somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ছোটগল্পঃ আলো-ছায়ার ওপাড়ে

০২ রা ফেব্রুয়ারি, ২০০৯ রাত ৩:০৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


রবীন্দ্রনাথের পরে আর কিছু লেখার কোনো মানে হয়না। বরং আসুন আমরা তাঁর উচ্চতা মাপি। দৈর্ঘ্য ছাব্বিশ ইঞ্চি, প্রস্থ ছাব্বিশ ইঞ্চি, উচ্চতা ছাব্বিশ ইঞ্চি। আপত্তির কিছু নেই; আমাদের হ-য-ব-র-ল’র ফিতেতে ছাব্বিশটুকুই টিকে আছে। ছাব্বিশই সই। ওটি তেরও হতে পারত। আমি মাপন ফিতেটি গলায় ঝুলিয়ে আবার রবীন্দ্র গবেষণায় মন দেই, যার উচ্চতা ছাব্বিশ ইঞ্চি। ওই ছাব্বিশটুকু পরিমাপ করতেই আমাকে পেছনে হেলতে হয়। হেলতে হেলতে গীতবিতানে পিঠ ঠেকে। বলা যায়, গীতবিতানে আটকাই বলেই আমার সপাট পতন রুদ্ধ হয়। মা পাশের ঘর থেকে জিজ্ঞেস করেন, ‘কি হলোরে?’ আমি বলি, ‘কিছু না মা। রবীন্দ্রনাথ।’ মার আর কোনো শব্দ পাইনা। হয়তো মা নিশ্চিন্ত থাকেন আমার রবীন্দ্র পতনে।

রবীন্দ্রনাথ কবে ঢুকেছিলেন আমাদের বাড়ীতে, আমি জানিনা। মা হয়তো জানেন। অনুমান হয়- উপহার প্রার্থনীয় নহে, দোয়া কাম্য- লেখা দাওয়াত কার্ডের সূত্রধরেই ভদ্রলোক আমাদের বাড়ীতে ঢুকেছিলেন। সুখী হও, তেরশ বাষট্টি- নীল কালিতে প্যাঁচানো হাতের লেখাকে সম্বল করে আমি হয়তো উদঘাটন করতে পারি গীতবিতানের গৃহপ্রবেশ ইতিহাস; কিন্তু আমার ইচ্ছে হয়নি। মা হয়তো জানেন। মার কাছে জানলেই হয়! আমার বড় বোনও জানতে পারে। হয়তো বাবাও। কিন্তু কেন যেন জীবনানন্দের মতো আমারো হৃদয় খননের অভিরুচি হয়নি। গীতবিতানের পাতাগুলো বুড়োর দাঁতের মতো ন্যালন্যালে হয়েছে আমার অত্যাচারে। আমার বয়স বেড়েছে, গীতবিতানেরও বেড়েছে। হয়তো রবীন্দ্রনাথেরও। কিন্তু তেরশ বাষট্টি কথাটি কেবল তেরশ বাষট্টিতে ঠোক্কর খাচ্ছে।

আমার রবীন্দ্র পতন রক্ষা হলেও, বাবার হাতে গীতবিতান ধরা পড়ে। সাথে আমিও। বাবা জিজ্ঞেস করেন, ‘এখানে কী হচ্ছে?’ বাবাকে আমি যমের মতো ভয় পাই। রবীন্দ্রনাথ বাবাকে দেখলেই বলেন, ‘হেনকালে হায় যমদুত প্রায়।’ আমি রবীন্দ্রনাথকে খুঁজি। বুড়ো পালিয়েছে। আমি বলি, ‘তেরশ বাষট্টি।’ বাবা বলেন, ‘তেরশ বাষট্টি! এখন ক্যালকুলাস করতে বস।’ আমি গীতবিতান হাতে বসেই ছিলাম। উঠে দাঁড়াই। বাবা ঘরময় হাঁটেন। আবার প্রশ্ন করেন, ‘তেরশ বাষট্টি কি?’ বাবার প্রশ্নে আমি আছাড় খাই। তাইতো, তেরশ বাষট্টি কি? গীতবিতানের এক-বাই-আট ফর্মার প্রথম পৃষ্ঠায়, নীল কালিতে লেখা- তেরশ বাষট্টি কথাটির মানে কি! মানে নেই। কোনো মানে নেই। আমার মাপন যন্ত্রে তেইশ, কিংবা তেরশ বাষট্টি একই রকম লাগে। বাবা বলেন, ‘হাতে কি?’ আমি এই প্রশ্নের উত্তর জানি। বলি, ‘রবীন্দ্রনাথ।’ উত্তরে দশে দশ আশা করে আমি বাবার দিকে তাকাই। বাবা বলেন, ‘ওটি শেলফে তুলে রাখো।’ আমি চাইনা বইটি শেলফে থাকুক। ওখানে নীল কালিতে শুধু তেরশ বাষট্টি কথাটিই লেখা নেই। আরো টুকরো লেখাও রয়েছে। সুখী হও, তেরশ বাষট্টি- কার লেখা জানিনা। বাকীগুলো আমার। বাবার হাতে পড়লে বানান ভুল বেরুবে, আমি নিশ্চিত।

‘বইটা আমার ঘরে নিয়ে যাই?’ আমি ভালো মানুষের মতো বাবাকে অনুরোধ করি। বাবা আমার হাত থেকে গীতবিতানটি নিয়ে নেন। বলা যায় আলগোছে ছিনিয়ে নেন। বলেন, ‘এবার অঙ্কে যেন কত পাওয়া হয়েছে?’ বাবার ভাববাচ্যের প্রশ্নটি আমাকে লজ্জিত করে। আমি ছিনতাই হওয়া গীতবিতানের শোক নিয়ে নিজের ঘরে ফিরি। ঘরে ফিরি কিনা বুঝতে পারিনা, ব্যাপারটা দাঁড়ায় ‘ফিরেছ কি ফির নাই, বুঝিব কেমনে’ গানটার মতো। আমি টেবিলে বসি। কান রাখি ঘরের বাইরে, বাবা কী বলেন শোনার জন্য।

‘শুনছো!’ বাবা মাকে ডাকছেন। মার কোন নাম নেই। আমরা মাকে মা বলি। বাবা মাকে ডাকেন- শুনছো, কই গেলে- এ জাতীয় কোনো শব্দে। আমার বাবারও কোনো নাম নেই। মা বাবার সাথে কথা শুরু করেন- ওগো শব্দটি যোগ করে। এ বাড়ীতে শুনছো, কিংবা ওগো শব্দদুটো আমার আর বড় আপার জন্য বরাদ্দ রাখা হয়নি। আবারো বাবার গলা শুনি, ‘কী হলো, শুনছো?’ মার সাড়া নেই। আমি কান খোলা রাখতে রাখতে অধৈর্য হই। ক্যালকুলাস বইয়ের শেষ পৃষ্ঠায় লিখি- আমি কান পেতে রই।

রাতে খাবার টেবিলে বসতেই মা আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তেরশ বাষট্টি কিরে?’ আমি আকাশ থেকে পড়ি। মাও জানেনা! তাহলে কে জানবে আর! বড় আপা? সে সম্ভাবনা ক্ষীণ। গ্রেস অ্যানাটমি মুখস্ততে সে এখন ব্যস্ত। গীতবিতানে তার মাথাব্যথা নেই। আমি হতাশ সুরে মাকে বলি, ‘তুমিও জাননো না!’ মা বলেন, ‘তুই না-কি গীতবিতানে কীসব লিখে রেখেছিস?’ আমি আমতা আমতা করি। বলি, ‘কে বলেছে?’ মা হাসেন, বলেন, ‘খুব সেয়ানা হচ্ছো, তাইনা!’ সেয়ানা কথাটিতে আমার বরাবরই আপত্তি। রবীন্দ্রনাথেরও আপত্তি ছিল শব্দটিতে। বলি, ‘মা, তুমি অরাবীন্দ্রিক শব্দ ব্যবহার করছ খাওয়ার টেবিলে।’ মা এবার জোরে হাসেন। তারপর গুনগুন করে গেয়ে ওঠেন, ‘যে রাতে মোর দুয়ারগুলি ভাঙলো ঝড়ে।’ আমি বলি, ‘গান ছাড়লে কেন?’
- ‘তোদের জ্বালায়।’
- ‘আমরা খুব জ্বালাই তোমাকে?’
- ‘মা হওয়ার পর বুঝবি।’
- ‘কী বুঝবো?’
- ‘তোর মেয়েরা যখন গীতবিতানের পাতায় প্রেমের কবিতা লিখতে শুরু করবে সেদিন টের পাবি।’

মার কথা শুনে আমি লাল হই। হুমায়ূন আহমেদ হলে বলতেন- বেগুনী। যাহোক, কান গরম হয়ে উঠছে, টেরপাই। আমি কাঁপা কাঁপা গলায় বলি, ‘ওগুলো প্রেমের কবিতা না। রবীন্দ্র সঙ্গীতের টুকরো।’ মা হাসেন। প্লেটে ভাত বাড়তে বাড়তে এবার একটু উচ্চস্বরে গেয়ে ওঠেন, ‘জানিনাইকো আসবে তুমি এমন করে।’ তারপর হঠাৎ গান থামিয়ে বলেন, ‘তোর বাবাকে খেতে ডাক।’ আমি মায়ের কাছে মিনতি করি, ‘বাবার সামনে এসব কথা তুলো না।’

খাবার টেবিলে বড় আপা চেয়ার টানতে টানতে বাবাকে জিজ্ঞেস করল, ‘তেরশ বাষট্টি কি?’ বাবা কেবল ভাত মুখে নিয়েছেন, বড় আপার প্রশ্ন শেষ না হতেই তিনি হেচকি তুললেন। আমি ভাবলাম, যাক তেরশ বাষট্টির এবার একটা হিল্লে হবে। বাবা একের পর এক হেচকি তুলতেই থাকলেন। মা বললেন, ‘খাওয়ার সময় এত কথা কিসের!’ বড় আপা বলল, ‘সারাদিন এই তেরশ বাষট্টি শুনতে শুনতে কাটল!’ মা বললেন, ‘তুই থামতো!’

আমরা থেমে গেলেও তেরশ বাষট্টি আমাদের মাথায় গেঁথে রইল। আমার মাথায়। বড় আপার মাথায়। মার মাথায়। শুধু বাবার মাথাই রক্ষা পেয়েছে তেরশ বাষট্টি থেকে। তেরশ বাষট্টি বাবার গলায় হেচকি হয়ে আটকে আছে। মাথায় ওঠার সাহস পাচ্ছেনা।

রাতের খাবার শেষে বড় আপার রুমে ঢুকতেই আপা বলল, ‘তোর প্রিয় একটা কবিতা বল।’ আমি বললাম, ‘কেন?’ বড় কপট বিরক্ততে বলল, ‘দরকার আছে।’
- ‘কোন রসের কবিতা শুনবে- কাম রস, না করুণ রস?’
- ‘তোর ইচড়ে পাকামো রাখ।’

আমি ইচড়ে পাকামো রবীন্দ্রনাথের জন্য তুলে রেখে সুনীলের কবিতার কথা ভাবি। পূর্ণেন্দু পত্রী হাতড়াই। না কিছু মাথায় আসছেনা। রবীন্দ্র কবিতার ছিটে-ফোঁটাও মনে নেই। এই হয়! পরীক্ষায় আমি বরাবর ফেল করি। বড় আপাকে বলি, ‘গান হলে চলবে?’
- ‘আগে শুনি!’
- ‘এই লভিনু সঙ্গ তব সুন্দর হে সুন্দর।’
- ‘নতুন কিছু শোনা। এটি পঁচে গেছে।’
- ‘আমার ভাঙা পথের রাঙা ধূলায় পড়েছে কার পায়ের চিহ্ন।’
- ‘এটিও পঁচে গেছে। রবীন্দ্রপ্রেমীদের সমস্যা কি জানিস, ওরা রবীন্দ্রসঙ্গীতকে পচনশীল জৈবে পরিণত করেছে।’

বড় আপার কথায় আমি আহত হই। ওর মনের মতো গানটি খুঁজে পাচ্ছিনা বলে অস্থির লাগে। রবীন্দ্রনাথের ওপর খুব রাগ হয়। কেন রাগ হয়? জানিনা। হয়তো আমার মনে হয়েছে, এই মানুষটির ওপর রাগ করা যায়। তাই রাগ করি।

- ‘আমি তোমাতে পেতেছি শয্যা, আমি তোমাতে করিব বাস, দীর্ঘ বরষা, দীর্ঘ শ্রাবণ মাস।’
- ‘তুই নাকি পুরো গীতবিতান মুখস্থ করেছিস! বাবা বললেন।’
- ‘আমি কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় না যে- গীতবিতান মুখস্থ করতে যাব।’
- ‘তোর এই- পেতেছি শয্যা গানটি ভাল। আবার বল, লিখে রাখি।’
- ‘আপা তুমি প্রেমে পড়েছো?’

বড় আপা আমার দিকে শ্যেন চোখে তাকিয়ে থাকে। রবীন্দ্রনাথ হলে বলতেন, কটাক্ষ হানিলো। আমি বলি, ‘প্রেমে পতনের প্রথম প্রকাশ, রবীন্দ্রসঙ্গীতকে পঁচা প্রমানে। এটি তীব্রভাবে তোমাকে ধারণ করে বলেই একে অসহ্য ভাব।’ বড় আপা আমার দিকে আবার কটাক্ষ হানে। বলে, ‘তোকে কে শিখিয়েছে এসব?’ আমি হাসি। বড় আপাকে তৎসম শব্দের প্যাঁচে ফেলা গেছে। বলি, ‘রবীন্দ্রনাথ।’ ‘রবীন্দ্রনাথ দেখি তোকে সবকিছু বলে গেছে!’- বড় আপা আমার কান টেনে ধরে। আমি কান বাঁচাই এবং রবীন্দ্র-ইজ্জত বাঁচাতে জোর গলায় গেয়ে উঠি, ‘সহে না যাতনা, দিবস গনিয়া গনিয়া বিরলে।’ বড় আপা আমার কান ছেড়ে দিয়ে মুখ চেপে ধরে। বলে, ‘বাবা শুনতে পাবে।’ আমি আমার রবীন্দ্র প্রতিভায় বিমুগ্ধ হই। যেন রবীন্দ্রনাথকে গেয়ে উঠলেই বাবা টের পাবেন- বড় আপা প্রেমে পড়েছে! আমি আরো একবার রবীন্দ্র-উচ্চতা মাপি। দৈর্ঘ্য তেইশ, প্রস্থ তেইশ, উচ্চতা তেইশ।

সে রাতে লোডশেডিংয়ের ছুটি শুরু হলে- আমি মাকে ছাদে খুঁজতে যাই। দেখি বাবা ছাদে হাঁটছেন। মা রেলিংয়ে হেলান দিয়ে বসে। অন্ধকারে দু’জনকে কী দেখে আমার কী যেন হয়, রবীন্দ্রনাথ আমার কণ্ঠে সাহস নিয়ে গেয়ে ওঠেন, ‘দু’জনে মুখোমুখি, গভীর দুঃখে দুখী আঁধারে মিশে গেছে আর সব।’ বাবা শব্দ করে হাসেন। বলেন, ‘মিনু, একটা গান শোনাও।’ আবছায়া বলেই বাবা মায়ের নাম ধরে ডাকেন এবং হয়তো আবছায়া বলেই আমার মনে হয়, বাবা মিনু নামেই মাকে সারা জীবন ডেকেছেন। আমি মায়ের গা ঘেঁষে বসি। বলি, ‘শোনাও না একটা গান!’ মা বলেন, ‘এতদিনে গানের সব কথা ভুলে গেছিরে।’ বাবা বলেন, ‘যেটুকু মনে আছে, তাই শোনাও।’ মা প্রথমে গুণগুণ করে শুরু করলেন, ‘এ পারে মুখর হলো কেকা ওই, ও পারে নীরব কেন কুহু হায়।’ মায়ের গুণগুণ কণ্ঠ কখন যেন একলা কেকা হয়ে আমাদের ছাদে উড়ে বেড়াতে লাগল। কোথাও বাতাবী লেবু গাছে ফুল এসেছে। মাকে সঙ্গত করতেই লেবুঘ্রাণ থমকে রইল বাতাসে। হয়তো রবীন্দ্রনাথও দূরে কোথাও দাঁড়িয়ে ছিলেন।

এভাবেই রবীন্দ্রনাথ আমাদের বাড়ীতে টিকে আছেন। গীতবিতানে, খাওয়ার টেবিলে, কিংবা আমার সেয়ানা হয়ে ওঠায়, লেবু ঘ্রানমাখা অন্ধকার রাতে, ছাদে।

গান শেষ হলে, আমরা যখন চুপ করে বসে ছিলাম, বড় আপার আসাও টের পাইনি, তখন বাবা মাকে বলেন, ‘অনেকদিন পরে পুরো একটা গান গাইলে। মনে হয়, কয়েক যুগ পরে।’ মা কিছুক্ষণ চুপ রইলেন। তারপর বললেন, ‘তোমার মনে আছে তেরশ বাষট্টি?’ বাবা উত্তর দিলেন না। হয়তো তার বলার মতো কিছু নেই। বেশ তেরশ বাষট্টির প্যাঁচে পড়া গেলতো!

আমি বললাম, ‘তুমিইতো আমাকে জিজ্ঞেস করলে, তেরশ বাষট্টি কি?’ মা কথার জবাব দিলেন না। বাবা মাথা নীচু করে রইলেন। অনেকক্ষণ। আমি ফিসফিস করে মাকে বললাম, ‘তেরশ বাষট্টি কি মা?’ মা নিশ্চুপ। হয়তো কথা সাজাচ্ছেন, আর আমার চুলে বিলি কাটছেন। কিংবা হয়তো ও পারের নিঃসঙ্গ কুহুর কথা ভাবছেন। হয়তো বাবার কাছ থেকেই শুনতে চাইছেন তেরশ বাষট্টিকে।

‘আমাদের বিয়েতে তোর মায়ের গানের মাষ্টার বইটা উপহার দিয়েছিল’, বাবা কথা শুরু করেন। আমরা কান খাড়া করি। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়- ‘আমি কান পেতে রই।’ কথা আর এগোয় না। কান পাতা সাড় হয়। বড় আপা বলেন, ‘এই খবরটিকে এত ভয়াবহ বানাচ্ছো কেন?’ বাবা চুপ থাকেন। মাও চুপ। আমার কেমন যেন অস্বস্তি লাগে। বুড়ো রবীন্দ্রনাথ আমাকে বলেন, ‘সত্য যে কঠিন, কঠিনেরে ভালবাসিলাম।’ আমি বলি, ‘কিন্তু তোমাদের বিয়েতো আর বাষট্টিতে হয়নি! আরো বছর পাঁচেক পরে হয়েছে।’ আমার পাকামোতে বড় আপা চিমটি কাটে। মা চুল ধরে টান দেন।

‘লোকটির হয়তো আর কিছু দেবার ছিলনা। পুরনো বইটিই দিয়েছে’, মা বলেন। আবার সব চুপচাপ। অমোঘ মৌনতা। তারপর নীরবতা অসহ্য হয়ে ওঠার আগেই বাবা বলেন, ‘এক রাতে লোকটি আমাদের বাড়ীতে আশ্রয় নিতে এসেছিল। একাত্তর সালের মাঝামাঝি।’ আমরা তেরশ বাষট্টির রহস্যভেদে হামাগুড়ি দিয়ে এগোই। অবিন্যস্ত আবছায়া বাবা-মাকে ঘিরে। আলোর বরফি। আঁধারের ছক। এ যেন মৈত্রেয়ী দেবী আর রবীন্দ্রনাথকে ঘিরে আলো-ছায়ার খেলা। এক সময় মার চোখে পানি জমে হয়তো। নাহলে অনেকক্ষণ পরে, মা কেন ভাঙা ভাঙা গলায় বলে উঠলেন, ‘আমরা তাকে অন্য মানুষের হাতে তুলে দিয়েছিলাম।’ তারপর আর কোনো কথা নেই। বাবা দূরে কোথাও তাকিয়ে থাকেন। মা আরো দূরে। আমি ফিসফিস করে বলি, ‘কাদের হাতে?’ মার উত্তর দিতে খুব দেরী হয়। বাবারও।

লেবু ঘ্রাণ, আমাদের মৌনতা, কিংবা আমরা রবীন্দ্রপ্রেমীরা আবছায় বসে থাকি। হয়তো রবীন্দ্রনাথও বসে থাকেন। হয়তো বুড়ো মানুষটি গাইতে থাকেন, ‘অমল ধবল পালে লেগেছে মন্দ-মধুর হাওয়া।’ কিংবা তিনিও আঁধারে মিশে থাকেন। আলো-ছায়ার ওপাড়ে।
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই ডিসেম্বর, ২০১০ রাত ১:৩৭
৬৩টি মন্তব্য ৪৩টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

অন্যায় অত্যাচার ও অনিয়মের দেশ, শেখ হাসিনার বাংলাদেশ

লিখেছেন রাজীব নুর, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৪:৪০



'অন্যায় অত্যাচার ও অনিয়মের দেশ, শেখ হাসিনার বাংলাদেশ'।
হাহাকার ভরা কথাটা আমার নয়, একজন পথচারীর। পথচারীর দুই হাত ভরতি বাজার। কিন্ত সে ফুটপাত দিয়ে হাটতে পারছে না। মানুষের... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

দ্য অরিজিনস অফ পলিটিক্যাল জোকস

লিখেছেন শেরজা তপন, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১১:১৯


রাজনৈতিক আলোচনা - এমন কিছু যা অনেকেই আন্তরিকভাবে ঘৃণা করেন বা এবং কিছু মানুষ এই ব্যাপারে একেবারেই উদাসীন। ধর্ম, যৌন, পড়াশুনা, যুদ্ধ, রোগ বালাই, বাজার দর থেকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×