হুমায়ুন আহমেদ গুলতেকিনকে ডিভোর্স দিয়ে ছাপ্পান্ন বছর বয়সে তেইশ বছরের শাওনকে বিয়ে করেছিলেন। আজকে যারা মুশতাক-তিশা দম্পতিকে ‘ভুয়া ভুয়া’, ‘লুচ্চা’ বা ‘ছিঃ ছিঃ’ স্লোগান দিয়ে বইমেলা থেকে বের করে দিয়েছে; সেইসব সমাজ সচেতনরা কি হুমায়ুন আহমেদ আর শাওনের সঙ্গে এমন আচরণ করেছিল? কিংবা এখন বইমেলায় গিয়ে হুমায়ুন আহমেদের বই বিক্রির বিরুদ্ধে দলবদ্ধ হয়ে এমন আওয়াজ তুলবে? সমাজ নষ্টের দায়ে কাঠগড়ায় তুলবে প্রয়াত হুমায়ুন আর শাওনকে?
কিংবা অনেক শতাব্দী পূর্বে ভিন্ন ভূ-খণ্ডের, ভিন্ন ভাষার, ভিন্ন সংস্কৃতির তিপ্পান্ন বছর বয়সী যে লোকটি ছয় বছরের শিশুকে বিয়ে করেছিলেন, আজকের বইমেলার এইসব সমাজ সচেতনরা কি তার বিরুদ্ধে, তার দর্শন প্রচারের বিরুদ্ধে দলবদ্ধ হয়ে প্রতিবাদ জানাবে? বলবে কি ওই লোকটির মতবাদ আমাদের সমাজ নষ্ট করেছে?
না, প্রতিবাদ জানাবে না, এদের বিরুদ্ধে কোনো কথাও বলবে না। বরং পুজো করবে। কারণ, বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষের বিবেকের ভূমি বড় অসমতল, ব্যক্তি বা সম্প্রদায় বিশেষে কখনও জল ফুঁড়ে নদীর চরের মতো জেগে ওঠে, কখনও জলের তলে বেঘোরে পড়ে থাকে!
মুশতাক-তিশা দুজনই প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ, দেশের প্রচলিত আইন মেনেই তারা বিয়ে করেছেন। সেই অধিকার তাদের অবশ্যই আছে। প্রাপ্ত বয়স্ক যে-কোনো বয়সী মানুষেরই প্রাপ্ত বয়স্ক যে-কোনো বয়সের মানুষকে বিয়ে স্বাধীনতা আছে, সেটা সেই দুজন ব্যক্তির ব্যাপার একান্ত ব্যক্তিগত, আমজনতার সেই বিষয়ে নাক গলানোর কোনো অধিকার নেই। কারো ভালো না লাগলে তাদেরকে উপেক্ষা করতে পারে। মুশতাক তার আর তিশার জীবন নিয়ে বই লিখেছেন, সে-ই বই প্রকাশ করার এবং বইমেলায় বিক্রি করার অধিকার অবশ্যই তাদের আছে। একজন মানুষ যত খারাপ মানের বই-ই লিখুন না কেন, তিনি চাইবেন তার বই বিক্রি হোক, বুক ভরা আশা নিয়ে মেলায় যাবেন। মুশতাক-তিশাও গিয়েছেন। সমস্যা তাদের নয়। সমস্যা যারা মুশতাকের বই কিনছেন আর যে-সব গণমাধ্যম ভাইরালের নেশায় উন্মত্ত হয়ে তাদের বইয়ের প্রচার করছে। যারা মুশতাকের বই কিনছেন বা যে-সব সাংবাদিক তার বইয়ের প্রচার করছেন, তাদের রুচি-শিক্ষা-সংস্কৃতি নিয়ে প্রশ্ন তোলা যেতে পারে। অনেকে তুলছেনও। কারো ভালো না লাগলে এইসব নিউজ উপেক্ষা করতে পারে, লাইক-কমেন্ট-শেয়ার করা থেকে নিজেকে বিরত রাখতে পারে, যে প্রকাশনীর স্টলে বসে মুশতাক-তিশা বই বিক্রি করে, সেই স্টলের ত্রিশ হাত দূর দিয়ে যেতে পারে, অনাগ্রহী ব্যক্তির ওই স্টলের দিকে তাকানোরও দরকার নেই। কিন্তু কোনো অবস্থাতেই কিছু লোক দলবদ্ধ হয়ে কোনো বইয়ের লেখককে মেলা থেকে বের করে দিতে পারে না। যারা বইমেলায় এভাবে স্লোগান তুলে মেলার পরিবেশ নষ্ট করেছে, এরা বইয়ের পাঠক আমি তা বিশ্বাস করি না। এরাও মুশতাকের বইয়ের ক্রেতার মতোই নির্বোধ। এদের এক-দুই পুরুষ পিছনে ফিরে তাকালেই দেখা যাবে যে বাবা কিংবা দাদা-পরদাদা নাবালিকা বিয়ে করেছে। আমার মনে হয় এই অতি উৎসাহীরা ব্যক্তিজীবনে ভীষণ অসুখী, এরা সবকিছুতেই নিজেকে জড়িয়ে ফেলে, তাই সব জায়গায় এদের নাক গলানোর অভ্যাস। তাই এদের মুক্তি মেলে না, শান্তি মেলে না। নাকি এই ঘটনা কোনো বিশেষ মহলের চক্রান্ত? ভিডিও ফুটেজে স্লোগান দেওয়া ছেলেদের দেখে পাঠক বলে মনে হলো না। এখন কিন্তু প্রেসক্লাবের সামনে মিছিল-মিটিংয়ের জন্য লোক ভাড়া পাাওয়া যায়, এদের দেখে তেমনই মনে হয়েছে।
যেটাই হোক, যারা মেলার মধ্যে এই কাজটি করেছে, মেলা কর্তৃপক্ষ বা পুলিশ কি তাদের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেবে? অবশ্যই সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। কোনো লেখকের লেখা অপছন্দ হলেই কেউ সেই লেখককে মেলা থেকে বের করে দিতে পারে না। এটা ঘৃণ্য কাজ, এর মধ্যে লুকিয়ে আছে ভবিষ্যতের বিশৃঙ্খলার বীজ। এইসব অতি উৎসাহীদের বিরুদ্ধে এখনই ব্যবস্থা না নিলে, এরা আজ মুশতাক-তিশাকে বইমেলা থেকে বের করেছে, কাল আমার লেখা পছন্দ না হলে আমাকে বের করে দেবে, পরশু আরেকজনের লেখা পছন্দ না হলে তাকে মেলা থেকে বের করে দেবে! এটা অশনি সংকেত।
অনেক লেখক-প্রকাশক ভীত হয়ে পড়েছেন এই ভেবে যে মুশতাক-সাবরিনাদের মতো এসব ভাইরাল লেখকরা এভাবে বইয়ের বাজার দখল করে নিলে তাদের বই বেচা-বিক্রির কী হবে? অনেকে এইসব ভাইরাল লেখক ও তাদের পাঠকদের রুচি-শিক্ষা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। মেলার পরিবেশ খারাপ হচ্ছে ভেবে শঙ্কিত হচ্ছেন। আচ্ছা মেলার পরিবেশ কি এবারই প্রথম খারাপ হয়েছে? পাঠকের রুচি-শিক্ষার মান কি এবারই নিচে নেমে গেছে ভাইরাল লেখকদের কারণে? এত অল্প সময়ে মানুষের শিক্ষা-সংস্কৃতি-রুচির মানদণ্ড নিচে নেমে যায়?
মেলার পরিবেশ খারাপ হয়েছে প্রায় সাড়ে তিন দশক আগে, পাঠকের শিক্ষা-সংস্কৃতি-রুচির মান নিচে নামতে শুরু করেছে সেই সাড়ে তিন দশক আগে, মেলার পরিবেশও নষ্ট হতে শুরু করেছে সাড়ে তিন দশক আগে থেকেই। আর এই অবনমনের শুরুটা হয়েছে প্রথমে ইমদাদুল হক মিলন, তারপর হুমায়ুন আহমেদের হাত ধরে। এরা দুজন বছরের পর বছর নিকৃষ্টশ্রেণির বড় গল্প আর নভেলা উপন্যাসের নামে পাঠককে গিলিয়েছেন! গণরুচিকে প্রাধান্য দিয়ে বই লিখেছেন। তাদের বইয়ের পাঠক সামগ্রিকভাবে বাংলা সাহিত্যের পাঠক নয়। এরা অপাঠক। কেউ হয়ত এদের একটা-দুটো নিন্মমাঝারি মানের বইয়ের নাম উল্লেখ করে ভালো লেখা দাবী করবেন। যদি সেই একটা দুটো নিন্মমাঝারি লেখাকে ভালো লেখা বলে ধরেও নিই, তাহলেও একথা সত্য যে ওই একটা দুটো লেখার বিপরীতে চল্লিশটা নিকৃষ্ট বই লিখেছেন শুধুমাত্র টাকার লোভে। একজন সৃজনশীল লেখক বা শিল্পীকে অপরাধ করতে কাউকে প্রহার করতে হয় না, মানুষ খুন করতে হয় না, শিল্পী অপরাধ করে তার সৃজনের মধ্য দিয়ে। হুমায়ুন আহমেদ আর ইমদাদুল হক মিলন যেটা করেছেন, সেটা- সাংস্কৃতিক অপরাধ। শুধুমাত্র টাকা রোজগার করার জন্য বছরে আট-দশটি নিকৃষ্ট বই প্রকাশ করেছেন। কারো টাকার যদি খুব অভাব-ই থাকে, তাহলে সাহিত্য-সংস্কৃতি ধ্বংস না করে, যৌনকর্মী বা জিগোলোর পেশা বেছে নেওয়া উচিত, তবু সাহিত্য-সংস্কৃতি ধ্বংস নয়। তাদের এই অপরাধ আরও উস্কে দিয়েছে দেশের গণমাধ্যম। আজকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক-মানবিক যে অবনমন ঘটেছে, এর পিছনে গণমাধ্যমের বিরাট ভূমিকা আছে। পরবর্তীকালে যখন গণমাধ্যমের সংখ্যা হু হু করে বেড়েছে, তখন তারা বহু অলেখককে বড় লেখক, অশিল্পীকে খ্যাতিমান শিল্পী বানিয়ে একেকটি ঘরানা তৈরি করেছে! অন্যপ্রকাশ নামে সাহিত্য-সংস্কৃতি-পাঠক ধ্বংসকারী একটি প্রকাশনী, যাদের মানায় মাংস কিংবা কাওরানবাজারের কাঁচা মালের আড়তের ব্যবসায়, অথচ তারা চলে এসেছে বইয়ের ব্যবসায়, কিন্তু বইয়ের ব্যবসা তো অন্য পাঁচটা ব্যবসার মতো ব্যবসা নয়, শিল্পের প্রতি দায় থাকতে হয়, সৎ থাকতে হয়। অন্য প্রকাশ বছরের পর বছর কাগজের পেয়ালায় পাঠকের হাতে তুলে দিয়েছে শব্দের বিষ! এখনও দিচ্ছে!
মনে পড়ে যখন শুধু বাংলা একাডেমিতে মেলা হতো, তখন যে গলিতে অন্যপ্রকাশের স্টল থাকত, ভিড়ের চোটে সেই গলি দিয়ে যাওয়াই দুষ্কর হতো। না, রোজই হুমায়ুন আহমেদ বা ইমদাদুল হক মিলন অন্যপ্রকাশের স্টলে থাকতেন না, রোজ থাকতেন সেই যুগের আরেক ভাইরাল লেখক প্রণব ভট্ট। তার অটোগ্রাফ নেবার জন্যও তুমুল ভিড় হতো! আর আশপাশের গলিতেই দেখতাম আগামী প্রকাশনীর স্টলে হুমায়ুন আজাদকে, কখনও কখনও দেখতাম সময় প্রকাশনীর স্টলে সেলিনা হোসেনকে, সেখানে কোনো ভিড় থাকত না, কদাচিৎ দু-চারজন পাঠক দাঁড়াত। কাছে গিয়ে কথা বলার সাহস হতো না বলে আমি দূর থেকে শ্রদ্ধাভরে-নয়নভরে দেখতাম হুয়ায়ুন আজাদ আর সেলিনা হোসেনকে। তখন আমার ঊনিশ-বিশ বছর বয়স, কিন্তু কখনই ওই মাছির মতো ভিড় আমায় টানেনি, কখনই হুমায়ুন আহমেদ-ইমদাদুল-প্রনবের মতো পাঠকবেষ্টিত হয়ে থাকা বা তারকাখ্যাতি পাওয়ার নেশা আমায় গ্রাস করেনি। সেই বয়স থেকেই বেছে নিয়েছি নির্জনতার পথ।
যাইহোক, মিডিয়াকে ব্যবহার করে অনেক অলেখককে লেখক বানিয়েছে অন্যপ্রকাশ। ২০২০ সালে এস এম রইজ উদ্দিন আহম্মদ নামে একজন সাহিত্য বিভাগে স্বাধীনতা পুরস্কার পেয়েছিলেন, পরে সমালোচনার মুখে রাষ্ট্র পদক তালিকা থেকে তার নাম বাদ দেয়। তিনি ছিলেন একজন আমলার বাবা। আমার স্মৃতি যদি আমার সাথে প্রতারণা না করে, নিন্মমানের কবিতায় ঠাসা তার কবিতার বইটি প্রকাশ করেছিল অন্যপ্রকাশ। অন্যপ্রকাশের মতো এইরকম আরও অসংখ্য প্রকাশনী এখন আছে, যারা প্রতিনিয়ত জন্ম দিয়ে চলেছে এযুগের প্রণব ভট্টদের! আজকের এই ভাইরাল লেখকদের একদিনে জন্ম হয়নি, একটা ধারাবাহিক অবনমিত প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে পাঠকের মনন তৈরি হয়েছে, আজ তার-ই বিস্ফোরণ ঘটছে, কিন্তু এটাই তো ঘটার কথাই ছিল, তাই না! সর্বক্ষেত্রে এখন চলছে ধ্বংসের কাল। হায় বাঙালি, কাগজের পেয়ালায় শব্দের বিষ পান করে নীল হিংস্র হয়ে উঠেছ!
ফেব্রুয়ারি, ২০২৪