আমার খুব প্রিয় একটা মুভি হল Blood Diamond'। কাহিনীর সত্যতা আর ডিক্যাপ্রিওর অনবদ্য অভিনয়ের বদৌলতে ছবিটা আমার সংক্ষিপ্ত কালেকশনে ঢুকে গেছে অনেক আগে।
পাশ্চাত্যের 'উন্নত' দেশগুলোর বড় বড় হীরা আর অস্ত্র ব্যবসায়ীরা কিভাবে তাদের দালালদের মাধ্যমে আফ্রিকায় গৃহযুদ্ধ লাগিয়ে রেখেছে বছরের পর বছর, এই ছবিতে তারই বাস্তবচিত্র ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। ছবিটার এক পর্যায় নায়ক ড্যানি আর্চার (ডিক্যাপ্রিও) আক্ষেপ করে বলেছিল 'God has left this country long ago' অর্থাৎ, বিধাতা বহু আগে এই দেশ ছেড়ে চলে গেছেন। আগে এই স্বগোতক্তিটা ছবির প্রয়োজনে নায়কের ক্যারিশমেটিক ডায়লগ হিসেবেই ভালো লাগত। কিন্তু নাইজেরিয়ার তিন শতাধিক স্কুলছাত্রী অপহরনের ঘটনা এবং এই ব্যাপারে বিশ্ব-মোড়লদের ভূমিকা দেখে এখন মনে হচ্ছে আসলেই বিধাতা অনেক আগেই আফ্রিকার এসব দেশগুলো ছেড়ে চলে গেছেন!
বিগত দশকের শুরুর দিকে যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র টুইন টাওয়ার ধ্বংসের মূল কারিগর আখ্যা (কোন অকাট্য প্রমান কি পেয়েছিলেন কেউ?) দিয়ে ওসামা তথা মুসলিমদের (War against Terrorism!) বিরুদ্ধে অলিখিত যুদ্ধ ঘোষনা করে, তারপর থেকে ওসামাকে ধরার (মারার) জন্য আফগানিস্তানের তোরাবোরা অঞ্চলে সাঁড়াশি আক্রমন চালায় মাসের পর মাস ধরে। কোটি কোটি ডলার খরচ করা হয় এই অভিযানে। এক মিলিয়ন ডলার দামের একটি বোমা ফেলে সর্বমোট একটি (১ টি মাত্র) পাহাড়ী ছাগল হত্যা করার গল্পও শোনা গেছে বাতাসে।
অথচ, নাইজেরিয়ার ইস্যুতে মার্কিন মোড়লদের ভূমিকা কি? অপহরনের প্রায় এক মাস পেরিয়ে যাবার পর মিঃ প্রেসিডেন্ট বিবৃতি দিলেন যে, হতভাগ্য ৩০০ মেয়েকে খুঁজে বের করতে তারা বাহিনী পাঠাবেন, বিশেষজ্ঞ দল পাঠাবেন ইত্যাদি ইত্যাদি। আরো বেশ কিছু ইউরোপীয়ান দেশও একই সুরে গান গাইতে লাগল। এমনকি, জাতিসংঘের সাবেক প্রধান কফি আনান সাহেবও অবিলম্বে উদ্ধারকাজে অংশগ্রহনের জন্য সব মোড়ল দেশগুলোর প্রতি 'আহবান' জানালেন, তাও প্রায় একমাস পরে। ইনি সেই কফি আনান, ৯০ দশকে রুয়ান্ডায় হুটু আর টুটসিদের মধ্যে জাতিগত দাঙ্গা রোধে যিনি চরম ব্যর্থ হয়েছিলেন, যার ফলশ্রুতিতে নিহত হয়েছিল প্রায় সাড়ে আট লক্ষ মানুষ।
আফ্রিকা মহাদেশ, যেখানে গত কয়েক দশক ধরে অগনিত যুদ্ধশিশুর জন্ম হয়েছে, যেই দেশে ধর্ষন যুদ্ধজয়ের একটি 'প্রচলিত' অনুষঙ্গ, সেই দেশে তিন শতাধিক স্কুলছাত্রীকে অপহরনের পর একমাস পার হয়ে গেছে, ওই হতভাগ্য মেয়েগুলোর ভাগ্যে কি হয়েছে, সেটা আমরা তৃতীয় বিশ্বের অতি সাধারন মানুষও দিব্যদৃষ্টি দিয়ে দেখতে পারি। অথচ বিশ্ব মোড়লদের গদাইলস্করি চাল দেখে মনে হয় তাদের তেমন তাড়া নেই।
যারা নিজেদের উদ্দেশ্য পূরনের জন্য পুরো দুনিয়া তোলপাড় করে ওসামাকে খুঁজে বের করতে পারে, মাটির নীচ থেকে সাদ্দামকে তুলে এনে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দিতে পারে, তাদের জন্য ৩০০ হতভাগ্য মেয়ের অবস্থান বের করা কি কঠিন কাজ? ওসামাকে খুঁজে বের করার অভিযান চালানোর সময় তো নির্বিচারে সাধারন মানুষ মেরেছেন আপনারা, এখন তাহলে কেন 'বোকো হারাম' নামের সংগঠনটিকে ধূলোয় মিশিয়ে দিতে আপনারা অপারগ? অপহরনকারীদের নেতা বন্দুক উঁচিয়ে আরো অপহরন করার হুমকি দেয় সদম্ভে, তাকে আপনারা ধরতে পারেন না। এটা কি আদৌ বিশ্বাসযোগ্য? প্রযুক্তির উৎকর্ষতার এই যুগে যেখানে নানা গ্রহে প্রানের অস্তিত্ব খোঁজার প্রয়াস চলে নিরন্তর, সেখানে নিজেদের এই চিরচেনা গ্রহে কিছু মানুষকে খুঁজে পাওয়া কি এতই অসম্ভব কাজ? হারিয়ে যাওয়া মালয়েশিয়ান উড়োজাহাজের খোঁজে তো ১৬ কোটি ডলার ব্যয় করেছেন আপনারা, সব উন্নত দেশগুলো নিজেদের আধুনিক প্রযুক্তির মহড়া দেখিয়েছেন। কিন্তু এই মেয়েগুলোর জন্য আপনারা কত ডলার খরচ করেছেন? কয়টা বোমা ফেলেছেন বোকো হারামের আস্তানায়?
পৃথিবীর সবচেয়ে দুর্ধর্ষ মেরিন সেনা আছে আপনাদের। কুয়েত, ইরাক কিম্বা আফগানিস্তানে তো চোখের নিমেষে ওদের পাঠিয়ে দিয়েছিলেন, তাহলে আফ্রিকাতে কেন মেরিন সেনাদের কোন ব্যবহার নেই? নাকি আপনাদের বিলাসিতার যোগান দেয়ার মত কিছু আর অবশিষ্ট নেই ওখানে, তাই ওদের ব্যাপারে আপনারা শীতল আচরন করছেন?
কি আর বলব। আপনারা বিশ্ব শাসন করেন, তাই আপনাদের উপরে কথা বলার তো উপায় নেই। যাদের সাথে আপনাদের কোন স্বার্থ জড়িত নেই, তাদের ব্যাপারে আপনারা নির্লিপ্ত থাকবেন, এটাই হয়তো স্বাভাবিক।
এইসব কিছু দেখে আসলেই এখন মনে হয় বিধাতা অনেকদিন হল পশ্চিমেই বসত গেড়েছেন। আমাদের তৃতীয় বিশ্বে মাঝে মাঝে আসেন বলে হয়তো আমরা এখনো করে খাচ্ছি, তবে অন্ধকার মহাদেশে যাওয়া একদমই ছেড়ে দিয়েছেন!!