২০১৫ সালের ১৩ এপ্রিল রাতে নিউ ইস্কাটন রোডে একটি গাড়ি থেকে এলোপাতাড়ি গুলি ছোড়া হয়। গুলিতে রাস্তার জ্যামে থেমে থাকা রিকশাচালক আবদুল হাকিম ও সিএনজি অটোরিকশা চালক ইয়াকুব আলী নিহত হয়।
দেশের কোন পত্রিকায় বা মিডিয়ায় খবরটি আসে নি, ই প্রথম আলো, ই ইতেফাক, ই যুগান্তর এখনো আছে। চেক করে দেখুন দেড় মাসেও কোন পত্রিকা এটি নিয়ে কোন খবর ছাপে নি, টিভিতেও আসে নি।
নিহতদের দরিদ্র স্বজনরা এমন কোন বিশেষ ব্যক্তি না যে হই চৈ করবে, মামলা করবে, টাকা খরচ করবে।
তখন ছিল জংগি হামলার বছর, মাত্র দুমাস আগে অভিজিত হত্যা, বিদেশী হত্যা, তাবেলা হত্যা, ব্লগার হত্যার তান্ডোবের বছর। পুলিশ প্রথমে ভেবেছিল জংগি হামলা। পরে বোঝা গেল অন্যরকম।
কোন তাগাদা ছাড়াই পুলিশ নিজেই ইউডি মামলা করলো, (পরে অবস্য নিহত হাকিমের মাতা মনোয়ারা বেগম কে দিয়ে রমনা থানায় অজ্ঞাত পরিচয় কয়েকজনকে আসামি করে মামলা করানো হয়েছিল) তদন্তে কোন কুলকিনারা নেই। এলাকার মানুষজনের ফুটপাতের হকার, এটিএম গার্ড কারো কাছেই জিজ্ঞেস করেও কিছু জানা যায় না, জানলেও পরে পুলিশি ভ্যাজালের ভয়ে, সাক্ষী হওয়ার ভয়ে কেউ বলে না। বলতে চায় না।
কিন্তু কিছু তো জানতে হবে, হত্যার একজ্যাক্ট টাইমটা জানতে হবে, সঠিক টাইমটা জানতে পারলে ভিন্ন ব্যাবস্থা বা ডিজিটাল মাধ্যম থেকে কিছু না কিছু পাওয়া যেতে পারে। আর ডাক্তারি ময়না তদন্ত তো দায়সারা কথা রাত দশটা থেকে রাত দুটার ভেতর কোন এক সময়ে গুলিবিদ্ধ হতে পারে।
টাকা ছাড়া, টাকা প্রাপ্তির আশ্বাস ছাড়া, পরিবারের তাগাদা ছাড়া মিডিয়ার চাপ ছাড়া পুলিশি তদন্ত কি আগায়?
একজন তদন্তকারি অফিসার, এসব ঘটনায় সাধারনত দায়সারা তদন্ত হয়ে থাকে, কোন পক্ষের কাছথেকেই অর্থয়াদায়ের সম্ভাবনা নেই, কার ঠেকা বিনে পয়শায় কাজ করা।
এরপরেও কেমনে কেমনে জানি তদন্ত হতে থাকলো,
ঐ এলাকার বিটিএস এর সব ফোনকল কথপকথন তন্ন তন্ন করে পাবলিকের বিভিন্ন কথা খোজা খুজি করে সেসব থেকেই হত্যার সঠিক টাইম বের করা হল।
যেমন কেউ ফোনে বউকে বলছে " শুনছো এই মাত্র গুলিতে এক রিক্সাওয়ালা মারা গেল ... পোলাটা বাসায় ফিরেছে কি না .. এই রাস্তায় যাতে না আসে" সাবধান করে দেয়া ইত্যাদি বিভিন্ন কথাবার্তা থেকে খুজে হত্যার টাইম বের করা হয়।
এবার সেই টাইম অনুযায়ি এলাকার আসে পাসের বিল্ডিঙ্গের ব্যক্তিগত ভিডিও ফুটেজ খুজে গাড়িটির নম্বর বের করা হল, জনকন্ঠ ভবনে লাগানো সিসি ক্যামেরায় স্পষ্ট গাড়ীটির নাম্বার পাওয়া গেছিল। রেজিষ্ট্রশন দেখে গাড়ীর মালিকের নাম জানা গেল।
ওরেব বাবা! গাড়ীর মালিক তো ভিআইপি!
সরকারি দলের এম্পি পুত। ধরলে চাকরিটাই হারানোর সম্ভাবনা, আর জিজ্ঞেস করলে সেতো অস্বীকার করবে? প্রমান লুকাবে।
তা হলে কি করা যায়। বেচারা ড্রাইভারকেই ধর।
এক রাতে ড্রাইভারকে গোপনে উঠিয়ে এনে পিটিয়ে সব খবর বের করা হয়। গাড়ীতে আরো দুজন আরোহি ছিল তাদেরকেও ধরে এনে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদে সব জানা যায়। ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে ড্রাইভার ও দুই আরোহীকে সাক্ষী হতে বাধ্য করা হয়।
এরপর পুলিশের উর্ধতন মহলের নির্দেশে থানা পুলিশ সকল তথ্যপ্রমান ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)র হাতে তুলে দেয়া হলে ২৪শে মে ২০১৫ মামলার দায়িত্ব গ্রহন করে ডিবি।
এরপর সবকিছু কনফার্ম হয়ে ৩০ মে ২০১৫ রনিকে যখন গ্রেফতার করা হয়, এরপর ৩১ মে প্রথমআলোর প্রথম পৃষ্ঠায় এই প্রথম খবরটি সবাই জানতে পারে। সব প্রমান রেডি ছিল, চার্জশিট দিতে দেরি হয় নি। যতেষ্ঠ প্রমানাদি থাকায় সরকারি মহল কোন বাধা দেয়নি (আওয়ামীলীগে কি নেতার অভাব পরেছে? একটা গেলে হাজারটা আছে) এই ৪ বছরেও বহু চেষ্টা বহু নেতা ধরে বহু তদ্বির করেও বের হতে পারেনি রনি।
আদালত মামলার ঘটনার বিবরণ দিয়ে বলেন, সাক্ষীদের সাক্ষ্য, তদন্ত কর্মকর্তাদের তদন্ত প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায়, ঘটনার দিন সাংসদ পিনু খানের পুত্র মদ্যপান করেছিলেন। তাঁর সঙ্গে ছিল লাইসেন্স করা পিস্তল। তবে তিনি স্বাভাবিক ছিলেন না। তাঁর শিশু সন্তান হাসপাতালে ভর্তি ছিল। রাতে রনির গাড়িটি মগবাজারের দিকে যায়, এর দশ মিনিটের মাথায় উল্টো পথ দিয়ে আবার ইস্কাটনের দিকে আসে।
আসামি বখতিয়ার আলম রনির গাড়ির চালক ইমরান ফকির ওই দিন তাঁর সঙ্গে থাকা আরোহি কামাল মাহমুদ (টাইগার কামাল) এবং জাহাঙ্গীর আলম আদালতে ১৬৪ ধারায় সেদিনের ঘটনার জবানবন্দি দেন। সাক্ষীদের সাক্ষ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, বখতিয়ার আলম রনি তার পিস্তল দিয়েই গুলি ছোড়েন। এই গুলিতেই রিকশাচালক হাকিম ও সিএনজি অটোরিকশা চালক ইয়াকুব গুলিবিদ্ধ হয়েই হাসপাতালে মারা যান। রায়ে বলা হয়, রনি যে পিস্তল ব্যবহার করেছেন তার লাইসেন্স ছিল কিনা সেই মূল কপি আদালতের কাছে উপস্থাপন করতে পারেনি। কতটি গুলি আসামি ব্যবহার করতে পারবেন সেই হিসাবের বিবরণও আদালতের কাছে দিতে পারে নি। তবে পুলিশ পিস্তল সহ ২১টি গুলি আসামির কাছ থেকে উদ্ধার করেছিল।
গত ১৫ই জানুয়ারি রাষ্ট্র ও আসামি পক্ষের যুক্তি উপস্থাপন শেষে ঢাকার দ্বিতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ মঞ্জুরুল ঈমাম রায় ঘোষণার জন্য ৩০শে জানুয়ারি দিন ধার্য করেন।
এর আগে ২০১৫ সালের ২১শে জুলাই রনিকে একমাত্র আসামি করে আদালতে অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দাখিল করেন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) এসআই দীপক কুমার দাস। ২০১৬ সালের ৬ই মার্চ রনির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন ঢাকার দ্বিতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ সামছুন নাহার।
মামলার রায় ঘোষণা ৩ বার পিছিয়ে গেছিল। বোঝা যায় আদালত বিভিন্ন চাপে ছিল।
জজ সাহেবও ছাড়ে নাই। গত ৪ঠা অক্টোবর মামলাটি রায়ের জন্য নির্ধারিত থাকলেও তদন্ত কর্মকর্তাকে পুনরায় সাক্ষ্য দেয়ার জন্য প্রয়োজন মনে করেন আদালত। ওইদিন রায় না দিয়ে ১৭ই অক্টোবর তদন্ত কর্মকর্তার পুনরায় সাক্ষ্য-জেরার জন্য দিন ধার্য করেন ঢাকার দ্বিতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ মঞ্জুরুল ঈমাম।
এ ছাড়া গত বছরের ৮ই মে এ মামলায় রায়ের জন্য দিন ধার্য থাকলেও আদালত মনে করছেন মামলাটির বিষয়ে অধিকতর যুক্তিতর্কের প্রয়োজন আছে। ফলে আদালত স্বপ্রণোদিত হয়ে মামলার বিষয়ে অধিকতর যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের করা প্রয়জন মনে করেন। এ্র পর আদালত সকল যুক্তিতর্ক শুনানি শেষে ৩০শে জানুয়ারি রায় ঘোষণার জন্য তারিখ ধার্য করেন।
আর সরকার পক্ষও চায় নি নির্বাচনের আগে মামলাটির রায়। কোন কারনে আসামী এম্পি পুত্র খালাস পেয়ে গেলে নির্বাচিনের আগে মিডিয়ার হাতে নাস্তানাবুদ হওয়ার সমুহ সম্ভাবনা, নির্বাচনে খারাপ প্রভাব পড়তোই।
৩০২ ধারা (নরহত্যা) সর্বচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড, যাবজ্জীবন কারাদন্ড বা অর্খদন্ডে দন্ডিত যে কোন একটি হতে পারে,
৩০৪ ধারা ( হত্যা উইত মোটিভ, পুর্ব পরিকল্পিত ভাবে হত্যা) - সর্বচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড।
আদালত এ ঘটনায় ৩০২ ধারায় অপরাধ প্রমাণ হওয়ায় সংসদ সদস্য পিনু খানের পুত্র বখতিয়ার আলম রনিকে শাস্তি দেয়া হয়। যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। একই সঙ্গে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা ও অনাদায়ে আরো ৬ মাসের কারাদণ্ডের আদেশ।