somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ভূতের ভবিষ্যৎঃ খুলে দেখি সময়ের মুখোশ

১৪ ই জুলাই, ২০১২ রাত ১:২২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

'আপনার কী ধরণের ছবি ? সামাজিক না লারেলাপ্পা ? নাকি পুরোপুরি আতেলমার্কা ওই ম্যাসেজট্যাসেজওয়ালা আর্ট ফিল্ম !? একটা সময় ছিলো আমরা সিনেক্লাব করতাম । কীসব ছবি ছিলো , আহা ! ফেলিনি , ধ্রোফো , ইঙ্গমার আর আমাদের সত্যজিত , ঋত্বিক , মৃণাল ...’

সময় কেমন পাল্টায় । সেই পাল্টানো সময়টা যদি শুধু পেছনের দিকটাকেই তুলে ধরে তাতে ‘ভূত-ভবিষ্যৎ’ একটা অনিশ্চয়তার ঘেরাটোপেই আটকে থাকে । আর সেই আটকানো সময়ের এক ধূসর ফ্রেম তৈরি হচ্ছে কিংবা হয়ে থাকবে বোধকরি ... বাঙলা সিনেমা দেশীয় গন্ডি পেড়িয়ে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে নিয়ে যাওয়া আর বাঙালি মানসে ‘সিনে-সংস্কৃতি’ চাগিয়ে আজকের পথচলায় উপরের কোট করা কথার যে বেশ মিল আছে তা কম-বেশি যারা সিনেমা দেখে থাকেন তাদের স্বীকার না করে উপায় নাই । আর সিনেমার এ হেন অবস্থার জন্য কে কারা কী কারণ থাকতে পারে তা নিয়ে অনেক আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে , তাতে কী হচ্ছে বা হবে তা সিনেগ্রাহী মাত্রেই জানেন । আর এই লেখায় সেই আলোচনা করার সুযোগ নাই ।
কথা হচ্ছে ... কলকাতার সিনেমা নিয়া । মাস চারেক আগে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘ভুতের ভবিষ্যৎ’ সিনেমা কলকাতায় যে হৈ চৈ হলো , তার কারণ কী ? কী আছে সেই সিনেমায় যে পুরো কলকাতাবাসী হৈহৈরৈরৈ করে উঠলো ? বিগত ক’বছর ধরে লক্ষ করেছি কলকাতার সিনেমায় একধরণের নির্জীবতা চলে এসেছে । কলকাতার সিনেমা মানেই একধরণের ধৈর্য ধরাও ! ধীরগতির ; সিনেমার আদ্যপান্ত কলকাতার নগর-নাগরিক , শহুরে সংস্কৃতি , শাহরিক মনমেজাজে নাগরিক স্খলন নয়তো নাগরিক ভাঙন , বিচ্ছিন্নতা , হতাশা এইসবই সিনেমার উপজীব্য বিষয়বস্থু ।

আর এগুলো যে সমাজের উপরিঅংশ তা বলার অপেক্ষা রাখে না । এমনি এক সময়ে অনীক দত্ত তাঁর প্রথম সিনেমা ‘ভূতের ভবিষ্যৎ’ উপহার দিলেন লেন কলকাতাবাসীকে । তবে কী ‘ভূতের ভবিষ্যৎ’ সেই উপরিতলাকে ভেদ করে দিয়েছে ? সে প্রশ্ন মাথায় রেখেই আমরা ‘ভূতের ভবিষ্যৎ’ যদি দেখতে বসি তাহলে একটু অস্বস্তিবোধ করতে পারি । তো , সেই চিন্তাকে বাদ দিয়ে সিনেমা দেখলে আমরা দেখবো ...


‘প্রগতিরও গুতোয় ভেঙে চলছে সব ধরণের ঘর-বাড়ি ...’ সূচনাসঙ্গীতের রেশ কাটতে না কাটতেই মিনিট পাঁচেক পরেই শুরু হয়ে যায় ভূতুরে সব কান্ডকারখানা । জমিদার দর্পনারায়ণ চৌধুরী , ইংরেজ র‍্যামসে , নায়িকা কদলীবালা , বাঙাল ভূতনাথ ভাদুরী , নবাব সিরাজউদ্দোউলার বাবুর্চি খাজা খান , রিক্সাওয়ালা আত্মারাম পাসোয়ান , কারগিল যুদ্ধের শহীদ ব্রিগেডিয়ার যোধাযিদ সরকার , নতুন প্রজন্মের গায়ক হওয়ার প্রত্যাশী পাবলো পত্রনবীশ , শিল্পপতি ওকে ধরের মেয়ে কোয়েল আর বিপ্লবী নকশাল বিপ্লব দাশগুপ্ত । এদের প্রত্যেকের কেউই আর বেঁচে নাই , মরে ভূত হয়ে আছেন । ভূতেদেরও তো বাসস্থান লাগে , নাকি ? তো এই ভূতেরা নানা ঝামেলা শেষে একটা বাড়িতে থাকেন আর সেই বাড়ির মালিক সাবেক ও বর্তমানে ভূত জমিদার দর্পনারায়ণ চৌধুরী । আর এই আবাসন সমস্যার সমাধান ও একজোট হয়ে বসবাস এতো সহজে হয় নি , রীতিমত ইন্টারভিউ বোর্ড বসিয়ে যোগ্যদের স্থান দেওয়া হয়েছিলো এই বাড়িতে । এই বাড়িই অনীক দত্তের ‘ভূতের ভবিষ্যৎ’ সিনেমার প্রাণকেন্দ্র ।

নবাব সিরাজের খাস বাবুর্চি খাজা খান এই সিনেমায় উপস্থিত । পলাশি যুদ্ধের শেষে ইংরেজদের যে প্রচার –প্রসার তা আজ কারো অবিধিত নয় । ইতিহাস তো এরকমটাই ইঙ্গিত বহন করে । সে নবাব সিরাজ বাঙালি হোন আর নাই হোন । এমনি এক পিরিয়ডের রসুইঘরের লোককে হাজির করে ‘ভুতের ভবিষ্যৎ’ সিনেমায় যে ইঙ্গিত দেন অনীক তা ইতিহাস বিস্মৃতিরকালে একটু চোখেই লাগে ! এর পরেই ক্যামেরায় ধরে পড়ে র‍্যামসে সাহেব । তখন স্বরাজ চলছে পুরো ভারতবর্ষজুড়ে । চারিদিকে ‘ইংরেজ খেদাও’ আন্দোলন ক্রমশ জোরদার হচ্ছে । এর রেশ বাংলাতেও লেগেছে । বাংলার তরুণরা বিপ্লবের অগ্নিমন্ত্রে স্থির-অটল । বড়লাটকে মারার জন্য ওত পেতে গঙ্গার ধারে বসে আছেন বিপ্লবী ক্ষুধিরাম বসু । না , হাত বোমায় মারা পরে , র‍্যামসে । সেদিন গঙ্গায় আসেনি বড়লাট । দর্পনারায়ণ যে কীনা ইংরেজদের খুশি করে বাগিয়ে নেয় ‘রায়বাহাদুর’ খেতাব সে খাজনা আদায়ে বেঘোরে মারা পড়ে ডাকাতের হাতে ।

সাতচল্লিশের দাঙ্গায় ভিটেমাটি হারিয়ে এই বাঙলার ভূতনাথ ভাদুরী কলকাতায় আশ্রয় নেয় । কেমন ছিলো সেইখানে সে ... ‘বাঙাল’ তার মুখে বারবার শুনতে শুনতে বুঝা যায় সে কেমন ছিলো । আছেন চল্লিশের দশকের নায়িকা কদলীবালা । জমিদারপুত্রের প্ররোচনায় ক্যারিয়ারের উঠতি সময়ে তার প্রেমে পরে প্রতারিত হয়ে আত্মহত্যা করেন । আছেন কারগিল যুদ্ধের শহীদ সৈনিক ব্রিগেডিয়ার যোদাযিদ সরকার ।

সত্তরের দশক । বাঙলার এক ক্রান্তিকাল । কলকাতায় তখন জঙ্গলের আইন । যাকে পারছে ধরে ধরে এনকাউন্টারে মারছে পুলিশ । চারিদিকে তখন ‘নকশাল আন্দোলন’ ছড়িয়ে পড়েছে । এই সময়েই বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া বিপ্লব দাশগুপ্ত জড়িয়ে পড়ে নকশাল আন্দোলনে । বিপ্লবকে ওরা বাঁচতে দেয় নি অন্য সবার মতো । এনকাউন্টারে মারা পড়ে বিপ্লব! আছে নতুন প্রজন্মের গায়ক পাবলো , কোয়েল । এদের লাইফ স্টাইল , চলাবলা , মন-মেজাজ , প্রেম , ব্যর্থতা ড্রাগ-ফাগ সবই তুলে এনেছেন অনীক দত্ত । এই বাড়িকেন্দ্রিক যে চরিত্রগুলো রূপালিপর্দায় প্রাণসঞ্চার করেছে তাঁদের সময়কাল ভিন্নভিন্ন ।

বিভিন্ন সময়ের যেসব ঘটনাবলী এইসব চরিত্রবহন করে চলেছে তা এই সিনেমা মোটাদাগে হয়তো বহন করে না কিন্তু স্যাটায়ার বলে যদি ধরে নেন একটা কিছু তবে অনীক দত্তের ‘ভূতের ভবিষ্যৎ’ সেই জায়গায় সন্দেহ নাই বাজিমাত করে দিয়েছে । বাঙলা সিনেমায় স্যাটায়ার সত্যজিতের পর যারা ভুলতে বসেছেন তাদের জন্য অনীকের ‘ভূতের ভবিষ্যৎ’ একটা চ্যালেঞ্জড রেখে গেলেন । বাঙলা সিনেমায় যে স্যাটায়ার তা আজতক সত্যজিতের পর আর কেউ এতোটা সফলতা দেখাতে পারেন নি । ঠাট্টা-বিদ্রূপ যে কী শিল্পিত হতে পারে তা অনীকও বোধকরি সত্যজিতকে আমলে নিয়ে থাকবেন । ‘ভূতের ভবিষ্যৎ’ সিনেমায় চরিত্রের যে হিউমার তা না দেখলে আন্দাজ করা যাবে না ।

এতোদিন পর বাঙলা সিনেমায় অনীক সেই রেশটা ভালোভাবে ধরতে পেরেছেন তা দেখে পুরো কলকাতাবাসী হয়তো এতোদিন পর আনন্দে উদ্বেলিত । প্রোমোটার বাড়িভেঙে দেবে তাকে ঠেকিয়ে সিনেমা শেষ হয়ে যায় কিন্তু যে রেশ থেকে যায় তা বাংলার বিভিন্ন সময়ের সোনালি অধ্যায়গুলো , যা কীনা বাঙালির মানসপট থেকে ক্রমশ দূর বহুদূরে চলে যাচ্ছে .....

বাঙালি বিস্মৃত , সেই বিস্মৃত বাঙলা-বাঙালিকে সিনেমায় একফ্রেমে বেঁধে ঘন্টাদুয়েকে ধরেবেঁধে রাখা যায় বটে কিন্তু সেই রেশ কেটে গেলে কী হয় অনীক জানেন বোধ করি । না হলে অনীক সেই দায় কাঁধে নেবেন কেনো , তার কীসের এতো দায় ? এ উত্তর হয়তো এই ...কাউকে না কাউকেই তো দায় স্বীকার করতে হবে ...আর অনীক দত্ত হয়তো সেই দায় জেনেবুঝেই নিয়েছেন । হ্যাঁ , আপনারা দেখতে পারেন নিঃসঙ্কোচে , সেই দায় আপনাদের উপর অনীক ছেড়ে দিয়েছেন । অনীক দত্ত বোধহয় জানেন , সিনেমার দায় সর্বোপরি দর্শক-বোদ্ধাদের উপরই বর্তায় । আর তা যদি দেখার ভারে নতজানু হয়ে যায় সে দায় কিন্তু পরিচালক নিতে পারেন বা নিতে বাধ্য , তা সে প্রযোজক যতই ‘গুড়ের পিঁপড়া’ হোক না কেনো ! সে দায়মুক্তি অবশ্য ইতিমধ্যে অনীকের হয়েই গেছে , তবে আমরা যখন এ বাংলায় বসে এসব চেখে দেখি তখন একটু আত্মশ্লাঘায় জর্জরিত হই । আমাদের ছিলো এরকমটা একদিন , এই সেদিন পর্যন্ত আমাদের একজন ছিলেন ...'এ বাংলায় পুরুষ জীয়ে না !’ বলেই কীনা তারেক মাসুদ গেলেন । আমাদের ছিলো প্রায় তের’শ সিনেমা হল , আজ তা নামতে নামতে ছয়’শর কোটায় নেমে গেছে । আমরা আজ সেইসব সোনালি দিনের কথা বলি আর জাবরকাটি । আমাদের এই ক্রান্তিকালের মুখোশ খুলে দেওয়ার জন্য একজন অনীক দত্ত দরকার দরকার একটা ‘ভুতের ভবিষ্যৎ’র মতো সিনেমা । যা উন্মোচন করবে নিজেকে আপন সত্ত্বাকে, খুলে দিবে সময়ের মুখোশ ।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই জুলাই, ২০১২ রাত ১:৪১
২টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

=নীল আকাশের প্রান্ত ছুঁয়ে-৭ (আকাশ ভালোবেসে)=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৬ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:১৯

০১।



=আকাশের মন খারাপ আজ, অথচ ফুলেরা হাসে=
আকাশের মন খারাপ, মেঘ কাজল চোখ তার,
কেঁদে দিলেই লেপ্টে যাবে চোখের কাজল,
আকাশের বুকে বিষাদের ছাউনি,
ধ্বস নামলেই ডুবে যাবে মাটি!
================================================
অনেক দিন পর আকাশের ছবি নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগ লিখেছি: কথাটার পরে ভাসছে ১১ বছর ১১ মাস... কথাটা

লিখেছেন আবু ছােলহ, ০৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:১৮

ব্লগ লিখেছি: কথাটার পরে ভাসছে ১১ বছর ১১ মাস... কথাটা

গুগল থেকে নেয়া ছবি।

সামুতে মাল্টি নিক নিয়ে অনেকেই কথা বলেন। অনেকের কাছে মাল্টি যন্ত্রণারও কারণ। শুধু যন্ত্রণা নয়, নরক যন্ত্রণাও... ...বাকিটুকু পড়ুন

পানি জলে ধর্ম দ্বন্দ

লিখেছেন প্রামানিক, ০৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৫২


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

জল পানিতে দ্বন্দ লেগে
ভাগ হলোরে বঙ্গ দেশ
এপার ওপার দুই পারেতে
বাঙালিদের জীবন শেষ।

পানি বললে জাত থাকে না
ঈমান থাকে না জলে
এইটা নিয়েই দুই বাংলাতে
রেষারেষি চলে।

জল বললে কয় নাউযুবিল্লাহ
পানি বললে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সমস্যা মিয়ার সমস্যা

লিখেছেন রিয়াদ( শেষ রাতের আঁধার ), ০৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৭

সমস্যা মিয়ার সিঙ্গারা সমুচার দোকানে প্রতিদিন আমরা এসে জমায়েত হই, যখন বিকালের বিষণ্ন রোদ গড়িয়ে গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে, সন্ধ্যা পেরিয়ে আকাশের রঙিন আলোর আভা মিলিয়ে যেতে শুরু করে। সন্ধ্যা সাড়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

এই মুহূর্তে তারেক জিয়ার দরকার নিজেকে আরও উন্মুক্ত করে দেওয়া।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ০৬ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:২৬


তারেক জিয়া ও বিএনপির নেতৃত্ব নিয়ে আমি ব্লগে অনেকবারই পোস্ট দিয়েছি এবং বিএনপি'র নেতৃত্ব সংকটের কথা খুব স্পষ্টভাবে দেখিয়েছি ও বলেছি। এটার জন্য বিএনপিকে সমর্থন করে কিংবা বিএনপি'র প্রতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×