। সমস্যার সময়ে ঘাবড়ে না গিয়ে মেজাজকে নিয়ন্ত্রণে রেখে ধৈর্য, সাহস ও মনোবলকে দৃঢ় রেখে সমস্যার মোকাবিলা করা উচিত। উত্তেজনাকে পরিহার করে, আত্মবিশ্বাসকে প্রাধান্য দিয়ে “আমি পারব” এমন ইতিবাচক ধারণা পোষণ করতে হবে মনে-প্রাণে। লক্ষ্যকে ঠিক রাখতে হবে। উদ্দেশ্যহীন অপরিকল্পিত পদক্ষেপ কোন কাজের সমাধান দেয় না বরং পরাজয়ের আশংকা বেশি থাকে।
নাগরিক জীবন সমস্যায় জর্জরিত। এছাড়া হতাশার কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে নিরাপত্তাহীনতা, শিক্ষা, কার্যক্ষেত্রে সঠিক মূল্যায়নের অভাব, কালোটাকা ও পেশী শক্তির কাছে মেধা, যোগ্যতার পরাজয়। সততা, মহত্ব প্রভৃতি গুণ কেবল পাঠ্যপুস্তকের অন্তর্গত। আবেগ, সহমর্মিতা, সহানুভূতি, বিনয় এখন আর আগের মত দেখা যায় না। পারস্পরিক বিশ্বাস, শ্রদ্ধা, সম্মান হারাতে বসেছে সকলের মন থেকে। ভাঙ্গছে পারিবারিক সম্পর্ক। বৈবাহিক সম্পর্কে অনাগ্রহ বাড়ছে। মানসিক যাতনা প্রকট হচ্ছে। মানসিক রোগীর সংখ্যা বাড়ছে।
কুসংস্কার আর কিছু কিছু ক্ষেত্রে ভুল পদক্ষেপ রোগভোগকে দীর্ঘায়িত করছে। চিকিৎসার ক্ষেত্রেও সীমাবদ্ধতা আছে। মানসিক রোগীর চেয়ে শয্যা সংখ্যা অপ্রতুল। দক্ষ জনশক্তিরও ঘাটতি রয়েছে। সরকারের পাশাপাশি, বেসরকারি সংস্থা, বড় বড় এনজিওদের এগিয়ে আসা উচিত। শারীরিক স্বাস্থ্যসেবার পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্যসেবার খাতেও সেবার মান ও সেবার সহজ প্রাপ্তিতা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। চিকিৎসার যোগ্য রোগী যেন চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত না হয়, অবহেলার শিকার না হয়, সেদিকটিও লক্ষ্য রাখতে হবে পরিবারের পক্ষ থেকে।
তবে সাময়িক হতাশা, উদ্বেগ থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে নিজেদেরকেই উদ্যোগী হতে হবে। ভেঙ্গে ফেলতে হবে সকল দ্বন্দ্ব, উপড়ে ফেলতে হবে হতাশার শিকড়। সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ মনের উদ্বেগ আর হতাশাকে ঝেটিয়ে বিদায় করে মনে জ্বালাতে হবে আশার আলো।

[চিকিৎসক: ডা. ডালিয়া নাসরীন লোপা]
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ব্যাড গাই গুড গাই

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১১ ই মে, ২০২৪ সকাল ৯:০৩

নেগোশিয়েশনে একটা কৌশল আছে৷ ব্যাড গাই, গুড গাই৷ বিষয়টা কী বিস্তারিত বুঝিয়ে বলছি৷ ধরুন, কোন একজন আসামীকে পুলিশ হেফাজতে নেয়া হয়েছে৷ পারিপার্শ্বিক অবস্থায় বুঝা যায় তার কাছ থেকে তথ্য পাওয়ার... ...বাকিটুকু পড়ুন

টান

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ১১ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:২২


কোথাও স্ব‌স্তি নেই আর
বিচ্যুতি ঠেকা‌তে ছু‌টির পাহাড়
দিগন্ত অদূর, ছ‌বি আঁকা মেঘ
হঠাৎ মৃদু হাওয়া বা‌ড়ে গ‌তি‌বেগ
ভাবনা‌দের ঘুরপাক শূণ্যতা তোমার..
কোথাও স্ব‌স্তি নেই আর।
:(
হাঁটুজ‌লে ঢেউ এ‌সে ভাসাইল বুক
সদ্যযাত্রা দম্প‌তি... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্বল্প আয়ের লক্ষ্যে যে স্কিলগুলো জরুরী

লিখেছেন সাজ্জাদ হোসেন বাংলাদেশ, ১১ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:১৯

স্বল্প আয়ের লক্ষ্যে যে স্কিলগুলো জরুরীঃ


১। নিজের সিভি নিজে লেখা শিখবেন। প্রয়োজন অনুযায়ী কাস্টোমাইজ করার অভ্যাস থাকতে হবে। কম্পিউটারের দোকান থেকে সিভি বানাবেন না। তবে চাইলে, প্রফেশনাল সিভি মেকারের... ...বাকিটুকু পড়ুন

অহনা বলেছিল, তুমি হারাবে না

লিখেছেন সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই, ১১ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:০৫

অহনা বলেছিল, তুমি হারাবে না
অহনা বলেছিল, আমি জানি আমি তোমাকে পেয়েছি সবখানি
আমি তাই নিশ্চিন্তে হারিয়ে যাই যখন যেখানে খুশি

অহনা বলেছিল, যতটা উদাসীন আমাকে দেখো, তার চেয়ে
বহুগুণ উদাসীন আমি
তোমাকে পাওয়ার জন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

শিয়াল ফিলিস্তিনীরা লেজ গুটিয়ে রাফা থেকে পালাচ্ছে কেন?

লিখেছেন সোনাগাজী, ১১ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:১০



যখন সারা বিশ্বের মানুষ ফিলিস্তিনীদের পক্ষে ফেটে পড়েছে, যখন জাতিসংঘ ফিলিস্তিনকে সাধারণ সদস্য করার জন্য ভোট নিয়েছে, যখন আমেরিকা বলছে যে, ইসরায়েল সাধারণ ফিলিস্তিনীদের হত্যা করার জন্য আমেরিকান-যুদ্ধাস্ত্র... ...বাকিটুকু পড়ুন

×