somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বিবাগী সংসার

১০ ই জুন, ২০১৩ দুপুর ১২:০৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বেশ কিছুদিন আগ পর্যন্তও নিজেকে ডালা বন্ধ হয়ে যাওয়া ঝিনুকের মতো মনে হতো। এখন আর সেরকম মনে হয় না বরং খোলা ঝিনুকের ডালার নীচেও যে একটা নরম শরীর আছে যেখানে রোদ–শিশির ঝরে পড়তে পারে, তেমন সব সুখের অনুভব একটু একটু করে ফিরে আসছে। ডালা বন্ধ হয়ে যাওয়া যে ঝিনুকটা পৃথিবীর আলো থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলো অন্ধকারের দিকে, যে চোখে আলোকরশ্মি পড়লে কেঁপে–কেঁপে উঠতো, নিজেকে গুটিয়ে নিতো, সে ঝিনুকটা কেমন যেন ধীরে ধীরে পাল্টে যাচ্ছে, ঠিক যেমন করে কবিতারাও পাল্টে যাচ্ছে। এখন কবিতায় ঝিনুকের ভুমিকা যতটুকু না থাকে তারচেয়েও বেশী থাকে তাকে ঘিরে হাওয়া-বাতাসেরা, থাকে ছায়ামানবীর পদভারে উদ্ভাসিত। আর সে ঝিনুকটা সম্ভবত আমিই ছিলাম।


“অল্পেই সুখ- অল্পেই তুষ্টি আর অল্পেই মুক্তি” এ কথাগুলো বলে দেখতে চাই পৃথিবীর শান্ত সৌন্দর্য ঝলমল করে উঠেছে, খুব করে চাই মানুষের মুখরতার দিন-বদল বয়ে যাক বনমর্মর ধ্বনিতে। দীর্ঘ দুই যুগের অস্বাভাবিক শীত-ঘুম কিংবা আত্মবিস্মৃতির শেষে খুব ইচ্ছে করে এখন নতুন করে জীবন শুরু করি, মানুষ হয়ে শেষ দিনটুকু বেঁচে থাকি। জানি না কোন স্থির প্রণোদনায় সেই ইচ্ছেরা হামাগুড়ি দিতে শিখেছিলো। তবে আমি মোটামুটিভাবে ধীর লয়ে রপ্ত করতে শুরু করেছি জীবনের সুরে সুর মেলাতে। হয়তো হৃদয়াবেগই আমার চালিকাশক্তি।


“ মাঝে মাঝে সায়াহ্ন ঝলকে কিছু রঙিন আলো ঝরে পড়ে
কালান্তিক পরাভৃত কিছু বেদনায় টের পাই
আমি হয়তো তোমাদের কেউ নই।
মাঝে মাঝে মধ্যরাতের পূর্ণ চাঁদ
জোছনার ঝালরে-
চন্দ্রলোকের স্থির জলে-
খুব সন্তর্পণে নাড়া দিয়ে যায়-
আরো কোনো গভীরতম বেদনায় হাওয়ায়– হাওয়ায় শিস বেজে ওঠে
আসলেই আমি তোমাদের কেউ কি ছিলাম না !

আমি আর কিছুই চাই না শেষপর্যন্ত
কোনো এক পরজন্মের আকাশের অদৃশ্যতা থেকে
নামিয়ে আনতে চাই কবিতার পসরা।
মাটির নৈঃশব্দ্যে থেকে কারিগর যেমন
ছেঁকে–ছেঁকে আনে শিল্পের নমনীয়তা
তেমনি আদরে আদরে শুন্যতা থেকে
নামিয়ে আনতে চাই কবিতা তোমাকে।

কবিতা! তুমি কি টের পাও
তোমার মাঝে আমার এই লীন হতে চাওয়া ?”


প্রায় সন্ধ্যায়ই আমার বাড়ি ফেরা হয় না। হয়তো এই জলছায়া সন্ধ্যা, পশ্চিমের গোধূলিটান, কাঠবাদাম গাছটায় পাতার সর–সর আওয়াজে কেউ কেউ বাড়ি ফেরে। কিন্তু আমার বাড়ি ফিরতে বেশ রাত হয়ে যায়। আমার জন্য কেউ জেগে রয়’না বলেই হয়তো এতো বিলম্বে বাড়ী ফেরা। আমি না হতে পারলাম গেরস্ত না হলাম উদাসী! দু’পায়ের নীচের যে জমি, লেবুবাগান, হাস্নুহেনার ঝাড় কিংবা মাথার ওপরের ছাদ, যা এখন পরের করুনায় বাঁধা অনিশ্চিত জীবনের নাওয়ে ভেসে চলা, দিনের সমাপ্তি টেনে রাত্রির আগমনে অন্ধকারে মুখ লুকোনো। কেউ চেয়েছিল ভিটে–মাটি, দলিল–দস্তাবেজ করে বুঝে নিতে, কেউ চেয়েছিল রেসিং কার, কেউ চেয়েছিল আত্মজের কাছে হবো চক্ষুশূল। হাহ হাহ হাহ! আমি তোমাদের সবার চাওয়াই পূর্ণ করেছি। যে যা চেয়েছ আমাকে নিংড়ে শেষ নির্যাসটুকু নিয়ে করেছ আমায় নিঃস্ব–সম্বলহীন। এবার অন্তত সময় তুমি আমার হও।

অনেক চাইবার পরে হঠাৎ একদিন রোদ–ঘাস–কাশবনের চাপা নিঃশ্বাস, ঝিনুকের ডালা খুলে পায়ে পায়ে সময়রুপী কবিতা কিংবা কবিতারুপী সময় মন্থর পায়ে এগিয়ে এলো আমার দিকে।

- তুই কে রে মানব সন্তান? আমায় কেন ডাকিস?
- কবিতা, তুমি আমায় তোমার মাঝে একটুখানি ঠাঁই দিবে আমার দহন নেভাতে?
- আহা বাছা, আর ক’টা দিন সহ্য করেই দেখ না সংসারে থেকে। আমজনতা হতে পারিস কিনা?
- আর যে পারি না আমি। দু’ যুগ ধরে জ্বলছি আমি শুধু একটু বাতাসের জন্য। দম ভরে যে নিঃশ্বাস নিতে চাই আমি, বাঁচতে চাই।
- তবে তাই হোক। বর দিচ্ছি তোকে। কবিতায় হোক তোর বসবাস।

ম্লান বেগুনী কোনো অন্ধকারে, মুখচাপা হাসির মতো আওয়াজ তুলে কবিতা আমার আরো কাছাকাছি এগিয়ে এলো। অসম্ভব এক দৈহিক কষ্টের ঢেউ যেন শরীরের এপার–ওপার কেটে দিচ্ছে স্বচ্ছ কাঁচখণ্ড দিয়ে, আবছা মতো শুধু কোমল ঝলকানি টের পেলাম। দুই যুগ পেরিয়ে আমার শোক নমনীয় হয়ে এলো কবিতার আগমনে। দুঃখ তার কান্না হারিয়ে ডুবে গেলো চোরাবালিতে। বৃষ্টি শেষে আকাশ ঝকঝকে নীল হলো। শুরু হলো শিল্পের জন্য আমার সংগ্রাম।

নান্দনিক এক শিল্পের জগতে অনুপ্রবেশ করলাম যেন। শুরু হলো নতুন আমার জন্মবাদ– কবিতায়।

“ গহীন অরণ্যে, নিঃসঙ্গতায় একা যেতে
আর যে ইচ্ছে করে না
শুকনো পাতার ভাঙা নিঃশ্বাসের মর্মর ধ্বনি
আছড়ে পড়ে
কেঁদে মরে
চাপা হাওয়ায়
একজন সঙ্গিনী যে বড্ড প্রয়োজন !”


সময় কিংবা কবিতা তোমরা জেগে আছো কি? আরও একটা বর যে আমার লাগবে। দয়া করো হে বন্ধু আমার!

- বাছা তোর তো ভীষণ লোভ! আবার বর চাইছিস?
- এই – ই শেষ। আর চাইবোনা।
- সঙ্গিনী পেলে কবিতা হারাতে হবে। এখন বল শুধু সঙ্গিনী পেলে কি তোর মন তুষ্ট হবে? ভেবে চিন্তে বল
- আমার যে দুই-ই লাগবে
- হাহ হাহ হাহ! প্রেমের নিভৃত শিল্পে, পন্যে, পিপাসায়, নূপুরের ঝমঝম শব্দে–কবিতা আর নারী যে একসাথে যায় না! কবিতা আর নারী একে অপরের সতীন জানিস না বুঝি তুই?
- একি নিষ্ঠুরতা তোমার! আমাকে সেই নারী এনে দাও যার রন্ধ্রে রন্ধ্রে কবিতা বহমান।
- বাছা, তুই বড্ড লোভী। তবে এই – ই শেষ, মনে রাখিস কিন্তু। বিদায়।


হঠাৎ করেই আমার সামনের সিংহদ্বার খুলে যায়। চেয়ে দেখি সেখানে সীমাহীন শুন্যতার অন্ধকার। আমি চিৎকার করে উঠি। আমার তীব্র অভিমান হয়। একি তবে কবিতার এক ধরনের বঞ্চনা ? যদি আমার জন্য কেউ নাই– ই থাকবে তবে কেন খুলে গেলো দ্বার, কেন রইলাম তবে সঙ্গিনীর প্রতীক্ষায় ! সম্ভবত আমার আক্ষেপ কমাতেই বুঝি ক্রমেই আবছা আবছা অন্ধকারে ছায়ামানবী স্পষ্ট হতে থাকে। ধীর পায়ে এগিয়ে আসতে থাকে আমার দিকে। আমার হৃদস্পন্দন দ্রুত থেকে দ্রুততর হয়, এইযে, যে দৃশ্য আমার চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি তা বাস্তব নাকি স্বপ্ন বলে ভ্রম হতে থাকে। আঙুলে ছুঁয়ে ছায়ামানবীকে স্পর্শ করতেও ভয় হয় যদি সে শূন্যে মিলায়। তবুও দুরন্ত এক অভিলাসে তার মুখ আমি ধরে তুলি আমার দু’ করতলে –

“ ছায়ামানবী!
আমরা ছিলাম নদীর বাঁকের ঘূর্ণিস্রোতে সন্ধ্যেবেলায়
আয়না নিয়ে দেখো আমি তোমার সে নিরুদ্দেশ সখা
তোমার দু’ চোখের কান্না–কান্না জ্বালা,
প্রথম দ্বিধা, প্রথম ছোঁয়া,
গোপন গ্রন্থির এক তুমুল শিহরণ।
চিনতে কি পারছ আমায়? ”


পিছনে পড়ে থাকে পাতার শব্দ, ছায়াপ্রশাখার জটিলতায় দুপুরের নির্জনতা গোধূলিতে গড়ায়, সে শুধু পায়ে– পায়ে তোমাকে আপন করে নিতে ছায়ামানবী– কবিতার স্তুতিতে।
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই জুন, ২০১৩ দুপুর ১:৩১
৩৩টি মন্তব্য ৩৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বারবাজারে মাটির নিচ থেকে উঠে আসা মসজিদ

লিখেছেন কামরুল ইসলাম মান্না, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:৪০

ঝিনাইদহ জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার বারবাজার ইউনিয়নে মাটির নিচ থেকে মসজিদ পাওয়া গেছে। এরকম গল্প অনেকের কাছেই শুনেছিলাম। তারপর মনে হলো একদিন যেয়ে দেখি কি ঘটনা। চলে গেলাম বারবাজার। জানলাম আসল... ...বাকিটুকু পড়ুন

সৎ মানুষ দেশে নেই,ব্লগে আছে তো?

লিখেছেন শূন্য সারমর্ম, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:৪৮








আশেপাশে সৎ মানুষ কেমন দেখা যায়? উনারা তো নাকি একা থাকে, সময় সুযোগে সৃষ্টিকর্তা নিজের কাছে তুলে নেয় যা আমাদের ডেফিনিশনে তাড়াতাড়ি চলে যাওয়া বলে। আপনি জীবনে যতগুলো বসন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

পরিবর্তন অপরিহার্য গত দেড়যুগের যন্ত্রণা জাতির ঘাড়ে,ব্যবসায়ীরা কোথায় কোথায় অসহায় জানেন কি?

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৩:৫৭


রমজানে বেশিরভাগ ব্যবসায়ীকে বেপরোয়া হতে দেখা যায়। সবাই গালমন্দ ব্যবসায়ীকেই করেন। আপনি জানেন কি তাতে কোন ব্যবসায়ীই আপনার মুখের দিকেও তাকায় না? বরং মনে মনে একটা চরম গালিই দেয়! আপনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

গরমান্ত দুপুরের আলাপ

লিখেছেন কালো যাদুকর, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৫৯

মাঝে মাঝে মনে হয় ব্লগে কেন আসি? সোজা উত্তর- আড্ডা দেয়ার জন্য। এই যে ২০/২৫ জন ব্লগারদের নাম দেখা যাচ্ছে, অথচ একজন আরেক জনের সাথে সরাসরি কথা বলতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৃষ্টির জন্য নামাজ পড়তে চায়।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৮



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বৃষ্টি নামানোর জন্য ইসতিসকার নামাজ পড়বে তার অনুমতি নিতে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটির অনুমতি দেয়নি, যার জন্য তারা সোশ্যাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

×