আমার ট্রুপ এগার জনের। এরমধ্যে আমরা পাঁচ জন একই গ্রামের। আমি আর বদিউজ্জামান বুদু ছাত্র, আ্ব্দুর রহমান ও তরিকুল ইসলাম কৃষক আর আ্ব্দুল বাকের রিকসা-ভ্যান চালক। অন্য ছ'জনের মধ্যে আমাদের পাশের গ্রাম চরমিরকামারি'র আব্দুর রহিম, জামাত আলী, আবুল কালাম আজাদ, সিদ্দিকুর রহমান, ঈশ্বরদী রেলগেইট এলাকার মোস্তাক আহমেদ্ও ছাত্র। সর্বশেষ জন আব্দুস সাত্তার, ওর বাড়ি জয়নগর, পেশায় মৌসুমী বা ছুটা ব্যবসায়ী।
সে যাইহোক, সময়টা বাংলাদেশের জন্মের ঊষালগ্ন অথবা বিশ্বমানচিত্রে পূর্ব পাকিস্তান নামটি চিরতরে মুছে যাওয়ার সন্ধিক্ষণ অর্থাৎ ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ বিকাল সাড়ে চারটার পর হঠাৎ করেই ঈশ্বরদী উপজেলার প্রায় সব গ্রামে কমবেশি আশ্রয়গ্রহণ করা মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্রগুলো গর্জে উঠলো মুহূর্মুহূ শব্দে। বিশ্বের তাবৎ রেডিও স্টেশন থেকে একযোগে ধোষণা করা হলো মুকিএযাদ্ধা ও ভারতীয় সেনাবাহিনীর যৌথকমাণ্ডের কাছে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী রেসকোর্স ময়দানে আত্মসমর্পন করেছে। সেই বিজয়ের মুহূর্তে উল্লাস প্রকাশ করতেই মুক্তিযোদ্ধাদের ঊর্দ্ধমুখী গুলি ছোঁড়া। সেদিন কে কত রাউণ্ড গুলি ফুটালো তার কোনো লেখাজোখা নেই।
এরপরই ট্রুপের প্রায় সব সদস্যের বায়না, ছুটি চাই, শুধু আজকের রাতের জন্য, বাড়ি গিয়ে বাবা-মা, ভাই-বোন ও আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে দেখা করেই সকালে আবার ফিরে আসবো। ঈশ্বরদী বা পাবনার কোথাও তখনো যৌথবাহিনী বিশেষ করে ভারতীয় বাহিনীর পদার্পন ঘটেনি। সেই অর্থে ঈশ্বরদীবাসী তখনো সম্পূণ মুক্ত নয়। ঈশ্বরদী শহর ও বাজার এলাকার বাঙালি মালিকানাধীণ সব বাড়িঘর ও দোকানপাট লুট ও দখল করে আছে স্থানীয় বিহারি, রাজাকার ও শান্তিকমিটির লোকজন। সেকারণে সবাইকে একসঙ্গে ছুটি দেয়া দেয়াও সমিচীন মনে হলো না। তবে ছুটি নিয়ে যে ক'জন বাড়ি গেল তাদের মধ্যে আ্ব্দুর রহমানও ছিল। সম্পর্কে আমরা চাচা-ভাতিজা, সমবয়সী। যাওয়ার সময় ওকে আবারও বলে দিলাম, বাজান, সকালেই চলে আসিস, কিন্তু।
ভাবলাম, ও বাপের বড় ছেলে, ওর যে অনেক দায়িত্ব। বাবা-মাকে দেখার জন্য উতলা হয়ে উঠেছে ওর মনটা।
পরদিন কিছু সময়ের ব্যবধানে সবাই অস্থায়ী শিবিরে ফিরে এলেও আাব্দুর রহমান ফিরলো না। স্থানীয় কৃষি গবেষণা কেন্দ্র, ইক্ষু গবেষণা ইন্সটিটিউট, রেশমবীজ গবেষণা কেন্দ্র, আলহাজ্ব টেক্সটাইল মিলস্, থানা, রেস্ট হাউজ সর্বত্র মিলে গড়ে উঠেছে পাকসেনাদের অস্থায়ী ক্যান্টনমেন্ট। এসব আস্তানাগুলোতে পাক হানাদাররা তখনো গিজগিজ করছে। একারণে আমরাও শহরে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রবেশ করি নি পরবর্তী দু'দিন।
১৭ ডিসেম্বর বিকালে আমি বাড়ি আসি। দেখেশুনে ফিরে যাচ্ছি এসময় আ্দুর রহমানের কথা মনে পড়লো। লোকজনের কাছে জানতে চাই, আ্ব্দুর রহমান কোথায়, গতকাল বিকাল থেকে তার কোনো খোঁজ নেই। গ্রামের কেউ কেউ বললো, গতকাল বিকেলে তাকে বাজারের দিকে যেতে দেখা গেছে।
মানুষজনের এই কথা শুনামাত্রই আমার বুকের মধ্যে একটা অজানা আশংকা খচখচ করে বিধতে লাগলো। কোনো যুদ্ধে আব্দুর রহমান মারা গেলে কোনো দুঃখ থাকতো না। কিন্তু স্বাধীনতা এনে দিয়ে সে কোথায় হারিয়ে গেল। মনকে সান্ত্বনা দিয়ে রাখলাম এই বলে যে, হয়তো সে দুরে কোথাও কোনো আত্মীয়বাড়িতে গেছে, এসে পড়বে 'ক্ষণ।
তেতাল্লিশ বছর হয়ে গেল, আ্ব্দুর রহমান আজও ফিরে আসে নি।
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই এপ্রিল, ২০১৫ সন্ধ্যা ৬:২০