somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

শবে বরাত : একটি তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ

২৬ শে জুন, ২০১২ দুপুর ১২:৩৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



প্রিয় মুসলিম ভাইয়েরা!
বছরের ১২টি মাসই আল্লাহ তায়ালার অশেষ দান । প্রত্যেকটি মাসই অতীব গুরুত্বপূর্ন। তবে আল্লাহ তায়ালা নিজেই কতেক মাসকে এক একটি আলাদা বৈশিষ্ঠ্য দিয়ে অন্যান্য মাসের তুলনায় বেশি মর্যাদাবান করেছেন। তম্মধ্যে শাবান একটি অন্যতম মাস। এ মাসের রয়েছে অনেক ফযীলত ও আমল। তবে এই শাবান মাসকে (বিশেষ করে শবে বরাত) কেন্দ্র করে আমাদের সমাজে এমন অনেক আমল প্রচলিত রয়েছে যা সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমানিত নয় বা শরীয়াত সম্মত নয়। তাই সবার অবগতির লক্ষ্যে দলিল প্রমাণ সহ এ মাসের করণীয়-বর্জণীয় সম্পর্কে কিছু কথা পেশ করলাম। আল্লাহ আমাদেরকে এগুলো বুঝা এবং তদানুযায়ী আমল করার তাওফীক দান করুন।

হাদিসের বর্নণায় শা‘বান মাসের ফযীলত ও আমলঃ
১। উম্মুল মুমিনীন আয়েশা (রা.) বলেছেন, আমি রাসুলকে (সা.) রমজান ছাড়া অন্য কোন মাসে মাস ব্যাপী রোযা রাখতে দেখিনি এবং তাকে (সা.) অন্য কোন মাসে শা‘বানের চেয়ে বেশী রোযা রাখতে দেখিনি। (বুখারী, মুসলিম)।
২। উসামা বিন যায়েদ (রা.) বলেন, আমি রাসুলকে (সা.) প্রশ্ন করলাম, আপনাকে আমি শা’বানে যত রোযা রাখতে দেখি অন্য কোন মাসে তো এতো রোযা রাখতে দেখি না? উত্তরে তিনি বল্লেন, এটা এমন মাস যে মাসে আল্লাহ তায়ালার নিকট আমল সমূহ পেশ করা হয়। তাই আমি চাই যে, রোযা অবস্থায় আমার আমল গুলো উপরে যাক। (আল্ফুরু-৩/১২০-হাসান)
৩। রাসুল (সা.) বলেন, তোমরা রমজানের ১/২দিন আগে রোযা রাখবে না। (বুখারী,মুসলিম)
* অতএব, শাবানের ২৮/২৯ তারিখ ছাড়া গোটা মাসেই যথাসাধ্য বেশি বেশি রোযা রাখবো।

শবে বরাতের বিশ্লেষণ
ক) শবে বরাতের ফযীলতঃ
এই রাতের ফযীলতের ব্যাপারে ওলামাদের মাঝে মতবিরোধ রয়েছে। তবে নির্ভরযোগ্য মত হলো একাধিক মরফূ হাদিস ও আসারের মাধ্যমে এই রাতের ফযীলত প্রমানিত। তবে এ বিষয়ে অসংখ্য অতি দুর্বল ও বানোয়াট হাদিসও রয়েছে।
(ইবনে তাইমিয়া রহ. - ইকতিযাউস্সিরাতিলমুস্তাকীম ২/৬৩১)
১। মুয়ায বিন জাবাল (রাঃ) থেকে বর্নিত, রাসুল (সাঃ) বলেছেন, শাবানের মধ্যভাগের রাতে (শবে বরাতে) আল্লাহ তায়ালা তাঁর মাখলুকের প্রতি রহমতের দৃষ্টি দেন এবং শুধুমাত্র মুশরিক ও বিদ্বেষ পোষণকারী ছাড়া সকলকে ক্ষমা করে দেন। (বাইহাকী-৩/৩৮২, ইবনে হিব্বান-১৩/৪৮১) ।
২। উম্মুল মুমিনীন আয়েশা (রাঃ)থেকে বর্নিত রাসুল (সাঃ) বলেছেন, এই হলো অর্ধ-শাবানের রাত। আল্লাহ তায়ালা অর্ধ-শাবানের রাতে তাঁর বান্দাদের প্রতি রহমতের দৃষ্টি দেন এবং ক্ষমা প্রার্থণাকারীদেরকে ক্ষমা করেন ও দয়াপ্রার্থীদেরকে দয়া করেন। (বাইহাকী-৩/৩৮২)।
৩। ইমাম আউযায়ী (রহ.) বলেন, এই রাতে নামায,আলোচনা বা দোয়ার জন্য মসজিদে সমবেত হওয়া মাকরুহ। তবে একাকী মামায পড়তে কোন সমস্যা নেই। (লাতাইফ- ১৪৪)।

খ) শবে বরাতের নামাযঃ
এই রাতে নির্দিষ্ট সংখ্যক রাকাত বা নির্দিষ্ট সূরার বিশেষ পদ্ধতির কোন নামায নেই। দুই-দুই রাকাত করে যে কোন সূরা মিলিয়ে যত রাকাত মনে চায় নফল নামায পড়বে। তবে দীর্ঘ সময় নিয়ে ধীরে ধীরে একাগ্রতার সাথে নামায পড়তে হবে।
১। উম্মুল মুমিনীন আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্নিত, তিনি বলেন, একবার রাসুল (সা.) রাতে নামাযে দাঁড়ান এবং এত দীর্ঘ সেজদা করেন যে, আমি মনে করলাম তিনি হয়ত ইন্তেকাল করেছেন.....(বাইহাকী-৩/৩৮২) সেটা ছিল শবে বরাতের রাত।
২। ইবনে দাহিয়্যা (রহ.) বলেন, শবে বরাতের (বিশেষ পদ্ধতির) নামায সংক্রান্ত হাদীস সমূহ বানোয়াট।(তাজকিরাতুল মাউদুয়াত-৪৫)
৩। ইবনে জাযারী, ইরাকী (রহ.) সহ হাদীসের একদল হাফিজ বলেছেন, শবে কদর, শবে বরাত ও শবে মেরাজের (বিশেষ পদ্ধতির) নামায সমূহ বানোয়াট। ( সুন্নত ও বিদআত-৪৬২)।

গ) শবে বরাতের রোযাঃ
১। ইবনে তাইমিয়া (রহ.)বলেন, বিশেষ ভাবে শুধুমাত্র শাবানের ১৫ তারিখে রোযা রাখা মাকরুহ এবং এর কোন ভিত্তি নেই। (ইকতিযাউস ্সিরাতিল মুস্তাকীম ২/৬৩১) ।
২। আল্লামা তাকী ইসমানী (দা.বা.) বলেন, শাবানের ১৫ তারিখে রোযা রাখার আদেশ সম্বলিত (ইবনে মাযায় বর্নিত) হাদীসটি দুর্বল। তাই শুধুমাত্র এই হাদীসের উপর ভিত্তি করে শাবানের ১৫ তারিখের রোযাকে সৃন্নাত বা মুস্তাহাব বলা অনেক আলেমের দৃষ্টিতেই অনুচিত। তবে শাবান মাস ও আইয়ামেবীয (১৩,১৪,১৫ তারিখ) হিসেবে (আগে-পরে সহ) ১৫ তারিখে রোযা রাখলে সওয়াব পাওয়া যাবে ইনশাআল্লাহ। ( ইসলাহী খুতুবাত)।

ঘ) শবে বরাতের করণীয়-বর্জনীয়ঃ
১। ইমাম ইবনে রজব (রহ.) বলেন, একজন মুমিন বান্দাÍ উচিত, এ রাতে যিকির ও দুআর জন্য পুরোপুরি অবসর হওয়া। প্রথমে খাটি মনে তওবা করবে; এরপর মাগফেরাত ও ক্ষমা প্রার্থনা করবে; আপদ-বিপদ দূর হওয়ার জন্য দুআ করবে এবং নফল নামায পড়বে। সব সময় সেসব গুনাহ থেকে বিরত থাকবে যেগুলো ওই রাতের বিশেষ ফযীলত থেকে মানুষকে বঞ্চিত করে। যেমন শিরক, হত্যা, যিনা, হিংসা ইত্যাদি। (লাতাইফুল মায়ারেফ- ১৫১)
২। ইমাম ইবনুল হাজ্ব (রহঃ) বলেন, “এ রাত যদিও শবে ক্বদরের মত নয়; কিন্তু এর অনেক ফযীলত ও বরকত রয়েছে। আমাদের পূর্বসূরি পুণ্যাত্মারা এই রাতের যথেষ্ট মর্যাদা দিতেন এবং এর যাথাযথ হক আদায় করতেন। কিন্তু আজ সাধারণ লোকেরা বিষয়টিকে সম্পূর্ণ উল্টো করে ফেলেছে। তারা রসম-রেওয়াজ ও কুসংস্কারের পেছনে পড়ে এর খায়ের বরকত ও কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। (আল্মাদখাল-১/২৯৯)।
৩। শায়েখ আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী (রহঃ) বলেন,“এই রাতের নিকৃষ্টতম বেদআতসমূহের মাঝে নিচের বিষয়গুলো অন্তর্ভূক্ত- ঘর-বাড়ি, দোকান-পাটে আলোকসজ্জা করা, খেলাধুলা ও আতশবাজির উদ্দেশ্যে সমবেত হওয়া ইত্যাদি। এগুলো সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন এর সপক্ষে কোন জাল রেওয়ায়েতও কোথাও নেই। প্রবল ধারণা যে, এগুলো হিন্দুদের দেওয়ালী প্রথা থেকে গ্রহণ করা হয়েছে।” (মা-সাবাতা বিস্সুন্নাহ-৩৫৩)

বি: দ্র: ফিকাহর একটি মূলনীতি হল, الاصرار على المندوب يبلغه الى حد الكراهة অর্থ্যাৎ - যে কোন মুস্তাহাব বা মুবাহ আমলের উপর যদি ওয়াজিবের মত গুরুত্ত্ব দেওয়া হয়; অথবা এমন গুরুত্ত্ব দেয়া হয় যাতে করে সাধারণ জনগন সেটাকে সুন্নাত বা ওয়াজিব মনে করতে শুরু করে; তাহলে সেটা মাকরুহ হয়ে যায়। ( তানকীহ-২/৩৩৩, সায়াইয়াহ- ২/২৬৫, ফতোয়ায়ে মাহমুদিয়া - ৫/৪৭০)
অতএব আমরা বিশেষ ভাবে নিম্নের কাজগুলো করব না।
ক. মসজিদে দলবদ্ধ ভাবে কোন আমল করব না।
খ. ওয়াজ মাহফিলের আয়োজন করব না।
গ. দলবদ্ধভাবে কবর জেয়ারত করব না।
ঘ. মাইকে শবীনা পড়ব না।
ঙ. প্রচলিত হালুয়া রুটি খাওয়া বা বিতরণ থেকে বিরত থাকব।
চ. মসজিদে জিলাপী, বিস্কুট ইত্যাদি কোন ধরণের খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করব না ।
সর্বোপরি একাকী নির্জনে যথাসাধ্য নফল এবাদত করতে থাকব। তবে ফজরের জামাত যেন ছুটে না যায়। সে ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করবো।
তথ্যসুত্র : আহসানুল ফাতাওয়া-১০/৮০, ফতোয়ায়ে মাহমুদিয়া - ৫/৪৭০, মাসিক আল কাউসার-সেপ্টেম্বর-২০০৬)
আল্লাহ আমাদের সকলকে উপরোল্লিখিত বিষয়গুলো বুঝা এবং তদানুযায়ী আমলের তাওফীক দান করুন। আমীন !
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জীবন চলবেই ... কারো জন্য থেমে থাকবে না

লিখেছেন অপু তানভীর, ০২ রা মে, ২০২৪ সকাল ১০:০৪



নাইমদের বাসার ঠিক সামনেই ছিল দোকানটা । দোকানের মাথার উপরে একটা সাইনবোর্ডে লেখা থাকতও ওয়ান টু নাইন্টি নাইন সপ ! তবে মূলত সেটা ছিল একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। প্রায়ই... ...বাকিটুকু পড়ুন

যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ ঠেকাতে পুলিশি নির্মমতা

লিখেছেন এমজেডএফ, ০২ রা মে, ২০২৪ দুপুর ১:১১



সমগ্র যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলোতে বিক্ষোভের ঝড় বইছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ কর্মসূচী অব্যাহত রয়েছে। একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বিক্ষোভ দমনের প্রচেষ্টা চালালেও তেমন সফল... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ ০১

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ৯:৫৫



নতুন নতুন শহরে এলে মনে হয় প্রতি টি ছেলেরি এক টা প্রেম করতে ইচ্ছে হয় । এর পেছনের কারন যা আমার মনে হয় তা হলো, বাড়িতে মা, বোনের আদরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

হিটস্ট্রোক - লক্ষণ ও তাৎক্ষণিক করণীয়

লিখেছেন ঢাকার লোক, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:০৭

সাধারণত গরমে পরিশ্রম করার ফলে হিটস্ট্রোক হতে পারে। এতে দেহের তাপমাত্রা অতি দ্রুত বেড়ে ১০৪ ডিগ্রী ফারেনহাইট বা তারও বেশি হয়ে যেতে পারে।

হিটস্ট্রোক জরুরি চিকিৎসা প্রয়োজন। চিকিৎসা... ...বাকিটুকু পড়ুন

আল্লাহকে অবিশ্বাস করার সংগত কোন কারণ নাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৩



সব কিছু এমনি এমনি হতে পারলে আল্লাহ এমনি এমনি হতে সমস্যা নাই। বীগ ব্যাং এ সব কিছু হতে পারলে আল্লাহও হতে পারেন। সব কিছুর প্রথম ঈশ্বর কণা হতে পারলে আল্লাহও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×