somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্প-কাঁঠাল

০১ লা জুন, ২০১২ সকাল ১১:৩৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


স্কুল থেকে ফিরেই মা’র কাছে ভাত চাইল অপু। দুপুরে রাঁধা সে ভাত আর তরকারি জুড়িয়ে গেছে অনেক আগেই। এই গরমের দিনে খাবারটুকুর খানিক উষ্ণতা দানের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেননা সোমলতা। শীতল খাবারই স্টীলের থালায় বেড়ে দেন অপুকে। সারাদিনের কাজের ধকল সামলে এই সময়টুকুতেই তার শরীর ছেড়ে দেয়। বিকাল থেকে সন্ধ্যা তার বিশ্রামের সময়। ভাত বেড়ে আবার শুতে চলে যান তিনি।
ক্লাস থ্রি পড়ুয়া অপু আজ মহাখুশি। স্কুলের আম-কাঁঠালের ছুটি কাল থেকে শুরু। এই সময় তার বন্ধুদের অধিকাংশই বেড়াতে যায় গ্রামের বাড়িতে। ফিরে এসে তাদের পেটে বিনা পয়সায় কত আম-কাঁঠালের সমাধি হলো তার হিসাব দেয়। যারা এখানেই থাকে তারাও পিছপা হয়না সেই হিসাবে। আম-কাঁঠালের চাইতেও তাদের যার যার বাবার পয়সার হিসাবটাই মুখ্য হয়ে উঠে তখন। এইসব সরব আম-কাঁঠালের আলোচনায় অপু নীরব হয়ে থাকে। তার গ্রামের বাড়ী অথবা বাবার পয়সা কোনটাই এই আলোচনার জন্যে যোগ্য হয়ে উঠেনা। আলোচনার কল্পিত আম-কাঁঠাল তার কাছে বাস্তবে ধরা দেওয়ার প্রার্থনায় করে যায় সে। আম-কাঁঠালের ছুটি ঠিক আম-কাঁঠালের ছুটি হয়ে ধরা না দিলেও এই ছুটিটা খুব উপভোগ করে সে।
আজ ছিল ছুটির আগের শেষদিন। অপুর বন্ধু সমীর আজ বেশ গর্ব করে বলছিল, এবার ছুটিতে তারা কক্সবাজার বেড়াতে যাবে। সেখানে নাকি কত জল, কত বড় সৈকত, কত শামুক, কত ঝিনুক, কত মুক্তা। অপু সেসব শুনে তাচ্ছিল্যের স্বরে সমুদ্রের সাথে তাদের বাড়ির পাশে বয়ে যাওয়া কর্ণফুলীর তুলনা দিতে গিয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই তুলনা বেশি দূর গেলনা। পঁচা শামুক পর্যন্ত আটকে রইতে হলো, মুক্তো পর্যন্ত যাওয়া আর হলনা। সমীর তার জন্য বার্মিস আচার আনার আশ্বাস দিয়ে গিয়ে তার এই তর্কযুদ্ধের পরাজয় আরো নোনা স্বাদে ভরিয়ে দিল।

স্কুল থেকে ফেরার পথে মনে মনে সে সোমলতার কাছে কক্সবাজার যাওয়ার আবদারের মানসিক প্রস্তুতি নিল অপু। কথাটা কি কৌশলে মায়ের কাছে পাড়বে এই কথা ভাবতে ভাবতে তার ভাত খাওয়ার ছন্দপতন ঘটছিল বারবার। একসময় খাওয়া শেষ করে মায়ের বিছানার এসে মা’র গলা জড়িয়ে ধরলো। অস্ফুট স্বরে ডাকলো- ‘মা’। সোমলতা ঘুমের ঘোরে তার চাইতেও ক্ষীণ কণ্ঠে প্রত্যুত্তর করলো-‘উঃ’। মার ছোট্ট উত্তরে অপু বুঝে গেলো, এখনকার সময় তার কথা পাড়ার জন্য সুসময় নয়। খানিকটা বিষন্নতা নিয়ে ছাদে খেলতে চলে গেলো সে।
গরমের দিন। একদম ঘেমে নেয়ে ধূলোময় অপু সন্ধ্যায় নিচে নেমে এলো। সোমলতা তখন সন্ধ্যা পূজায় ব্যস্ত। অপু ফিরতেই তাকে একটু ঠাকুরনামের উপদেশ দিয়ে আবার একই কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন তিনি। অন্য সময় অপু একটু মুখ ভেংচি দিয়ে মার চোখের সামনে থেকে ছুট দেয়। আজকে একদম সুবোধ বালকের মতো হাত মুখ ধুয়ে এসে মার কাছে এসে বসলো আর মনে মনে ঈশ্বরের কাছে তার মনোবাঞ্চনা পূর্ণের বর প্রার্থনা করতে লাগলো। সান্ধ্য কাজ শেষ হলে সোমলতা ঘরের বারান্দায় বসলেন একটু ঠান্ডা হাওয়া খাওয়ার আশায়। অপুও মার পিছে পিছে গিয়ে মা’র কাছটিতে গিয়ে বসলো। একটা কৃত্রিম কান্না চোখে মুখে ফুটিয়ে আম-কাঁঠালের ছুটি সম্পর্কে তার সমস্ত অভিযোগ তুলে ধরলো। সবাই এই ছুটিতে বেড়াতে যায়, সে কেন সে সুযোগ পায়না এই কথায় সে মায়ের কানে তুললো। তার বন্ধু সমীরের কক্সবাজার যাওয়া সম্পর্কে অবহিত করলো আর নিজেই সে জায়গায় যাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করলো।

সোমলতা একটু হেসে বললো-“সে জায়গায় এমন কি আছে?” অপু তার উত্তরে সমীরের বর্ণনার সাথে নিজের কল্পনাপ্রসূত বর্ণনা যোগ করে বলতে লাগলো। সোমলতা বুঝলেন এখন না করলে, তার এই অবুঝ ছেলেটি কেঁদেকেঁটে তাকে অস্থির করে তুলবেন। তাই কক্সবাজার যাওয়ার মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে তখনকার মতো অপুকে শান্ত রাখলেন।

রাতে ভাত খাওয়ার পর অপু মা’কে আবার ধরলো। তাদের কবে যাওয়া হচ্ছে সে বিষয়ে সে নিশ্চিত হতে চায়। মা আস্তে আস্তে বললেন, “কক্সবাজারে শুধু পানি। সমীর তোকে বোকা বানিয়েছে। তোকে এইবার গজারিয়া নিয়ে যাবো। সেখানে আমাদের কিছু দূরসম্পর্কের আত্মীয় আছে। তাদের অনেকদিন খোঁজখবর নেওয়া হয়না। তাদের খোঁজ ও নেওয়া হলো, আর তোর বেড়ানোও হলো। সেখান কত বড় নদী। কত বড় ঢেউ। সে তো সমুদ্রের চাইতে কিছু কম নয়। তোকে ট্রলারে চড়াবো”। কক্সবাজারের সাথে কর্ণফুলীর তুলনা দিতে অপুর কথার সাথে এই কথাগুলো অনেকাংশেই মিলে যায়। কিন্তু স্নেহভরা মায়ের এই কথাগুলোতে অপু হার মানে। সে ভাবে মা ঠিকই বলবে। কক্সবাজার শুধুই পানি।
পরের সপ্তাহের শুক্রবার তাদের যাওয়ার দিন ঠিক হয়। দিন যেন ফুরাতেই চায়না। সোম, মঙ্গল, বুধ। অপু দেখে গজারিয়া যাওয়ার জন্য মার তেমন কোনই প্রস্তুতি নেই। সে ভাবে বৃহঃস্পতি তো আছেই। বৃহঃস্পতিবার দুপুর পর্যন্ত মাকে নিত্যদিনের কাজের বাইরে অন্য কোন কাজ করতে না দেখে সে মাকে শুধোয়-“মা আমরা কাল যাচ্ছিনা?” সোমলতা একটা লজ্জার হাসি দিয়ে বলে- “বাবা এতো গরম। এখন কি বেড়ানো ঠিক হবে? তার উপর যখন তখন কাল-বৈশাখী ঝড়। মেঘনা নদী। যদি নৌকা ডুবে যায়?” মা’র এই কথা শুনে অপু চেঁচিয়ে উঠলো। কেঁদে কেঁদে বললো- “মিথ্যাবাদী। তাহলে বললে কেন তুমি যাবে?”
প্রকৃতপক্ষে অপুর বায়নার কাছে সোমলতার সেদিন ঠিকই গজারিয়া যাওয়ার জন্য মন ঠিক করেছিল। কিন্তু পরে ভেবে দেখলো, টাকার সংকটে পড়ার সম্ভাবনা আছে এতে। আর তাছাড়া তার শরীরও কয়দিন ভালো যাচ্ছেনা। তাই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে হলো।
রাতে অপু রাগ করে ভাত খেলোনা। মা স্নেহময় কণ্ঠে বললো- “এইবার নয়, পরেরবার ঠিক যাবো”। অপু গাল ফুলিয়ে বললো- “তোমাকে কোথাও যেতে হবেনা”। অপুর এই কথাতে মাতৃহূদয়ে কিছুটা অভিমান হলো। বললো-“ঠিক আছে তোর যেহেতু এতোই যাওয়ার শখ, কালই যাবো”। মা’র এই কথা শুনে অপু ভাবলো-“মা পেয়েছেটা কি? আমি কি এতো ছোট? আমাকে শুধু ভুলায়? দাঁড়াওনা কালকে তুমি যখন যেতে চাইবে আমি যাবনা। তখন দেখি তোমার কেমন লাগে?”
না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়লো অপু। সকালে যখন ঘুম ভাংগলো তখন চারপাশ অন্ধকার। আকাশ কালো মেঘে ছেয়ে আছে। এই দেখে আবার ঘুমিয়ে পড়লো সে। একটু পর মা তাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলতে তুলতে বললেন- “দেখ অপু, কি ঝড়। আমি বলেছিলাম না? যদি আজকে যেতাম কি অবস্থা হতো দেখেছিস?” অপু ভেবেছিল মা যখন যাওয়ার প্রস্তুতি সেরে ফেলবে তখন সে তার না যাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করবে। মাকে মজা দেখাবে। দেখাবে মানুষের মন ভাঙ্গলে কেমন লাগে? এখন তা হলোনা দেখে তার খুব কান্না পেলো। বিছানায় ঠাঁই শুয়ে রইলো সে। সোমলতা খাওয়ার জন্য অনেক অনুরোধ করলো, আরো কত মিথ্যা আশ্বাস দিল। কিছুতেই কিছু হলোনা। কাঁদতে কাঁদতে আবার ঘুমিয়ে পড়লো সে। দুপুরের দিকে সোমলতা আবারো অপুকে ডাকলো। অপু সোমলতার গা থেকে কাঁঠালের গন্ধ পেলো যেন। চোখ খুলে দেখলো একটা বড় কাঁঠাল নিয়ে হাসি হাসি মুখ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সোমলতা। এঁচোড়ের শেষ সময়ে এই পাকা কাঁঠাল দেখে মন খুশিতে ভরে উঠলো অপুর। একটা পাকা কাঁঠাল তাকে ভুলিয়ে দিলো যত নদী আর সমুদ্রকে......
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে জুন, ২০১৩ রাত ১১:২৪
৪টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

হুজুররা প্রেমিক হলে বাংলাদেশ বদলে যাবে

লিখেছেন মিশু মিলন, ০১ লা মে, ২০২৪ রাত ৯:২০



তখন প্রথম বর্ষের ছাত্র। আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে আমাদের আরেক বন্ধুর জন্মদিনের উপহার কিনতে গেছি মৌচাক মার্কেটের পিছনে, আনারকলি মার্কেটের সামনের ক্রাফটের দোকানগুলোতে। একটা নারীর ভাস্কর্য দেখে আমার... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইসলামের বিধান হতে হলে কোন কথা হাদিসে থাকতেই হবে এটা জরুরী না

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০১ লা মে, ২০২৪ রাত ১০:৫৫



সূরাঃ ৫ মায়িদাহ, ৩ নং আয়াতের অনুবাদ-
৩। তোমাদের জন্য হারাম করা হয়েছে মৃত, রক্ত, শূকরমাংস, আল্লাহ ব্যতীত অপরের নামে যবেহকৃত পশু, আর শ্বাসরোধে মৃত জন্তু, প্রহারে মৃত... ...বাকিটুকু পড়ুন

লবণ্যময়ী হাসি দিয়ে ভাইরাল হওয়া পিয়া জান্নাতুল কে নিয়ে কিছু কথা

লিখেছেন সম্রাট সাদ্দাম, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১:৫৪

ব্যারিস্টার সুমনের পেছনে দাঁড়িয়ে কয়েকদিন আগে মুচকি হাসি দিয়ে রাতারাতি ভাইরাল হয়েছিল শোবিজ অঙ্গনে আলোচিত মুখ পিয়া জান্নাতুল। যিনি একাধারে একজন আইনজীবি, অভিনেত্রী, মডেল ও একজন মা।



মুচকি হাসি ভাইরাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবন চলবেই ... কারো জন্য থেমে থাকবে না

লিখেছেন অপু তানভীর, ০২ রা মে, ২০২৪ সকাল ১০:০৪



নাইমদের বাসার ঠিক সামনেই ছিল দোকানটা । দোকানের মাথার উপরে একটা সাইনবোর্ডে লেখা থাকতও ওয়ান টু নাইন্টি নাইন সপ ! তবে মূলত সেটা ছিল একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। প্রায়ই... ...বাকিটুকু পড়ুন

দেশ এগিয়ে যাচ্ছে; ভাবতে ভালই লাগে

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০২ রা মে, ২০২৪ দুপুর ১:০৩


বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ছিল নেতিবাচক। একই বছরে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ছিল প্রায় ১ শতাংশ। ১৯৭৩ সালে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রবৃদ্ধি ছিল ৭... ...বাকিটুকু পড়ুন

×