একদিন টিফিনের সময় একটা বন্ধু এসে বললো 'চল তোকে এক জায়গায় নিয়ে যাই', আমি খুব কৌতুহলি হয়েই ওর সাথে গেলাম। আমাদের মাদরাসা গেইট থেকে সামনের বড় রাস্তাটা পেরোলেই একসারি দোকান পেরিয়ে ঘন গাছ-পালা ঘেরা বাগানের জায়গাটায় ছোট্ট একটা ঘর মতো দেখা গেলো, একটু সামনে এগুতেই মানুষের কথার আওয়াজ শুনতে পেলাম। বন্ধুটি আমাকে ভিতরে নিয়ে গেলো, দেখলাম আমার চেনা মুখের অনেকেই সেখানে আছেন ! সবার সাথে পরিচিত হলাম, আর তাতেই বুঝলাম এটা "বাংলাদেশ ছাত্র শিবির'র" একটা পাঠাগার যেখানে তাদের সংগঠণের যাবতীয় কার্জকলাপ সম্পাদন করা হয়। আমার কাছে বিষয়টা তেমন খারাপ লাগে নাই, তাই বন্ধুরা প্রায় ডাকলেই চলে যেতাম আর তাদের কথাগুলো শুনতাম।
এভাবে প্রায় যাওয়া হতো আর এমনি একদিন এক লোক আমার হাতে একটা ফরম তুলে দিলো, যেখানে আমার নাম পিতা-মাতার নাম আর একেবারে শেষের দিকে একটা শপথ বাণী ছিলো। আমি সব পূরণ করে দিলাম ! এখন আমিও বা্ংলাদেশ ছাত্র শিবিরের একজন কর্মি !! একদিন যেয়ে দেখলাম অনেকগুলো পোষ্টারে ছেয়ে আছে পাঠাগারটির চারপাশ, রক্তাক্ত কতোগুলো মানুষ যাদের সবার মাথায় সবুজ পাগড়ি বাঁধা। তাদের কাছে জানতে চাইলাম এগুলা কি আর কেনই বা লাগানো হইছে ?? তাদের সোজাসাপ্টা উত্তর পেলাম 'আরো বড় হও তখন বুঝবে' !!
এভাবেই বড় হওয়ার অপেক্ষায় থাকতে থাকতে একবছর পার হয়ে গেলো, আর তখনই আমার আব্বুর ইচ্ছায় আরো বড় ও ভাল শিক্ষা প্রতিষ্ঠাণ লক্ষ্মিপুরের একটা সনামধন্য মাদরাসা আমার নতুন ঠিকানা হলো।
এখানে বোর্ডিং জীবন, প্রথম প্রথম খুব খারাপ লাগতো। একা সুযোগ পেলেই একটু কেঁদে বুক হালকা করে নিতাম ! আস্তে আস্তে সেখানেও মন সয়ে গেলো, অনেক মুখের সাথে পরিচিত হলাম একাকিত্ব নামক যে একটা বিষয় এতদিন আমায় ঝেঁকে ছিলো তা ধীরে ধীরে হালকা হয়ে গেলো। কিন্তু এখানে আমায় কেউ কোথাও নিয়ে যায় না দেখে অবাক হলাম, তারপর মাদরাসার এক সাংষ্কৃতিক অনুষ্ঠানে প্রিন্সিপাল হুজুরের আলোচনা থেকে বুঝতে পারলাম এখানে কোন রাজনৈতিক দল করার সুযোগ নাই। বরং কেউ এর সাথে জড়িত আছে জানা গেলে শাশ্তির ব্যবস্থা আছে !
কোনরকম দল বা সংগঠণ ছাড়া আমার সময়টা ভালই যাচ্ছিলো, বিকেল হলেই ক্রিকেট ব্যাট হাতে নেমে যেতাম। নিজের স্পিন বলের কেরামতি দেখিয়ে আর স্পিডি চারের (অনেকে একসাথে খেলার কারনে ছোট্ট কোর্ট করে খেলতাম) মার মেরে জীবনটা অন্যরকম এক ছন্দে এগিয়ে যাচ্ছিলো। কিন্তু হঠাৎ একদিন কি একটা বিষয় নিয়ে জামায়াতের লোকদের সাথে এক বিশাল ঝামেলায় মাদরাসা জড়িয়ে যায়, সমস্ত মাদরাসা পুলিশে ছেয়ে গেলো ! খুব ভয় হতে থাকলো কি থেকে কি হয় !! কিন্তু কোন রকম ক্ষতি ছাড়াই সেদিনের সেই শো-ডউন শেষ হলো !!!
কিন্তু সেদিন রাত আসে আমাদের জন্য কালো রাত হয়ে ! রাত প্রায় ১২/১টার দিকে লক্ষ্মিপুর আলিয়া মাদরাসা শাখার জামায়াতে ইসলামীর কর্মিরা আমাদের মাদরাসায় হামলা করে, চারপাশ থেকে 'নারায়ে তাকবির' ধ্বনি কামানের গোলার মতো ধেয়ে আসছিলো যেন কোন কফেরের দুর্গ দখলে নেমেছে !! মসজিদের মাইক থেকে বলে দেয় হলো কেউ যেন রুম থেকে না বেরয়। আমারা তো ভয়েই শেষ বের হবো কি আর !! প্রায় ঘন্টা খানেক বাইরের ইসলাম প্রিয় সৈনিকদের হু্ল্লা চললো, অবষেশে তাদের তকবির ধ্বনিও মিলিয়ে গেলো। কি হলো তা দেখার জন্য বুকে ভয় নিয়ে রুমের বের হলাম, বাইরের অবস্থা দেখার মতো না ! অনেক রুমের দরজা ভাঙ্গা, কোন রুমের জানলা ভাঙ্গা এমন করে দেখতে দেখতে শেষ মাথায় বোর্ডিং সুপারের রুমের বাইরে অস্বাভাবিক ভিড় দেখে সেখানে যেয়ে দেখি এক বড় ভাই নিথর পড়ে আছেন আর তার পায়ের পাতার উপর থেকে রক্ত গড়িয়ে হয়ে মেঝে ভিজে যাচ্ছে !! জানলাম তা্র পায়ের রগ কেটে ফেলা হইছে !!! (পরবর্তিতে উনি সেরে ওঠেছিলেন)
হুম আমি যে সংগঠণের ফরম পূরণ করেছিলাম তারাই এই তান্ডব করেছে ! আল্লাহু আকবার তাকবির দিয়ে একটি ইসলামি শিক্ষাঙ্গনে হামলা চালিয়েছে !! পায়ের রগ কেটে মেরে ফেলতে চেয়েছে একটা মানুষকে !!! আমার ছোট্ট মনে তখন একটা প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার ইচ্ছা ছোট খাটো সাইক্লোনে রুপ নিয়েছে, "আমি ইসলামী কোন শিক্ষাঙ্গণে পড়ছি নাকি যারা হামলা করলো তারা কোন ইসলামী দলের সদস্য ??"
এখানে জামায়াতে ইসলামীর পরিচয় পাওয়ার পর আর একবছর এখানে থাকা হইছিলো, তারপর পাড়ি জমাই বাংলাদেশের অন্যতম শিক্ষা প্রতিষ্ঠাণ যা ঢাকায় অবস্থিত। জামায়াতের আসল রুপ দেখার পর তাদের প্রতি আমার ঘৃণা যে রুপ নিয়েছে তা মনে হয় ঢাকার প্রত্যেক জামায়াতের কর্মির চোখে সুস্পষ্ট হয়ে ধরা দিয়েছে ! দীর্ঘ ৭ বছরের এই সময়ে আমাকে কোন জামায়াত কর্মি দাওয়াত দেয়ার সাহস ও করে নাই !! এমন কি বাংলাদেশের কোন ইসলামী বা অনৈসলামী কোন দলের সাথে এই আমি জড়িত নই
কারণ আমি জানি "সব সাপেরই বিষ থাকে, আর যে সাপের থাকে না সে মানুষ মারার অভিনব পন্হা জানে" !!
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে অক্টোবর, ২০১৪ বিকাল ৫:০২