"৩৭ নম্বর রোগী কে? ভিতরে যান।"
আজ রোগী তেমন নেই। চেম্বার প্রায় ফাঁকাই বলা যায়।
এসিস্ট্যান্টের ডাক শুনে লালপেরে শাড়ী পড়া একজন অসম্ভব রকমের রূপবতী মহিলা উঠে দাড়াল। দীর্ঘদীন বিলেতে থাকলে চেহারায় যেমন একটা ফর্সা ফর্সা ভাব চলে আসে, মহিলাটির চেহারায় তেমন একটা ভাব আছে । মহিলার বয়স ত্রিশের কোঠায়। চকলেট রংয়ের ফ্রেমের চশমাটা বেশ মানিয়ে গেছে তার চেহারায়। তার চোখ দু'টো যেন তৈরিই হয়েছে চকলেট রংয়ের ফ্রেমে বাঁধা পড়ার জন্য। মহিলাটি কিছুটা দ্বিধা নিয়ে সায়কায়াট্রিস্ট জিব্রান সাহেবের চেম্বারে প্রবেশ করল। সায়কায়াট্টিস্ট জিব্রান সাহেবের কামরাটা বেশ সাজানো গোঁছানো| সৌখিন মানুষ জিব্রান। সৌখিনতার বেশ কিছু চিহ্ন রয়েছে ঘরে| কিছু দামী তৈলচিত্র ঝুলছে দেয়ালে। ফ্লাওয়ার ভাসে কিছু তাজা রজনীগন্ধা রাখা হয়েছে। হালকা ফুলের গন্ধে মৌ মৌ করছে কামরাটা।
মহিলাটি কামরায় ঢুকে একটু ইতস্তত করতে লাগল। যেন কোন ব্যাপারে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে।
রেজস্টার ফাইলে মহিলাটার নাম দেখল জিব্রান। বলাকা চৌধুরী| একটু ভ্রু কুঁচকাল সে। এই ধরণের নাম আগে তেমন শুনেছে বলে মনে পড়ল না তার। অবশ্য আজকাল অনেক ব্যতিক্রমধর্মী নাম চোখে পড়ে তার। আরেকটা তথ্য দেখে সে অবাক হল| মহিলার বয়স বত্রিশ। অসম্ভব রূপবতী। কিন্তু অবিবাহিত। বাঙালী মেয়েরা এত বয়স পর্যন্ত সাধারণত অবিবাহিত থাকে না।
"বসুন মিস বলাকা।"
জিব্রানের কথা শুনে একটু অন্যমনস্ক হয়েই বসে পড়ল বলাকা| আশেপাশে তাকিয়ে আতিপাতি করে কি যেন খুঁজল। জিব্রান একটু চিন্তিত হল। বলাকা কি এনশিটি ডিসঅর্ডারে ভুগছে?
"আপনি কিছু খুঁজছেন মিস বলাকা?"
"একট কঙ্কাল....।"
"কঙ্কাল?"
ভ্রু কুঁচকে ফেলল জিব্রান। কঙ্কাল খুঁজছে সে? ডাক্তারদের চেম্বারে কঙ্কাল থাকাটা খুব অস্বাভাবিক নয়, তবে কঙ্কাল খোঁজাটা কিছুটা অস্বাভাবিক। এমন সময হঠাৎ তার মনে পড়ল, বলাকা কি দেয়ালে ঝুলানো তৈলচিত্রের কথা বলছে?
বাঁ দিকের দেয়ালে একটা তৈলচিত্র ঝুলছে। একটা ঘোড়ার উপর একজন অশ্বারোহী। অশ্বারোহীর হাতে বল্লম। যেন শিকার করতে বেড়িয়েছে। মজার ব্যাপার হল, ঘোড়া এবং অশ্বারোহী উভয়ই কঙ্কাল। এমনকি ঘোড়ার পায়ের কাছেও কিছু হাড়-গোড় পড়ে আছে।
জিব্রান হেসে বলল, "ওহ আপনি ঐ ছবিটার কথা বলছেন? এটা সালভাদর দালির আঁকা একটা বিখ্যাত ছবি-'ক্যাভালো মেটাফিস্কো'। সালভাদর দালির নাম শুনেছেন নিশ্চয়ই? ফরাসী চিত্রশিল্পী| ১৯০৪ সালে জন্মগ্রহণ করেছেন। আসলে আমি ছবি টবির কিছু বুঝি না তেমন। তবে আমার উড বি ওয়াইফ সুজাতা বেশ বোঝে| ওই ছবিগুলো কিনেছে।"
সুজাতার কথা শুনে বলাকার চোখের পাতা একটু কেঁপে উঠল| বিরবির করে বলল,"..হবু স্ত্রী...সুজাতা...।"
সেটা শুনে জিব্রান বলল, "জ্বী, সুজাতা- তার সাথেই আগামী মাসে আমার বিয়ে হচ্ছে।"
বলাকার তেমন প্রতিক্রিয়া হল না।
"তো বলাকা, আপনি কেমন আছেন?"
"ভাল।"
"আপনার কোন একটা সমস্যা আছে। আপনি আমার কাছে এসেছেন...?"
বলাকার ভিতর এতক্ষণ একটা ছন্নছাড়া ভাব ছিল । হঠাৎ করেই সেটা গায়েব হয়ে গেল । অনেক আত্মবিশ্বাসী দেখাল তাকে| বিষয়টা লক্ষ্য করল জিব্রান। এটা ডিসোশিয়েটিভ আইডেনটিটি ডিস-অর্ডারের সিম্পটম। বলাকার সমস্যাটা বেশ জটিল মনে হচ্ছে। "আমার সমস্যাটা হল স্বপ্ন| আমি স্বপ্নে যা দেখি, সেটা বাস্তবে হুবহু ফলে যায়।"
জিব্রান হতাশ হল। এই সমস্যা নিয়েও এ যুগে কেউ সায়কায়াট্রিস্টের কাছে আসে।
"আপনি প্রিমনিশনের কথা বলছেন?"
জিব্রানের মনোভাব বুঝতে পেরে বলাকা বলল, "এত সহজ ভাববেন না| বিষয়টা অনেক জটিল। আমার স্বপ্নের প্রতিটি লাইন হুবহু ফলে যায়। এবং স্বপ্ন থেকে জেগে উঠে আমি হাতে ভবিষ্যতের কোন জিনিস দেখতে পাই।"
"ভবিষ্যতের জিনিস? সেটা কেমন?"
"একটা ঘটনা বলি। একবার আমি স্বপ্নে দেখি যে আমার মামা মারা গিয়েছেন। মানুষ তার লাশের পাশে কান্নাকাটি করছে।লাশের পাশে একটা কাগজ। সেটা হাতে নিয়ে দেখি, একটা ডেথ সার্টিফিকেট। স্বপ্ন এতটুকুই। কিন্তু ঘুম থেকে উঠে দেখি আমার হাতে সত্যি সত্যি একটা ডেথ সার্টিফিকেট। মামার নাম লেখা তাতে। তারিখটা ঠিক এক বছর পরের। 19th June, 2009. মৃত্যুর কারণ লেখা-Suffocation. আমি এই সার্টিফিকেট কাউকে দেখায়নি। কিন্তু ঠিক এক বছর পর ১৯ জুন আমার মামা মারা যায়। কজ অব ডেথও মিলে যায়| শ্বাসকষ্ট । সবচেয়ে মজার ব্যাপার, মামার আসল ডেথ সার্টিফিকেট আর স্বপ্নে পাওয়া ডেথ সার্টিফিকেট হুবহু মিলে এক।"
জিব্রান প্রচন্ড বিস্মিত হলেও সেটা চেহারায় প্রকাশ করল না।
.
.
.
*** *** ***
এই গল্পটা আমি ইন্টারমিডিয়েট ফার্স্ট ইয়ারে পড়ার সময় লিখেছিলাম। এটা খুঁজে পেয়েছি পুরানো ডায়েরিতে। যেমনভাবে ছিল, হুবহু তেমনভাবেই লিখে দিয়েছি। এর পরের অংশ খুঁজে পাইনি। কি ভেবে গল্পটা লিখেছিলাম, সেটা আর মনে নেই এখন। সালভাদর দালির ক্যাভালো মেটাফিস্কো প্রথম দেখেই হয়ত লিখে ফেলেছিলাম এটা।
এই গল্পের পরের অংশ আমার জানা নেই। সেই সময়ের "আমি" হয়ত জানতাম, এই সময়ের আমি জানি না। একটু-আধটু মনে পড়ছে অবশ্য, তবে পরের পর্ব লেখার জন্য একবারেই যথেষ্ঠ নয়। যে যার মত করে কল্পনা করে নিতে পারেন বাকীটুকু।
সংযোজন: পর্ব-২
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে অক্টোবর, ২০১৪ সকাল ১০:৪৮

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




