বাংলাদেশের একমাত্র যাযাবর সম্প্রদায় হলো বেদে। বৈদ্য থেকে বেদে শব্দটির উদ্ভব। সাধারণত: অধিকাংশ বেদে পুরুষ এবং নারী নানা রকম ঝড়িবুটি এবং টোটকা চিকিৎসার সাথে জড়িত বলে এদের নাম হয়েছে বেদে বা বাইদা। এই সম্প্রদায়ের লোকেরা মোট নয়টি শাখায় বিভক্ত। এগুলো হলো- লাউয়ো, চাপাইলা, বাজিকর, বেজ, গাইন, মেল্লছ, বান্দাইরা, মাল ও সাপুড়িয়া। এর মধ্যে মেল্লছ গোষ্ঠীর বেদেরা কুকুরের মাংস ভক্ষণ করে থাকে। তারা একটা কুকুরকে মেরে তার চামড়া এবং নাড়িভুড়ি ফেলে দেয়, এরপর মৃত কুকুরের পেটের ভিতর ভিজানো চাল, মশলা এবং অন্যান্য উপাদান ঢুকিয়ে ঐ কুকুরটিকে আগুনে পুড়িয়ে কাচু দিয়ে কেটে কেটে সবাই মিলে খায়। এ কারণে অন্যান্য বেদের সাথে মেল্লেছদের বিয়ে-শাদী বা সামাজিক আদান-প্রদান নাই বললেই চলে। শুধু মেল্লছ গোষ্ঠীর সাথেই মেল্লছ গোষ্ঠীর বিবাহ হয়। বেদে সম্প্রদায়ের অন্যান্য গোষ্ঠীর বিবাহ মুসলিম ধর্মীয় মতে হলেও তাদের রীতিনীতি বিচিত্র। বেদেদের বিয়ের আগে হবুবর একটি গাছে উঠে সবচেয়ে উঁচু ডালে গিয়ে বসে আর কনে দাঁড়িয়ে থাকে গাছের নিচে, কনে বরকে নেমে আসার জন্য বার বার অনুরোধ করা সত্ত্বেও বর নেমে আসে না। তখন সে বরকে প্রলোভন দেখাতে শুরু করে আমি তোমার সংসারের কাজ করবো। শ্বশুর-শাশুড়ির সেবা করবো। ছেলেমেয়েদের লালন পালন করবো।
বর নির্বিকার সে উঁচু ডালে বসেই আছে নামার কোনো লক্ষণ নেই। কনে এবার বলে আমি তোমার বিরুদ্ধে কোনো সময় অভিযোগ করবো না। তুমি যা বলবে তাই শুনবো
বর তবু বসে থাকে
শেষে যখন কনে বলে- তোমাকে আমার ভরণ-পোষণ করতে হবে না, বরং আমিই তোমাকে সারাজীবন রোজগার করে খাওয়াব তখন বর গাছের মগডাল থেকে নেমে আসে- এরপর তাদের বিয়ে হয়। বেদেদের পারিবারিক বন খুব দৃঢ়, তাদের মধ্যে বিবাহ-বিচ্ছেদ সহজে ঘটে না, অবশ্য একাধিক বিবাহ এবং বাল্যবিবাহের প্রচলন এদের মধ্যেও আছে।
বেদিনীরা গ্রামে গ্রামে গিয়ে নানা ধরনের অসুখ-বিসুখের চিকিৎসা করে; তারা দাঁতের পোকা খসায়, রস- বিষ-খসায় এমনকি স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে অমিল থাকলে তাদের মধ্যে মেলবনের জন্য তাবিজ দিয়ে থাকে। বেদে পুরুষেরা পাখি শিকার, সাপ ধরা এবং পানিতে কারো সোনা বা রূপার গহনা হারিয়ে গেলে- টাকার বিনিময়ে সেগুলো খুঁজে দেয়। এরা নৌকা বহরে থাকে, প্রত্যেক বহরের মধ্যে একজন সর্দার বিদ্যমান দেখা যায়। কেউ কোনো অপরাধ করলে সর্দার তার বিচার করে। এ ক্ষেত্রে সর্দারের কাছে দু'পক্ষেরই টাকা জমা রাখতে হয়, যে পক্ষ বিচারে হেরে যায়- সর্দার তার টাকা দিয়ে বহরের লোকজনকে খাওয়ে থাকে। বাংলাদেশের নির্দিষ্ট কিছু জায়গায় বেদে সম্প্রদায়কে দেখা যায়। আবদুল্লাহপুর, মীরকাদিম, চিতলীয়, মাকহাটি এলাকায় বেদেদের আদি বাস ছিলো- এই সব এলাকা থেকেই সম্ভবত তারা ভাটপাড়া, বক্তারপুর, আমিনবাজার প্রভৃতি স্খানে ছড়িয়ে পড়েছে। বেদেরা দাবি করে তারা মোগল আমলে ১৬৩৮ খৃস্টাব্দে আরাকান থেকে এ দেশে এসেছিলো। এ জন্যই তাদের কথায় কিছুটা আরাকানী টান আছে। তারা নিজেদের মধ্যে যখন কথাবার্তা বলে তখন এই টান স্পষ্ট বুঝা যায়। বেদেদের এই নিজস্ব ভাষাকে বলা হয় ঠের। বাংলা সাহিত্যে বেদেদের জীবন নিয়ে নাটক, কবিতা ও গল্প লেখা হয়েছে। পল্লী কবি জসীম উদ্দীনের বেদের মেয়ে গীতনাট্য বেদে সমাজের সংগ্রাম এবং নির্যাতনের জীবন্ত আলেখ্য। বেদেরা যাযাবর একটি উপজাতি হলেও কোনোভাবেই তারা মূল বাঙালি সংস্কৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। এ দেশের প্রতি মমত্ববোধ এবং এ দেশের অন্যান্য সম্প্রদায়কে তারা কোনো সময়ই প্রতিপক্ষ মনে করে না।
(সূত্র: বাংলাপিডিয়া )

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


