অন্যকে দোষ না দিয়ে আমি বরং নিজের দিকে তাকাবো। নিজের উদাসীনতা, মানসিকতা, অযোগ্যতা, অদক্ষতার দিকে তাকাবো। কিছু ঘটলেই অন্যকে দোষারোপ করার মানসিকতা জাতিগতভাবে আমরা এমনভাবে রপ্ত করেছি যে এক শিয়াল হুক্কাহুয়া বললেই সব শিয়াল জানান দেয়- কিয়া হুয়া ভাই কিয়া হুয়া! আমাদের রাষ্ট্র এবং জনগণ ইতিহাস-ঐতিহ্য নিয়ে বরাবরই উদাসীন। আমাদের ইতিহাস থেমে আছে ১৯৫২ সালে, এর বাইরে আমরা যে ইতিহাসের প্রতি আগ্রহী, যে ইতিহাস চর্চা করি, তা আরবের ইতিহাস। আমরা কেন ভারতের আগে জিআই স্বত্ত্বের জন্য আবেদন করতে পারলাম না, এই প্রশ্ন আগে উঠা উচিত। তাঁত বোর্ডকে জবাবদিহিতার আওতায় আনা উচিত। সরকারের বিরুদ্ধে আঙুল তোলা উচিত। সব জায়গা অযোগ্য-অদক্ষ আর আনকালচারড লোকে ভরে গেছে। দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, শিল্প-সংস্কৃতি কোনো কিছুর প্রতি এদের নূন্যতম দরদ নেই। প্রায় গোটা একটা জাতি বেঁচে আছে যে-কোনো উপায়ে অর্থ রোজগার, উদর পূর্তি আর যৌন তৃপ্তির জন্য!
সেই ১৯৪৭ সালের দেশ ভাগের সময় থেকেই মুমিনদের অত্যাচারে প্রাণ বাঁচাতে টাঙ্গাইলের তাঁতশিল্পী বসাক সম্প্রদায় দেশ ছাড়তে শুরু করে। পাকিস্তান আমলে এবং বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পরেও বিভিন্ন সময়ে তারা দেশ ছেড়েছে, দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছে। ভারতের নদীয়ায় গিয়ে নতুন তাঁতশালা খুলে নতুন জীবন শুরু করেছে। তারা বংশ পরম্পরায় টাঙ্গাইলের শাড়ি তৈরি করছে। টাঙ্গাইলের শাড়ির প্রতি আমাদের যেমনি ভালোবাসা আছে, আবেগ আছে; তেমনি তাদেরও ভালোবাসা কিংবা আবেগ কম নয়। উপরন্তু তাদের আছে ভিটে-মাটি, দেশ ছাড়ার যাতনা। টাঙ্গাইল শাড়ির জিআই স্বত্ত্ব ভারত পাওয়ায় আমাদের টাঙ্গাইলের তাঁতশিল্পীরা কাজের স্বীকৃতি থেকে বঞ্চিত হয়েছেন, আমাদেরও খারাপ লেগেছে। আবার জিআই স্বত্ত্ব যদি আমরা পেতাম, নদীয়ার তাঁতশিল্পীরাও বঞ্চিত হতেন, তাদেরও কষ্ট লাগত। ফলে ভারতের টাঙ্গাইল শাড়ির জিআই স্বত্ত্ব দাবী করা এবং সেটা পেয়ে যাওয়াকে অন্যায্য বলতে পারছি না। যেমনি বলতে পারব না ঋত্ত্বিক ঘটক, বুদ্ধদেব বসু, মিহির সেনগুপ্ত, সুনীল সঙ্গোপাধ্যায়, সুচিত্রা সেন, বাপ্পি লাহিড়ীসহ আরও অনেকের শিল্পকর্ম বাংলাদেশের। মুসলমানদের অত্যাচারে সনাতন ধর্মাবলম্বীসহ বাংলাদেশের আরও কিছু জাতিগোষ্ঠীর মানুষের একটা অংশ ভারতে চলে গেছে, সেখানে গিয়ে তারা তাদের ঐতিহ্য লালন করছে। ফলে তাদের সেই ঐতিহ্যের জিআই স্বত্ত্ব দাবী করতে পারবে না? ইউরোপের দেশগুলোর মতো নয় এই জনপদের ইতিহাস। এখানে দেশভাগের মতো হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটানোর পাশাপাশি রাষ্ট্র এবং জনগণ পরিকল্পিতভাবে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষকে নির্যাতনের মাধ্যমে দেশছাড়া করেছে। এখনো সংখ্যালঘুদের ভূমি কেড়ে নিয়ে দেশছাড়া করা হচ্ছে। এই বিষয়গুলোও বিবেচনা করতে হবে।
ভারতের কয়েকটি রাজ্য এবং বাংলাদেশের ভাষা-সংস্কৃতি একই হওয়ায়, অনেক শিল্পের বিস্তার ঘটেছে দুই দেশেই। কোনো কোনো শিল্পের শিকড় কোথায়, তার প্রকৃত তথ্য হয়ত আজ আর বের করাও সম্ভব নয়। বাংলাদেশের মুমিনকুল দাবি করে থাকে যে বাংলাদেশের নকশীকাঁথা, ফজলি আমসহ আরও অনেক পণ্যের জিআই স্বত্ত্ব ভারত নিজেদের নামে করিয়ে নিয়েছে। এইসব দাবী হাস্যকর, এই দাবীর মাধ্যমে নিজেদের অযোগ্যতাকেই সামনে নিয়ে আসা হয়। অবিভক্ত বাংলার অনেক জায়গায় নকশীকাঁথা তৈরি হতো, এখনো হয়। মুমিনকুল বীরভূমে গেলে দেখতে পাবে নকশীকাঁথা কী জিনিস। কী অসাধারণ সব কাজ করছেন কাঁথাশিল্পীরা। এবছর ভারতের রাষ্ট্রীয় পদ্মশ্রী পদক পেয়েছেন বীরভূমের কাঁথাশিল্পী তাকদিরা বেগম। মালদাতে ফজলি আম হয়। ফলে তারা নকশীকাঁথা, ফজলি আমের জন্য জিআই স্বত্ত্বের আবেদন করেছিল এবং সেটা তারা পেয়েছে। কথা হলো, যেহেতু কিছু শিল্প বা জিনিসের বিস্তার দুই জায়গাতেই আছে, তাহলে আমরা কেন ভারতের আগে জিআই স্বত্ত্বের জন্য আবেদন করলাম না? আমরা করতে পারিনি কারণ- আমরা অদক্ষ, অযোগ্য, আমাদের ইতিহাস সচেতনতা নেই, সংস্কৃতির প্রতি ভালোবাসা নেই। অক্ষমের আস্ফালন প্রকাশ পায় অন্যকে দোষারোপ করার মধ্য দিয়ে। উভয় দেশেই প্রচলিত এইসব শিল্প বা জিনিসের জিআই স্বত্ত্ব ভারত নিজেদের নামে করিয়ে নিয়েছে কারণ তারা আমাদের চেয়ে অধিক ইতিহাস সচেতন, সংস্কৃতিপ্রেমী যোগ্য ও দক্ষ। এই সত্যটা স্বীকার করার মানসিকতা আমাদের নেই।
সরাশিল্পের প্রচলন ঘটেছিল পূর্ববঙ্গে বা আমাদের এখনকার বাংলাদেশে। ঢাকাই সরা, রিলিফেরা সরা, ফরিদপুরের সরেশ্বরী সরা বিখ্যাত। দেশভাগের সময় থেকে এই সরাশিল্পীরাদের অনেকেই পশ্চিমবঙ্গে চলে গেছেন। সেখানে সরাশিল্প আরও বিস্তার লাভ করেছে। দারুণ সব কাজ হচ্ছে। কিন্তু আমরা কি সরাশিল্পের জিআই নিয়ে ভাবছি? নাকি ভাবছি এসব মালাউনদের কুফরিকর্ম, শিরক! ভাবছি কি মনিপুরী শাড়ির জিআই স্বত্ত্ব নিয়ে? মনিপুরীরা কিন্তু ভারতেও আছে। ভরত যখন স্বত্ত্ব নিয়ে নেবে, তখন আমরা হাউকাউ শুরু করব। এরকম আরও অনেক বিষয় আছে, যার শিকড় হয়ত কোনোটা এপার বাংলায়, কোনোটা ওপার বাংলায়। কৃষ্ণনগরের মৃৎশিল্পের শিকড়ও কিন্তু বাংলাদেশে। মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় রাজশাহীর মৃৎশিল্পীদের ওখানে নিয়ে গিয়েছিলেন। পৃষ্টপোষকতা পেলে একটা শিল্প উন্নতির কোন স্তরে পৌঁছতে পারে, তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ কৃষ্ণনগরের মৃৎশিল্পী। আমাদের এখানে সব লোকশিল্পই এখন ধ্বংসের মুখে। ধর্মীয় সংস্কৃতির কারণে জনগণের বড় অংশটি এসব লোকশিল্প থেকে বিচ্ছিন্ন। আর জনগণের যে জিনিসের প্রতি আগ্রহ কম, রাষ্ট্রও সে জিনিসের উন্নতিতে কোনো উদ্যোগ নেয় না, পৃষ্ঠপোষকতা করে না। কেননা এই জনগণই তো রাষ্ট্র ক্ষমতায় বসে। সঙ্গত কারণেই এই দেশে ধুঁকতে ধুঁকতে টিকে আছে লোকশিল্প।
আজ হঠাৎ কিছু মানুষের শাড়িপ্রেম উথলে উঠেছে, কিন্তু এদের অনেকের পরিবারের নারীরাই শাড়ি পরে না। শহর থেকে প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত দাবানলের মতো বিস্তার ঘটেছে বোরকার। বোরকার নিচে পরে সালোয়ার কামিজ। লক্ষ লক্ষ নারীর শাড়ির সাথে কোনো সম্পর্কই নেই। শাড়িকে হিন্দুয়ানী পোশাক হিসেবে প্রচার চালানো হয়। নিজের ভাষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস, শিকড়ের প্রতি নূন্যতম প্রেম নেই। বরং পাপ ও লজ্জার মনে করে। কিন্তু গৌরব অর্জনের ভাগ নেবার বেলায় ষোলো আনা!
অন্যকে দোষারোপ না করে আয়নায় আমাদের নিজেদের চেহারা দ্যাখা উচিত, সাতাত্তর বছরে আমরা কী হারিয়েছি সেই হিসাবের খাতাটা খুলে বসা উচিত। বুদ্ধদেবদের হারিয়ে আমরা পেয়েছি মামুনুল হকদের, বাপ্পি লাহিড়ীদের হারিয়ে আমরা পেছি হাজার হাজার ওয়াজী। মৃৎশিল্প বা লোকশিল্পকে বিলুপ্তির পথে ঠেলে দিয়ে আমরা পেয়েছি ঢিলাকুলুপশিল্পী! আহা কী প্রাপ্তি!
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ রাত ১০:২৪