আধুনিক কৃষি পেলাম যেমন করে
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
অরণ্যচারী ও যাযাবর জনগোষ্ঠীকে আধুনিক সমাজ স্রোতে যুক্ত করেছিল কৃষি। প্রথমদিকে কৃষি ছিল বন-জঙ্গল ঘুরে ঘুরে ফসল সংগ্রহ ও পশু-পাখি শিকার করে জীবিকা নির্বাহ। পরে যখন গুহাবাসী দেখলো ফসলের বীজ থেকে নতুন ফসল জন্মে এবং সে ফসল থেকে অনুরূপ ফলন পাওয়া যায়, বন্য পশু-পাখি পোষ মানেÑ তখনই মূলত আধুনিক কৃষির সূচনাকাল। প্রথমদিকে কৃষকরা জমিতে কৃষিকর্ম ও বন্য পশু-পাখি পোষ মানিয়ে নিজেদের পরিবারের চাহিদা মেটাতো। যে উর্বর ভূমিতে ফসল উৎপাদন হতো, সেখানে মানববসতির গোড়াপত্তন ঘটতো। সে সঙ্গে স্থায়ী সমাজ ও পরিবার কাঠামোর বিকাশ ঘটতো। পরিবারের খাদ্য চাহিদার নিশ্চয়তায় পরে সমাজের একটি বৃহৎ জনগোষ্ঠী আধুনিক সভ্যতার বিনির্মাণ ও শিল্প বিপ্লবের নেতৃত্ব দিয়েছিল। আদিম, মধ্য এবং আধুনিক যুগে কৃষি ক্ষেত্রে নিত্যনতুন কলাকৌশল ও যন্ত্রপাতির আবিষ্কারে কৃষির বিকাশ বর্তমান অবস্থায় রয়েছে।
১০ হাজার বছর আগে মিসর, মধ্যপ্রাচ্য ও ভারতবর্ষের উর্বর ভূমিতে সর্বপ্রথম কৃষিকাজ শুরু হয়। আদিমানুষ তখন বন্য ফসলের বীজ পরিকল্পনামাফিক বপন ও ফসল সংগ্রহের কলাকৌশল আয়ত্ত করতে পেরেছিল। স্বাধীনভাবে কৃষির উন্নয়ন ঘটেছিল উত্তর-পশ্চিম চীন, আফ্রিকা, নিউগিনি ও আমেরিকার কিছু অংশে। এ অঞ্চলে বসবাসকারী জনগোষ্ঠী প্রথমে গম ও কর্নের এবং পরে বার্লি, মটর, মসুর ও ছোলার আবাদ করতো। খ্রিস্টপূর্ব সাত হাজার বছর আগে মিসরের কিছু অংশ ও ভারতবর্ষের বেলুচিস্তানে ক্ষুদ্র পরিসরে গম ও বার্লির চাষাবাদ শুরু করে এ অঞ্চলের আদিবাসীরা। তখন আদিবাসী গোষ্ঠীগুলোর চাষাবাদ মূলত পারিবারিক চাহিদা মেটানোই মুখ্য ছিল। খ্রিস্টপূর্ব ছয় হাজার বছর আগে মধ্যম আকারে কৃষির সূচনা ঘটে নীল নদের তীরকে ঘিরে। সে সময়ে দূরপ্রাচ্যের দেশগুলো নিজেদের প্রয়োজনে ধান, গম মৌলিক ফসলগুলোর আবাদ শুরু করে। চীন ও ইন্দোনেশিয়ার কৃষকরা কচু, শিম, মুগডাল, সয়াবিন, আজুকির চাষাবাদ শুরু করে। তখন কার্বোহাইড্রেডের চাহিদা মোটামুটি পূরণ হলে মানুষ অন্যান্য চাহিদা পূরণের জন্য সংঘবদ্ধ হয়। সংঘবদ্ধ মানুষ প্রোটিনের চাহিদা পূরণের জন্য নদী, খাল, বিল ও সমুদ্র সৈকত থেকে জাল দিয়ে মাছ শিকার শুরু করে। নতুন পদ্ধতিতে চাষাবাদ ও মাছ শিকার অতিমাত্রায় জনসংখ্যা বৃদ্ধির সূচনা করে, যা বর্তমানেও অব্যাহত রয়েছে। পাঁচ হাজার খ্রিস্টপূর্বে টাইগ্রিস এবং ইউফ্রেটিস অঞ্চলে বিশাল এলাকাজুড়ে চাষাবাদ করার জন্য কিছু মৌলিক পদ্ধতির উদ্ভাবন করা হয়েছিল। পদ্ধতিগুলো হলো একক ফসল চাষ, জমিতে সেচ দেয়া, শ্রমশক্তি ব্যবহার করা ইত্যাদি। এ অঞ্চলের কৃষকরা কৃষিকর্মের পাশাপাশি বন্য গরু ও ভেড়ার জাত পোষ মানায়। বিশাল পরিমাণে পোষ মানানো এসব পশু-পাখি তারা ব্যবহার করতো মাংস ও তন্তুর চাহিদা মেটাতে। তখন দক্ষিণ আমেরিকার পাহাড়ের ঢালুতে আলু, টমেটো, মরিচ, স্কোয়াশ ও কিছু প্রজাতির শিম, তামাক জাতের চাষ শুরু হয়। দক্ষিণ গ্রিসের কৃষকরা তাদের অনুর্বর ভূমিতে নতুন চাষাবাদের কলাকৌশল তৈরি ও প্রয়োগ করে উচ্চ ফলন পায়। রোমানরা খাদ্যশস্য নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে কিছু পরিমাণ বিক্রি শুরু করে।
মধ্যযুগে উত্তর আফ্রিকা ও পূর্বের মুসলিম কৃষকরা যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে সেচের পদ্ধতি উদ্ভাবন করে এবং তা পরে বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে দেয়। মাটির নিচ থেকে পানি উত্তোলন যন্ত্র, ডোবা, কৃত্রিম জলাধার কৃষিজমিতে সেচের জন্য বহুল ব্যবহৃত হতে শুরু করে। মধ্যযুগে তারা অঞ্চলভিত্তিক চাষাবাদ পদ্ধতি ও যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে আখ, লেবুজাতীয় ফসল, তুলা, সাফরান ইত্যাদি ফসল খাপ খাওয়ানোর ওপর বই প্রকাশ করে। মুসলমানরা লেবু, কমলা, কলার জাত স্পেন থেকে এনে চাষাবাদ শুরু করে। মধ্যযুগে এক জমিতে তিন ফসল ক্রমপরিবর্তন চাষাবাদ পদ্ধতি উদ্ভাবিত হয়। চীন তখন চাষাবাদ পদ্ধতি সহজতর করার জন্য মোলবোর্ড চাষাবাদ যন্ত্র উদ্ভাবন করে। মোলবোর্ড চাষাবাদ যন্ত্র পরে চাষাবাদ প্রক্রিয়া সহজ করে দেয় এবং ফলন বৃদ্ধি করে।
১৪৯২ সালের পরে স্থানীয় ফসলের জাত ও পোষা প্রাণী এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে স্থানান্তর ঘটে। টমেটো, ভুট্টা, আলু, তামাক ইত্যাদি প্রধান ফসল অগ্রসর অঞ্চল থেকে অনগ্রসর অঞ্চলে আগমন ঘটে। অন্যদিকে গম, মসলা, কফি ও আখ অনগ্রসর থেকে অগ্রসর অঞ্চলে আগমন ঘটে। কলাম্বিয়ান আমেরিকায় কিছু কুকুরের জাত পালন করা হতো, যা বিভিন্ন কাজকর্মের উপযুক্ত ছিল না। তাই পশ্চাৎপদ অঞ্চল থেকে তারা কিছু কুকুর ও ঘোড়ার জাত আমদানি করে। ঘোড়া ও কুকুরের জাতগুলো পশ্চিমাঞ্চলে কৃষি উৎপাদনে ভূমিকা রাখে। ষোড়শ শতাব্দীতে পর্তুগিজ কর্তৃক চাষ সূচনাকারী আলু উত্তর ইউরোপের প্রধান খাদ্যশস্যে পরিণত হয়। সে সময়ে ভুট্টা আফ্রিকার স্থানীয় খাদ্যশস্যের জায়গা দখল করে নেয়। অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথমদিকে গঠন বা প্রয়োজনীয় বৈশিষ্ট্যের ওপর ভিত্তি করে কৃষিকৌশল, যন্ত্রপাতি, বীজ ও মাঠ ফসলের নামকরণ করা হয় এবং তাদের গঠনগত পরিবর্তন গঠতে থাকে। এ সময় মধ্যযুগ থেকে কয়েকগুণ মাঠ ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষে এবং ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুতে ট্রাক্টর ও উন্নত কলাকৌশল ব্যবহার করে আমেরিকা, ইসরাইল, জার্মানি ও অগ্রসর দেশ প্রতি একর ভূমি ব্যবহার করে সর্বোচ্চ ফলন ফলায়। হেবার বোস পদ্ধতি ব্যবহার করে অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট উৎপাদন ফসল উৎপাদনের সব প্রতিবন্ধকতা দূর করে কৃষিতে ফলন বৃদ্ধিতে বিপ্লব ঘটায়। ফলন বৃদ্ধি, সার, কীটনাশক, জাত উন্নতকরণ, যন্ত্রপাতির ব্যবহার, পানি দূষণ এবং কৃষিতে ভর্তুকি গত শতাব্দীর আলোচিত বিষয় ছিল। সাম্প্রতিককালে উন্নত দেশগুলো পরিবেশের ওপর কৃষির বিরূপ প্রতিক্রিয়ার কথা চিন্তা করে জৈব কৃষির সূচনা করছে। নতুন নতুন ফসলের জাত ও কলাকৌশল উদ্ভাবনের কারণে বিংশ শতাব্দীর শেষদিকে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে কৃষির বিপ্লব ঘটতে থাকে। আমেরিকা তাদের সাবিনের জাত উন্নয়নের জন্য চীন, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া থেকে জার্মপ্লাজম সংগ্রহ করে। এবং চীন ও জাপান বিভিন্ন ফল ও নাটজাতীয় ফসলের জার্মপ্লাজম সংগ্রহ করে। ২০০৫ সালে কৃষির সবচেয়ে বেশি উৎপাদন ছিল চীনে। বর্তমানে সারা পৃথিবীর উৎপাদনের এক-ষষ্ঠাংশের নিয়ন্ত্রণকারী দেশ হলো ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ভারত এবং আমেরিকা। বর্তমানে আমেরিকার প্রতি হেক্টর জমিতে উৎপাদন ১৯৪৮ সালের উৎপাদন থেকে আড়াই গুণের বেশি। বর্তমানে সারাবিশ্বে রপ্তানিকৃত খাদ্যশস্যের নব্বই ভাগ আসে আমেরিকা, কানাডা, ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়া, আর্জেন্টিনা এবং থাইল্যান্ড থেকে। পানির দু®প্রাপ্যতার জন্য মধ্য আকারের দেশ আলজেরিয়া, ইরান, মিসর, মেক্সিকো এবং উন্নয়নশীল কিছু দেশের খাদ্যশস্য আমদানি করতে হচ্ছে। পরিবেশ ও মানব শরীরের বিরূপ প্রতিক্রিয়ার জন্য জিএমও এবং হাইব্রিড ফসল নিয়ে বিতর্ক চলছে। অন্যদিকে সারাবিশ্বে খাদ্যের চাহিদা মেটাতে ফসলের উন্নত জাত উৎপাদন কৃষি ও জিন বিজ্ঞানীদের গবেষণা অব্যাহত রয়েছে। একদিকে আমেরিকা ও আফ্রিকার বায়োফুয়েলের উৎপাদন প্রক্রিয়া খাদ্য নিরাপত্তাকে হুমকিতে ফেলছে, অন্যদিকে কিউবাসহ লাতিন আমেরিকার জৈব কৃষি চাষ প্রযুক্তি পরিবেশের জন্য আশাব্যঞ্জক।
৩টি মন্তব্য ০টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
আমাদের হাদিকে গুলি করা, আর আওয়ামী শুয়োরদের উল্লাস। আমাদের ভুল কোথায়?


৩০ জনের একটা হিটলিস্ট দেখলাম। সেখানে আমার ও আমার স্নেহের-পরিচিত অনেকের নাম আছে। খুব বিশ্বাস করেছি তা না, আবার খুব অবিশ্বাস করারও সুযোগ নাই। এটাই আমার প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন
এ যুগের বুদ্ধিজীবীরা !

ডিসেম্বর মাসের চৌদ্দ তারিখ বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবী দিবস পালন করা হয়। পাকিস্তান মিলিটারী ও তাদের সহযোগীরা মিলে ঘর থেকে ডেকে নিয়ে হত্যা করেন লেখক, ডাক্তার, চিকিৎসক সহ নানান পেশার বাংলাদেশপন্থী বুদ্ধিজীবীদের!... ...বাকিটুকু পড়ুন
মায়াময় স্মৃতি, পবিত্র হজ্জ্ব- ২০২৫….(৭)
ষষ্ঠ পর্বের লিঙ্কঃ মায়াময় স্মৃতি, পবিত্র হজ্জ্ব- ২০২৫-….(৬)
০৬ জুন ২০২৫ তারিখে সূর্যোদয়ের পরে পরেই আমাদেরকে বাসে করে আরাফাতের ময়দানে নিয়ে আসা হলো। এই দিনটি বছরের পবিত্রতম দিন।... ...বাকিটুকু পড়ুন
আধা রাজাকারি পোষ্ট ......

আমি স্বাধীন বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করেছি। আমার কাছে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা, বা পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে আজকের বাংলাদেশের তুলনা—এসব নিয়ে কোনো আবেগ বা নস্টালজিয়া নেই। আমি জন্মগতভাবেই স্বাধীন দেশের নাগরিক, কিন্তু... ...বাকিটুকু পড়ুন
ইন্দিরা কেন ভারতীয় বাহিনীকে বাংলাদেশে দীর্ঘদিন রাখেনি?

কারণ, কোল্ডওয়ারের সেই যুগে (১৯৭১সাল ), আমেরিকা ও চীন পাকিস্তানের পক্ষে ছিলো; ইন্দিরা বাংলাদেশে সৈন্য রেখে বিশ্বের বড় শক্তিগুলোর সাথে বিতন্ডায় জড়াতে চাহেনি।
ব্লগে নতুন পাগলের উদ্ভব ঘটেছে;... ...বাকিটুকু পড়ুন

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।