অনুরোধ করবো ছবি দুটো দেখেন। দুটি ছবি কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন সময়ের, ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষাপটের। কিন্তু দুটোর ছবির কিন্তু ভাষা একই। অর্থাৎ বিপদগ্রস্থ মানুষের সাহায্যের আবেদন, চোখে অনিশ্চয়তার ভাষা, সব হারানোর ব্যথা, ক্ষুধাপীড়িত চাহনি।
প্রথম ছবিটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের কোন এক সময়ের (একটি শিশু তার মায়ের কোলে কাঁদছে) দ্বিতীয় ছবিটি খুবই সামপ্রতিক রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠির একটি ক্ষুদ্র অংশ যারা নিজ দেশ থেকে বিতাড়িত হয়ে পার্শ্ববর্তী দেশ বাংলাদেশের জলসীমানা দিয়ে ঢুকে আশ্রয় প্রার্থনা করছে। ছবিটির শিশুগুলোর দিকে একটু খেয়াল করেন। অবুঝ, ক্লান্ত, ক্ষুধার্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে।
শিশুগুলোর বাবা মা'র কত র্দূভাগ্য। তাদের নিজেদের চোখে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে হচ্ছে এ দৃশ্য। এসব ব্যাপারে আমি খুবই অধৈর্য্য, অস্থির, অসহিষ্ণু। আমি কখনই আমার বাচ্চাদের কোন কষ্ট দেখতে পারি না। ঠিক এমনই অন্যকোন বাচ্চার কষ্ট দেখলে ওখানে আমার বাচ্চার চেহারাটাই ফুটে ওঠে। ইট পাথরের নগরীর কঠিন জীবনে বলতে পারেন এটা আমার একটা লিমিটেশন।
= ইতিহাস =
ইতিহাস পূনরায় বলার প্রয়োজন না থাকলেও কিছুটা বলি। ৭০ এবং ৯০ দশকে মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গা এসেছিল আমাদের এই দেশে। বিভিন্ন হিসাবমতে এখনও বাংলাদেশে প্রায় দেড়/দুই লাখ রোহিঙ্গা বসবাস করে। বর্তমানে মিয়ানমারে প্রায় সাড়ে ছয় কোটি অধিবাসী রয়েছে এবং ওখানকার সরকার ওখানকার ১৩৫টি নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর স্বীকার করে নিয়েছে। কিন্তু এই রোহিঙ্গাদের স্বীকার করছে না। রবং মায়ানমারের সরকার তাদের ‘সন্ত্রাসবাদী’ বলে মনে করে।
এক ইতিহাস থেকে দেখা যায়, ৭৮৮-৮১২ খ্রিঃ আরব মুসলিমদের একটা নৌ বণিকের দল বিভিন্ন ঘটনার বশবর্তী হয়ে সে সময়ের আরাকান অঞ্চলের চন্দ্রবংশীয় রাজা মহৎ-ইঙ্গ-চন্দ্রের রাজত্বকালে রাজার দ্বারা অনুমতিপ্রাপ্ত হয়ে আরাকানে স্থায়ী বসতি গড়ে তোলে (মতভেদ আছে)। এরপর থেকে আছে বিভিন্ন ইতিহাস ও উত্থান পতন। এরা পরিচয়হীনভাবে বেড়ে ওঠা কোন জনগোষ্ঠী নয়। মূলত রোহিঙ্গারাই আরাকানের স্থায়ী ও আদি মুসলমান। রোহিঙ্গাদের আলাদা ভাষা থাকলেও অধিকাংশই বাংলা ভাষায় কথা বলে। মায়ানমারের আকিয়াব, রেথেডাং, বুথিডাং এলাকায় এদের বাস। মায়ানমার ছাড়াও বাংলাদেশ সহ আশেপাশের কয়েকটি দেশে এই রোহিঙ্গারা বসবাস করে। জাতিসংঘের হিসাব মতে এদের মোট সংখ্যা ৭২৯,০০০ (২০০৯ ইং)। চেহারা ও গঠনপ্রকৃতির দিক দিয়ে এরা অনেকটা বাঙালিদের মতো।
=বর্তমান প্রেক্ষাপট=
একজন রোহিঙ্গা যুবক কর্তৃক একজন রাখাইন নারী ধর্ষন এবং মসজিদে ইট ছোড়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে কয়েকদিন আগে ঐ অঞ্চল উত্তপ্ত হয়ে উঠে। শুরু হয় ওখানকার বৌদ্ধ ও মুসলমান দাঙ্গা। এতে অনেক রোহিঙ্গাকে নৃশংস ভাবে মারা হয়। সরকারি নিরাপত্তা বাহিনীও এ গোলযোগে ঘি ঢালছে বলে অভিযোগ আছে বলে শোনা যাচ্ছে। নিরাপদ আশ্রয় হারিয়ে নিরীহ নারী, শিশু, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, পুরুষ সমূদ্র ও নাফ নদী পার হয়ে বাংলাদেশের সীমান্তে এসে উঠার চেষ্টা করছে। বাংলাদেশ সরকার তাদের প্রতিহত করার চেষ্টা করছে। বাংলাদেশ সরকারের তরফ থেকে সাফ জানিয়ে দেয়া হয়েছে 'বাংলাদেশ রোহিঙ্গা আশ্রয়ে বাধ্য নয়'।
বাংলাদেশে আশ্রয় না পেয়ে তারা সমূদ্রের মাঝে নৌকায় করে ভাসছে। যেকোন সময়ে ঢেউ এর তোড়ে নৌকা উল্টে গিয়ে প্রাণহানি ঘটতে পারে। পত্রিকায় পড়লাম, বিজিবি একটি নৌকা উদ্ধার করেছে যেটাতে শুধু দেড়মাস বয়সী একটি বাচ্চা ছাড়া আর কিছু পাওয়া যায়নি। জানিনা বাদবাকী আরোহীদের ভাগ্যে কি ঘটেছে। এই দৃশ্যগুলো কল্পনা করলে চোখে পানি আসে।
=আমার মতে বর্তমান প্রেক্ষাপটে করণীয়=
বর্তমানে স্থানাভাব, পরিবেশগত, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ছাড়াও বিভিন্ন সমস্যায় জর্জড়িত আমরা বাংলাদেশের জনগণ সহ সরকার।
এমতাবস্থায় ঐসব ক্ষুধার্ত শিশু-নারীকে ফিরিয়ে না দিয়ে একটা নির্দিষ্ট জায়গায় আশ্রয় দিয়ে নুন্যতম খাবার-চিকিৎসাসেবা সবরবাহ করা উচিত। এবং নজর রাখতে হবে এরা যেন আগে বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গাদের সাথে সম্পর্ক না রাখতে পারে। এরা না পারছে, এই মূহুর্তে দেশে ফিরে যেতে না পারছে নিজের সন্তানদের হত্যা করে আত্মহত্যা করতে। অনেক অনেক অসহায় এরা। এরপরে পরিবেশ শান্ত হলে জাতিসংঘ শরনার্থী সংস্থার সহায়তা নিয়ে এসব শরনার্থী সহ আগে আসা সব রোহিঙ্গা শরনার্থীদের তাদের দেশে প্রত্যাবর্তনে সহায়তা করা।
= কিছু বিবেচ্য বিষয় =
শুধু শরনার্থী আশ্রয় দিলেই হবে না নির্দিষ্ট সময়ের জন্য তাদের দেখভাল করতে হবে। আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ভারত আমাদের বহু শরনার্থী আশ্রয় দিয়েছিল সেইসাথে মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিংও দিয়েছিল। সেইসময়ের জন্য সেটা খুবই প্রয়োজন ছিল।
আবার ভারতে মুসলিম হিন্দু দাঙ্গার সময় বিহার প্রদেশ থেকে বহু বিহারী এদেশে চলে আসে। এখনও তারা এই দেশে বসবাস করছে। যদিও বিভিন্ন কারণবশতঃ তারা আর সেখানে ফিরে যায়নি আর তাদের ভাষার ও সংস্কৃতির কাছাকাছি ধারক বাহক পাকিস্থানও তাদের গ্রহন করতে সম্মত হয়নি কখনও।
= পরিশেষে =
এখানে কোন ধর্ম নয়, কোন জাতি নয়, এখানে সবচেয়ে বড় সত্য তারা মানুষ। সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই জুন, ২০১২ সকাল ১০:৩৩

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




