somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

একজন আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধার জীবনচিত্র

১৪ ই আগস্ট, ২০১২ সন্ধ্যা ৬:১৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে জমিদার-মহাজন শ্রেণির শোষণ-উৎপীড়ন ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে বারবার আন্দোলন করেছে, বিদ্রোহ করেছে এদেশের আদিবাসীরা। তাদের আন্দোলন বিদ্রোহের মধ্যে চাকমা বিদ্রোহ, সাঁওতাল বিদ্রোহ, হাতি খেদা বিরোধী বিদ্রোহ, মু-া বিদ্রোহ, হদি আন্দোলন, টংক আন্দোলন উল্লেখযোগ্য। ১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতা। স্বাধীনতা আমাদের সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন। বাঙালিদের পাশাপাশি মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয় এদেশের গারো, হাজং, কোচ, ডালু, সাঁওতাল, ওঁরাও, মু-া, ত্রিপুরা, মগ, মারমা, মণিপুরী, খাসিয়া, রাখাইন আদিবাসী ছাত্র-যুবক। চাকমা রাজা ত্রিদিব রায় মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করলেও চট্টগ্রামের সড়ক ও জনপথ বিভাগের তৎকালীন প্রকৌশলী জ্যোতিবিকাশ চাকমার নেতৃত্বে বেশ কয়েকজন চাকমা ছাত্র-যুবক মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধারা এখনও অনেকটা ইতিহাসের অন্তরালেই রয়ে গেছেন। রাজশাহীর আদিবাসী নেতা সাগরাম মাঝি, নেত্রকোণার দুর্গাপুরের যোয়াকিম আশাক্রা, প্রমোদ মানখিন, রেভারেন্ড সুভাষ চন্দ্র সাংমা, হালুয়াঘাটের বিন্দুনাথ হাউই প্রমুখ মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে অবদান রাখেন। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গুলিতে সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ হন গারো, হাজং, ডালু ও মণিপুরী কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা। নি¤েœ মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণকারী নেত্রকোণা জেলার কলমাকান্দা উপজেলার বালুচড়া গ্রামের গারো মুক্তিযোদ্ধা লেবিনাথ সাংমা’র পরিচয়, মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের প্রেক্ষাপট, ট্রেনিং সেন্টার, যুদ্ধক্ষেত্র, স্মৃতিচারণ ও জীবনচিত্র আলোচনা করা হয়েছে।

লেবিনাথ সাংমা

ভারতের মেঘালয় প্রদেশের রংরা হয়ে বাংলাদেশের নেত্রকোণা জেলার কলমাকান্দা উপজেলার জগন্নাথপুর-লেঙ্গুরা-বালুচড়া-নলচাপ্রা-নাজিরপুর গ্রামগুলোর পাশ দিয়ে প্রবাহিত হয়ে আত্রাখালি নদীতে মিশেছে গণেশ্বরী নামক একটি নদী। এই গণেশ্বরী নদীর পশ্চিম পাড়ে বালুচড়া নামক স্থানে মুক্তিযোদ্ধা লেবিনাথ সাংমার জরাজীর্ণ বাড়ি।

পরিচয়
লেবিনাথ সাংমা ১৯৪৫ সালে নেত্রকোণা জেলার কলমাকান্দা উপজেলার বালুচড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম স্লাং ঘাগ্রা। মাতার নাম মনচাই জাম্বিল। পিতামাতা দুজনেই মৃত্যুবরণ করেছেন। লেবিনাথ সাংমা পড়ালেখা তেমন করেননি। নলচাপ্রা প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পঞ্চম শ্রেণি পাস করেই শিক্ষা জীবনের ইতি টানেন। পিতার সাথে কৃষিকাজে যোগ দেন। লেবিনাথ সাংমা মুক্তিযুদ্ধের তিন বছর পূর্বে কলমাকান্দার নলচাপ্রা গ্রামের কম্বু দারিং ও কিলমাই নকরেকের কন্যা ঝর্ণা নকরেককে বিয়ে করেন। পারিবারিক জীবনে তিনি অজুফা নকরেক ও হ্যাপি নকরেক নামে দুই কন্যা ও বিকাশ নকরেক নামে এক পুত্র সন্তানের জনক।

স্মৃতিচারণ
১৯৭১ সালের এপ্রিল মাস। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কলমাকান্দা-নাজিরপুর অঞ্চলে তা-ব চালাচ্ছে। ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিচ্ছে। মানুষ মারছে। এলাকায় আতংক। সাধারণ মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে পালাচ্ছে। সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে যাচ্ছে। আমার পরিবার পরিজনও ভারতে চলে গেলো। আমি গেলাম না। অপেক্ষায় থাকলাম। কোনভাবে দেশের উপকারে আসতে পারি কিনা। এভাবে প্রায় তিন মাস জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রয়ে গেলাম।
১৯৭১ সালের জুলাই মাসের শেষ কিংবা আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহ। শুনলাম আদিবাসী ছাত্র-যুবকদের মধ্যে অনেকেই মুক্তিযুদ্ধে যাচ্ছে। আমিও সিদ্ধান্ত নিলাম মুক্তিযুদ্ধে যাবো। মাতৃভূমিকে শত্রুমুক্ত করবো। তারপর বালুচড়ার তরুণ দারিং, সতীশ সাংমা, থিওফিল হাজং, মিহির কুমার ¯œাল, শিবপুরের রবার্ট সাংমা, বদীন সাংমা, তারানগরের ফেবিয়ান মারাক, নলচাপ্রার প্রদীপ ঘাগ্রা, প্রফুল্ল হাজং, ইউবুস নকরেকের সাথে বাংলাদেশের সীমানা অতিক্রম করে ভারতের রংরা২ হয়ে বাঘমারা৩ ইয়ুথ ক্যাম্পে গেলাম। মুক্তিযুদ্ধে যারা অংশ নিতে চায় বাঘমারা ইয়ুথ ক্যাম্প থেকেই তাদের রিক্রুটিং চলতো। আমরা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে রিক্রুট হলাম। একরাত সেখানেই থাকলাম। পরদিন আমাদেরকে ট্রেনিংয়ের জন্য পাঠিয়ে দিলেন ভারতের মেঘালয় প্রদেশের তুরার রংনাবাগ ট্রেনিং সেন্টারে। আমরা ট্রাক যোগে তুরার রংনাবাগ গেলাম। প্রায় এক মাসের ট্রেনিং নিলাম। থ্রি নট থ্রি রাইফেল, এলএমজি, এসএমজি, এসএলআর, টু-ইঞ্চি মর্টার প্রভৃতি অস্ত্র চালাতে শিখলাম। গ্রেনেড থ্রোইং শিখলাম। জঙ্গলে আরো তিনদিন ট্রেনিং হলো। এভাবে শেষ করলাম ট্রেনিং জীবনের সময়কাল।
তারপর আমাদেরকে একটি মাঠে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করানো হলো। নেতৃবৃন্দ বক্তৃতা করলেন। বক্তৃতার মাধ্যমে দেশপ্রেমে আরো উদ্বুদ্ধ করলেন। নিজ নিজ ধর্মমত অনুসারে কেউ কুরআন, কেউ বাইবেল, কেউ গীতা স্পর্শ করে শপথ নিলাম। শপথের মাঠ থেকেই আমাদেরকে নির্দিষ্ট কোম্পানি কমান্ডারের অধীনে অন্তর্ভূক্ত করা হলো। আমি ইলিয়াস কোম্পানিতে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে অন্তর্ভূক্ত হলাম। মোহনগঞ্জের ইলিয়াস চৌধুরী আমার কোম্পানি কমান্ডার। প্লাটুন কমান্ডার কলমাকান্দা বালুচড়ার তরুণ দারিং। সেক্টর কমান্ডার এগার নম্বর সেক্টরের কর্নেল আবু তাহের। প্রত্যেক মুক্তিযোদ্ধাকে একটি করে অস্ত্র ও প্রয়োজনীয় সংখ্যক গোলাবারুদ দেওয়া হলো। ঈশ্বরের নাম নিয়ে মাতৃভূমিকে শত্রুমুক্ত করার জন্য দেশের ভেতরে প্রবেশ করে আমি বিজয়পুর, কলমাকান্দা ও নেত্রকোণার যুদ্ধে অংশগ্রহণ করি।

জীবনচিত্র
মুক্তিযোদ্ধা লেবিনাথ সাংমা দীর্ঘ বিশ বছর যাবৎ প্যারালাইসিসে ভুগছেন। শয্যাশায়ী। জমিজমা বাঙালিরা বেদখল করেছে। সংসারে চরম অভাব। চিকিৎসা নেই। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করা একাত্তরের বীর মুক্তিযোদ্ধা লেবিনাথ সাংমা এখন নিজেই জীবন যুদ্ধে পরাজিত। নিদারুণ কষ্টে অমানবিক জীবনযাপন করছেন। কারো প্রতি তার রাগ কিংবা অভিমান নেই। তবে আক্ষেপ আছে সরকারের প্রতি- কোন সরকার তার খোঁজ নেয়নি বলে। লেবিনাথ সাংমার স্ত্রী ঝর্ণা নকরেক সরকারের নিকট তার স্বামীর চিকিৎসার দাবি জানান। আমি স্বচক্ষে দেখেছি মুক্তিযোদ্ধা লেবিনাথ সাংমার পিঠে ঘা হয়ে গেছে। জলচৌকিতে করে শোয়া অবস্থায় জরাজীর্ণ ঘর থেকে উঠানে আনা হলো দীর্ঘাংদেহী কংকালসার বীর মুক্তিযোদ্ধা লেবিনাথ সাংমাকে। তারপরও তিনি গর্ববোধ করলেন দেশ স্বাধীনের যুদ্ধে অংশ নিতে পেরেছেন বলে।

মুক্তিযুদ্ধে আদিবাসীদের অবদান খাটো করে দেখার মতো নয়। তারা শুধুমাত্র সক্রিয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণই করেননি, অনেকেই মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নৃশংস হত্যাকা-ের প্রতিবাদ করেছেন। অধিকাংশ আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধা ভূমিহীন, গৃহহীন ও দিনমজুর। সামাজিকভাবেও তারা অবহেলিত। বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ করতে গিয়ে হালুয়াঘাট, ধোবাউড়া, দুর্গাপুর, কলমাকান্দা ও শেরপুরের অনেক আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধা নির্যাতিত হয়েছেন, কারাবরণ করেছেন, ভিটেমাটি ছাড়া হয়েছেন। তানোরের আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধারা এতটাই নিগৃহীত যে, তারা তাদের নিজ টাকায় হোটেল-রেঁস্তোরায় খাওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত। হালুয়াঘাটের আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধারা তাদের সম্মানী ভাতাও পুরোপুরি হাতে পান না। গুটিকয়েক বাঙালি দালাল মুক্তিযোদ্ধা সেখান থেকে দাদন নেয়। সর্বোপরি মানবেতর জীবনযাপন করছেন স্বাধীন দেশের আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধারা। তারা আদিবাসী হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি চান, ভূমির অধিকার চান, মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য নিজস্ব সমাধি ভূমি চান।
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছি , অবৈধ দখলদার॥ আজকের প্রতিটি অন‍্যায়ের বিচার হবে একদিন।

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১০



ধিক ‼️বর্তমান অবৈধভাবে দখলদার বর্তমান নরাধমদের। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষমা চাইতে হলো ! রাজাকার তাজুলের অবৈধ আদালতে। এর চাইতে অবমাননা আর কিছুই হোতে পারেনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আম্লিগকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধে আর কোন বাধা নেই

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:২২


মঈন উদ্দিন ফখর উদ্দিনের ওয়ান-ইলেভেনে সরকারের ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতের সহায়তায় পাতানো নির্বাচনে হাসিনা ক্ষমতায় বসে। এরপরই পরিকল্পিত উপায়ে মাত্র দুই মাসের মধ্যে দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের পর্যায়ক্রমে বিডিআরে পদায়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ

লিখেছেন এ আর ১৫, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:৪০



এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ


২০০৪ সালের ২১ শে অগাষ্ঠে গ্রেনেড হামলার কারন হিসাবে বলা হয়েছিল , হাসিনা নাকি ভ্যানেটি ব্যাগে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×