কখনো যদি জ্বর আসে, দাদীকে অনেক মিস্ করি। জ্বর কম হোক অথবা বেশি, বিছানাতে মাথার নীচে প্লাস্টিকের রাবার ক্লথ বিছিয়ে তারউপর শুইয়ে দিয়ে মগ অথবা এ্যালুমিনিয়ামের বদনার নল দিয়ে মাথায় ঠান্ডা পানি ঢালা আর ভালবেসে মাথায় হাত বুলানো। ওহ্! কি অদ্ভুত শান্তি! প্রায়ই আমি মাথার তালুতে সেই ঠান্ডা পানির প্রবাহটা খুব মিস্ করি। দাদীর মধ্যে আরেকটা ব্যাপার ছিল তা হল জ্বর হলে কিছুতেই ভাত খেতে দিতেন না। জ্বর মানেই স্যুপ খাওয়া আর সেই সাথে পাউরুটি। আর একটু পর পর এক চুমুক করে হলেও লেবুর শরবত অথবা ডাবের পানি খেতে হত। আমাদের কারোর বিশেষ করে আমার গায়ে জ্বর দেখা দিলেই বাসায় সাথে সাথে চলে আসত চায়না জাংশন রেস্টুরেন্ট এর থাই স্যুপ, অলিম্পিয়া পাউরুটি, কলা এবং মাখন। পাউরুটির প্যাকেটের সাথে এক ফ্লাক্স গরম পানি আর হরলিক্সের বয়াম সারারাত আমাদের বেডসাইড টেবিলে রাখা থাকত যেন রাতে যেকোন সময় ঘুম ভাঙ্গলে সাথে সাথে দাদী আমাকে কিছু একটা খাওয়াতে পারেন। এগুলোতেও তার শান্তি ছিলনা, একটু পরপর উনার অনবরত জিজ্ঞাসাবাদ ছিল - ' ও দাদন! একটু চিন্তা করে দেখো তো, কি খেতে মন চায়!' আরো কত্ত কত্ত ভালবাসা!...
রাতের বেলা ইলেক্ট্রিসিটি চলে গেলে গরমে যখন ঘুম ভেঙ্গে যায়, খুব করে দাদীকে মনে পরে। ছোটবেলায় এমন হলেও কখনো গরম লাগত না। ইলেক্ট্রিসিটি চলে গেল কিনা টেরও পেতামনা। গরম লাগার আগেই হাতপাখা দিয়ে দাদী বাতাস করতে থাকতেন।
খুব মনে পরে সেই ছোট্ট ফর্সা, সুন্দর মুখটা। সবসময় পান খাওয়া লাল টুকটুকে ঠোঁটটা। আমি দাদীকে ডাকতাম টিয়াপাখি বলে। আমার প্রাণের টিয়াপাখি। আমার জন্য দাদীর একটা এক্সট্রা টান ছিল সবসময়। আসল কথা টানটা ছিল দাদাজানের প্রতি। খুব ভালবাসা ছিল দুজনের। দাদাজানের মৃত্যুর পর আমার দাদী খুব বেশি মানসিক বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েন। একদম চুপচাপ হয়ে যান। উনাকে সামলানো সবার জন্য খুব কঠিন হয়ে গিয়েছিল। দাদাজানের চলে যাওয়ার দুই বছর পর আমার জন্ম হয়। সেই গায়ের রঙ, সেই চেহারা নিয়েই নাকি আমার জন্ম। আমাকে কোলে নিয়েই নাকি দুই বছর পর আমার দাদী হেসেছিলেন। সেই থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আমাকে ডাকতেন 'খন্দকার সাহেব' বলে।
দাদীর বিয়ের গল্পটা মনে পড়ে গেল। কুষ্টিয়ার কুমারখালি উপজেলার মধুপুর গ্রামের সম্ভ্রান্ত পরিবারের খুব সুন্দরী মেয়ে ছিলেন আমার দাদী। আমার দাদা তখন সরকারী উচ্চপদস্হ কর্মকর্তা। ভাল বংশের শিক্ষিত ছেলে পেয়ে খুব খুশি হয়ে দাদীর বাবা ধুমধাম করে মেয়ের বিয়ের আয়োজন করে ফেললেন। ঘটনা অন্য দিকে মোড় নিল বিয়ের দিন যখন দাদীর মা আমার দাদাকে প্রথম দেখলেন। উনার এত সুন্দর আদরের মেয়েকে এমন কালো ছেলের সাথে কিছুতেই বিয়ে দেবেন না তিনি। এদিকে দাদীর বাবাও এত ভাল পাত্র হাতছাড়া করতে নারাজ। কিভাবে যেন কথাটা আমার দাদা জেনে গেলেন। মুরুব্বীদের আপত্তি সত্ত্বেও আমার দাদা তখন সাফ জানিয়ে দিলেন আমার দাদীর সাথে তিনি সরাসরি দেখা করতে চান এবং দাদীর অমত থাকলে এ বিয়ে তিনি করবেন না। তখনকার সমাজ ব্যবস্হায় ব্যাপারটা একটু অন্যরকম ছিল। শেষমেশ আমার দাদাকে সরাসরি দেখে, কথা বলার পর দাদী বিয়েতে মত দিলেন। যদিও আমার দাদীর বিয়ে পড়ানোর সময় অন্যদিকে নাকি তার মায়ের মাথায় পানি ঢালা হচ্ছিল।(হাহাহা):p
দাদীকে পরে জিজ্ঞেস করেছিলাম, 'আপনি কেন রাজী হলেন দাদী?'
দাদী বলেছিলেন, 'মানুষটার গায়ের রঙ কালো। এটাতো কোন দোষ হতে পারেনা। তাছাড়া আমার মতামত চেয়ে যে সম্মান আমাকে দিয়েছিলেন সেটাই আমাকে মুগ্ধ করেছিল'।
দাদাজান সত্যিকার ভাবেই দাদীকে কখনো অসম্মানিত হতে দেননি। বিয়ের পর দাদীর কিছু একটা শারীরিক সমস্যা থাকায় সন্তান হতে দেরী হয়েছিল। গ্রামের মানুষ আর আত্মীয়- স্বজনদের কাউকে কখনোই দাদীকে কিছু বলার সুযোগ দেননি দাদাজান। ইন্ডিয়া, পাকিস্তান যখন যেখানে পোস্টিং ছিল সেখানেই দাদীকে নিজের কাছে রেখেছেন। লেখাপড়া করিয়েছেন। চিকিৎসা করিয়েছেন। অবশেষে কলকাতার কোন এক মিশনারী হাসপাতালের সফল চিকিৎসায় বিয়ের আট বছর পর এবং সর্বোমোট নয়টি অপারেশন শেষে প্রথম সন্তানের মুখ দেখেন এই দম্পতি। এরপর অবশ্য আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। চার ছেলে, চার মেয়ে, ছেলেদের বউ, মেয়েদের জামাই ছাড়াও একগাদা নাতি নাতনী নিয়ে রূপকথার মত সুখের জীবন কাটিয়েছেন একসাথে।
এত সুন্দরী ফুটফুটে মহিলার আটটি সন্তানেরই গায়ের রঙ কালো। নাতি- নাতনীও সব কালো। যে কালো নিয়ে এক সময়ময় বেচারীর বিয়ে ভেঙ্গে যাচ্ছিল আমি সেটা নিয়েই দাদীকে খোঁচাতাম। 'ও দাদী! আপনার মা তো আমাদের সবাইকে দেখলে স্ট্রোক করেই মারা যেতেন।'
দাদী খিলখিল করে হাসতেন। বলতেন, 'না রে দাদন। অনেক আদর করত তোমাদের পেলে। পরে তো তোমার দাদাজানকে ক-ত ভালবেসেছেন!' দাদী যখন এই গল্পগুলো করতেন তার চোখগুলো সুখ স্মৃতিতে চকচক করত। আমরা নাতী নাত্নীরা দাদীর কোলে শুয়ে, পিঠে হেলান দিয়ে কত ঠাট্টা তামাশা করতাম।
সব কিছু মনে পড়ে দাদী।
আর মনে পড়ে আপনাকে নিয়ে কাটানো প্রতিটা মা দিবসের কথা।
মা দিবস মানেই আমাদের বাসায় ছিল এক প্রকান্ড আয়োজন। দাদীর সব ছেলে মেয়ে আর নাতী নাতনীরা সবাই মিলে দাদীকে ঘিরে সারাদিন ধরে হৈ চৈ। সাধারণত দাদী রান্না না করলেও ঐদিন দাদী নিজ হাতে সবার জন্য ইলিশ খিচুড়ী রাঁধতেন। এটা ছিল দাদীর হাতের স্পেশাল ডিশ। আমরা সবাই আঙ্গুল চেটে চেটে খেতাম। আহ্! কি অদ্ভুত স্বাদ! ভাবলেই সেই সুঘ্রাণ আমি এখনো পাই।
আরেকটা ঘ্রাণ আমি চোখ বন্ধ করলেই পাই।
দাদীর বুকের এক অদ্ভুত মিষ্টি ঘ্রাণ।
আনন্দ,কষ্ট, অভিমানে আমার বাবা, চাচা,ফুফু সহ আমার মা, চাচীরা এমনকি আমরা ভাই-বোনেরা বিভিন্ন সময় মুখ গুজে রাখতাম যেখানে, কিভাবে ভুলি সেই ঘ্রাণ! মানুষটা আমাদের রেখে চলে গেছে সেই ২০১২ সালের ২৪ শে সেপ্টেম্বর। ঘ্রাণটা আর ভালবাসার স্মৃতিগুলো এখনো যেন অমলিন। এত ভালবেসে সবাইকে জড়িয়ে রাখতে সবাই পারেনা।
আরো একটা গোপন কষ্ট আছে আমার। আমার সংসার, আমার সন্তানকে দাদী দেখে যেতে পারেন নি। তবে আমি জানি, উনার দোয়া সবসময় আমাদের সাথেই আছে। খুব জানতে ইচ্ছা করে,পৃথিবী থেকে হারিয়ে যাওয়া আপনজনেরা হারিয়ে গেলে কোথায় যায়! উনারা কি আমাদের দেখতে পায়? আমার কেন যেন মনে হয় উনারা আমাদের দেখতে পান।মনেহয়, দাদী আর দাদাজান ওপারে আবার সুখে সংসার গড়েছেন। নাতী পুতি যাদেরকে দাদাজান দেখে যান নাই তাদেরকে দেখিয়ে দেখিয়ে দাদী দাদার কাছে পরিচয় করিয়ে দেন,নাম ধরে ধরে গল্প করেন। আমাদের মজার সব কর্মকান্ড দেখে দুজনেই একসাথে হাসেন আর পান খান। আমাদের দু:খ দেখলে, দাদী দাদার বুকে মাথা রেখে কাঁদেন,আর দাদাজান দীর্ঘশ্বাস বুকে চেপে আদুরে বউয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দেন। হয়ত: দুজন মিলেই আমাদের জন্যই অপেক্ষা করেন,কখন আমরা একে একে উনাদের কাছে যাব। আর আমাদের পরম মমতায় আদর করে বুকে টেনে নেবেন।
জানি এটা সঠিক না, কল্পনা।তবুও এমন কল্পনা করতে আমার ভাল লাগে। কেন যে এভাবে চিন্তা করি সেটাও জানি না। শুধু জানি খুব মিস্ করি আমার দাদীকে। মিস্ করি কোনদিন না দেখে শুধু দাদীর মুখে শুনে যাওয়া তার ভালোবাসার মানুষ আমার দাদাজানকে। কিছুই করার নাই, তাই মনেপ্রাণে দোয়া করি। দোয়া করি খুব ভাল থাকুক হাজার মাইল আকাশের দূরত্বে হারিয়ে যাওয়া আমাদের সকল প্রিয় মানুষ।
২৪.০৯.২০১৭ইং।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা সেপ্টেম্বর, ২০২০ সকাল ১০:৫৮