সম্প্রতি আমার দেখা ছবিগুলোর মাঝে একটি ছবির নাম ‘ইংলিশ ভিংলিশ’। ভারতীয় এই ছবিটি নানা কারণে আলোচনায় এসেছিলো। ছবির গল্প ভারতীয় গতানুগতিক ছবির গল্পের বাইরে, চমৎকার সঙ্গীত ইত্যাদিকে ছাড়িয়ে শ্রীদেবির দীর্ঘদিন পর চলচ্চিত্রে প্রত্যাবর্তন আলোচনার একটা বড় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। আমিও সেই আগ্রহ থেকেই ছবিটি দেখেছিলাম।
ছবিটায় একটা অতিথি চরিত্রে অভিনয় করেছেন অমিতাভ বচ্চন। এবং সর্বোপরি একটি ব্যতিক্রম ধর্মী ছবিই এটি। এই ছবি দেখে নিজের ভেতর নানান দিকে সাহস অর্জন করা যায়। কিন্তু সেসব মুখ্য বিষয় নয়। মুখ্য বিষয় হলো, ছবির শুরুতে অমিতাভ বচ্চনকে উৎসর্গ করতে গিয়ে যে বাক্যটি বলেছে তা হলো মুখ্য। সেখানে লিখা ছিলো, ‘ভারতীয় চলচ্চিত্রের ১০০ বছর, অমিতাভ বচ্চনের ৭০ বছর।’ ঘটনা হৈলো অমিতাভ বচ্চনের বয়স ২০১২ সালে ৭০ হৈছে। তাদের চলচ্চিত্রের বয়স একশ’ বছর হৈছে। এই একশ বছরে তাদের (ভারতের) চলচ্চিত্র নিজের পায়ে তো নিজে দাঁড়াইছেই, দাঁড় করাইছে পুরা ভারতবাসীকে। পৃথিবীর অনেক দেশে শুধুমাত্র সিনেমার কারণেই ভারতকে চেনে। কিছুদিন আগে ঢাকায় শর্ট ফিল্ম ফ্যাস্টিভ্যালে ২০০৭ এর রাশিয়ান একটা মুভি দেখলাম, যদিও প্রেক্ষাপটটা আরও বছর ৩০ আগের। ছবিটায় একটা শিশু একটা ডিমের বিনিময়ে একটা সিনেমা দেখতে চায়। কিন্তু গ্রামের কিছু দুষ্টু ছেলে তাকে ডিম থাকতেও ছবি দেখতে দেয় না। এই ছবির গল্প সেই সুদূর রাশিয়ার কোনও এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে। আর এই সিনেমায় সিনেমাহলে যে ছবিটা চলে তাও অমিতাভ বচ্চনের। তাহলে বোঝাই যায়, ভারতীয় সিনেমার দৌর কোন পর্যন্ত। আর সম্প্রতি এই সিনেমার দৌড়াত্ব ঢাকায়ও এসে পড়তে চাইতেছে। চাইতেছে বললে একটু ভুলই হবে। বলতে হবে এসে পড়েছে। কিছুদিন আগে এমনই এক লক্ষ্য নিয়ে ঢাকা ঘুরে গেলেন পশ্চিমবঙ্গের তিন বিশিষ্ট চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব। আর তারা হলেন- গৌতম ঘোষ, প্রসেঞ্জিৎ চট্টোপাধ্যায় ও জিৎ। এরা একেক জন একেক ধরণের ছবির সাথে সম্পৃক্ত থাকলেও ছবির মূল বিষয় যে বাণিজ্য তারা মূলত বাংলাদেশে এসেছিলো ঐ বাণিজ্যের টানেই। তারা চায় তাদের ছবি আমাদের সিনেমাহলগুলোতে চলুক। এতে আমাদের সাথে তাদের সংস্কৃতির লেনদেন হবে। তবে আদতে এই সংস্কৃতির লেনদেনের চাইতেও বড় বিষয় এখানে বাণিজ্য। কারণ, আমাদের বাংলাদেশ তাদের একটা বড় বাজার বলেই আমরা দেখতে পাচ্ছি। আমাদের মা-খালা, বোন, বোনের বান্ধবি, নিজেদের বান্ধবীরা তাদের সব কিছুরই ভক্ত। আমরা ছেলেরাও তাদের দেশের নায়িকা প্রিয়াঙ্কা, দিপীকা, আনুশকাসহ কমবেশী সবার ভক্ত। আমাদের কাছে তারা আবার আইকনও। এই অবস্থায় আমাদের দেশে ভারতের ছবি তো আসতেই পারে। আসলেই বাণিজ্য। আর এই বাণিজ্য তাদের করতে দিতে যে আমরা চার পায়ে (গরু/গাধার মতো) খাড়া। তাদের এই ‘সাংস্কৃতিক লেনদেন’ এর সাথে যদি বাণিজ্যের সম্পর্ক না থাকতো তবে আমি একপায়ে রাজি হয়ে যেতাম। কিন্তু এখন এই ‘সাংস্কৃতিক লেনদেন’ এর নামে এই বাণিজ্যের আমি পক্ষে না। কারণ, আমাদের চলচ্চিত্রে বয়স অমিতাভের সিনেমাযাত্রার বয়সেরও সমান না। আমাদের ছবি এখনো নিজের পায়েই দাঁড়াতে পারে নি। আমাদের কাছে আমাদের নায়কেরা এখনো আইকন হতে পারে নি। আমাদের চলচ্চিত্রকারেরা এখনো বিকল্প পেশার কথা চিন্তা করে। আমাদের সিনেমাহলগুলোর পরিবেশ জঘণ্য। আমাদের সিনেমা নির্মাণের পদ্ধতি মান্ধাতা আমলের। এতসব প্রতিবন্ধকতার পরও আমাদের দেশে ছবি হচ্ছে। মাঝে মাঝে ভুইফোর হিসেবে কিছু ছবি সিনেমাহলে দর্শকও টানছে। এ আশার কথা সত্যি, কিন্তু এই অবস্থায় সরকার কি করে এমন সিদ্ধান্ত নিয়ে নিতে পারে? যেখানে এত চেষ্টার পরও বাংলাদেশী চ্যানেলগুলো পর্যন্ত ভারতে চালানোর ব্যবস্থা করা গেলো না। তাই যদি তাদের সিনেমা আমাদের দেশের সিনেমাহলগুলোতে চালাতেই হয়, আমি যে দাবিগুলো করবো, তা পুরণ হলেই কেবল আমি সেই সিনেমা আমাদের সিনেমাহলগুলোতে চালাতে দিতে পারি। সেখানে প্রথম দাবি, আমাদের দেশের সবগুলো টিভি চ্যানল ভারতে দেখার ব্যবস্থা করা। ভারতীয় প্রযোজকেরা যেসব ছবি বাংলাদেশে এনে দেখাতে চান, একই গল্পের একই প্রতিষ্ঠানের ছবি বাংলাদেশী নির্মাতা ও শিল্পীদের দিয়ে নির্মাণ করিয়ে আগে বাংলাদেশে মুক্তি দেয়া। যে পরিমাণ ছবি ভারত থেকে (পশ্চিমবঙ্গ থেকে) বাংলাদেশে বছরে আসবে, ঠিক সে পরিমান বাংলাদেশী ছবি ভারতে মুক্তি দেয়ার ব্যবস্থা করলেই আমি এতে রাজি হবো। কিন্তু তা হবার নয় বলেই মনে হচ্ছে। কারণ ঐসব তারকাদের পক্ষেই কথা বলতে দেখেছি স্বয়ং তথ্যমন্ত্রীকে। বেশ কয়েকজনকে তো উনার নামে তাঁদের কাছ থেকে সুবিধা আদায়ের অভিযোগও করতে শুনলাম। আমিও সন্দেহে সেইসব কথা শুনি। তাদের বলতে শুনি যেই মন্ত্রী চলচ্চিত্রকে একটা শিল্প হিসেবে ঘোষণা করালেন। যিনি সেন্সর প্রথা বিলুপ্তের ঘোষণা দিয়ে সার্টিফিকেশন ব্যবস্থা জারির কথা জানালেন। তিনি কিনা চলচ্চিত্রশিল্পের এই সম্ভাবনার সময়ে এসে আত্মঘাতি একটি সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছেন? তাই প্রশ্নগুলোর উত্তর জরুরী। আর সেদিন কোনও চুক্তি হয়েছে কিনা কোনও স্পষ্ট ধারণাও পাওয়া যাচ্ছে না। চুক্তি হয়ে থাকলে সেই চুক্তিতে কি আছে? তা জন সমক্ষে প্রকাশ হচ্ছে না কেনো? এসবও ভাবনার বিষয়। এসব প্রশ্নের উত্তর মিললেই অনেক কিছু স্পষ্ট হয়ে যেতো। তাই প্রশ্নগুলোর উত্তর জরুরী।
বাংলাদেশ চলচ্চিত্র দীর্ঘ দিন পর এখন একটা সম্ভাবনা নিয়ে হাজির হচ্ছে। তরুণ, উদ্দমী ও মেধাবী চলচ্চিত্রকারেরা চলচ্চিত্রের দিকে ঝুঁকছেন। এই সম্ভাবনাটাকে এখন কাজে লাগানো উচিত। আর তা কাজে লাগলে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের চেহারা বদলাতে আর খুব বেশী সময় লাগবে না। এই সময়ে সরকারের এমন আত্মঘাতী সিদ্ধান্তের কোনও যৌক্তিকতাই নেই। তাই আপাতত বাংলাদেশে ভারতের সিনেমা আসুক তা প্রত্যাশা করি না। প্রত্যাশা করি আমাদের তথ্যমন্ত্রী এসব বিতর্কের ঊর্ধ্বে ওঠে চলচ্চিত্রের জন্য কিছু একটা করবেন। চলচ্চিত্রের সুদিন যে সামনেই।