somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ওরাল সাসপেনশন 42 mg/ml

০৫ ই আগস্ট, ২০১১ বিকাল ৪:৪৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

১.

এখানে প্রায়ই চিঠি আসে। এরোপ্লেন,খাকি অথবা হলুদ প্রচলিত খামে।
সকাল ৭টায় আসাটা অবশ্য ব্যতিক্রম।
দোতলা হোটেলের আড়াইতলায় ২টা ছোট রুম তার বাসা, অবশ্য পুরো হোটেলটার মালিকও মঞ্জুষা নিজেই। এটা ১টা পুরানো আমলের ধাচে গড়া সস্তা শাদা হোটেল, যেখানে স্লাইডিং থাই গ্লাস লাগিয়ে আধুনিকায়নের মোটামুটি ব্যর্থ প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে।
শাটার টেনে তুলতে দেখা গেল হারু মিয়া ইতস্তত চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে।
মঞ্জুষা তার খয়েরী জ্যাকেটের চেইন আটকাতে আটকাতে বিরক্ত স্বরে বলল, এই ঠাণ্ডার মধ্যে ৭টার সময় আসছেন, নিজে কাঁপতেছেন আমার ঘুমটাও নষ্ট করছেন।
কী করুম আইজকা কাইলকা ছুট্টি, অইদিকে আপনের চিডির উপ্রে লেখা আর্জেন, তাই বাজারে যাওনের আগে ভাবলাম দিয়া যাই।
মেয়েটা প্রেরকের নাম পড়ে চিঠিটা ক্যাশিয়ারের ডেস্কের ওপর রেখে দিল।


২.

হোটেলের ১টা টেবিল সাফ করে সে কফি নিয়ে বসল। কুয়াশার বিন্দুগুলো এখন কাঁচের জানালা দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে। সে ওদিকে তাকাতে দেখল তার সামনে একটা পুকুর চারপাশে সবুজ নরম ঘাস, সে চেয়ার থেকে উঠে নীলচে কালো পানির দিকে এগুতে লাগলো, আকাশ গাঢ় ধূসর। আর তারপর খেয়াল করল সে জানালার সামনে দাঁড়ানো।
এখানে সে একাই থাকে, তার মা আর ভাই এখন দেশের বাইরে।


৩.

কোন কোন মাস খুব বরবাদ মাস হয়। একটার পর একটা বিরক্তিকর দিন আসতে থাকে আর মনে হয় কখনও আর কোন কিছু ঠিক হবার না। এটা হয়ত এরকম একটা মাস। আড়াইতলা হোটেলটার দুটো জেনারেটর একসাথে কখনও ডাউন হয় না, এবার তা-ই হল। তাদের বাবুর্চি সরদার কাকা মেয়ের বিয়েতে যাবার নাম করে ফিরে আসলো না এবং গতপরশু তাকে এলাকায় নতুন গজানো কাচের হোটেলটার ভেতর দেখা গেল। এবং হঠাৎ করেই তার মামার টাকার ষাট হাজার টাকার দরকার পড়ল, অবশ্য না দেয়ায় হোটেলটা (নিতান্তই ছা-পোষা খাবার হোটেল) যে আসলে একটা ব্রোথেল এটা সে পত্রিকাওয়ালাদের কাছে ফাঁস করে দেবে বলে শাসিয়ে গেল। অবশ্য তার জন্য এ মাসের সবচে’ অপ্রত্যাশিত বিষয় ছিল শনিবার সে ডাক্তারের চেম্বারে গিয়ে জানতে পারল ডাক্তার মারা গেছে। অথচ এ মাস থেকে ক্যাপসুলের বদলে তাকে একটা ওরাল সাসপেনশন দেবার কথা।


৪.

খামটার রং হলুদ , প্রেরক আবু সুফিয়ান, বড়লেখা, সিলেট। নামটা দেখে তার বিরক্তিতে ঠোঁটের দুপাশ কুঁচকে গেল। লোকটার লিকলিকে চেহারায় এমন একটা চতুরতা লুকিয়ে থাকে যেটার কাছে গেলে মানুষ অনিরাপদ বোধ করে। সত্যিকার অর্থে সে সেই সব মানুষদেরই মত যারা কাছাকাছি মানুষ হয়ে প্রতারণা করে।
সাড়ে পাঁচ বছর আগে আবু সুফিয়ান অথবা সুফিয়ান কাকা লোকটার কারণে তার নির্বোধ বাবা তাদের পথে বসিয়ে মারা যায়, এবং নির্লজ্জ মানুষের মতই সুফিয়ান আর তার স্ত্রী মঞ্জুষাদের বাড়ি বিক্রি করে দিলো। তার বাবা কেন তার সবকিছু ছেলে মেয়েকে না দিয়ে আবু সুফিয়ানের নামে লিখে দিলেন তা কখনও তাদের জানা হল না, শুধু চাপা একটা তিক্ততা নিয়ে তারা জীবন যাপন করে যেতে লাগল। আর চাপা ক্ষোভ, তিক্ততা নিয়ে চলে বেড়ানো মানুষের মত তাদের মধ্যে অসুখের কীট বেড়ে উঠল।


৫.

ছুটির সকালগুলো তার বেশ ভালোই কাটে , অবশ্য আজকের দিনটা খুব একটা ব্যস্ত যাবে বলেও মনে হচ্ছে না।
অবসরের একটা ক্লান্তি আছে আজকে সে সেটাও চাইছে না। ছুটি বনাম অবসর সে ভাবল। অন্যান্য একা মানুষের মতই সে কিছুক্ষণ নিজের সাথে কথা বলল যেমন আজকে হোটেল বন্ধ রেখে তার কোথাও ঘুরতে যাওয়া উচিত, কয়েকজনকে ফোন করা হচ্ছে না, শীতকালে কাশবন কেমন দেখায় ভেবে ভেবে সে তার সামনের দৃশ্যপট পরিবর্তিত করল। এখন সে দাঁড়িয়ে আছে বাগান দিয়ে মোড়ানো একতলা কাঁচাপাকা একটা বার্ধক্য ঘেষা বাড়ির সামনে, বাতাসে উড়ে আসছে অনেকগুলো ফুলের মিশ্র একটা স্নিগ্ধ গন্ধ ।
এরকম কখনও হয় না , ধরে নিন কোন ছুটির দুপুরে আপনি বাতি বন্ধ করা আপনার শান্ত বসার ঘরটার দিকে যাচ্ছেন এবং হঠাৎই সমস্ত দৃশ্যপট বদলে গেল? আপনি তখন অচেনা একটা জায়গায় হাটছেন, একটা ঘাসছাটা মাঠ, কড়া রোদ, দূরে বিচিত্র নকশা কাটা ছায়াহীন রাবার গাছ, আরো দূরে কারো শৌখিন বাঁকানো বাঁশবেতের গেট, কাছে যেতে আপনি আরো বিস্ময়ে লক্ষ্য করলেন বেতের ফটকজুড়ে পেঁচিয়ে আছে ঝলমলে ফলন্ত আঙুরের ঝাড়। আপনি দেখছেন সবুজ পুকুর, পেঁপে গাছের সারি, ছোট ছোট হলুদ ফুল, আকাশে সরে সরে যাওয়া পাতলা মেঘ যার সমস্ত খুটিনাটি বিষয় আপনাকে অভিভূত করছে। এবং আপনি ফিরে আসলেন আপনার পরিচিত বসার ঘরে, তাকাতে খেয়াল করলেন হাঁটতে হাঁটতে আপনি গন্তব্য সোফা থেকে দূরে সরে চলে এসেছেন জানালার কাছে।
অথবা রাস্তার ভিড়ে আঁখের রসের কলের সামনে দিয়ে যাবার সময় আপনি দেখলেন গ্রামের চড়া হাইওয়ে দিয়ে কৃষক বোঝাই ট্রাক্টর ভটভট শব্দে চলে যেতে।

অথবা বন্ধুদের সাথে গল্প করার সময় আপনার নিজের কাছে নিজের কন্ঠ অচেনা মনে হতে লাগলো। আপনার মস্তিষ্কের বাইরে যেন আপনার একটা অস্তিত্ব, যেন একটা আলাদা চোখ আপনাকে দেখাতে লাগলো – আপনাকে।
এসবের জন্য আপনাকে অসাধারণ কেউ হতে হবে না, আমাদের কাছেধারেই এধরণের লোকজন মিশে থাকে। সামনে তাকিয়ে যারা সামনে হারিয়ে যায়। এবং তাদের সঙ্গী হয় কিছু অসুধ, কখনও কখনও ওরাল সাসপেনশন।


৬.

সকাল ৭টা ৪০এ হোটেলের শাদা শাটার নামিয়ে সে বের হয়ে পড়ল। ম্যানেজার রবিউলের নাম্বারে ফোন দিতে গিয়েও দেয়া হল না।
কান খাড়া করে সে ব্যস্ত সড়কের গতিবিধি বুঝার চেষ্টা করল। নাহ এখনও মানুষ খুব একটা জেগে ওঠে নি। চড়া রাস্তায় উঠতে সে প্রাতঃভ্রমণ ফেরত বৃদ্ধ লোক আর মহিলার আনন্দিত চেহারার সাথে সৌহার্দ্য বিনিময় করল।
লেকের পানি বেশ নেমে গেছে, এখন কেউ মাছ ধরার জন্য বড়শি পেতে নেই। তারও একটা বড়শি চাই, সে ভাবল। তারপর পানির কাছাকাছি একটা ঢিবিতে বসে খামটা খোলে।

প্রিয় মা মঞ্জুষা
আমাদের উপর তোমার ক্ষোভ থাকিবে এটাই স্বাভাবিক, কিন্তু আমাদের অপারগতা যদি জানিতে তাহা হইলে হয়ত তুমি বাস্তবতা বুঝিতে পারিতে। আমরা যে তোমাদের আপনজন তাহাও বুঝিতে। আপনজন মানিয়াই বলিতেছি, তোমার সুফিয়ান কাকার শরীর ভালো যাইতেছে না। তিনি তোমাকে আর তোমার বড় ভাইকে দেখার জন্য ব্যাকুল হইয়া আছেন। আমি জানিতাম তিনি তোমাদিগকে সন্তানতুল্য মনে করেন এখন তাহাই প্রমাণিত হইল। তোমাদের জন্য তার দোয়া হিসাবে কিছু সম্পত্তি রাখিয়া যাইতে চাইতেছেন। আশা করি তোমরা আপত্তি করিবে না।
কিন্তু তাহার যে মানসিক অবস্থা যাইতেছে তাতে তাকে বাতুল ব্যাতীত আর কী বলিব, নিজেকে তিনি তোমাদের পিতা ফারুক উল্লা বলিয়া সারাদিন চিৎকার চেঁচামেচি দ্বারা পাড়া মাথায় তুলিতেছেন, এমন কী আমাকেও নিজের স্ত্রী হিসেবে স্বীকার করিতেছেন না। তাই তোমাদেরকে জমি জমা লিখিয়া দিয়া গেলেও প্রতিবেশী বা সরকার তাহা গ্রাহ্য করিবে কি?
তাহার মানসিক অবনতির কারণ কি কিছুই জানা নাই, তবে ডায়রি ঘাটিয়া ৪টি নাম ও ঠিকানা জোগাড় করিয়াছি যাহার মাধ্যমে আমরা হয়ত রোগের হেতু জানিতে পারিব।
তুমি মা আমাদের এই দুর্দিনে পাশে থাকিবে এই আশাই করি, কারণ তোমার কাকা তোমাদেরকেই শেষ সময়ে আপন মানিয়াছেন।
ঠিকানাগুলায় যোগাযোগ করিয়া তুমি অনুসন্ধান করিয়ো এ-ই আমার আর্জি।

অনেক আদর ও দোয়ান্তে
মতিয়া বেগম
বড়লেখা

প্রাথমিক ভাবে চিঠিটা সুফিয়ান পাঠান নি, পাঠিয়েছেন মতিয়া চাচি। একজন চতুর মহিলা। তাই চিঠিতে যা লিখেছেন তার সত্যতা নিয়ে মঞ্জুষার সন্দেহই রয়ে গেল।
তারপর সে ঘটনাকে নতুন করে মেরামত করল।
সুফিয়ান কাকা মানসিক বিকারগ্রস্থ
সে নিজেকে ফারুক উল্লাহ দাবি করছে
স্বাভাবিকভাবেই মতিয়া তার কাছে তার স্ত্রী না
মঞ্জুষা আর সুষমকে তার নিজের ছেলে মেয়ে মনে হচ্ছে
তাই তাদেরকে দেখতে চেঁচামেচি করছে
তার সহায় সম্পত্তি ছেলে মেয়ে পাবে না তো বন্ধুর স্ত্রী (মতিয়া) পাবে!
মতিয়া চাচি ব্যাপারটা কাউকে জানাতে পারছেন না
সুফিয়ান কাকার মাথা নষ্ট হবার খবর পেলে ভাই ভাতিজারা লুটপাট করতে এসে পরবে
মঞ্জুষা ঢাকা থেকে বড়লেখা এসে ঝামেলা বাঁধাবে না, তাই তাকে লোভ দেখিয়ে কাজ করানো যেতে পারে

বাহ! সকালের শুরুতেই ভালো খবর, ভেবে সে হাসল।
এখন দরকার হল সময় করে সুফিয়ান কাকার বাড়ি যাওয়া। কাগজপত্র নিশ্চয় তৈরিই করা আছে।
প্রতিশোধ নেবার জন্য ‘সময়’ একটা চমৎকার ব্যাপার।


৭.

কী ভেবে সে চিঠিটা উল্টে নাম ৪টা দেখল।
১টা নাম ছাড়া অন্যগুলো আবছাভাবে পরিচিত। অন্ধকারাচ্ছন্ন একটা দিন না হয় ঘুরে ফিরেই কাটল এই ভেবে সে বাস স্ট্যান্ডের দিকে হাঁটা শুরু করে।

#সকাল ৯টা ২৬
৭৪/সি, মিরপুর ১
আনোয়ার আলম, সাংবাদিক


দুইতলা বাসাটার সামনে এসে দাঁড়িয়ে এখন তার অস্বস্তি হচ্ছে।
সাড়ে নয়টা কারো সাথে দেখা করার জন্য ভালো সময় না। তাও লোকটা সাংবাদিক মানুষ, নির্দিষ্ট কোন ছুটি থাকার কথা না। দেখা করলে কী নিয়ে কথা বলবে তারও ঠিক নেই। ইতস্তত করেই মঞ্জুষা কলিং বেল এ হাত রাখল।
চুপচাপ আবহাওয়া। ষোল সতের বছরের একটা ছেলে দরজায় দাঁড়িয়ে বলল, কী চাই?
আনোয়ার সাহেবের সাথে দেখা করতে এসেছিলাম। বলো ফারুক উল্লা আর আবু সুফিয়ানের ব্যাপারে যদি তিনি কোন কথা বলতে আগ্রহী হন যেন আমাকে ডাকেন।
কিছুক্ষণ পর ছেলেটা বাইরে এসে বলল, উনার শরীর বিশেষ ভালো না। তাই আপনি বেশিক্ষণ বসবেন না।
পেপার, ম্যাগাজিন আর বইপত্রে ঠাসা একেকটা কামরা পেরিয়ে সে কোণার একটা ঘরে পৌছাল। এখানে কাগজের কোন গন্ধ আসছে না। বরং স্পিরিটের ঝাঁঝালো একটা ভাব আছে। দরজা খুলতেই একজন অত্যন্ত শীর্ণ মানুষকে বিছানায় শুয়ে থাকতে দেখল সে। চামড়া নীলচে হয়ে আছে।
এই লোককে বিরক্ত করতে ইচ্ছা করছে না, কিন্তু লোকটা মনে হয় কোন দর্শনার্থী পায় না, তাই আশান্বিত হয়ে মঞ্জুষার দিকে তাকিয়ে থাকল।
আমি ফারুক উল্লার মেয়ে, আবু সুফিয়ান এর স্ত্রী আমাকে আপনার সাথে যোগাযোগ করতে বলেছেন।
লোকটা হাসল। বিছানার পাশে রাখা একটা হাতে বাজানো বেল চেপে ছেলেটাকে ডাকল।
শফি একে একটা চেয়ার আর নাস্তা দিয়ে যা।
এমন কী লোকটার স্বরও ভাঙ্গা, সে ভাবল।
বেশ পরিশ্রম করে এবার লোকটা দেয়ালে হেলান দিয়ে আধশোয়া হয়।
আমি ঠিক তাদের সম্পর্কে নির্দিষ্ট কিছু বলব না, সাধারণ কথা বলব। ভেবে চিন্তে দেখলে তুমি হয়ত .. বলে সে থামল।
মঞ্জুষার বেশ খিদে পেয়েছে সে নাস্তার কথা ভেবে এদিক ওদিক তাকালো।
লোকটা থেমে থেমে বলা শুরু করে।
আমরা নিজেদেরকে খুব ক্ষমতাবান মনে করি, স্বভাবতই, হয়ত আমাদেরকে কখনও ক্ষমতার প্রমাণ দিতে হয় না তাই। কেউ কেউ বলি আমরা অন্ধকার ভালো বাসি কারণ অন্ধকারকে এখানে আমরা পোষ্য করে রেখেছি।
যদি,
তুমি কখনও মনুষ্য বিবর্জিত কোন সীমানায় যাও তখন তুমি তোমার মৌলিক অস্তিত্বের দেখা পাবে। সে কেমন হবে তুমি এখন জানো না। হয়ত সাহসী, হয়ত দুর্বল। সমস্যা হল তুমি কখনও তোমাকে দেখছো না। তুমি কার কার কাছে ঋণ নিয়ে রেখেছো তাও দেখছ না। তোমার মৌলিক অস্তিত্ব এই ব্যস্ততার সামনে ঘোলাটে পলায়নপর একটা চরিত্র। কথা বলে যাচ্ছ, হাত নেড়ে যাচ্ছ, চোখের পাতা ওঠানামা করছে এর মধ্যে তুমি তোমাকে ভুলে থাকছ। পাকস্থলির সংকোচন প্রসারণ, শ্বাসের বাতাসের ধারালো আসা যাওয়া, মেরুদন্ডের হালকা বেঁকে থাকা বলতে গেলে জৈবিক স্বত্তাকে অগ্রাহ্য করছি। তাই যখন আমি নিজে এই কথাগুলো বলছি আমার শ্রবণের আলাদা একটা অংশ বলছে এই স্বর অপরিচিত, অন্য একটা অংশ আমার গলার স্বরযন্ত্রের কম্পনে আতংকিত হচ্ছে। তোমার মৌলিক স্বত্তা যদি অন্য কিছুতে আটকা পড়ে থাকে, এবং কখনও যদি সেটার সন্ধান পায় তাহলে কী করবে, হলে নিজেকে সেখান থেকে মুক্ত করে ফেলবে, তা না হলে নিজেকে সেটার অংশ করে নেবে।
তুমি বুঝতে পারছ তো আমি কী বলছি?
কিছুটা।
এরপর একা একা আয়নার সামনে দাঁড়াও, সমষ্টির বাইরে জীবকোষগুলোকে দেখো।
বলে সে শুয়ে পড়ল।
মঞ্জুষা বুঝল চলে যাবার ইঙ্গিত এটা।
শুধু শুধু উন্মাদের কথা শুনে সময় নষ্ট হল, সাথে পেটে চিনচিনে খিদে নিয়ে সে রাস্তায় নামল। এসব ব্যাপার সে আগেই জানে, নতুন করে শোনার আগ্রহ ছিল না। খাবারের জন্য এবার সে অন্যের হোটেলে পা রাখে।
তখনই মনে পড়ল আবু সুফিয়ানের অসুখ সম্পর্কে কিছুই বলা হয় নি একে।

#দুপুর ২টা ৩৫
১২/এ সন্ধ্যাতারা, উত্তরা
সংগীতা বোস, গায়িকা


ছয়তলা অ্যাপার্টমেন্ট, মহিলা থাকে তৃতীয়তলায়। এবং দরজাটা সম্ভবত ওই মহিলাই খুলে দিলো।
আমি আবু সুফিয়ান এর ব্যাপারে কথা বলতে এসেছিলাম।
বলতেই বিরক্তিতে মহিলার ভ্রু বেঁকে উঠল।
তার তো কোন ছেলে মেয়ে নেই, তুমি কে?
জ্বি আমাকে তার স্ত্রী আপনার সাথে যোগাযোগ করতে বলেছেন। উনি মানসিক ভাবে অসুস্থ। নিজেকে এক বন্ধু ফারুক উল্লা বলে দাবি করছেন।
এবার গায়িকা প্রৌঢ়া হাসলো।
মঞ্জুষা তার দিকে প্রশ্ন চোখে তাকিয়ে থাকতে সে জানায়, এরকমই তো হবার কথা। ফারুক মারা যাবার আগে নিজেকে সুফিয়ান মনে করত, সুফিয়ানও এখন নিজেকে ফারুক মনে করছে। আইডেন্টিটি শিফট করছে তার স্মৃতি।
মঞ্জুষা জানত না তার বাবা নিজেকে সুফিয়ান মনে করত। কিন্তু নিজে সুফিয়ান হলে সম্পত্তি আবার সুফিয়ান এর নামে লিখার কী ছিল সে ভেবে পেল না। তাই এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করল।
ওহ তুমি ফারুকের সম্পর্কে জানো বুঝি? বেশ কয়েক বছর আগের ঘটনা ফারুক নিজেকে সুফিয়ান মনে করার পর তো ঢাকা ছেড়ে চলে যায়। তখন কোন সুযোগে হয়ত তারা লিখিয়ে নিয়েছে।
আজকের দিনটা আসলেই অদ্ভুত! এসব মানুষ এতদিন ছিলো কোথায়!
সে জানতে চাইল তারা আইডেন্টিটি শিফট করছে ক্যানো?
এটা আমি ঠিক জানি না, কিন্তু যখন আমরা একসাথে পড়তাম, মাঝে মাঝে তর্কের সময় তারা একটা অদ্ভুত কাজ করত। মাঝামাঝি বা শেষের দিকে এসে তারা তাদের মোটিভ পাল্টে ফেলত। ধর এতক্ষণ তুমি বলেছ, আজকের দিনটা আসলেই অদ্ভুত! এসব মানুষ এতদিন ছিলো কোথায়!
আর আমি ভাবছিলাম দিনটা মোটেও অদ্ভুত না, এরকম দিনে ঠিক এরকম ঘটনাই ঘটে।
মঞ্জুষা চমকে মহিলার দিকে তাকালো। ওই মুহূর্তে সে ঠিক এই কথাটাই ভাবছিলো।


#বিকাল ৫টা ২০
৮০ নূরজাহান রোড, মোহাম্মদপুর
কাশেম সিকদার, স্কুলশিক্ষক


দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করতে জানা গেল তিনি কয়েকমাস আগে মারা গেছেন, মৃতব্যক্তির পরিবারকে বিরক্ত করতে ইচ্ছা করল না তার।
সে শেষ ঠিকানাটার দিকে তাকালো , আরোগ্য সাধন ঔষধালয়। কাছে ধারেই আছে। তাই সে হাঁটতে শুরু করে।
অন্যমনষ্ক ছিল, একটা মোটর বাইক তার একদম সামনে দিয়ে হুস করে বেরিয়ে যায়।
সংগীতা মহিলাটা আসলেই অদ্ভুত ছিল, সে ভাবছিল। আমার মাথার ভেতরেই যদি ঢুকতে পারে তাহলে তার জানা উচিত ছিল আমি ফারুক উল্লার মেয়ে নাকি ঘটনাগুলো নিতান্তই কাকতালীয়! নাকি মহিলাটা এখনও আমার মাথায় ঢুকে আছে, আমি টের পাচ্ছি না, আমাকে দিয়ে এসব ভাবাচ্ছে। সে বিরক্তি নিয়ে চারপাশে তাকায়।

#বিকাল ৫টা ৪২
আরোগ্য সাধন ঔষধালয়, রায়েরবাজার
মোকাদ্দেস হালদার, হোমিও ডাক্তার


২রুমের একটা চেম্বার, তাতে এই ফ্লোরোসেন্টের যুগে বিস্ময়করভাবে হলুদ বাতি জ্বলছে। টাক মাথার হাসিখুশি প্রৌঢ় তাকে বসতে বলে সামনে রাখা সিঙারার প্লেটটা এগিয়ে দিলো। তুমি ফারুকের মেয়ে না?
হ্যা, আপনাকেও চেনা চেনা লাগছে।
আরে আমরা বাসাবোতে থাকতে পাশাপাশি বাসায় থাকতাম।
ওহ! ভুলেই যাচ্ছিলাম বাসাবোতে থাকার সময়টা।
তা কী জন্য দেখা করতে এলে? বলে লোকটা তার এসিস্টেন্টকে পরে রোগী আনার কথা জানায়। অজানা কারণে একে তার ভালো লাগছে না, ঠিক যৌন দুশ্চরিত্রতা না, লোকটার হাসিতে একটা শিকারী গোছের কিছু আছে।
আবু সুফিয়ানকে আপনি চিনবেন হয়ত।
হ্যা সে তো গত মাসেও এসে দেখা করে গেল, কী হয়েছে?
তার স্ত্রী জানালো তার নাকি মানসিক বিকার দেখা দিয়েছে, সে নিজেকে আমার বাবা ফারুক উল্লা মনে করে। এ ব্যাপারে আপনি কোন সাহায্য করতে পারবেন কি না?
সুফিয়ান তো ছোটোকাল থেকেই আমার বন্ধু, আর তোমার বাবা বিশ্ববিদ্যালয়ে ওঠার পর আমরা একসাথে হই।
কিন্তু তাদের এরকম সমস্যা হবার পেছনে কারণ কী?
গতমাসে সুফিয়ান যখন এসেছিলো, ফারুকের ব্যাপারে আমাদের অনেকদিন পর কথা হলো। আমি জানতে চেয়েছিলাম সে কারো কাছে ঋণী কি না। সে তখন ফারুকের কথা বলল। ফারুক যদি তাকে সম্পত্তি না দিয়ে যেত তাদেরকে নাকি না খেয়ে মরতে হত।
মিথ্যা। তিনি মোটেও সুস্থ অবস্থায় এই কাজ করেন নি, সুফিয়ান কাকা তার মানসিক বিকারের সুযোগ নিয়েছিলেন।

বিকার তো এটাই ছিলো যে সে নিজেকে আবু সুফিয়ান মনে করত?

মঞ্জুষা আবারও অবাক হল, এরা সবাই ঘটনাটা জানে অথচ কেউ তাদের সাহায্য করল না তখন। তার তীব্র আক্রোশ হয় এই মানুষগুলোর ওপর।
মানুষ কখন নিজেকে ভুলে যায়? যখন সে নিজেকে নগন্য মনে করে নাকি যখন তার অস্তিত্ব ছাপিয়ে অন্যের অস্তিত্ব অর্থবহ হয়ে ওঠে? মানুষ যখন কিছুতে বা অন্যতে আটকা পড়ে যায় তখন সে কী করে?
মঞ্জুষা বিড়বিড় করে বলে, হলে সে নিজেকে সেখান থেকে মুক্ত করে ফেলে, তা না হলে নিজেকে সেটার অংশ করে নেয়।
ফারুকও কোনভাবে আটকা পড়ে ছিল তাই সে নিজেকে সুফিয়ানের অংশ করতে চেয়েছিলো। আর কোন কাঠামোর নিখুঁত অংশ কিন্তু ওই কাঠামোরই সার্বিক পরিচয়ের ক্ষুদ্রাংশ। ভুল বললাম?
জানি না।
স্মৃতি তার সাথেই অদল বদল করা সম্ভব যার সাথে আমাদের অনেক কমন স্মৃতি আছে, চাইলেই আমরা একটা ঘটনা যার দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে পারি তার মস্তিষ্কই আমাদের জন্য পরিচিত কাঠামো। তাই না?
আমি আজকে বেশ ক্লান্ত, ভাবতে ইচ্ছা করছে না।
তাহলে সহজ করে বলি, বলে মোকাদ্দেস লোকটা আনন্দের হাসি হাসলো। তোমার কারো কাছে ঋণ আছে? যে না থাকলে তুমি আজকে তুমি ‘তুমি’ হতে না?
মঞ্জুষা ভেবে দেখে তার মা, বাবা কোন বন্ধু ভাই অথবা পরিচিত মানুষদের কথা। কাউকেই তার তেমন যুক্তিগ্রাহ্য লাগে না।
বরং নিজেকেই নিজের কাছে অর্থবহ লাগে। পরিত্যক্ত সময়ে সে নিজেকেই পাশে পেয়েছে।
নাহ এরকম কেউ নেই আমার।
কেউ নেই যাকে তোমার নিজের চেয়ে সামনের সারির মনে হয়? নিজের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়? লোকটাকে এবার তার ছকের ভেতর আশাহত লাগে।
নাহ, বলে হাসিমুখে মঞ্জুষা হোমিওপ্যাথের গন্ধের রাজত্ব ভেদ করে বাইরে আসে।

আকাশ এখন ক্রমশ বেগুণি হারাতে শুরু করেছে। সে তার শব্দবর্জিত নিঃসঙ্গ জীবন নিয়ে ভাবলো। হোটেলের বাড়তি বাজেট, ভিসা পাওয়ার অপেক্ষা নিয়েও ভাবলো। পিচঢালা কালো সড়কে দাঁড়িয়ে সে আরেকবার হিসাব করে। মহাশূণ্যে ঘুরতে থাকা ১টা নিঃসঙ্গ গ্রহ, চুম্বকের মত তাতে সেঁটে থাকা প্রাণী আর উদ্ভিদেরা, নতুন পুরানো উদ্ভাবনেরা তাকে ঘিরে রেখেছে। বেগুনি আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে তার জীবকোষগুলোকে তার বিচ্ছিন্ন লাগে। বাম চোখের উপরদিকের একটা ব্যাথাই কেবল তার অস্তিত্বকে বিচ্ছিন্নতা থেকে একবিন্দুগামী করে তোলে। জাগতিক তাপের সাথে তার তাপীয় তারতম্য, দু’পায়ের চটিজোড়ার ভেতরে উঁকি দেয়া শক্ত পা তাকে পৃথিবীতে ঠুনকো অথচ শক্তিশালী পেরেকের মত গেঁথে রেখেছে।
যেতে যেতে দোকানের আয়নায় তাকালো সে। নাহ, এটা অন্য কোন উন্নততর মানুষের মুখ না। আয়নায় তার ক্লান্ত, একঘেয়ে, পরিচিত চিন্তিত চেহারা।
গল্পগুলো কখনও এরকম হয় না যে সব কিছু ঠিক হয়ে যায়, কিছু জিনিস সব সময়ই বাকি পড়ে থাকে। সে স্বপ্ন বনাম দুঃস্বপ্ন নিয়ে ভাবলো। এটা যদি ঘুম হয় তবে স্বপ্নের চেয়ে দুঃস্বপ্ন দেখাই ভালো। সুখস্বপ্ন শেষে ঘুম ভাঙ্গার পর মন খারাপ হয়, আর দুঃস্বপ্ন শেষে ঘুম ভাঙলে তীব্র আনন্দ হয়। কারণ কখনোই এ দুটোয় কোনোকিছু বদলে যায় না।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই আগস্ট, ২০১১ বিকাল ৫:৩৩
৯টি মন্তব্য ৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মামুনুলের মুক্তির খবরে কাল বৃষ্টি নেমেছিল

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ৯:৪৯


হেফাজত নেতা মামুনুল হক কারামুক্ত হওয়ায় তার অনুসারীদের মধ্যে খুশির জোয়ার বয়ে যাচ্ছে। কেউ কেউ তো বলল, তার মুক্তির খবরে কাল রাতে বৃষ্টি নেমেছিল। কিন্তু পিছিয়ে যাওয়ায় আজ গাজীপুরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

'চুরি তো চুরি, আবার সিনাজুরি'

লিখেছেন এমজেডএফ, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৮


নীলসাধুকে চকলেট বিতরণের দায়িত্ব দিয়ে প্রবাসী ব্লগার সোহানীর যে তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছিল তা বিলম্বে হলেও আমরা জেনেছি। যাদেরকে চকলেট দেওয়ার কথা ছিল তাদের একজনকেও তিনি চকলেট দেননি। এমতাবস্থায় প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বরাবর ব্লগ কর্তৃপক্ষ

লিখেছেন নীলসাধু, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১১:২২

আমি ব্লগে নিয়মিত নই।
মাঝে মাঝে আসি। নিজের লেখা পোষ্ট করি আবার চলে যাই।
মাঝেমাঝে সহ ব্লগারদের পোষ্টে মন্তব্য করি
তাদের লেখা পড়ি।
এই ব্লগের কয়েকজন ব্লগার নিজ নিক ও ফেইক... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ অপেক্ষা

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১১:২৩



গরমের সময় ক্লাশ গুলো বেশ লম্বা মনে হয়, তার উপর সানোয়ার স্যারের ক্লাশ এমনিতেই লম্বা হয় । তার একটা মুদ্রা দোষ আছে প্যারা প্রতি একটা শব্দ তিনি করেন, ব্যাস... ...বাকিটুকু পড়ুন

মসজিদে মসজিদে মোল্লা,ও কমিটি নতুন আইনে চালাচ্ছে সমাজ.

লিখেছেন এম ডি মুসা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সকাল ১০:২৩

গত সপ্তাহে ভোলার জাহানপুর ইউনিয়নের চরফ্যাশন ওমরাবাজ গ্রামের এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। লোকটি নিয়মিত মসজিদে যেত না, মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়েনি, জানা গেল সে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসী ছিল, স্বীকারোক্তিতে সে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×