somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বাসর রাত্রিতে বিড়াল মারিবার দুর্ধর্ষ কাহিনী

২৭ শে মার্চ, ২০১৩ বিকাল ৫:১২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বাসর রাত্রিতে বিড়াল মারিবার দুর্ধর্ষ কাহিনী





বাংলাভাষায় বহুল প্রচলিত একখানা প্রবাদ রহিয়াছে। সেই খ্যাতিসম্পন্ন প্রবাদখানা হইলো ’বাসর রাত্রিতে বিড়াল মারা’। আমরা যাহারা বাংলা ভাষাভাষী, তাহারা উক্ত কথাখানার সহিত অত্যধিক পরিচিত। এই বাক্যখানা নব্যবিবাহিত যুগলের ক্ষেত্রেই সমধিক প্রয়োগ হইয়া থাকে। ’বাসর রাত্রি’ বলিতে বুঝায় নববিবাহিত যুগলের জীবনের প্রথম রাত্রি (যদিও যুগ এখন বদলাইয়াছে, যুগলগণ এখন আর সেই পূর্ব যুগের ধ্যান ধারণায় বিশ্বাসী নহেন, তাই বাসর রাত্রিকে তাহাদের ’জীবনের প্রথম রাত্রি’ বলাটা সমিচীন হইতেছে কিনা, তাহা আমার বোধগম্য নহে)।


অপরপক্ষে ’বিড়াল’ একখানা নিরীহ প্রাণী, যাহা মনুষ্য আদর লাভে সর্বদা সচেষ্ট থাকে। অতএব, ’বাসর রাত্রিকালে বিড়াল মারা’ বলিতে বুঝায় বাসর রাত্রিতে বিড়াল নামক প্রাণীটিকে হত্যা করিয়া ফেলা। উক্ত বাক্যখানার ভিন্নতর শব্দার্থ থাকিলেও থাকিতে পারে। কিন্তু আপাত: দৃষ্টিতে ইহা একটি অমানবিক কাজ বলিয়াই বোধগম্য হইতেছে। যে সামান্য বিড়াল, নিরীহ-অবলা একখানা প্রাণী, তাহাকে অন্য কোন সময় নহে, বরং বাসর রাত্রিকালেই মারিয়া ফেলিতে হইবে কেন? ইহা কেমন কথা হইলো? কিভাবেই বা ইহার সূচনা হইলো? পাঠককূল, আসুন তাহা হইলে এক্ষণে আমরা জানিয়া লই বাসর রাত্রিকালে বিড়াল মারিয়া ফেলিবার প্রকৃত ঘটনাখানা।


বহুকাল পূর্বের ঘটনা। শ্যামদেশের রাজা রুদ্রপ্রতাপের দুই কন্যা ছিল। লীলাবতী এবং মায়াবতী। তাহারা রূপে, গুণে যেমন গুণান্বিত ছিলো, তেমনি ছিল শিক্ষিতা। কিন্তু তাহা হইলে হইবে কি? রাজকণ্যাদ্বয়ের আরও একখানা গুণ ছিল। তাহা হইলো, তাহারা ছিল অত্যাধিক বদমেজাজী এবং পিতার ন্যায় অত্যাচারীও বটে। কথায় কথায় প্রজাকুলের গর্দান নেওয়া ছিল তাহাদের নিকট বৃক্ষ হইতে পরিপক্ক ফল পারিবার মতোই জলবৎতরলং ঘটনা মাত্র।


কন্যাদ্বয়ের এহেন বদমেজাজের কারণে রাজা রুদ্রপ্রতাপ বেশ চিন্তিত হইয়া পড়িলেন। কেননা, তাহারা এখন বিবাহযোগ্যা। কিন্তু তাহাদের অত্যাচারের মাত্রা দিন দিন বাড়িতেছে এবং ইহা প্রজাকুলের মাঝে ব্যাপক পীড়াদায়ক হইয়া গিয়াছে বিধায় কণ্যাদ্বয়ের জন্য যোগ্য পাত্র থাকা সত্ত্বেও কেহই তাহাদের পুত্রদিগকে এহেন কন্যার সহিত বিবাহে সম্মত হইতেছেনা। এমতাবস্থায় রাজন কণ্যাদ্বয়ের বিবাহ বিষয়ক জটিলতা লইয়া গভীর চিন্তায় মগ্ন হইলেন। দিন, মাস, বছর পার হইলো। অবশেষে রাজার চিন্তার অবসান হইলো এবং তিনি ঘোষণা করিলেন রাজ্যের সবচাইতে নিরীহ দুইজন পাত্রকে অনতিবিলম্বে খোঁজা হউক এবং তাহাদের সহিত-ই লীলাবতী এবং মায়াবতীর নিকট ভবিষ্যতে বিবাহ হইবে। নচেৎ সকলের গর্দান যাইবে। তৎক্ষণাত চারিদিকে খোঁজ পড়িয়া গেল। কিন্তু নিরীহ দুখানা পাত্র পাওয়াটাই যে দুষ্কর। কেই বা সাধ করিয়া সিংহের খাঁচায় নিজেকে সমর্পণ করিতে চায়?


অবশেষে ঠাকুর মুখ তুলিলেন। হবুচন্দ্র এবং গবুচন্দ্র নামক নেহায়েত গোবেচারা দু’জনকে রাজ পেয়াদা রাজাধিরাজের সম্মুখে উপস্থিত করিল। পাত্রদ্বয়কে দেখিয়া তৎক্ষণাত রাজার মনে ধরিল এবং মহা ধুমধামের সহিত তাহার কন্যাদ্বয় লীলাবতি এবং মায়াবতীকে যথাক্রমে হবুচন্দ্র এবং গবুচন্দ্রের নিকট সমর্পণ করিলেন।

বিবাহ অনুষ্ঠান কার্যাদি সম্পাদন শেষ হইবার পর গভীর রাত্রিতে নববধূকে লইয়া হবুচন্দ্র ভয়ে ভয়ে নিজ গৃহে প্রবেশ করিল। লীলাবতির বদমেজাজজনিত গুণের কথা পূর্বেই সে বেশ ভালোভাবে অবগত রহিয়াছে। অতএব, হবুচন্দ্র তাহার নববধূকে বাসর রাত্রিতে না ঘাটাইবার সিদ্ধান্ত নিয়া ঘরের এক প্রান্তে মাটিতে শীতল পাটি বিছাইয়া চুপচাপ বসিয়া রইল। অন্যদিকে লীলাবতি ফুলেল বিছানায় শুইয়া নিদ্রায় মগ্ন হইলো।

রাত্রি গভীর হইলো। হবুচন্দ্রের কিঞ্চিত ঝিমুনি আসিতেছিল। কিন্তু তক্ষতের কর্কশ ডাকে তাহা কাটিয়া যাইতেই সে অদ্ভুত একখানা বিষয় লক্ষ্য করিল। অবাক বিস্ময়ে হবুচন্দ্র দেখিল, একখানা বিড়াল শ্রেণীর প্রাণী লীলাবতীর বিছানায় তাহার পাশে, যেখানে হবুচন্দ্রের থাকার কথা, সে স্থলে বেশ আয়েশ করিয়া শুইয়া রহিয়াছে। ইহাতে হবুচন্দ্রের মন এবং মেজাজ ব্যাপক খারাপ হইয়া গেল। নববধূকে কাছে পাইবার কাম পিপাসাকে কঠোর হস্তে দমন করিয়া গুটি গুটি পায়ে সে বিছানার দিকে আগাইয়া গেল। তাহার মাথায় তখন ঘুরিতেছে, বিড়াল শ্রেণীর এই প্রাণীটির কারণে যদি লীলাবতির ঘুমে ব্যাঘাত ঘটে, তাহা হইলে নির্ঘাত হবুচন্দ্রের গর্দান যাইবে আজ। অতএব, নিজ জীবন বাঁচাইতে হবুচন্দ্র বিড়ালটির কাছে গিয়া তরবারি কোষমুক্ত করিয়া এককোপে বিড়ালটির ধড় তার দেহ হইতে বিচ্ছিন্ন করিয়া ফেলিল।

তরবারির শব্দে লীলাবতির ঘুম ভাঙিয়া গেল। কোষমুক্ত তরবারি এবং বিছানায় রক্ত দেখিয়া সে প্রায় মূর্ছা যাইবার উপক্রম হইলো। হবুচন্দ্রের এহেন ভয়ঙ্কর কীর্তিকলাপ দেখিয়া লীলাবতি ভীত এবং সন্ত্রস্ত্র হইয়া পড়িল। সাথে সাথে সে হবুচন্দ্রের পদযুগল জড়াইয়া কাঁদিতে কাঁদিতে বলিল, ”আমাকে মারিবেন না, আমি আপনার নববধূ। আজ হইতে আপনার সেবা করিয়া যাইব চিরটা কাল। দয়া করিয়া আমাকে মারিবেন না...”


বাসর রাত্রিতে হবুচন্দ্রের বিড়াল মারিবার পরদিন হইতে লীলাবতি সম্পূর্ণরূপে বদলাইয়া গেল। তাহার বদমেজাজ উবিয়া গিয়া পতি সেবায় সে তাহার দিনাতিপাত করিতে লাগিল। এবং এই ঘটনার মাস খানেক পরে গবুচন্দ্র যখন হবুচন্দ্রের বটীতে বেড়াইতে আসিল, লীলাবতির এহেন পরিবর্তন এবং পতিসেবা স্বচক্ষে দেখিয়া গবু যারপরনাই বিস্মিত হইলো। কেননা, মায়াবতী ঠিক তার আগের রূপেই আছে, তাহার বদমেজাজের সহিত গবুচন্দ্রের একেবারেই বনিবনা হইতেছিল না। হবুচন্দ্রকে তৎক্ষণাত গবু সুধাইলো, ’ওহে হবু, ঘটনা কি হে? খুলিয়া বলোতো, লীলাবতীর ন্যায় বদমেজাজী নারী কি উপায়ে এত ভালো আচরণ করিতেছে?’ হবুচন্দ্র উত্তরে মুচকি হাসিয়া কহিল, ’বাসর রাত্রিতে বিড়াল মারিয়াছি। বিড়ালখানা লীলাবতির আদরের পালিত ছিল বৈকি। কিন্তু তাহা হইলেও এক্ষণে সবকিছু নিজ চোখেইতো অবলোকন করিতেছ’।

ওই দিনই গবুচন্দ্র স্বীয় বটীতে ফিরিয়া নিজ বধূ মায়াবতীর একমাত্র আদরের পালিত কুকুরটিকে তরবারীর এক কোপে হত্যা করিল। এই ঘটনায় মায়াবতী ক্ষুব্ধ হইয়া গবুচন্দ্রের গর্দান লইবার আদেশ প্রদান করিল। গর্দান যাইবার প্রাক্কালে গবু হবুকে সুধাইলো, ”ভ্রাতা, কিছুইতো বুঝিলাম না। তুমি বিড়াল মারিলে, আর আমি মারিলাম কুক্কুর। তুমি থাকিবে সুখে, আর আমার যাইবে গর্দান? এ কেমন বিচার হইলো?”

উত্তরে হবুচন্দ্র ফের মুচকি হাসিয়া কহিল, "ভ্রাতা, কুক্কুর মারিলেতো চলিবেনা, মারিতে হইবে বিড়াল, এবং তাহা বাসর রাত্রিতেই মারিতে হইবে। তুমিও মারিয়াছ, কিন্তু বড্ড দেরী করিয়া ফেলিয়াছ।”

০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বরিষ ধরা-মাঝে শান্তির বারি

লিখেছেন বিষাদ সময়, ০৬ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:১৬





মাসের আধিক কাল ধরে দাবদাহে মানব প্রাণ ওষ্ঠাগত। সেই যে অগ্নি স্নানে ধরা শুচি হওয়া শুরু হলো, তো হলোই। ধরা ম্লান হয়ে, শুষ্ক হয়, মুমূর্ষ হয়ে গেল... ...বাকিটুকু পড়ুন

=নীল আকাশের প্রান্ত ছুঁয়ে-৭ (আকাশ ভালোবেসে)=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৬ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:১৯

০১।



=আকাশের মন খারাপ আজ, অথচ ফুলেরা হাসে=
আকাশের মন খারাপ, মেঘ কাজল চোখ তার,
কেঁদে দিলেই লেপ্টে যাবে চোখের কাজল,
আকাশের বুকে বিষাদের ছাউনি,
ধ্বস নামলেই ডুবে যাবে মাটি!
================================================
অনেক দিন পর আকাশের ছবি নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

পানি জলে ধর্ম দ্বন্দ

লিখেছেন প্রামানিক, ০৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৫২


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

জল পানিতে দ্বন্দ লেগে
ভাগ হলোরে বঙ্গ দেশ
এপার ওপার দুই পারেতে
বাঙালিদের জীবন শেষ।

পানি বললে জাত থাকে না
ঈমান থাকে না জলে
এইটা নিয়েই দুই বাংলাতে
রেষারেষি চলে।

জল বললে কয় নাউযুবিল্লাহ
পানি বললে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সমস্যা মিয়ার সমস্যা

লিখেছেন রিয়াদ( শেষ রাতের আঁধার ), ০৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৭

সমস্যা মিয়ার সিঙ্গারা সমুচার দোকানে প্রতিদিন আমরা এসে জমায়েত হই, যখন বিকালের বিষণ্ন রোদ গড়িয়ে গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে, সন্ধ্যা পেরিয়ে আকাশের রঙিন আলোর আভা মিলিয়ে যেতে শুরু করে। সন্ধ্যা সাড়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

এই মুহূর্তে তারেক জিয়ার দরকার নিজেকে আরও উন্মুক্ত করে দেওয়া।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ০৬ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:২৬


তারেক জিয়া ও বিএনপির নেতৃত্ব নিয়ে আমি ব্লগে অনেকবারই পোস্ট দিয়েছি এবং বিএনপি'র নেতৃত্ব সংকটের কথা খুব স্পষ্টভাবে দেখিয়েছি ও বলেছি। এটার জন্য বিএনপিকে সমর্থন করে কিংবা বিএনপি'র প্রতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×