শেষ রক্ষা হলো না গল্প সাজিয়েও
আশরাফ-উল-আলম
মামলা থেকে রেহাই পেতে গল্প সাজিয়েছিলেন মিরপুরের 'কসাই কাদের' নামে খ্যাত জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লা। কিন্তু বাঁচতে পারলেন না। ফাঁসির দড়িতে ঝুলতে হলো তাঁকে।
কাদের মোল্লা বরাবরই বলে আসছিলেন, তিনি কসাই কাদের নন। তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় মিরপুর এলাকায় ছিলেন না। কাউকে হত্যাও করেননি। তিনি মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার জন্য প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন বলেও দাবি করেন। কিন্তু তাঁর এসব দাবিকে ট্রাইব্যুনাল আষাঢ়ে গল্প বলে প্রত্যাখ্যান করেন। তাঁর বিরুদ্ধে কয়েক শ লোককে হত্যার অভিযোগ প্রমাণিত হয়। কিন্তু এ সত্ত্বেও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কাদেরকে ফাঁসির দণ্ডের পরিবর্তে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ দেন।
যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে খুশি হতে পারেননি কাদের মোল্লা। তাই তিনি ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন। অন্যদিকে একাত্তরে সাড়ে তিন শরও বেশি নারী-পুরুষকে হত্যাসহ আরো কয়েকটি হত্যা ও ধর্ষণের অভিযোগ আদালতে প্রমাণিত হলেও কাদের মোল্লার শুধু যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায় শুনে ট্রাইব্যুনালে উপস্থিত বিশিষ্ট ব্যক্তিরা তৎক্ষণাৎ হতাশা ব্যক্ত করেন। বিস্ময় প্রকাশ করেন মামলার প্রসিকিউটররা। মামলার প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ আলী তাৎক্ষণিক প্রশ্ন তোলেন, 'আর কতজনকে হত্যা বা ধর্ষণ করলে আসামিকে ফাঁসি দেওয়া যাবে?' ট্রাইব্যুনালে রায় শুনতে আসা যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের কেউ কেউ ক্ষোভে-দুঃখে বলেন, 'বরং আমরা যাঁরা মুক্তিযুদ্ধ করেছি, তাঁদেরকেই ফাঁসিতে ঝোলানো হোক।'
এ ধরনের মর্মস্পর্শী সব হতাশাধ্বনির পাশাপাশি সারা দেশে সর্বস্তরের মানুষের কণ্ঠে উচ্চারিত হয়- 'এ রায় মানি না।' মানুষ নেমে আসে রাজপথে। দুপুর থেকে রাত পর্যন্ত চলে প্রতিবাদ, বিক্ষোভ। সন্ধ্যার পর থেকে উত্তাল হয়ে ওঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা। মশাল, মোমবাতি জ্বালিয়ে দীর্ঘ মিছিল নিয়ে একে একে এসে জড়ো হতে থাকে বিভিন্ন সংগঠনের কর্মীরা। তারা স্লোগানে স্লোগানে মুখর করে তোলে শাহবাগ থেকে টিএসসি চত্বর পর্যন্ত। সবার কণ্ঠে একই দাবি- 'কাদের মোল্লার ফাঁসি চাই।' শাহবাগে প্রতিষ্ঠিত হয় গণজাগরণ মঞ্চ। সারা দেশে এ ধরনের মঞ্চ তৈরি করে জনগণ কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবি করতে থাকে।
জনগণের অব্যাহত দাবির মুখে ১৮ ফেব্রুয়ারি ট্রাইব্যুনালের যেকোনো রায়ের বিরুদ্ধে সরকারকে আপিল করার সুযোগ দিয়ে ট্রাইব্যুনাল আইন সংশোধন করে সরকার। এরপর ৩ মার্চ সরকার ও ৪ মার্চ কাদের মোল্লা আপিল করেন। সরকারের আপিলে কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ডাদেশ চাওয়া হয়। অন্যদিকে কাদের মোল্লা নিজেকে নির্দোষ দাবি করে খালাস চেয়ে আপিল করেন।
আপিল বিভাগে শুনানি শেষে কাদের মোল্লার আপিল খারিজ করে সরকারের আপিল মঞ্জুর করা হয়। গত ১৭ সেপ্টেম্বর আপিলের রায় দেওয়া হয়। রায়ে কাদের মোল্লাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার আদেশ দেওয়া হয়। গত ৫ ডিসেম্বর পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়। এরপর শুরু হয় দণ্ড কার্যকর করার প্রক্রিয়া।
'একাত্তরে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং নিয়েছিলাম'- কাদের মোল্লার এই বক্তব্য মিথ্যা বলে প্রমাণিত আপিল বিভাগেও। আদালত তাঁর বক্তব্য গ্রহণ করেননি।
ট্রাইব্যুনালে কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষ্য দেওয়া শেষ হলে তাঁর পক্ষে ছয়জন সাক্ষী সাক্ষ্য দেন (সাফাই সাক্ষী)। সাফাই সাক্ষী হিসেবে তিনি নিজেই নিজের পক্ষে গত বছর (২০১২ সালের) ডিসেম্বর ট্রাইব্যুনালে জবানবন্দি দেন। জবানবন্দিতে তিনি বলেন, '১৯৭১ সালের ১২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্রামের বাড়ি ফরিদপুরের আমিরাবাদ চলে যাই এবং মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময়ই গ্রামের বাড়িতে অবস্থান করি। গ্রামে অবস্থানকালে বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ ও হাইস্কুলের প্রায় ৩০ জন ছাত্রের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং নেই।' কাদের মোল্লা বলেন, ২৩ মার্চ থেকে ১ মে ১৯৭১ পাকিস্তান সেনাবাহিনী ফরিদপুরে পৌঁছার দিন পর্যন্ত অন্যদের সঙ্গে তিনি মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং চালিয়ে যান। তিনিসহ অন্যদের ডামি রাইফেল দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং দেন সেনাবাহিনীর জুনিয়র কমিশন অফিসার (জেসিও) মফিজুর রহমান।
জবানবন্দিতে আবদুল কাদের মোল্লা বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি বাড়িতে অবস্থান করে আকাশবাণী কলকাতা, স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র এবং পাকিস্তান রেডিওর খবর নিয়মিত শুনতেন। গ্রামে অবস্থানের সময় মৌলভী মো. ইসহাক ওরফে ধলা মিয়া পীর সাহেবের বাড়িতে যেতেন এবং ওনার দুই মেয়েকে পড়াতেন। ওই পীর সাহেবের এক জামাতা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন এবং পীর সাহেবের ছেলেরা সবাই স্বাধীন বাংলার সমর্থক ছিলেন। পীর সাহেব মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁকে (কাদের মোল্লা) কিছু টাকা দেন ব্যবসা-বাণিজ্য করার জন্য। এ নিয়ে তিনি ব্যবসা শুরু করেন চৌদ্দরশি বাজারে। ওই বাজারটি কাগজে-কলমে সাড়ে সাতরশি বাজার নামে পরিচিত। বাজারটির হাটবার ছিল শনি ও মঙ্গলবার, তবে প্রতিদিন বাজার বসত। ১৯৭১ সাল এবং ১৯৭২ সালের প্রায় পুরো সময় তিনি প্রতি সপ্তাহে ওই দুই দিন বাজারে যেতেন এবং পীর সাহেবের বাজারের ঘরে বসতেন এবং ব্যবসা করতেন।
ট্রাইব্যুনাল-২ কর্তৃক ঘোষিত মামলার রায়ে বিষয়টি উঠে এসেছে। রায়ে প্রশ্ন তোলা হয়, কাদের মোল্লার এই কাহিনী বিশ্বাসযোগ্য কি? রায়ে এর জবাবও দেওয়া হয়, কাদের মোল্লা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হল শাখার ইসলামী ছাত্র সংঘের সভাপতি ছিলেন এটা স্বীকৃত। তিনি ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজে পড়ার সময়ও জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘের নেতা ছিলেন। তাঁর পক্ষে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেওয়ার কাহিনী সত্য হতে পারে না। ১৯৯৮ সালে করাচি থেকে প্রকাশিত মহিউদ্দিন চৌধুরীর লেখা বই 'সানসেট অ্যাট মিডওয়ে'তে উল্লেখ আছে, ইসলামী ছাত্রসংঘের সব কর্মীই আলবদর ছিল। এ ছাড়া নিউ ইয়র্ক টাইমসের ১৯৭২ সালের ৩ জানুয়ারি সংখ্যায় প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, আলবদর বাহিনী জামায়াতে ইসলামীর পরিকল্পনা বাস্তবায়নকারী সংস্থা ছিল।
রায়ে আরো বলা হয়েছে, এটা প্রমাণিত যে কাদের মোল্লা মুক্তিযুদ্ধের সময় মিরপুর এলাকায় ছিলেন এবং সেখানে তিনি নিজে উপস্থিত থেকে বিভিন্ন অপরাধে অংশ নিয়েছেন। কাজেই গ্রামের বাড়িতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ গ্রহণ আষাঢ়ে গল্প ছাড়া আর কিছু নয়।
দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগও কাদের মোল্লার মুক্তিযুদ্ধে প্রশিক্ষণ নেওয়ার গল্প বিশ্বাস করেননি। রায়ে বলা হয়েছে, আসামি মিরপুরের ঘটনাস্থলে থেকে মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছেন।
শেষ রক্ষা হলো না গল্প সাজিয়েও ][ আশরাফ-উল-আলম
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
যুক্তরাষ্ট্রে ইসরাইল বিরোধী প্রতিবাদ বিক্ষোভ
গাজায় হামাস উচ্ছেদ অতি সন্নিকটে হওয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিউইয়র্ক ও লসএঞ্জেলসে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পরেছিল। আস্তে আস্তে নিউ ইয়র্ক ও অন্যান্ন ইউনিভার্সিটিতে বিক্ষোভকারীরা রীতিমত তাঁবু টানিয়ে সেখানে অবস্থান নিয়েছিল।
... ...বাকিটুকু পড়ুন
৫০১–এর মুক্তিতে অনেকেই আলহামদুলিল্লাহ বলছে…
১. মামুনুল হক কোন সময় ৫০১-এ ধরা পড়েছিলেন? যে সময় অনেক মাদ্রাসা ছাত্র রাজনৈতিক হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছিল। দেশ তখন উত্তাল। ঐ সময় তার মত পরিচিত একজন লোকের কীভাবে মাথায় আসলো... ...বাকিটুকু পড়ুন
মেহেদীর পরিবার সংক্রান্ত আপডেট
মার্চ মাস থেকেই বিষয়টি নিয়ে ভাবছিলাম। ক'দিন আগেও খুলনায় যাওয়ার ইচ্ছের কথা জানিয়েও আমার বিগত লিখায় কিছু তথ্য চেয়েছিলাম। অনেক ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও মেহেদীর পরিবারকে দেখতে আমার খুলনা যাওয়া হয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন
'চুরি তো চুরি, আবার সিনাজুরি'
নীলসাধুকে চকলেট বিতরণের দায়িত্ব দিয়ে প্রবাসী ব্লগার সোহানীর যে তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছিল তা বিলম্বে হলেও আমরা জেনেছি। যাদেরকে চকলেট দেওয়ার কথা ছিল তাদের একজনকেও তিনি চকলেট দেননি। এমতাবস্থায় প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন
বরাবর ব্লগ কর্তৃপক্ষ
আমি ব্লগে নিয়মিত নই।
মাঝে মাঝে আসি। নিজের লেখা পোষ্ট করি আবার চলে যাই।
মাঝেমাঝে সহ ব্লগারদের পোষ্টে মন্তব্য করি
তাদের লেখা পড়ি।
এই ব্লগের কয়েকজন ব্লগার নিজ নিক ও ফেইক... ...বাকিটুকু পড়ুন