বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে যদি আপনি কেউকে জিজ্ঞেস করেন, আলেম কাকে বলে?
শতকরা ৯৯ জন উত্তর দিবেন, আলেম মানে তো হুজুর! যারা মাদ্রাসায় লেখা পড়া করে তারাই আলেম।
বলা বাহুল্য উত্তরটি নিঃসন্দেহে ভুল। মাদ্রাসায় পড়লেন, দাঁড়ি টুপি পড়লেই কেউ আলেম হয়ে যান না। আলেম মানে হচ্ছে জ্ঞানী। যিনি কোন বিষয়ে সঠিক ও সুক্ষ জ্ঞান ধারন করেন তিনিই আলেম। তবে শব্দিক অর্থ দিয়ে আলেমের পরিচয় সম্ভব নহে, পারিভাষিক অর্থ দ্বারা আলেমের পরিচয় পাওয়া যায়। আলেম হবার জন্য কারো মাদ্রাসায় পড়া জরুরী নয়। ধার্মিক প্রেক্ষাপটে বিশেষ করে ইসলামি প্রেক্ষাপটে যে ব্যক্তি কোরআন, হাদীস, ইজমা কিয়াস ও অন্যান্য বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করতে সক্ষম হবেন এবং যিনি পরিবর্তিত সমাজ ব্যবস্থার সাথে প্রচলিত দ্বীনের সঠিক সমন্বয় ঘটানোর ব্যাপারে নিজ অবস্থানকে যৌক্তিকভাবে প্রমান করতে পারবেন, তিনিই একজন ধর্মীয় আলেম। আমাদের দেশে প্রকৃত কোন ধর্মীয় আলেম আছে কি না তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। অন্য ধর্মের কথা জানি না, তবে মুসলিম প্রধান দেশ হিসেবে বাংলাদেশে ইসলামিক আলেমদের সংখ্যা দিন দিন আশংকাজনকহারে কমে যাচ্ছে।
বাংলাদেশে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যানে যে সকল তথাকথিত আলেম বিখ্যাত হয়েছেন বা শ্রোতা প্রিয়তা পেয়েছেন দুই একজন বাদ দিয়ে অধিকাংশ বিভিন্ন দল, আকীদা বা মতে বিভক্ত। সেই সাথে আছে আত্ম অহংকার, ক্ষমতার দাপট, একে অন্যের সাথে রেষারেষি ও গীবত। অথচ একজন প্রকৃত আলেম কখনই অহংকারী হবেন না। তিনি কখনই নিজের ক্ষমতার কথা, নিজের প্রভাবের কথা মানুষকে জোর গলায় জানাবেন না। কিন্তু আমরা ইউটিউবের মাধ্যমে দেখেছি আমাদের বিখ্যাত সব আলেমরা কি পরিমান অহংকারী, ক্ষমতা প্রয়োগ করতে চায়, নিজ সুবিধার কারনে কোরান হাদীস ব্যবহার করে। আমাদের দেশের মানুষ এই সব জেনে বুঝেও এদেরকে অনুসরন করে। কারন অলস বাংলাদেশী মুসলমানরা নিজে কোরান হাদীস পড়বে না, বুঝবে না। তারা শটকার্ট প্রিয়। অন্যের লেজ না ধরলে আমরা সাহস পাই না। অবশ্য তাদেরকে ধন্যবাদ কারন এত লেজ ধরে টানাটানির কারনে অনেক কিছুই দৃশ্যমান হচ্ছে।
আমি খুব অবাক হই যে, একটি অত্যন্ত ঘৃন্য বিষয়ে আমাদের এই সব তথাকথিত আলেমরা একজোট। তাঁরা তাদের বিভিন্ন বক্তব্যে, ওয়াজে ইনিয়ে বিনিয়ে যে সকল ব্যক্তিদের ইসলামী শহীদ হিসেবে আখ্যা দেন, তারা সকলের জামাতে ইসলামির চিহ্নিত যুদ্ধপরাধী। কি দুর্ভাগ্য ! আমাদের হুজুররা, ধর্মীয় আলেমরা দেশের সাথে বেঈমানী করা মানুষগুলোর পক্ষে কথা বলেন। তাঁরা এই বলে যুক্তি দেন - উনারা কতখানি অপরাধী আমরা জানি না, আমরা দেখি নাই। যদি তারা অপরাধ করেন, তার শাস্তি তারা পেয়ে গেছেন। এই যুক্তিতে তাদেরকে অপবাদ দেয়া যাবে না গালি দেয়া যাবে না। অথচ আমাদের হুজুরদের ৯৯% প্রতিনিয়ত অভিজিৎ, হুমায়ূন আজাদ সহ মৃত বা অন্যায়ভাবে হত্যাকৃত আরো অনেক ধর্ম অবিশ্বাসীদের গালাগালি করেন। এই ক্ষেত্রে কোন যুক্তি নেই, হাদীস নেই, কোরান নেই। সবচেয়ে বড় কথা- যে হুজুররা না দেখা কোন কিছুতে সহজে বিশ্বাস করতে চান না, সেই হুজুররা অদেখা সৃষ্টিকর্তাকে বিনাবাক্যে বিশ্বাস করেন। ঈমান আনেন। শুধু ধর্মীয় কারনে, মুসলিম ভাতৃত্ববোধের নামে যারা অন্যায়ভাবে মানুষ হত্যাকে জায়েজ ভাবে, অনুতপ্ত না হয়ে সামগ্রিক কর্মকান্ডকে একটি যুদ্ধকালীন রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত হিসেবে চালিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে এবং এই সংক্রান্ত কাজের পিছে যারা নেতৃত্ব দিয়েছেন তাদেরকে 'শহীদ' এবং তাদের উপর আরোপিত শাস্তিকে অস্বীকার করে 'অন্যায়- অবিচারের' তকমা দেন - তাদেরকে আমি ব্যক্তিগতভাবে আলেম বলে বিশ্বাস ও স্বীকার করি না। মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব - কারন মানুষের বিবেক আছে। আমি এই বিবেকের কাছে দায়বদ্ধ।
শীতকালে বাংলাদেশে ওয়াজ মাহফিল হয়। মানুষ ধর্মীয় নানা বিষয়ে জানতে পারেন, আলোচনা সভা হয়। এই ওয়াজ হচ্ছে গ্রামীন অঞ্চলে অন্যতম বিনোদন। আমাদের দেশে বর্তমানে ওয়াজের হট টপিক হচ্ছে - কোন হুজুর কে কি বলেছে, সেটার পক্ষে বিপক্ষে কথা বলা, অন্যের গীবত করা। দুই, আত্ম অহংকার করা, নিজের প্রচারনা করা, নিজের ক্ষমতা জাহির করা, কে কত ওয়াজ করেছেন, কিভাবে গিয়েছেন ইত্যাদি। তিন, মহিলাদের পর্দা!।
যে কয়টা ওয়াজে আমি গিয়েছে বা দেখেছি বা শুনেছি প্রায় সব ওয়াজের বক্তাদের কথা শুনলে মনে হয়- দেশে আন্তর্জাতিক চিৎকার প্রতিযোগিতা চলছে কিংবা তাদেরকে বলা হইছে ওয়ার ক্রাই বা প্রতিপক্ষের মনে ভয় ধরার জন্য যুদ্ধকালীন চিৎকার দেয়ার জন্য। ইয়া আল্লাহ! উনাদের কে বুঝাবে - ইসলাম শান্তির ধর্ম।
গত বছর থেকে লক্ষ্য করে আসছি, আমাদের মাদ্রাসাগুলোতে শিশু নির্যাতন ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। ছেলে-মেয়ে কারো রক্ষা নাই। কয়েকদিন আগে এক শিশু বালককে যৌন নির্যাতনের কারনে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছিলো। আজকে গাজীপুরের কালীগঞ্জে এক মাদ্রাসা শিক্ষকের থাকার কক্ষের ওয়ারড্রোব থেকে চার বছরের এক ছেলে শিশুর লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। তাকে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
আমরা কি কিউ বলতে পারি, শুধুমাত্র মাদ্রাসায় কেন শিশুকামী এই সব জানোয়ারদের দেখা যায়? কেন এই চুড়ান্ত ভয়াবহতা, বিকৃতি? এর জবাব অনেকেরই ভালো লাগবে না। দেশের অনেক মাদ্রাসা আছে যেখানে নুন্যতম মানবিক সুযোগ সুবিধা নাই। দরিদ্র এতিম বাচ্চাদের নিয়ে চলছে অমানবিকতার চুড়ান্ত। পড়া শিখানোর নামে, মুখস্ত করার নামে চলে ভয়াবহ শারিরীক নির্যাতন। এই সব নির্যাতনের কোন কোন পর্যায়ে তা রূপ নেয় পাশবিক যৌন নির্যাতনেও। যে প্রচন্ড মানসিক চাপে এই ছোট বাচ্চাগুলোর শৈশব কাটে তাতে বড় হয়ে তাদের মানসিক বিকৃতি ঘটা অস্বাভাবিক কিছু না। বরং সেটাই যৌক্তিক সম্ভবনা।
আফসোসের বিষয়, এই বিকৃত অনাচার নিয়ে আমাদের হুজুররা বা আলেমরা তেমন সোচ্চার নন। আজকে আপনি অনুগ্রহ করে ইউটিউবে একটু সার্চ দিয়ে দেখবেন দেশের মাদ্রাসায় এই ধরনের ঘটনার ব্যাপারে কয়টি ওয়াজ পান, প্রকাশ্যে কে কি বলেছেন। আমি হয়ত খারাপ মানুষ, শয়তান ( এই লেখা পড়লে প্রিয় হুজুররা আমাকে হয়ত এই নামেই ডাকবেন) তাই হুজুরদের ভালো কথা খুঁজে পাই নি, খুঁজে পেয়েছি মাদ্রাসার সাথে বাংলা ও ইংলিশ মাধ্যমের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাথে অসুস্থ তুলনা। আমাদের আলেমরা, আমাদের হুজুররা বাংলা বা ইংরেজি মাধ্যমের খারাপ দিক দিয়ে মাদ্রাসায় সংঘটিত ভয়াবহ অন্যায়ের তুলনা করে ভালো মন্দের বিচার করেন। অথচ একটা খারাপ বা অন্যায় দিয়ে আরেকটি খারাপ বা অন্যায় জাস্টিফাইড হয় না। এটাই প্রকৃত আলেম আর তথাকথিত আলেমদের মধ্যে পার্থক্য। আমি খুব আশাবাদী মানুষ, আমি বিশ্বাস করি, নিশ্চয় আমাদের কোন না কোন আলেম, এই বিষয়ে ওয়াজ করেছেন, কথা বলেছেন, কালোকে কালো আর সাদাকে সাদা বলতে তিনি কোন ভয় করেন নি, দ্বিধা করেন নি।
আরেকটি বিষয় - বাংলাদশে ধর্ম চর্চা এখনও খুব প্রাগৈতিহাসিক পর্যায়ে আছে। একটা প্রচন্ড কামুম, বর্বর, হিংসুট এবং জেলি ফিস মস্তিস্কের জাতিকে ধর্ম দিয়ে জোর করে অবদমিত করে রাখা হয়েছে। ফলে হাজার হাজার চটি পেইজ, পর্ণগ্রাফিক পেইজে দেখবেন সব কিছু দেখে শুনে ইসলামের দাওয়াত দেয়া হয়, লাইক দিয়ে কাউন্ট করা হয় কে আল্লাহকে ভালোবাসে, কে নবীকে ভালোবাসে। ধার্মিকতার নামে কি প্রচন্ড বিকৃতি! পার্ভাসন কোথায় গেছে যে- চটি পেইজে গিয়ে সৃষ্টিকর্তাকে ভালোবেসে লাইক দিয়ে আসতে হবে।
যাইহোক, যদি আপনি ধার্মিক হন, তাহলে মনে রাখবেন - যে জাতির আলেমমা মিথ্যে নিয়ে পড়ে আছে, গীবত নিয়ে পড়ে আছে, অহংকার করে, মিথ্যে অপব্যাখ্যা করে কোরান ও সুন্নাহের সেই জাতীর অবস্থা ভয়াবহ হতে যাচ্ছে। আর যদি অধার্মিক হন তাহলে মনে রাখবেন প্রকৃতির বিচার বলে একটা ব্যাপার আছে। এই বিচার খুবই সুক্ষ এবং ভয়াবহ!
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা জানুয়ারি, ২০২০ বিকাল ৫:১২