গত কিছুদিন ধরে জাফর ইকবাল স্যারের লেখা কলামগুলো পড়া প্রায় ছেড়ে দিয়েছি। না-পড়ার জন্য প্রধান কারণটা হলও সাম্প্রতিক কালে স্যারের লেখাগুলোর বেশিভাগই হলও মানহীন ও যুক্তিহীন আবেগমিশ্রীত লেখা। যার সর্বশেষ উদাহরণ হলও জ্যোতি-পদার্থ বিজ্ঞান চর্চা ও গবেষণার জন্য ফরিদপুর জেলার ভাঙ্গা উপজেলায় জাতীয় মানমন্দির সংক্রান্ত একটি প্রস্তাবনা। "একটি স্বপ্ন, বিডিনিউজ২৪ডটকম, ২৭ শে জুন, ২০১৯"।
যে দেশের প্রায় ৪৩টি পাবলিক এবং ১০৩টি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনটিতেই জ্যোতির্বিজ্ঞান বা অ্যাস্ট্রোনমির কোনও স্নাতক ডিগ্রি পড়ানো হয়না সেই দেশে উনি শত কোটি টাকা খরচ করে জ্যোতি-পদার্থ বিজ্ঞান চর্চা ও গবেষণার জন্য একটি মানমন্দির প্রতিষ্ঠার জন্য দেশের সরকার প্রধানের দৃষ্টি আকর্ষণ করে কলাম লিখেছেন। স্যারের প্রস্তাবনা শুনে গ্রাম বাংলার জনৈক সওদাগরের ঘোড়ার পূর্বে চাবুক কেনার গল্পের কথা মনে পড়ে গেল। জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ে বাংলাদেশে কেয়েকটা সৌখিন ক্লাব ও সেগুলোর সাথে জড়িত কিছু সৌখিন জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চাকারি সেচ্ছাসেবী থাকলেও প্রাতিষ্ঠানিক পড়া-লেখা করা মানুষ আদৌ আছে কি না আমি সন্দিহান। আমি নিজেও শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় ঐ রকম একটা ক্লাবের "Shahjalal University Astronomical Society" সাথে জড়িত ছিলাম। শুধু জড়িত ছিলাম বললে কম বলা হবে। পর্যায়ক্রমে ঐ ক্লাবের প্রচার সম্পাদক, সহ-সাধারণ সম্পাদক ও সহ-সভাপতি ছিলাম। ঐ ক্লাবের আন্ডারে শাবিপ্রবিতে মহাকাশ পর্যবেক্ষণ বিষয়ক কর্মশালা আয়োজনে নেতৃত্ব দিয়েছি; ও প্রথম টেলিস্কোপের মাধ্যমে মহাকাশ পর্যবেক্ষণের ব্যবস্হা করেছি। টেলিস্কোপের মাধ্যমে মহাকাশ পর্যবেক্ষণের ব্যবস্হা করতে গিয়ে জাফর ইকবাল স্যারের পর্যাপ্ত অ-সহযোগিতা নিয়ে তিক্ত অবিজ্ঞ হয়েছিল যা অন্য একদিন শেয়ার করার আশা রাখি। যাই হউক, একাডেমিক দৃষ্টিকোণ থেকে জাফর ইকবাল স্যারের মানমন্দির প্রতিষ্ঠা সংক্রান্ত প্রস্তাবনাটা অনেক হাস্যকর শোনালেও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা ভেবে প্রস্তাবনাটা প্রশংসা পেতে পারে এই ভেবে যে বাংলাদেশে কোন কিছু প্রস্তাব করলেই তো আর হয় না; যেমন পাকিস্তান পিরিয়ডে ১৯৬৫ সালে কাজ শুরু করা রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার কাজ চলছে প্রস্তাবনার প্রায় ৫০ বছর পরে।
জাফর ইকবাল স্যারের লেখার সবচেয়ে মানহীন, যুক্তিহীন, ও হাস্যকর অংশটা হলও প্রস্তাবিত জাতীয় মানমন্দিরটি ফরিদপুর জেলার ভাঙ্গা উপজেলায় স্থাপনের প্রস্তাব করা। ঐ স্থানে মানমন্দিরটি স্থাপনের প্রধান যুক্তি হিসাবে যে কারণটি দেখিয়েছেন তা হলও
"আমার কাছে মনে হয়েছে কর্কট ক্রান্তি এবং ৯০ ডিগ্রি পূর্ব দ্রাঘিমার ছেদবিন্দু এই জায়গাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং বলা যায় এটি সারা পৃথিবীর একমাত্র এরকম একটি জায়গা। মাদাগাস্কার উপর দিয়ে মকর ক্রান্তি গিয়েছে এবং শুনেছি সেটাকেই তারা গুরুত্ব দিয়ে রক্ষা করার ব্যবস্থা করেছে। আমাদের বেলায় শুধু কর্কট ক্রান্তি নয় তার সাথে ৯০ ডিগ্রি পূর্ব দ্রাঘিমাও আছে এবং সেটি একটি নির্দিষ্ট বিন্দু। বলা যেতে পারে এটি হচ্ছে একটা মানমন্দির তৈরি করার জন্য একেবারে আদর্শ-তম জায়গা।"
বাস্তবতা হলও যে মানমন্দির স্থাপনের জন্য কোন স্থানের অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমাংশ কোন প্রধান বিবেচ্য বিষয় না। এমনকি প্রধান ২০ বা ৩০ বিষয়ের একটিও না। মানমন্দির স্থাপনের জন্য প্রধান বিবেচ্য বিষয় হলও কোন স্থানের আবহাওয়া, জলবায়ু ও সমুদ্র সমতল থেকে উচ্চতা। সত্য কথা বলতে কি বাংলাদেশের প্রথম মানমন্দিরটি ফরিদপুর জেলার স্থাপনের প্রস্তাব করেছে জাফর ইকবাল স্যারের মতো মানুষ তা দখে আর তার ঐ লেখাটা পুরো পড়ে দেখার আগ্রহ উবে গিয়েছিল।
আমি কেন বলছি যে ফরিদপুর জেলায় দেশের প্রথম মানমন্দিরটি স্থাপন মানহীন যুক্তি ও হাস্যকর প্রস্তাবনা তার বিস্তারিত লিখেছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও বিজ্ঞান বিষয়ক জনপ্রিয় লেখক Farseem Mannan Mohammedy স্যার। বাংলাদেশে জ্যোতির্বিজ্ঞান বা অ্যাস্ট্রোনমি বিষক প্রাতিষ্ঠানিক চর্চার পথিকৃতও বলা চলে উনাকে। বাংলা ভাষায় জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ক একাধিক বই লিখেছেন ফারসীম মান্নান মোহাম্মদী।
জাফর ইকবাল স্যারের প্রস্তাবিত মানমন্দির ফরিদপুর জেলায় স্হাপনের সাথে দ্বীমত প্রকাশ করে তথ্য-উপাত্ত দিয়ে ফারসীম মান্নান মোহাম্মদী স্যার বিডিনিউজ২৪ডটকমে ৭ ই জুলাই, ২০১৯ "জ্যোতির্বিজ্ঞান গবেষণা এবং জাতীয় মানমন্দির স্থাপনা বিষয়ে" শিরোনামে একটি মতামত প্রকাশ করেছেন। ফারসীম স্যারের লেখার কিছু অংশ কোট করলাম:
"মানমন্দির স্থাপনের কিছু সুনির্দিষ্ট শর্ত আছে- আবহমণ্ডলীয় সুস্থিতি, পরিষ্কার আকাশ মেঘমুক্ত থাকার অনুপাত, বাতাসের প্রবাহ-আর্দ্রতা-ঘনত্ব, বাতাসে অ্যারোসল কিংবা অন্য কণার উপস্থিতি এবং দূষণ-মুক্ত (ধূলি ও আলো) পরিবেশ, উঁচু স্থান, কিছুটা লোক-বর্জিত নির্জনতা, আর্দ্রতা-মুক্ত আবহ, বিশ্ববিদ্যালয়ের নৈকট্য ও গবেষণা-পরিচালনার সক্ষমতা, প্রয়োজনীয় রসদের সুলভতা ও সরবরাহ নিশ্চিত করা, ভূমির সিসমিক সক্রিয়তা, বন্যা ও অন্যান্য মানদণ্ড। এইরকম প্রায় ১১টি সুনির্দিষ্ট শর্তের [২] বহুমাত্রিক সিদ্ধান্ত (multi-criteria decision analysis) বিবেচনার (এর কোনোটি না হলে হবে না এমন নয়, তবে কিছু শর্তের প্রয়োজন আছে যদি আপনি প্রকৃত পর্যবেক্ষণ, পরিমাপন ও ডেটা সংগ্রহে আগ্রহী হন) মাধ্যমে মানমন্দিরের স্থান নির্দিষ্ট করা উচিত।" ফারসীম মান্নান মোহাম্মদী স্যার বিডিনিউজ২৪ডটকমে ৭ ই জুলাই, ২০১৯
সকলের জ্ঞাতার্থে ও আগ্রহী পাঠকদের মূল কলাম পড়ার জন্য নিচে লিংক সংযুক্ত করলাম। জ্যোতির্বিজ্ঞান গবেষণা এবং জাতীয় মানমন্দির স্থাপনা বিষয়ে
আপনারা সকলেই অবগত আছেন যে অল্প কিছুদিন পূর্বে জ্যোতি-পদার্থ বৈজ্ঞানিকরা প্রথম বারের মতো ব্ল্যাক-হোল এর ছবি প্রকাশ করেছিল। সেই ছবি তুলা হয়েছিল পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে অবস্থিত বিশাল আকারের ৮ টি রেডিও-টেলিস্কোপের (যে টেলিস্কোপ দ্বারা অন্য গ্রহ-উপগ্রহ থেকে আগত রেডিও তরঙ্গ গ্রহণ করা হয়) সাহায্যে যেগুলোকে সমন্বিত ভাবে বলে Event Horizon Telescope। ঐ ৮ টি রেডিও-টেলিস্কোপের ২ টি চিলিতে, ৩ টি আমেরিকায়, ১ টি স্পেনে, ১ টি মেক্সিকো ও ১ টি দক্ষিণ মেরুর বিভিন্ন পাহাড়ের শীর্ষে অবস্থিত।
ঐ ৮ টি টেলিস্কোপের নাম ও সেগুলো কোন উচ্চতায় অবস্থিত তা নিম্নে উল্লেখ করা হলও।
The Atacama Large Millimeter/submillimeter Array (ALMA) (চিলির আতাকামা মরুভূমির উপরে অবস্থিত; উচ্চতা ৫ হাজার ৬০ মিটার)
The Atacama Pathfinder Experiment (APEX) (চিলির আতাকামা মরুভূমির উপরে অবস্থিত; উচ্চতা ৫ হাজার ১০০ মিটার)
Heinrich Hertz Submillimeter Telescope (আমেরিকার অ্যারিজোনা রাজ্যের একটি পর্বতের ৩ হাজার ১৮৪ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত)
James Clerk Maxwell Telescope (আমেরিকার হাওয়াই রাজ্যের মাউনা কেয়া পর্বতের ৪ হাজার ৯২ মিটার উচ্চতার একটি শীর্ষে অবস্থিত)
The Submillimeter Array (SMA) (আমেরিকার হাওয়াই রাজ্যের মাউনা কেয়া পর্বতের ৪ হাজার ৮০ মিটার উচ্চতায় একটি শীর্ষে অবস্থিত)
The Large Millimeter Telescope (মেক্সিকোর একটি পাহাড়ের ৪ হাজার ৬৪০ মিটার উচ্চতার একটি শীর্ষে অবস্থিত)
IRAM 30m telescope (স্পেনের একটি পাহাড়ের ২ হাজার ৮৫০ মিটার উচ্চতার একটি শীর্ষে অবস্থিত)
The South Pole Telescope (SPT) (দক্ষিণ মেরুর একটি পাহাড়ের ২ হাজার ৮০০ মিটার উচ্চতার একটি শীর্ষে অবস্থিত)
উপরে বর্নিত ৮ টি রেডিও-টেলিস্কোপ হতে প্রাপ্ত ছবি কম্পিউটার আ্যালগরিদম এর সাহায্যে একিভূত করে সেই ছবি সংশোধন করে মূল ব্লাক-হোল এর Event Horizon এর ছবি পাওয়া গিয়েছে। নিচে সংযুক্ট ছবিতে দেখা যাচ্ছে কিভাবে স্তরে-স্তরে সম্পূর্ন কাজটি সম্পন্ন করা হয়। The Event Horizon Telescope: How It Works
আপনি প্রশ্ন করতে পারেন কেন মহাকাশ গবেষণার জন্য স্থাপিত টেলিস্কোপগুলো সাধারণ স্থানে না বসিয়ে পাহাড়ের শীর্ষে স্থাপন করা হয়ে থাকে? উত্তটা আপনার পড়া স্কুল জীবনের সাধারণ বিজ্ঞান কিংবা ভূগোল বই এ পড়েছেন। মনে করিয়ে দিচ্ছি। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের অন্যতম উপাদান হলও জ্বলিয় বাষ্প। যে জ্বলিয় বাষ্প সময়ে সময়ে ঘনীভূত হয়ে প্রথমে মেঘে পরিণত হয় ও এর পরে বায়ু সম্পৃক্ত হলে বৃষ্টি আকারে ভূ-পৃষ্ঠে পতিত হয়। বায়ুমণ্ডলের সর্বনিম্ন স্তরকে বলে ট্রপোসফেয়ার যার উচ্চতা পৃথিবী পৃষ্ট থেকে প্রায় ১২ থেকে ১৬ কিলোমিটার। পৃথিবী পৃষ্ট থেকে যদি ১২ কিলোমিটার উচ্চতার মই তৈরি করা হয় ও সেই মই মেয়ে আপনি উপরে উঠতে থাকেন তবে প্রতি কিলোমিটার উপরে উঠার ফলে তাপমাত্রা প্রায় ১০ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড কমতে থাকবে। এই একই কারণে প্রায় ৯ কিলোমিটার উচ্চতার হিমালয় পর্বতের উপরে তাপমাত্রা থেকে মাইনাস ৪০ থেকে ৬০ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড। বিজ্ঞান বইতে আপনারা আর একটা বিষয় শিখেছেন যে গরম বাতাসের জ্বলিয় বাষ্প ধারণ ক্ষমতা বেশি ঠাণ্ডা বাতাস অপেক্ষা। যেহেতু বহু-পৃষ্ঠ থেকে উপরের দিকে বাতাসের তাপমাত্রা কমতে থাকে তাই বহু-পৃষ্ঠ অপেক্ষা উপরের বাতসে জ্বলিয় বাষ্পের পরিমাণও কমতে থাকে। মাইনাস ২০ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় বাতাসে জ্বলিয় বাষ্পের পরিমাণ প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে আসে।
কোন স্থানে মহাকাশ গবেষণার জন্য স্থাপিত টেলিস্কোপগুলো বসানোর প্রধান শর্ত হলও ঐ স্থানের বাতাসে জ্বলীয় বাষ্পের পরিমাণ কত কম। যে কারণে প্রতিটি দেশ মহাকাশ গবেষণার জন্য টেলিস্কোপগুলো স্থাপন করলে সেই দেশের সবচেয়ে উঁচু স্থানটি নির্বাচন করে যাতে করে অন্য গ্রহ-উপগ্রহ থেকে আগত মহাকর্ষীয় তরঙ্গ বাতেসে অবস্থিত জ্বলিয় বাষ্প দ্বারা সর্বনিম্ন পরিমাণ শোষিত হয়। পৃথিবী পৃষ্ঠের যে কোন স্থানে টেলিস্কোপ স্থাপন করা হউক না কেন অন্য গ্রহ-উপগ্রহ থেকে আগত মহাকর্ষীয় তরঙ্গ বাতেসে অবস্থিত জ্বলিয় বাষ্প দ্বারা শোষিত হওয়ার সমস্যা থেকেই যায়। যে সমস্যাটি দূর করার জন্য ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন মহাকাশে একটি টেলিস্কোপ পাঠাতে যাচ্ছে ব্ল্যাক হোলের ছবি (নির্দিষ্ট করে বলতে বলতে হয় ব্ল্যাক হোলের ইভেন্ট হরাইজনের ছবি) আরও নিখুঁত ভাবে তোলার জন্য। ভূ-পৃষ্ঠের জ্বলিয় বাষ্প সমস্যার জন্য যে একই কারণে আমেরিকার মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা ইতিমধ্যেই মহাকাশে পাঠিয়েছে হাবল টেলিস্কোপ ও আগামীতে পাঠানো প্রস্তুতি নিচ্ছে James Webb Space Telescope। উপরে দেখেছেন ব্ল্যাক-হোল এর ছবি তুলার জন্য যে ৮ টি টেলিস্কোপ ব্যব হার করা হয়েছে তার ২ টি চিলির আতাকামা মরুভূমিতে স্থাপন করা। এখানে সবাইকে মনে করিয়ে দিতে চাই যে চিলির আতাকামা মরুভূমি হলও পৃথিবীর দুই মেরু ব্যতীত মূল ভূখণ্ডের শুষ্কতম স্থান। এই মরুভূমিতে এমনও স্থান রয়েছে যে স্থানে সারা বছরে কোন বৃষ্টিপাত হয় না। ঠিক এই বৈশিষ্ট্যের কারণে পৃথিবীতে মহাকাশ গবেষণায় শীর্ষস্থানীয় প্রায় প্রতিটি দেশ নিজস্ব গবেষণা টেলিস্কোপ বসিয়েছে সেখানে।
কোন স্থানে মহাকাশ গবেষণার জন্য স্থাপিত টেলিস্কোপগুলো বসানোর আর একটি প্রধান শর্ত হলও ঐ স্থানের বাতাসে প্রতি ঘনমিটারে উপস্থিত ধূলি-কণা, রাসায়নিক পদার্থের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণা যেগুলোকে সমন্বিত ভাবে এরোসল কণা বলে তাদের পরিমাণ। বাংলাদেশের বায়ু দূষণ নিয়ে যারা গবেষণা করে বা সামান্যতম ধারণা রাখে তারা জানেন যে সারা বাংলাদেশের মধ্যে বায়ুতে সবচেয়ে বেশি এরোসল কণার উপস্থিতি থাকে ঢাকা থেকে দেশের পশ্চিম অঞ্চলের জেলা গুলোতে। বায়ু দূষণ পরিমাপের জন্য যে সূচক ব্যবহার করা হয়ে থাকে তা হলও প্রতি ঘনমিটারে পার্টিকুলেট ম্যাটার এর পরিমাণ। এক ঘনমিটারের মধ্যে কত মাইক্রোগ্রাম পার্টিকুলেট ম্যাটার আছে। পার্টিকুলেট ম্যাটার হলও বাতাসের মধ্যে বিভিন্ন ধূলি কণা, ময়লা, আবর্জনা, লতা-পাতার ভগ্নাংশ, ফুলে রেণু ইত্যাদিকে বুঝায়। সাইজ অনুসারে পার্টিকুলেট ম্যেটারকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়ে থাকে: ব্যাস ২ দশমিক ৫ মাইক্রোমিটার (PM 2.5) বা তার চেয়ে ক্ষুদ্র ও ১০ মাইক্রোমিটার এর চেয়ে ছোট। ১ মাইক্রোমিটার হলও ১ মিটারের ১০ লক্ষ ভাগের এক ভাগ বা ১ মিলিমিটারের ১ হাজার ভাগের এক ভাগ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে গ্রহণযোগ্য ২ দশমিক ৫ মাইক্রোমিটার দৈর্ঘ্যের পার্টিকুলেট ম্যাটার এর পরিমাণ এক ঘনমিটারের মধ্যে সর্বোচ্চ ১০ মাইক্রোগ্রাম ও ১০ মাইক্রোমিটার ব্যাস এর পার্টিকুলেট ম্যাটার এর পরিমাণ প্রতি ঘনমিটারের সর্বোচ্চ ২০ মাইক্রোগ্রাম। PM 2.5 এতটাই ক্ষুদ্র যে তা চোখে দেখা যায় না। ঢাকা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক এম এম হক ও তার সহযোগীরা ২০১৩ সালের ১২ই ডিসেম্বর গাজীপুরে PM 2.5 এর ঘনত্ব পেয়েছে প্রতি ঘনমিটারে ২৩১ দশমিক ৫ মাইক্রোগ্রাম ও ২০১৪ সালের জানুয়ারি মাসে ঢাকায় PM 2.5 এর ঘনত্ব পেয়েছে ২৪৬ দশমিক ৫ মাইক্রোগ্রাম। অর্থাৎ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে প্রায় ২৫ গুন বেশি পরিমাণ PM 2.5 বিদ্যমান ঢাকার ও তার চার পাশের শহর গুলোতে। PM 10 এর ঘনত্বও ১৫ থেকে ২৫ গুন বেশি।
নিচে বাংলাদেশের আকাশে PM 2.5 এর ঘনত্ব এর পরিমাণ এর একটি মানচিত্র সংযুক্ত করলাম যে মানচিত্রটি আমি নিজে তৈরি করেছি আমেরিকান মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা এর কৃত্রিম ভূ-উপগ্রহ হতে প্রাপ্ত চিত্র বিশ্লেষণ করে সেই সাথে নাসার কৃত্রিম ভূ-উপগ্রহ হতে প্রাপ্ত একটি চিত্রও সংযুক্ত করে দিলাম যা থেকে ভারত ও বাংলাদেশের আকাশে বায়ু দুষনের পরিমান বোঝা যায়। এই চিত্র হতে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে যে ফরিদপুর জেলার আকাশে ব্যাপক পরিমাণ এরোসল কণা উপস্থিত থাকে ও বাংলাদেশের অন্যতম বায়ু দুষিত এলাকা। একই মাচিত্র থেকে দেখা যাচ্ছে যে পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবন, খগড়াছতি ও রাঙ্গামাটি জেলা হলও সারা বাংলাদেশের সবচেয়ে কম বায়ু দূষণ সম্পন্ন জেলা। একই সাথে এই জেলা ৩ টি সমুদ্র সমতল থেকে বাংলাদেশের সবচেয়ে উঁচু স্থানে অবস্থিত।
এইবার ভেবে দেখুনতো জাফর ইকবাল স্যার বাংলাদেশের প্রথম মানমন্দিরটি স্থাপনের জন্য ফরিদপুর জেলার ভাঙ্গা উপজেলাকে মনোনীত করেছে তা উপরে বর্ণিত টেলিস্কোপের প্রধান ৩ টি শর্ত (উচ্চতা, বাতাসে জ্বলিয় বাষ্পের পরিমাণ, ও বাতাসে এরোসল কণা উপস্থিতি) পূরণ করে কি না?
টেলোষ্কোপ স্থানের অন্য একটি শর্ত হলও লোকালয় ও কৃত্রিম আলো উৎস থেকে মানমন্দিরের স্থানটি যেন যথেষ্ট দূরে অবস্থিত হয় যাতে করে শহরের কৃত্রিম আলো, টেলিযোগাযোগ ব্যবস্হা ও প্রচার মাধ্যমে তরঙ্গ অন্য গ্রহ-উপগ্রহ থেকে আগত রেডিও তরঙ্গকে দুষিত না করে। আরও ডজন সংখ্যা ব্যাখ্যা প্রদান করা যাবে যে জাফর ইকবাল স্যার প্রস্তাবিত ফরিদপুর জেলার ভাঙ্গা উপজেলা মহাকাশ গবেষণার জন্য টেলিস্কোপগুলো স্থাপনের জন্য কোন আদর্শ স্থান না; এমনকি বলা চলে সারা বাংলাদেশের সবচেয়ে অ-যোগ্য স্থান।
আশা করি বাংলাদেশ সরকার প্রস্তাবিত “বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মানমন্দির” স্থাপন করার জন্য বাংলাদেশের সবচেয়ে আদর্শ স্থানটিকে নির্বাচন করবেন যুক্তিহীন আবেগ বর্জন দিয়ে। যুক্তিহীন আবেগ দিয়ে আর যাই হউক বিজ্ঞান চর্চা হয় না এই কথাটা আমরা যত তাড়াতাড়ি বুঝবো তত দ্রুত বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ। নইলে বরাবরের মতো এশিয়ার দেশ গুলোর লিস্টে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে পিছন দক থেকেই প্রথম হতে হবে নিয়মিত ভাবে; যে স্থানে আমরা ইতিমধ্যেই অবস্থান করছি।
বিঃদ্রঃ লেখায় অনিচ্ছাকৃত অনেক বানান ভুল রয়েছে যা পরবর্তীতে সংশোধ করে দিবো (আপাতত বানান ভুলের জন্য ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি)
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে ডিসেম্বর, ২০২১ বিকাল ৫:৩৪