বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট- ১ উৎক্ষেপণের ১ বছর পূর্ণ হলও গত ১২ই মে, ২০১৯। এক বছর পূর্বে একটা লেখায় মন্তব্য করেছিলাম "বঙ্গবন্ধু-১ নামক কৃত্রিম যোগাযোগ উপগ্রহটির জন্য শুভ কামনা রইল। আশাকরি বাংলাদেশ সরকারের বঙ্গবন্ধু-১ বাংলাদেশ সরকারের টেলিটক মোবাইল ও দোয়েল ল্যাপটপ প্রজেক্টের মতো মানুষের হাঁসির পাত্র হবে না। " বছর শেষের ফলাফলে দেখা যাচ্ছে বঙ্গবন্ধু-১ এর পরিণতি টেলিটক মোবাইল ও দোয়েল ল্যাপটপ প্রজেক্টের মতোই হতে যাচ্ছে। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট- ১ এর ১৫ বছর জীবনী কালের ১ বছর ইতিমধ্যেই শেষ হয়ে গেলেও গত ১ বছরে এই স্যাটেলাইট থেকে প্রায় ১ টাকাও আয় হয় নাই। অথচ, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট- ১ এর জন্য খরচ-কৃত ৩ হাজার কোটি টাকা উঠাতে হলে প্রতিদিন আয় করতে হবে ৫৫ লক্ষ টাকা। অর্থাৎ গত ১ বছরে আয় করতে হতো ২০০ কোটি টাকা। যেহেতু প্রথম বছরে কোন আয় হয় নাই তাই আগামী ১৪ বছরে প্রতিবছর ২১৪ কোটি টাকা করে আয় করতে হবে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট- ১ তরঙ্গ বিক্রি করে। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট- ১ এর কার্যক্রম চালানোর জন্য যে লোকবল দরকার তাদের বেতন ও রক্ষণাবেক্ষণ খরচ হিসাবে ধরা হয় নাই। ঐ হিসাব ধরলে এই স্যাটেলাইট এর খরচ ৩ হাজার কোটি টাকার অধিক হয়ে যাবে।
এই সপ্তাহে পত্রিকায় প্রকাশ যে উৎক্ষেপণের ১ বছর পরে সম্প্রতি বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট- ১ এর ফ্যাসিলিটি ব্যবহার নিয়ে বেসরকারি টেলিভিশন গুলোর সাথে চুক্তি হয়েছে; যেই চুক্তিতে প্রথম ৩ মাস বিনে পয়সায় তরঙ্গ ব্যবহার করবে ও ৩ মাস পর থেকে ফি প্রদান করবে। তবে কি পরিমাণ ফি প্রদান করবে তা কোন মাধ্যমেই প্রকাশিত না।
গতবছর বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট- ১ উৎক্ষেপনের সময় আমার লেখা পোষ্টে চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলেছিলাম যে বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট শুধুমাত্র একটি যোগাযোগ উপগ্রহ ও এই উপগ্রহ দিয়ে আবহাওয়া ও জলবায়ু সম্পর্কিত কোন তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব হবে না। যোগাযোগ উপগ্রহে পেলোড (কার্যকরি যন্ত্র) হিসাবে যে যন্ত্র থাকে তার নাম ট্রান্সপোন্ডার (transponder: An instrument used on communications satellites that receives a signal from a station on Earth at one frequency, amplifies it, and shifts it to a new frequency.)। ট্রান্সপোন্ডার শুধুমাত্র পৃথিবী পৃষ্ঠে অবস্থিত; বা অন্য কৃত্রিম উপগ্রহ থেকে পাঠানো কোন সিগনাল প্রথমে গ্রহণ করে এর পরে তা বিবর্ধিত করে ও সব শেষে তা আবারও পৃথিবী পৃষ্ঠে অবস্থিত কোন স্টেশনে বা অন্য কৃত্রিম উপগ্রহে পাঠিয়ে দেয়। এটাই হলও যোগাযোগ উপগ্রহের একমাত্র কাজ। পক্ষান্তরে আবহাওয়া উপগ্রহগুলোতে পেলোড হিসাবে রেডিও-মিটার (রেডিয়েশন মাপার যন্ত্র), স্কেটারোমিটার (পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে অবস্থিত বিভিন্ন গ্যাস যেমন কার্বনডাই অক্সাইড, ওজোন, নাইট্রাস অক্সাইড ইত্যাদি), লাইটিং ইমেজার ইত্যাদি নামক বিভিন্ন প্রকার মনিটরিং যন্ত্র ও ক্যামেরা থাকে।
ঘুর্নিঝড় ফণি এর কল্যানে সকলে বুঝতে পেরেছে যে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট- ১ দিয়ে আবহাওয়া ও জলবায়ু সম্পর্কিত কোন তথ্য সংগ্রহ করা যায় না। বিবিসি এর সাংবাদ পড়ে দেখতে পারেন: ঘূর্ণিঝড় ফণী: পূর্বাভাস প্রদানে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের ভূমিকা ছিল কি?
আওয়ামীলীগের মন্ত্রী-এমপি ও সংসদরা ও তাদের দলের ফেসবুক কর্মীরা বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট দিয়ে কি কি করা যাবে সেই লিস্টি ফেরি করে বেড়ান প্রতিনিয়ত। বিভিন্ন পত্রিকার পা-চাটা সংবাদিকরাও পিছিয়ে ছিলো না এই ব্যাপারে। তারাও সরকারের মন্ত্রী-এমপি ও সংসদদের উদৃতি দিয়ে পত্রিকার পাতা ভর্তি করেন বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট দিয়া কি কি করা যাবে। সেই লিস্টে দেখা যায় বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট দিয়ে বঙ্গোপসাগরের ঘূর্ণিঝড় পূর্বাভাষ করা যাবে; কৃষকদের বন্যার পূর্বাভাষ দেওয়া যাবে; মাটির নিচে কি প্রাকৃতিক সম্পদ আছে সেটাও জানা যাবে; বঙ্গোপসাগর পথহারা দেওয়া যাবে; দেশের নিরাপত্তা রক্ষা করা যাবে।
আমি মন্তব্য করেছিলাম যে আওয়ামীলীগের মন্ত্রী-এমপি ও সংসদরা ও তাদের দলের ফেসবুক কর্মীরা বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইটকে প্রায় গুলিস্তান মোড়ে বিক্রিত সর্বরোগের মহৌষধ বানিয়ে ফেলেছে। ঢাকার রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা বাসের জানালা দিয়ে কিছু কাগজ ছুড়ে দেওয়া হয় যেই সকল কাগজে লিখা থাকে: "চিকন স্বাস্থ্য মোটা করিবার ও টাঁক মাথায় চুল গজাইবার ১০০ ভাগ গ্যারান্টি; বিফলে মূল্য ফেরত"।
বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট দিয়ে কোন-কোন কাজ করা যাবে না সেই লিষ্ট টা যদি আওয়ামীলীগের মন্ত্রী-এমপি ও সংসদরা উল্লেখ করতো তাতে করে আরও ভালো হত। দেশের মানুষ তাহলে মনে করে নিতো এই কয়টা কাজ ব্যতীত পৃথিবীর সকল কাজ করা যাবে বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট দিয়া।
গতবছর বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট- ১ নিয়ে আমার লেখা "বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট যেন টেলিটক মোবাইল কিংবা দোয়েল (দুষ্ট লোকে কয় কাউয়া) ল্যাপটপের মতো পরিনতি বরণ না করে।" হতে কিছু অংশ এখানে তুলে দিলাম আবারও। সকলে মিলিয়ে দেখেন আমি কি বলেছিলাম ও গত ১ বছরে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট- ১ আমাদের কি কি সেবা দিলো ও এই স্যাটেলাইট কত টাকা আয় করলো????
"সরকারের দেওয়া তথ্য মতে বঙ্গবন্ধু-১ নামক কৃত্রিম যোগাযোগ উপগ্রহটিতে ৪০ ট্রান্সপন্ডার রয়েছে। এর মধ্যে ২০ বাংলাদেশ ব্যবহার করবে অন্য ২০ টি ট্রান্সপন্ডার বাণিজ্যিক ভাবে ভাড়া দেওয়া হবে টাকার বিনিময়ে। প্রশ্ন করতে পারেন ট্রান্সপন্ডার কি? ট্রান্সপন্ডার হলও কৃত্রিম ভূ-উপগ্রহে স্থাপিত একটি ইলেকট্রনিক ডিভাইস যা ভূ-পৃষ্ট থেকে প্রেরকের পাঠানো তড়িৎ সিগলান গ্রহণ করে তা বিবর্ধিত করে আবারও সেই সিগনাল প্রাপকের কাছে পাঠাতে পারে (Transponder: a device for receiving a radio signal and automatically transmitting a different signal.)। সরকারের তথ্য মতে বঙ্গবন্ধু-১ নামক কৃত্রিম যোগাযোগ উপগ্রহটি ক্রয় করা, সেটি উৎক্ষেপণ করা ও কক্ষপথে স্পেস কেনা বাদ সর্বমোট প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা খরচ হয়েছে। একটা কৃত্রিম ভূ-উপগ্রহের অপারেশনাল লাইফ টাইম হয়ে থাকে ৫ থেকে ১৫ বছর। সরকারের কর্তা ব্যাক্তিদের তথ্য মতে বঙ্গবন্ধু-১ নামক কৃত্রিম যোগাযোগ উপগ্রহটির জীবন কাল হবে ১৫ বছর। তবে অনেক সময় বিভিন্ন কারণে কৃত্রিম উপগ্রহ পূর্বে নির্ধারিত পুরো জীবনকাল পূরণ করতে পারে না বিভিন্ন কারণে জ্বালানি নির্ধারিত সময়ের পূর্বেই শেষ হয়ে যাওয়ার কারণে।
সরকারের নিতি-নির্ধারকরা বলছিল ২০ টি ট্রান্সপন্ডার বাণিজ্যিক ভাবে ভাড়া দিয়ে মিলিয়ন-মিলিয়ন ডলার আয় করবে। কৃত্রিম উপগ্রহ নিয়ে যাদের সামান্যতম ধারণা আছে তারা সরকারের নিতি-নির্ধারকদের দাবি শুনে মুচকি-মুচকি হাঁসেছিল হাজার কোটি টাকা আয়ের স্বপ্ন দেখানো গান্জাঁখুরি গল্প শুনে।
বাংলাদেশের প্রতিবেশী দেশ ভারত নিজে কৃত্রিম ভূ-উপগ্রহ বানিয়ে নিজেদের রকেটের মাধ্যমে তা পৃথিবীর কক্ষপথে স্থাপন করে থাকে। যেহেতু ভারত নিজেই ভূ-উপগ্রহ বানিয় ও তা কক্ষপথে স্থাপন করে তাই এই কৃত্রিম ভূ-উপগ্রহগুলো বাংলাদেশের চেয়ে অনেক কম খরচ হয়। এখানে উল্লেখ্য যে ভারত মঙ্গলগ্রহে একটি কৃত্রিম ভূ-উপগ্রহ পাঠিয়েছে আমেরিকার ১০ ভাগের এক ভাগ খরচে। ২০১৭ সালে ভারত একটি মাত্র রকেটে করে এক সাথে ১০৪ টি কৃত্রিম ভূ-উপগ্রহ পৃথিবীর কক্ষপথে স্থাপন করেছে। তার মাধ্যে একটা মাত্র কোম্পানি একই সাথে ৮৮ টি কৃত্রিম ভূ-উপগ্রহ পৃথিবীর কক্ষপথে স্থাপন করেছে। ভারতের সরকারি ও বেসরকারি অনেক কোম্পানির কৃত্রিম ভূ-উপগ্রহ আছে যেগুলো অনেক কম খরচে উৎক্ষেপণ করা হয়েছে।
বাংলাদেশের কর্তা ব্যাক্তিরা বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট- ১ এর ২০ টি ট্রান্সপন্ডার বাণিজ্যিক ভাবে ভাড়া দিয়ে মিলিয়ন-মিলিয়ন ডলার আয় করবে বলে আশার বানি শুনিয়েছিল বা এখনো শুনাচ্ছে তারা ভারতীয় সরকারি ও বেসরকারি কোম্পানি গুলোর সাথে প্রতিযোগিতা মূলক বাজারে নিজেদের পণ্য বিক্রয় করতে পারবে কি না? একই কথা প্রযোজ্য সিঙ্গাপুরের কোম্পানিগুলোর ক্ষেত্রেও। বাংলাদেশ সিঙ্গাপুরের কোম্পানিগুলোর সাথে প্রতিযোগিতা করে অপেক্ষাকৃত কম দামে ক্রেতার কাছে ২০ টি ট্রান্সপন্ডার বাণিজ্যিক ভাবে ভাড়া দিতে পারবে কি না?"
বছর শেষের ফলাফলে অনুমান করা যাচ্ছে যে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট- ১ ও টেলিটক মোবাইল ও দোয়েল ল্যাপটপ প্রজেক্টের মতো মানুষের হাঁসির পাত্র হতে যাচ্ছে।
গত ১ বছরে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট- ১ এর অর্জন নিয়ে বিবিসি বাংলা বিভাগ ও জার্মানির ডয়েচভেলে সংবাদ মাধ্যম বেশ কিছু সংবাদ প্রকাশ করেছে। নিচে কয়েকটির লিংক দিলাম সকলের পাঠের জন্য।
বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ থেকে এক বছরে প্রাপ্তি কতোটা
বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট: এক বছরে প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি
বাংলাদেশ স্যাটেলাইট: বাণিজ্যিকভাবে কতটা সফল হবে?
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে মে, ২০১৯ রাত ১২:২৬