
বিকাল বেলা স্কুল থেকে বাসায় ফিরতেই আমার ছোট ফুফু খুব এক্সাইটেড হয়ে বলল, মিথী,জলদি দেখো বাসায় কে এসেছে!
কে এসেছে এটা জিজ্ঞেস করার সুযোগ না দিয়েই আমার কাঁধ থেকে ব্যাগ টেনে নিয়ে ফুফু ভেতরে চলে গেলেন। আমি ডাইনিং রুমে চেয়ারে বসে জুতোর ফিতা খুলতে খুলতে কিছুটা আন্দাজ করার চেষ্টা করলাম ভেতরে কে হতে পারে!
ড্রইং রুম থেকে দাদীর খুব আনন্দমাখা একটা গলা শোনা যাচ্ছে আর সেইসাথে একজন অপরিচিত মানুষের খুব বিনয়ী কথার শব্দ। কে হতে পারে! মোজা-জুতো খুলে আমার রুমে যাওয়ার আগেই হালকা করে পর্দা সরিয়ে ড্রয়িংরুমে একটা উঁকি দিলাম। আমাকে দেখতে পেয়ে খুশিতে ডগমগ হয়ে দাদী বললেন, 'এই তো বাবা তোমার ছাত্রী চলে এসেছে।'
আমি সালাম দেওয়ার পর তিনি অবাক চোখে আমাকে দেখে নিয়ে উচ্ছাসিত কন্ঠে দাদীকে বললেন, 'কি বলেন খালাম্মা! এটা মিথী!'
নিজের চোখকে কিছুতেই যেন বিশ্বাস করতে পারলেন না। তাই কিছুটা বিড়বিড় করে আমার দিকে তাকিয়ে হেসে আরেকবার বললেন, 'ওহ্! তুমি মিথী! কত্ত বড় হয়ে গেছ। আমাকে চিনতে পেরেছো?'
আমি একটু বিব্রত হয়ে গেলাম। সাথে একটু লজ্জাও পেলাম। এক ঝলক তাকিয়ে সামনে বসা মানুষটাকে দেখলাম। ফর্সা, চশমা পড়া, একটু স্বাস্থ্যবান, মধ্যবয়সী একজন ভদ্রলোক।
মাথা নীচু করে আমি শুধু না বোধক হালকা করে মাথা নাড়লাম।
আমার দাদী হৈ হৈ করে উঠল- 'আরে! এটাতো আতিক, তোমার ছোটবেলার টিচার। তোমার প্রথম টিচার ছিলো এই আতিক। তোমাকে যে কত আদর করত জানো? কোনদিন হাতে করে তোমার জন্য কিছু একটা না নিয়ে তোমাকে পড়াতে আসেনাই। তুমি একবার ওর নাকে এমন জোরে পেন্সিল বক্স দিয়ে ব্যথা দিয়েছিলে, রক্ত বের হয়ে সে কি অবস্হা! কি যে আদর করত তোমাকে আর এখন তোমার মনে নাই!'
আমি আরো লজ্জায় পড়ে গেলাম। স্যার এবার হেসে উঠে দাদীকে বললেন, 'এই কথাটা আপনার মনে আছে খালাম্মা?'
দাদী বললেন, 'মনে থাকবেনা কেন বাবা? তুমি ওকে কতটা আদর করেছে সেটা কি ভুলে যাওয়ার মত? আমারতো প্রায় সময়ই তোমার কথা মনেহয় বাবা।'
দাদী আরো উৎসাহ নিয়ে আমাকে মনে করিয়ে দিতে লাগলেন, 'তোমার জন্মদিনের ভিডিওটাতেও তো ও আছে। পাগল ছেলেটা কি করেছিলো জানো! তোমাকে নিয়ে অনেকগুলো মিষ্টি মিষ্টি ছড়া লিখে উপহার দিয়েছিলো তোমাকে। কি যে আদর করতো তোমাকে!'
স্যার নিজেই এবার একটু লাজুক হেসে বললেন, ' ওর তো মনে থাকার কথাও না খালাম্মা। ওতো তখন ছোট্ট একটা বাচ্চা।'
আমি এতক্ষণে একটু মুখ তুলে স্যারের দিকে তাকালাম। চেহারাটা এখন একটু একটু পরিচিত লাগছে। আমার পঞ্চম জন্মদিনের অনুষ্ঠানে করা ভিডিও-তে দেখা চেহারাটা একটু যেন পরিষ্কার হল আমার কাছে। তখন এই চশমাটা ছিল না। আর গঠণটাও আরেকটু হালকা পাতলা ছিল। স্যার আমাকে বললেন, 'এখন তো ক্লাস এইটে পড়। কেমন লাগে পড়াশুনা?'
আমি মাথা নীচু করে হেসে বললাম, 'জ্বি, ভালো।'
তিনি এবার একটু জোরে হাসলেন। আনমনেই যেন বললেন, 'তখন তুমি পড়াশুনা নিয়ে কি-যে মর্জি করতে! চেয়ার টেবিলে কখনো পড়তে বসোনি। তোমাকে আমি কোলে নিয়ে বাগানে ঘুরতাম আর বর্ণমালা শেখাতাম। ছড়াগুলোও এভাবেই শিখেছো। কোলে না বসালে লিখতেও চাইতে না। খুব মিষ্টি একটা বাচ্চা ছিলে তুমি। ওভালটিন চকলেট আনতাম তোমার জন্য। তুমি খুব পছন্দ করতে। আর দোকানে নিয়ে গেলে গ্লুকোজ বিস্কুটেরর প্যাকেটটা ধরতে। তোমার মনে নাই হয়ত:। মনে থাকার কথাও না অবশ্য।'
এবার আমি আরেকটু লজ্জা পেলাম। এমন অনেক সুন্দর কিছু স্মৃতিচারণের পর স্যার আমাকে বললেন, 'গল্পের বই পড় তুমি?'
আমি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়তেই খানিকটা উদাস কন্ঠে স্যার বললেন, 'রবীন্দ্রনাথের কাবুলিওয়ালা গল্পটা পড়েছো তুমি?'
আমি বললাম, 'জ্বি'।
আমাকে অবাক করে দিয়ে স্যার বললেন, 'এই গল্পটা আমাকে তোমার কথা মনে করিয়ে দেয় মিথী। আমার জন্য তুমিই ছিলে ঐ ছোট্ট মিনি। মজার ব্যাপার দেখো, কাবুলিওয়ালা জেল থেকে ফিরে আসার পর মিনি তাকে চিনতে পারে নাই। আজ তুমিও আমাকে চিনতে পারোনি'।
একটু থেমে স্যার বললেন, 'আমার কাছে তুমি এখনো সেই ছোট্ট মেয়েটা, যে সবসময় মিনির মত আমার সন্তানতূল্য হয়ে থাকবে। মিনিকে কাবুলিওয়ালা তার দেশে ফেলে আসা মেয়ের স্হান দিয়েছিল, পড়েছো তো! আমি তোমাকে তেমন করেই ভালবেসেছি সবসময়'।
কথাগুলোর শেষদিকে স্যারের গলাটা খুব বিমর্ষ লাগছিল। আর ততক্ষণে আমার চোখে পানি চলে এসেছে। আমি প্রাণপণ মাথা নিচু রেখে চেখের পানি লুকাতে লাগলাম। কতগুলো চকচকে লাল,সবুজ ওভালটিন চকলেটের মোড়ক আর গোলাপি প্যাকেটে একগোছা আঙ্গুরের ছাপাওয়ালা গ্লুকোজ বিস্কিটের প্যাকেটের ছবি মনে হতেই কেমন একটা অপরাধ বোধে আচ্ছন্ন হয়ে গেলাম।
এই মানুষটাকে কেন আমি এক দেখাতেই চিনলাম না!
আমার জন্য তিনিও সেই কাবুলিওয়ালার মত কষ্ট পেলেন। নিজেকে খুব অপরাধী লাগছিল। এখনো এমনটাই অনুভব করি। ক্ষমা কি চাওয়া উচিৎ ছিলনা আমার! তারপরও কেন যে ক্ষমা চাওয়া হয়নি! কেন যে মুখ ফুটে বলতে পারিনি- এখন আমার মনে পড়েছে স্যার। আপনাকে আমি চিনতে পেরেছি। কাবুলিওয়ালার মত মনে কষ্ট চেপে আপনাকে আমি কিছুতেই যেতে দেবোনা স্যার!
কিছুই বলা হয়নি।শুধু চলে যাওয়ার সময় পায়ে হাত ছুঁয়ে সালাম করেছিলাম। স্যার বলেছিলেন, 'যোগাযোগ রেখো'।
স্যার আমার দাদীর কাছে উনার ঠিকানা আর ফোন নাম্বার লিখে দিয়েছিলেন। মাঝে মাঝে স্কুল থেকে ফিরে শুনতাম স্যার ফোন করছিলেন।খুব ভাল লাগত আমার।
আবার যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেল। এনালগ ফোনগুলো ডিজিটাল হয়ে যাওয়ায় ল্যান্ড ফোনের নাম্বার বদলে গেল। ঠিকানাটাও কোথায় রেখেছেন একসময় ভুলে গেলেন দাদী। আরেকবার হারিয়ে ফেললাম জীবনের আরেকজন পিতৃতুল্য, পরম শ্রদ্ধেয়, প্রিয় একজন, আমার জীবনের প্রথম শিক্ষক। ছোটবেলার পরম বন্ধু। আমার অনেক প্রিয় কাবুলিওয়ালা।
প্রাত্যহিক ব্যস্ততায় তেমনভাবে সারাবছর মনেও পড়েনা আজকাল এতটাই অকৃতজ্ঞ আমি। তারপরও বছরঘুরে শিক্ষক দিবস যখন আসে, তখন কেন যেন এই মানুষটার চেহারাটাই সবার প্রথম আমার মনে ভেসে ওঠে। সহস্র কৃতজ্ঞতা আপনার প্রতি স্যার, আমাকে এতটা আপন ভেবে মনে ঠাঁই দেবার জন্য। এতটা স্নেহ আর ভালোবাসা দেবার জন্য। আপনার এই ভালবাসার ঋণ আজীবন মাথা পেতে বয়ে বেড়াব আমি।
ছবি কার্টেসি : গুগল
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা সেপ্টেম্বর, ২০২০ সকাল ১০:৫৭

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




