খইয়াছরায় ক্যাম্পিং –
খইয়াছরায় প্রথম যাই ভ্রমন বাংলাদেশ গ্রুপ এর সাথে , যদিও ট্যুর টা অনেক অ্যাডভেনচারাস ও আনন্দময় ছিল কিন্তু প্রচণ্ড বৃষ্টিতে ফ্ল্যাশ ফ্লাড এর কারনে ঝর্না অবধি পৌঁছতে পারি নি । অনেক ঝুকি নিয়ে ও ঝর্নার কাছাকাছি যেয়ে ফিরে আসতে হয় । ঐ দিনই ঠিক করি আবার আসব খইয়াছরায় । যথারীতি এক সপ্তাহ পরে আবার আসলাম । এবার আগের চেয়ে বেশি বৃষ্টি , স্থানীয়রা অনুরুধ করলো সামনে না যাওয়ার জন্য। বাধ্য হয়ে আবার ফিরে আসলাম ।
রমজানের ঈদ এর ছুটিতে কুমিল্লা ছিলাম , প্ল্যান ছিল ঈদ এর একদিন পর যাব খইয়াছরায় , ঢাকা থেকে তাবু সহ ক্যাম্পিং করার সব সরঞ্জাম নিয়ে কুমিল্লা হাজির, সব ঠিকঠাক , কিন্তু আবারো কপাল খারাপ । না এবার বৃষ্টি না , ফুটবল খেলতে যেয়ে পায়ে ব্যাথা পেলাম , এমন ব্যাথা যে ২/৩ জনে কাঁধে করে বাড়ি নিতে হল। পরবর্তী এক মাস হাঁটতে কষ্ট হয়েছে। যথারীতি আবারও কান্সেল হল খইয়াছরা অভিযান ।
২১ শে সেপ্টেম্বর কক্সবাজারে বীচ ক্লিনিং ফেস্টিভ্যাল এ যোগ দিতে কক্সবাজার যাবার প্ল্যান করলাম। ১৯ তারিখ রাতের টিকেট ও কাটা ছিল । ১৯ তারিখ হরতাল ও ছিল । হঠাৎ রাসেল কে বললাম চলো খইয়াছরা যাই । রাসেল ও রাজি হয়ে গেল । হাসানের ঢাকায় জরুরী কাজ থাকায় যেতে পারলো না । হরতাল এর মধ্যেই রওয়ানা হলাম কুমিল্লা । একটা সি এন জি ঠিক করে চলে গেলাম কমলাপুর । এখান থেকেই কুমিল্লার এ সি বাস গুলো ছাড়ে । কমলাপুর নেমে পকেটে হাত দিয়ে দেখি ওয়ালেট আছে ঠিকই কিন্তু টাকা সহ আমার স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড আর সিটি ব্যাংক এর কার্ড যে ফোল্ডার এ রাখা তা নেই (পরবর্তীতে আর পাওয়া যায় নাই, নিশ্চয় সি এন জি বা রাস্তায় পড়ে গিয়েছিলো) । ওয়ালেট এ টাকা আছে মাত্র ৬০০/৭০০ । আপাকে ফোন করলাম টাকা পাঠানোর জন্য । ভাগ্নে এসে ৫০০০ টাকা দিয়ে গেল। কিন্তু হরতাল এর কারনে কোনও বাস ছাড়ছিল না । একটু পর বি আর টি সির এক লোক বলল ৪ টায় বাস ছাড়বে । অন্য কোনও বাস না থাকায় বি আর টি সির বাসেই উঠে বসলাম । আমাদের অনুমান কে ভুল প্রমান করে ৪ টা বাজেই গাড়ি ছাড়ল । ৭ টার মধ্যেই কুমিল্লা পৌঁছে গেলাম ।
ঢাকা থেকে ফোনে কথা বলেই ঠিক হল, জসিম মামা , রায়হান , সবুজ , ঘুমটি (শাহাদাত ) যাবে আমাদের সাথে । রাতে পুকুরের ঘাটে বসে সবাই ট্যুর প্ল্যান করছিলাম , সেখানে উপস্থিত মুকুল বলল সে ও যেতে চায়। আমার ২ টা তাবুতে ৭ জন থাকা যায়, তাই মুকুল কে ও সাথে নিতে রাজি হলাম। ঠিক হল, ভোর ৬ টায় রওয়ানা হব ।
পরদিন সকালে সবাই সময় মত উপস্থিত , শুধুমাত্র রায়হান নেই । ফোন করতেই ঘুম জড়িত কণ্ঠে বলল যেতে পারবে না, বিজনেস এর জরুরী কাজ আছে । সবুজ উপস্থিত হল লাল টকটকে চোখ নিয়ে । চোখ দিয়ে অনবরত পানি পড়ছে । সে ও যেতে পারবে না । ৭ জন থেকে হয়ে গেলাম ৫ জন। বাসের জন্য অপেক্ষা করছি । এমন সময় সবুজ বলল , ভাই আপনারা একটু অপেক্ষা করুন, আমার ব্যাগ গুছানো আছে, যা হয় হবে আমিও যাব । সবাই খুশি হয়ে অপেক্ষা করতে রাজি হলাম। সবুজ এক দৌড়ে বাড়ি থেকে ব্যাগ নিয়ে চলে আসলো ।
কুমিল্লা বিশ্বরোড এসে নাস্তা করে চট্টগ্রামগামী বাসে উঠলাম । মিরসরাই পার হয়ে বরতাকিয়া বাজারে নামলাম প্রায় সারে ১১ টা বাজে। মাঝে একবার বাসের চাকা পাঙ্কচার হওয়ায় একটু দেরি হল । বরতাকিয়া বাজার পার হয়ে গেলে আর খাবারের হোটেল বা দোকান পাট পাওয়া যাবে না । তাই আমরা খাবার খেয়ে ও প্রয়োজনীয় রসদ পাতি কিনে রওনা হলাম ঝর্নার উদ্দেশে । বাজারের লোকজন জানালো ২/৩ দিন আগেই নাকি এক ট্যুরিস্ট মারা গেছে ঝর্না থেকে পড়ে । সবাই একটু ভয় পেলে গেল, আমি আসস্থ করলাম , আমরা সাবধানে থাকব ।
বাজার থেকে বের হয়ে হাঁটতে হাঁটতে রেললাইন পার হয়ে গ্রাম্য পথ ধরে অবশেষে পৌঁছলাম ঝিরিপথ এ । এখান থেকে ঝিরি ধরে হাঁটতে হবে অথবা পাহাড়ি পথ ও আছে । প্রচণ্ড গরমে ঝিরির ঠাণ্ডা পানিতে পায়ের সাথে সাথে শরীর ও জুড়িয়ে যাচ্ছিল । সবাই ঝিরি পথেই হাঁটতে চাইল । ঝিরি ধরে হাটা একটু কষ্টকর , পানির বিপরীতমুখী স্রোত আর পাথর বোল্ডার এর কারনে আমাদের হাটার গতি বেশ কম ছিল। আগের ২ বারের তুলনায় পানি বেশ কম তবে পিচ্ছিল পথ । অবশেষে প্রায় ২ টার দিকে আমরা শেষ একটা বাক ঘুরতেই দেখা পেলাম পরম কাঙ্ক্ষিত খইয়াছরা ঝর্নার প্রথম স্টেপ । অসাধারন সুন্দর ঝর্না । ছবিতে বা ভাষায় বর্ণনা করার মত না।
বেশ কিছুক্ষণ ঝর্নার পানিতে দাপাদাপি ও ফটোসেশন এর পড়ে প্রায় খাড়া পথ বেয়ে উঠে গেলাম ২য় স্তরের ৩ তা স্টেপ এ। এটা আরও সুন্দর । তবে পানি কম থাকায় পুরো সৌন্দয ফুটে উঠেনি । কিছুক্ষণ সেখানে কাটিয়ে তার উপরের স্টেপ এ উঠার জন্য পাহাড় বেয়ে উঠা শুরু করলাম । আর সেটা ছিল ভুল পথ । প্রায় ৮০ ডিগ্রি খাড়া পথ , বেশ পিচ্ছিল ও জোঁক এর আস্তানা । সাথে থাকা চাপাতি দিয়ে ঝোপ ঝাড় কেটে গাছের ডাল লতা পাতা বেয়ে উপরে উঠে চললাম । দলের কেউ-ই অভিজ্ঞ ত্রাভেলার না, ৬ জনের মধ্যে আমি আর রাসেল ছাড়া সবাই নতুন । ৩ জন তো জীবনে এই প্রথম ঝর্না দেখল ,এতো উচু পাহাড়ে উঠাও প্রথম । তবুও সবাই বেশ উৎসাহ নিয়ে পাহাড় বেয়ে উঠে চললাম । অসংখ্য জোঁকের কামড় খেয়ে পাহাড়ের উপড়ে উঠে দেখলাম আমরা ঝর্নার উপড়ে না অন্য একটা পাহাড়ে চলে এসেছি । চারদিকে ঘন ঝোপ ঝাড় । ডেড এন্ড । কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে আবার নিচে নামা শুরু করলাম । খাড়া পথ বেয়ে নামা বেশ বিপদজনক , আর বেশ পিচ্ছিল পথ । শরীরের ব্যাল্যান্স রাখা বেশ কষ্টকর । একবার স্লিপ কাটলে সোজা ৩০০/৪০০ ফিট নিচে পড়তে হবে । বেশ কয়েকবার স্লিপ কেটে শেষ পর্যন্ত ঝর্নার ২য় স্টেপ এ নেমে আসলাম । সন্ধ্যা প্রায় নেমে আসছে । আর ক্যাম্পিং করার জায়গা পাওয়া যাচ্ছিল না । নিচের স্টেপ এ নেমেও ক্যাম্পিং করার জায়গা পেলাম না। চারদিকে ঝোপ ঝাড় পাথর , তাবু খাটানোর একটুও সমতল জায়গা নেই । সন্ধ্যার পর এখানে আটকে থাকলে বিপদে পড়ব । তাই ঝিরি পথ ধরে আবার লোকালয়ের দিকে ফিরে চললাম । কিছুক্ষণ হেঁটে লাস্ট যে বাড়িটা সেখানে পৌঁছলাম, একটু সামনে যেতেই দেখলাম পাহাড় আর ঝর্নার ফাকে একটা সমতল জায়গা। দেখেই পছন্দ হয়ে গেল । কাঁধ থেকে ব্যাগ তাবু নামিয়ে বিশ্রাম নিচ্ছিলাম । এমন সময় বৃদ্ধ এক লোক কে দেখলাম হেঁটে যাচ্ছে । ডাক দিয়ে নিজেদের পরিচয় দিয়ে রাতে এখানে থাকার অনুমুতি চাইতেই উনি জানালেন শেষ বাড়িটা তারই। আমরা চাইলে তার বাড়িতেই থাকতে পারি । উনার ব্যাবহারে মুগ্ধ হয়ে জানালাম আমরা তাবুতেই থাকতে চাই । উনি বললেন উনার উঠনে তাবু খাঁটিয়ে থাকতে পারি । এবারো সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করে জানালাম এখানেই থাকতে চাই । উনি বললেন কোনও অসুভিধা নেই । এখানে উনারা ছাড়া আর কেউ নেই, কোনও সমস্যা হবে না। উনাকে বললাম কাছাকাছি চা এর দোকান আছে নাকি । উনি বললেন ১০/১৫ মিনিটের হাটা পথে একটা দোকান আছে তবে তা সন্ধ্যার সময় বন্ধ হয়ে যায় ।
আমরা বেশ ক্ষুধার্ত ছিলাম । ঝিরিতে হাতমুখ ধুয়ে সাথে থাকা শুকনো খাবার খেলাম । এর মধ্যে চাচা আবার আসলেন। আমাদের শুকনো খাবার খেতে দেখে উনার বাড়িতে রাতে খাবার খেতে বললেন। আমাদের বললেন , বাবা , আমি গরিব মানুষ , তাছাড়া দোকান পাট বন্ধ হয়ে গেছে , আমার চাউল এর অভাব নেই । আপনাদের ভাত এর সাথে ডিম ভেঁজে দিব । আমার বাসায় খাবার খান । উনার আথিতেয়তায় আবার মুগ্ধ হলাম । এবং উনাকে ধন্যবাদ জানিয়ে রান্না করতে নিষেধ করলাম । উনি অনেক অনুরধ করলেন, কিন্তু আমরা রাতের বেলা উনাদের কষ্ট দিতে চাইলাম না। কিছুক্ষণ পর উনি আমাদের জন্য চা বানিয়ে নিয়ে এলেন । চা খেয়ে অনেকক্ষণ উনার সাথে গল্প করলাম । সবাই বেশ টায়ার্ড ছিলাম তবুও ঘুম আসছিলো না । আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ । চারপাশে আমরা ছাড়া কেউ নেই । জসিম মামা আর আমি প্রায় রাত ২ টা পর্যন্ত গল্প করলাম । শেষে আগামীকাল আবার পরিশ্রম হবে ভেবে একটু ঘুমিয়ে নিলাম ।
সকাল ৫ টায় ঘুম ভাঙল । সবাইকে ডেকে তুললাম । হাত মুখ ধুয়ে , তাবু ব্যাগ গুছিয়ে আবার ঝর্নার দিকে চললাম । ভোর বেলা ঝর্না দেখার শখ ছিল । এবার আর মালপত্র নিয়ে হাটলাম না। চাচার বাসায় তাবু ব্যাগ সব রেখে ঝর্নার দিকে চললাম । এবার বেশ তাড়াতাড়ি পৌঁছলাম । ঘণ্টা খানেক ঝর্নায় কাঁটিয়ে ফিরে আসলাম । সীতাকুণ্ড যাবার প্ল্যান আছে তাই বেশি দেরি করলাম না। চাচার বাড়িতে ফিরে এসে বিদায় নিয়ে ফিরে চললাম বরতাকিয়া বাজারের দিকে । তারপর সীতাকুণ্ড । সে আরেক কাহিনী।
সব ছবির লিংক - Click This Link