বাংলা আমাদের ভাষা। এই ভাষাকেই তো আমরা দেখি আরাকান রাজসভায়। দেখি সুলতানী বাংলায়। প্রাচীন যুগে। মধ্যযুগে। দেখি নানা জানা-অজানা কবির কাব্যে-পুঁথিতে। বাংলাদেশের জাতীয় ভাষা বাংলা। এছাড়াও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরার প্রধান ভাষাও বাংলা। প-িতরা মনে করেন আজকের বাংলা ভাষার মূল ভিত্তি হলো আর্য ভাষা। এই আর্য ভাষা থেকে বাংলা ভাষার বর্তমান রূপ নিতে সময় লেগেছে প্রায় তিন হাজার বছর। বাংলা এমন একটি ভাষা, যার মর্যাদা রক্ষার জন্য বাংলাদেশের মানুষ রক্ত দিয়েছে। ভাষার প্রতি মমত্ববোধ ও শ্রদ্ধা বাঙালি সংষ্কৃতির একটি বড় বৈশিষ্ট্য। ভাষাভাষীর সংখ্যা বিচারে পৃথিবীতে বাংলা ভাষার স্থান ষষ্ঠ।
আর্যদের ভাষা ছিল ইন্দো-ইউরোপীয় গোষ্ঠীর অর্ন্তভুক্ত। এ ভাষা বৈদিক বা সংষ্কৃত ভাষা নামেও পরিচিত। ভারতের অন্যান্য ভাষার সাথে মিশে আর্য ভাষা ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হতে থাকে। ভারতের মগধ (বিহার) রাজ্যে এসে এ ভাষার নাম হয় মাগধী প্রাকৃত। মাগধী প্রাকৃত থেকে উদ্ভব হয় অপভ্রংশ ভাষার। আর এ অপভ্রংশ ভাষার পরের ধাপেই সৃষ্টি হয় বাংলা ভাষার। নবম ও দশম শতকে লিখিত ‘চর্যাপদ’ হলো বাংলা ভাষায় লেখা সবচেয়ে পুরোনো বই।২ অর্থাৎ হাজার বছর আগে প্রাচীন ভারতীয় আর্য ভাষা রূপান্তরিত হয়ে বঙগীয় অঞ্চলে জন্ম নিয়েছিল এক মধুর-কোমল-বিদ্রোহী প্রাকৃত। তার নাম বাংলা। ওই ভাষাকে কখনো বলা হয়েছে ‘প্রাকৃত’, কখনো বলা হয়েছে ‘গৌড়ীয় ভাষা’, কখনো বলা হয়েছে ‘বাঙগলা’ বা ‘বাঙগালা।’ এখন বলি ‘বাংলা’।৩ দেশি বিদেশি শব্দের সংমিশ্রণে বাংলা ভাষার সৃষ্টি হয়েছে। বাংলা ভাষার অর্ধেকের সামান্য বেশি হলো দেশি শব্দ, অর্ধেকের কিছু কম সংষ্কৃত শব্দ এবং প্রায় পাঁচ শতাংশ বিদেশি শব্দ। আদি উৎস এক হওয়ায় ইন্দো-ইউরোপীয় গোষ্ঠীর ভাষাগুলোর সাথে অনেক বাংলা শব্দের মিল রয়েছে।
যে কোনো স্থানীয় বা আঞ্চলিক ইতিহাস গবেষণার ক্ষেত্রে সে অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর ভাষা বিশ্লেষণ গুরুত্বপূর্ণ। কোনো অঞ্চলের প্রকৃত পরিচয় তুলে ধরার ক্ষেত্রে সে অঞ্চলের ভাষা, উপভাষা বা আঞ্চলিক ভাষার স্বরূপ নিরূপণ করা দরকার। প্রখ্যাত ভাষাতত্ত্ববিদ গ্রিয়ার্সন বিশ খ-ে লিখিত ‘লিঙ্গুইসটিক সার্ভে অব ইন্ডিয়া’ গ্রন্থে ভারতের ১৭৯টি ভাষা ও ৫৪৪টি উপভাষার বিবরণ, তাদের ব্যাকরণ, পারস্পারিক সম্পর্ক এবং উৎস ও উদ্ভবের ইতিহাস লিপিবদ্ধ করেছেন।৪ ভাষা বিজ্ঞানীগণ বাংলা ভাষার প্রধানত পাঁচটি উপভাষার উল্লেখ্য করেছেন। যেমন :
১. রাঢ়ী
২. ঝাড়খন্ডী
৩. বরেন্দ্রী
৪. বাঙালি
৫. কামরূপী।৫
গ্রিয়ার্সন প্রস্তাবিত পদ্ধতি অনুসারে ভাষাতত্ত্ববিদ আবুল কালাম মনজুর মোরশেদ বাংলা ভাষার প্রধান উপভাষাগুলোকে নি¤œলিখিতভাবে শ্রেণিকরণ করেছেন-
ক. উত্তর বঙ্গ : দিনাজপুর, রাজশাহী, বগুড়া ও পাবনার প্রচলিত উপভাষা;
খ. রাজবংশী : রংপুরের উপভাষা;
গ. পূর্ববঙ্গীয় : (অ) ঢাকা, ময়মনসিংহ, ত্রিপুরা, বরিশাল ও সিলেটের উপভাষা;
(আ) ফরিদপুর, যশোর ও খুলনার উপভাষা;
ঘ. দক্ষিণাঞ্চলীয় : চট্টগ্রাম, নোয়াখালী ও চাকমা উপভাষা।৬
এই শ্রেণিকরণ থেকে উল্লেখ করা যায় যে, টাঙ্গাইল জেলার আঞ্চলিক ভাষা বাঙালি বা পূর্ববঙ্গীয় উপভাষার অর্ন্তগত। এ ছাড়াও বরেন্দ্র বা উত্তরবঙ্গের বিশেষ করে পাবনা ও সিরাজগঞ্জের আঞ্চলিক ভাষার সাথেও টাঙ্গাইলের চরাঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষা বা উপভাষার কিছু কিছু মিল রয়েছে। টাঙ্গাইল জেলার উত্তর, পূর্ব ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের কিছু কিছু এলাকা জামালপুর উপভাষাম-লের অর্ন্তগত। নেত্রকোণার সাথে যেমন কিশোরগঞ্জের সাদৃশ্য বেশি; জামালপুরের সাথে তেমনি টাঙ্গাইলের ভাষাগত আত্মীয়তা। যা হোক টাঙ্গাইল জেলার উপভাষা বা আঞ্চলিক ভাষার বৈশিষ্ট্যগুলো সংক্ষেপে আলোকপাত করছি।
ধ্বনিতত্ত্ব
ক. শব্দের আদি ধ্বনি সচরাচর ‘এ্যা’ কখনো ‘আ’ ধ্বনিতে পরিবর্তিত হয়। যেমন, তেল > ত্যাল, বেগুন > বাগুন ইত্যাদি। উদাহরণ : এক পা মালের ত্যাল কিনবা। শুদ্ধরূপ : এক পোয়া সরিষার তেল কিনবে। বাগুনটালে ক্যারা গাস তুলে? শুদ্ধরূপ : বেগুন ক্ষেতে কে ঘাস তুলে ?
খ. শব্দের আদি ও অন্তে ‘আ’ ধ্বনি থাকলে ‘আ’ ধ্বনির ‘এ্যা’ ধ্বনিতে পরিবর্তিত হয়। যেমন, টাকা > ট্যাকা, বাঁকা > ব্যাঁকা ইত্যাদি। উদাহরণ : কয় ট্যাহা কামাই করস যে এ্যাতো কতা কস ? শুদ্ধরূপ : কত টাকা রোজগার করিস যে বেশি কথা বলিস ?
গ. শব্দের অনাদিতে মহাপ্রাণ ধ্বনি লোপ পায়। যেমন : বাঘ > বাগ। উদাহরণ : ড্যাল দিয়া বাগ মারবা এডা কিবা কতা? শুদ্ধরূপ : ঢিল দিয়ে বাঘ মারবে এটা কেমন কথা ?
ঘ. শব্দের আদিতে ‘র’ ধ্বনি লোপ পায়। আবার কখনো ‘আ’ ধ্বনিতে পরিবর্তিত হয়। যেমন, রক্ত > অক্ত, রাজাকার > আজাকার ইত্যাদি। উদাহরণ : অক্তের টান বড় টান। শুদ্ধরূপ : রক্তের টান বড় টান। আজাকারের ফাঁসি চাই। শুদ্ধরূপ : রাজাকারের ফাঁসি চাই।
ঙ. শব্দের আদিতে ‘ল’ ধ্বনি ‘ন’ ধ্বনিতে পরিবর্তিত হয়। যেমন, লগি > নগি, লজ্জা > নজ্জা ইত্যাদি। উদাহরণ : নগি ছাড়া নাও, মাদবর ছাড়া গাঁও। শুদ্ধরূপ : লগি ছাড়া নৌকা, মাতব্বর ছাড়া গ্রাম। পোলাডার নজ্জা নাই। শুদ্ধরূপ : ছেলেটার লজ্জা নাই।
চ. শব্দের আদিতে ও মধ্য ‘স’ ধ্বনি ‘হ’ বা ‘হা’ ধ্বনি ‘আ’ ধ্বনিতে পরিবর্তিত হয়। যেমন, সন্ধ্যা > হন্ধ্যা, সরইপাড়া > হরইপাড়া, বামনহাটা > বামনআটা ইত্যাদি। উদাহরণ : হন্ধ্যা অইছে হলক জ্বালাও। শুদ্ধরূপ : সন্ধ্যা হয়েছে আলো জ্বালাও। বাড়ি কুনু গো- হরইপাড়া? শুদ্ধরূপ : বাড়ি কোথায় গো- সরইপাড়া। বামনআটার আটটা পুরাইনা। শুদ্ধরূপ : বামনহাটার হাটটা পুরানো।
স্বরধ্বনি
ক. শব্দের অন্তে ‘অ’ ধ্বনি ‘আ’ ধ্বনিতে পরিবর্তিত হয়। যেমন, ভাল > বালা, কাল > কালা ইত্যাদি। উদাহরণ : বালা চাইলে হাচা কতা’ ক। শুদ্ধরূপ : ভাল চাইলে সত্য কথা বল। ম্যায়াডা কালা তবে গঠন বালা। শুদ্ধরূপ : মেয়েটা কাল (কালো) তবে গঠন ভাল।
খ. শব্দের মধ্যধ্বনিতে ‘অ’ ধ্বনি ‘উ’ ধ্বনিতে পরিবর্তিত হয়। যেমন : চামচ > চামুচ, দেখন > দেহুন ইত্যাদি। উদাহরণ : এডা ভাতের চামুচ, ছালুনের পাইল্যায় দিছস ক্যা। শুদ্ধরূপ : এটা ভাতের চামচ, তরকারীর পাতিলে দিয়েছ কেনো ? দেহুন বেশি কথা কবেন না। শুদ্ধরূপ : দেখুন বেশি কথা বলবেন না।
গ. শব্দের মধ্যধ্বনিতে ‘আ’ ধ্বনি ‘উ’ ধ্বনিতে পরিবর্তিত হয়। যেমন : তামাক > তামুক, কামড় > কামুড় ইত্যাদি। উদাহরণ : তামুকটা ব্যাজায় তলক। শুদ্ধরূপ : তামাকটা খুবই তলক (কড়া)। পিঁপড়ায় কামুড় দিচ্ছে। শুদ্ধরূপ : পিঁপড়ায় কামড় দিয়েছে।
ঘ. আদি ‘ঔ’ ধ্বনি কখনো কখনো ‘ঐ’ ধ্বনিতে পরিবর্তিত হয়। যেমন : যৌবন > যৈবন, চৌকা > চৈকা ইত্যাদি। উদাহরণ : ক্যারমে ক্যারমে যৈবন আমার হইয়া গেল বুড়া। শুদ্ধরূপ : ক্রমে ক্রমে যৌবন আমার হয়ে গেল বুড়া। বাইষ্যা আওয়ার আগেই চৈকা বানাও। শুদ্ধরূপ : বর্ষা আসার আগেই চৌকা বানাও।
ঙ. টাঙ্গাইলের উপভাষায় পাবনা ও সিরাজগঞ্জের উপভাষার মতো অপিনিনিহিত ‘ই’ ধ্বনির প্রচলন রয়েছে। যেমন, আজি > আইজ, রাত্রি > রাইত ইত্যাদি। উদাহরণ : আইজ কুনু যাবা?। শুদ্ধরূপ : আজ কোথায় যাবে? রাইত কইরা বাইরে না যাওয়াই বালা। শুদ্ধরূপ : রাত করে বাইরে না যাওয়াই ভাল।
ব্যঞ্জনধ্বনি
ক. টাঙ্গাইল জেলার উপভাষায় শব্দের আদিতে অল্পপ্রাণ ব্যঞ্জনধ্বনিগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অপরিবর্তিত থাকে। যেমন, চাকা > চাহা। জিরানো > জিরানি ইত্যাদি। উদাহরণ : মাছটা কয়ডা চাহা করলা? শুদ্ধরূপ : মাছটা কয়টা চাকা (খ-) করলে?
খ. এ অঞ্চলের উপভাষাতে আদি ‘র’ ধ্বনি লুপ্ত হয়। টাঙ্গাইলের চরাঞ্চলে সিরাজগঞ্জ ও জামালপুর জেলার চরাঞ্চলে এ ধ্বনি বেশি লক্ষ করা যায়। যেমন, রাগ > আগ। রাজা > আজা। রাণী > আনী ইত্যাদি। উদাহরণ : নতুন বউ আগ করছে। শুদ্ধরূপ : নতুন বউ রাগ করেছে। রাণী : আজা, আজা তোমার কপালে অক্ত ক্যা? রাজা : অক্ত নয় আনী, অক্ত নয়, অঙ অঙ। শুদ্ধরূপ : রাণী : রাজা, রাজা তোমার কপালে রক্ত কেন ? রাজা : রক্ত নয়, রক্ত নয় রাণী রঙ রঙ।
গ. অনাদি ‘ব’ ধ্বনি কখনো কখনো ‘প’ ধ্বনিতে পরিবর্তিত হয়। যেমন, আসবা > আসপা, শিখবা > শিখপা ইত্যাদি। উদাহরণ : হে আসপার চাইয়া আইলো না। শুদ্ধরূপ : সে আসতে চেয়ে এলো না।
ঘ. বাংলা বর্ণমালায় ‘শ’, ‘ষ’ ও ‘স’ তিনটি উস্মবর্ণ। কিন্তু ‘শ’ ও ‘স’ দু’টি ধ্বনি। ‘ষ’ এর কোনো পৃথক উচ্চারণ নেই। প্রায় সর্বদাই ‘শ’ এর মতো উচ্চারিত হয়। ‘শ’ ও ‘স’ অবশ্য নিজ নিজ উচ্চারণ অনুযায়ী বাংলা বানানে লেখা হয় না। ময়মনসিংহের উপভাষার মতো টাঙ্গাইলের উপভাষায়ও ‘শ’ ও ‘স’ এর উচ্চারণ আছে। তবে শব্দের আদিস্থিত ‘শ’ ও ‘স’ অনেক ক্ষেত্রেই ‘হ’ ধ্বনিতে পরিবর্তিত হয়। যেমন : শরবী > হরবী, শালা > হালা, শালিক > হালিক, শোলা > হোলা, শিয়াল > হিয়াল, সাপ > হাপ, সস্তা > হস্তা ইত্যাদি। উদাহরণ : হস্তা দেইখা দুইডা হরবী কলা কিনলাম। শুদ্ধরূপ : সস্তা দেখে দুইটা শরবী কলা কিনলাম।
ঙ. টাঙ্গাইলের উপভাষায় শব্দের অনাদি ‘ট’ ধ্বনির স্থলে ‘ড’ ধ্বনির ব্যবহার প্রায় সর্বত্র লক্ষ্যণীয়। যেমন, কয়টা > কয়ডা, ছয়টা > ছয়ডা ইত্যাদি। উদাহরণ : প্রশ্ন, আইজকা কয়টা নাই ব্যাচলা ? উত্তর : ছয়ডা। শুদ্ধরূপ : প্রশ্ন, আজ কয়টা লাউ বেচলে ? উত্তর : ছয়টা।
রূপতত্ত্ব
ক. টাঙ্গাইলের উপভাষায় অব্যয় ‘ও’ ‘এবং’ এগুলোর ব্যবহার দেখা যায় না। এখানকার মানুষ তবে বা ‘তাহলে’ কে ‘তালি’, ‘নয়তো’ কে ‘নাতে’ বলে থাকে। উদাহরণ : তালি বিয়াতে ক্যারা ক্যারা যাবা? শুদ্ধরূপ : তাহলে বিয়েতে কে কে যাবে ?
খ. এ ভাষায় সর্বনাম শব্দের অন্তে ‘বা’ প্রত্যয় ব্যবহৃত হয়। যেমন, কেমন > কিবা, ওরকম > অবা ইত্যাদি।
গ. ক্রিয়াপদে বর্তমানকালে উত্তম পুরুষে ‘তাছি’ বিভক্তি ব্যবহৃত হয়। যেমন, করছি > করতাছি, ধরছি > ধরতাছি ইত্যাদি। একইভাবে অতীতকালে ‘লাম’ বিভক্তি এবং ভবিষ্যতকালের ক্রিয়ায় এ ভাষায় ‘ব’ স্থলে ‘মু’ প্রত্যয় হয়। যেমন, গিয়েছিলাম > গেছিলাম, খাব > খামু ইত্যাদি।
ঘ. এ অঞ্চলের উপভাষায় ‘টা’ ‘টি’ এর পরিবর্তিতে ‘ডা’ ডি’ ব্যবহৃত হয়। যেমন, মেয়েটা > ম্যায়াডা। ওটা > ওডা, আবার ‘গোটা’ এর ব্যবহার দেখা যায়। যেমন, গোটা পাঁচেক গরু।
ঙ. সম্বোধনের ক্ষেত্রে টাঙ্গাইলের উপভাষায় বিশেষ করে চরাঞ্চলে বংশ পদবীর সাথে ‘পো’ ‘বেটি’ ইত্যাদি মাত্রা যোগ করে থাকে। যেমন, ‘তালুকদারের পো’, ‘খোনকারের বেটি’ ইত্যাদি। উদাহরণ : তালুকদারের পো বাইত্তে আছাও গো। খোনকারের বেটি কুনু যাবা ?