somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্প: রসায়নবিদের প্রেম [সম্পূর্ণ]

২৮ শে আগস্ট, ২০১৪ বিকাল ৪:২৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :





সে অনেকদিন আগের কথা, এক দেশে বাস করত এক রসায়নবিদ। সে ছিল অসম্ভব সুন্দর। সে এতটাই সুন্দর ছিল যে, তার সৌন্দর্য দেখতে আকাশের পরীরা রাতে নেমে আসতো পৃথিবীতে। সে যখন স্নান করত নদীতে- মৎস্যকুমারীরা তার চারপাশে খেলা করত আর তাকে ছুঁয়ে ধন্য হত। শুধু রসায়নশাস্ত্রে নয়, তলোয়ার বিদ্যাতেও তার পারদর্শিতা ছিল। দেশ বিদেশের সুন্দরী রাজকুমারীরা প্রস্তাব পাঠাত তাকে বিয়ে করার জন্য। তবে সব প্রস্তাবই ফেরত যেত, কেননা রসায়নবিদের এসব দিকে খেয়াল নেই। সে তার গবেষণা নিয়েই ব্যস্ত থাকত রাত-দিন।

সে দেশের রাজা তাকে অনেক ভালোবাসতেন, অবশ্য তার সুন্দর চেহারার জন্য নয়, রসায়নশাস্ত্রে তার অগাধ পাণ্ডিত্যের জন্য। এজন্যই বনের ধারে এক সুন্দর গবেষণাগার বানিয়ে দিয়েছিলেন রাজা, যার চারপাশ ফুলের বাগানে ঘেরা, আর আছে একটি সুন্দর দীঘি। দেশ-বিদেশের অনেক অভিজ্ঞ টেকো রসায়নবিদেরাও রসায়নবিদ্যায় তার কাছে হার মানতো।

তবে বিপত্তি দেখা গেল যখন রাজপ্রাসাদে কানাঘুষো শুরু হল স্বয়ং রাজকুমারী রসায়নবিদের প্রেমে মশগুল। কথাটা রাজার কানে আসতেও দেরী হল না। রাজা গভীর চিন্তায় পড়ে গেলেন। রাজা তার একমাত্র মেয়েকে সরাসরি কষ্টও দিতে পারে না, আবার সহজ-সরল জ্ঞানী রসায়নবিদকেও তার খুব দরকার। এজন্য ঘনিষ্ঠ ক’জন রাজকর্মচারী নিয়ে সলাপরামর্শ করতে বসেন রাজা।

কেউ বলে, ‘আটকাও রসায়নবিদকে।’

কেউ আবার বলে, ‘হলে সম্বন্ধ রসায়নবিদের সাথে, দোষ কি তাতে। জ্ঞানে-বিজ্ঞানে তারতো জুড়ি নাই।’

সবার কথা শেষে রাজা বলেন কেশে, ‘রাজকর্ম জটিল কর্ম, হবে না ও মাথায়।’

হবে কি তবে এখন? অবশেষে বারো দিন বারো রাতে বের হল এক পন্থা, যে পন্থায় রসায়নবিদও বাঁচবে, রাজাও তাতে নাচবে।

রাজার নির্দেশে খুঁজে আনা হল রাজ্যের সেরা সুন্দরীদের। অবনী, শ্রাবণী, অনুরাধা সবাই গেল রসায়নবিদের কাছে রসালাপ জমাতে। তবে কারো রসেই ভিজল না রসায়নবিদের মন, সারাদিন-সারারাত রসায়নের রসেই ভিজে রইল সে। রাজ্যের সেরা সুন্দরী অরনাও গেল তার কাছে। সে তার মায়াময়ী কণ্ঠে, তার জাদুকরী ভঙ্গিমায় রসায়নবিদকে বধের সব চেষ্টা করতে লাগল। রসায়নবিদের গবেষণাগারে আলোর ঝলকানি হয়ে ঘুরে বেড়াত সে। রাজা অরনাকে দামী প্রসাধনী, জমকালো পোশাক দিলেন।

তবু বধ হয় না রসায়নবিদ। রাজা পড়লেন বিপাকে। যদি না হয় রসায়নবিদের প্রেম, তবে কেমনে ঠেকাবে রাজকুমারীকে?

এবারে রাজা ঘোষণা করেন, যে রসায়নবিদের সাথে প্রেম করতে পারবে, তার রসায়নবিদও মিলবে, ধন-সম্পদও মিলবে।

হাওয়ার বেগে কথাটা ছড়িয়ে পড়ল দেশ-বিদেশে। এরপর দিনের পর দিন সুন্দরীরা আসতে লাগল এই আজব প্রেমের খেলায় মাততে। তবে কিছুতেই কিছু হয় না, রসায়নবিদের মন রসায়নেই পড়ে রইল।

এত সব ঘটনা আর রাজকুমারী জানবে না, তা কি হয়? রাজকুমারী সব জেনে আরো বেশী ভালোবেসে ফেলল রসায়নবিদকে।

রাজপ্রাসাদে অশান্তি বেড়েই চলল। রাজার ঘুম হল কাবার, রাজকুমারী হল গৃহবন্দী।





সেই রাজ্যে বাস করত এক কুমার। তার ছিল এক কৃষ্ণবর্ণ কুমারী মেয়ে, নাম তার আনন্দা। আনন্দ বিতরন করাই তার কাজ। মানুষের মনে আনন্দ আনতে তার জুড়ি নেই। সব সময় হাসি-খুশী থাকে সে। তার গুণের শেষ নেই। বিদ্যা সাধনা থেকে শুরু করে দৈনন্দিন সব কাজ-কর্মে সে পটু। প্রতিবেশীদের মুখে তার গুণের ফুলঝুরি। তার গুণকীর্তন শুনে যে কেউ তাকে না দেখেই ভালোবেসে ফেলবে।

রসায়নবিদের প্রেমের কথা যখন রাজ্য জুড়ে, তখন কালো-ধলা কোন মেয়েই বসে থাকে নি। সবাই একটি বারের জন্য হলেও চেষ্টা করেছে। তবে আনন্দার এ বিষয়ে কোন উৎসাহ ছিল না। তার সখীরা তার কাছে বার বার বর্ণনা করেছে রসায়নবিদের রূপের কথা। আনন্দা সব কথা এক কান দিয়ে শোনে আর আরেক কান দিয়ে বের করে দেয়। তবে রসায়নবিদের সাথে প্রেমে ব্যর্থ সখীরা নাছোড়বান্দা, তারা চাই আনন্দাও তাদের মত ব্যর্থ হয়ে তাদের মনের দুঃখ বুঝুক। তাই তারা এক ফন্দি আঁটল।

একদিন সকালে আনন্দা ও তার সখীরা বনের ধারে নদীতে পানি আনতে গেল। ফেরার পথে সখীরা রসায়নবিদের বাগানে লুকালো। আনন্দা তার সখীদের খুঁজতে খুঁজতে রসায়নবিদের বাগানে চলে আসলো। সে তার পানির পাত্র বাগানের প্রবেশমুখে রেখে সখীদের খুঁজতে গেল বাগানে। একসময় সে দীঘির কাছে পৌঁছাল, দীঘির পরিষ্কার পানি দেখে সে চমকে উঠলো। দিঘীর জলে ফোটা নীল পদ্মের সৌন্দর্য সে অপলক দৃষ্টিতে দেখতে লাগল।

এমন সময় গবেষণাগারের চৌ-কাঠ খুলে বের হল রসায়নবিদ। একটি সফল গবেষণা শেষ করে উৎফুল্ল সে। তার কাছে আজ যেন সব কিছু অন্যরকম ভালো লাগতে লাগল। বাগানের প্রতিটি পাতা, প্রতিটি ফুলকে সজীব মনে হতে লাগল। পুব আকাশের সূর্যকেও আজ অষ্টাদশী চাঁদের মত সুন্দর মনে হতে লাগল। বাগান পেরিয়ে যখন সে দীঘির দিকে আসলো, তার সময় থমকে গেল। কে সে রমণী? ঢেউ কাটানো শরীরের গড়ন, চুল মাটি ছুঁই ছুঁই। রমণীর সম্মুখে এসে তার আবেগী চোখে রসায়নবিদের মন গলে যায়।

সে যে কৃষ্ণবর্ণ এক মেয়ে, তাতে কি? তার চোখ তাকে যে প্রশান্তি দিয়েছে তা কি অন্য কিছু দিতে পারবে! রসায়নবিদের হৃদয়ে ফুলের বাগানের সৃষ্টি হল। যেখানে হাজার রকমের ফুল, হাজার প্রজাপতি-পাখির আনাগোনা আর তার মাঝে মায়াবী কৃষ্ণবর্ণ মেয়েটি। রসায়নবিদ আনমনে মেয়েটির হাতে চুম্বন করল। আনন্দা হঠাত এ যুবকের চুম্বনে চমকে উঠলো। তবে তার দৃষ্টি সরে না। সে তখনো জানে না যুবকটি কে? তবু এক পলকেই যুবকের প্রেমে পড়ে গেল আনন্দা। লজ্জায় নিজেকে ছাড়িয়ে পালালো সে। আনন্দার সখীরা এ দৃশ্য দেখে আনন্দাকে হিংসে করতে লাগল। তবে রসায়নবিদ ও আনন্দার প্রেম থেমে থাকল না।

রাজ্যের আকাশে-বাতাসে ছড়িয়ে পড়ল রসায়নবিদের প্রেমের কথা। এ ঘটনায় রাজা যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলেন, এক রাজভোজের আয়োজন করতেও ভুললেন না। অন্যদিকে এ সংবাদে রাজকুমারীর মন যন্ত্রণায় ভরে উঠলো। তবে রসায়নবিদের প্রতি তার ভালোবাসা বিন্দুমাত্র কমে না। রসায়নবিদের চিন্তায় নাওয়া-খাওয়া পর্যন্ত ছেড়ে দিল।





রসায়নবিদ ও আনন্দার প্রেম দিনে দিনে আরো গভীর হতে থাকে। আর রাজকুমারী অসুখে পড়ল। তাই রাজপ্রাসাদের অশান্তিও যায় না।

এদিকে পাশের এক রাজ্যের সাথে যুদ্ধ শুরু হল। রাজা তার সেরা সৈন্য-সামন্তদের এ যুদ্ধে পাঠালেন। কিন্তু শক্তিশালী প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারছিল না রাজার বাহিনী, তাই যুদ্ধক্ষেত্র থেকে বার বার সাহায্যের আবেদন আসতে লাগল। রাজ্যের এই দুর্দিনে রসায়নবিদ বসে থাকতে পারল না। রাজার অনুমতি নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রের দিকে রওনা হল। সাথে নিল তেরটি হাতি এবং তেতাল্লিশ জন সঙ্গী, হাতির পিঠে তার রাসায়নিক দ্রব্য সামগ্রী। যুদ্ধের ময়দানে রসায়নবিদ যখন পৌঁছাল, সবাই ভাবল হাতির পিঠে খাবার ও যুদ্ধের বিভিন্ন রসদ। কিন্তু যখন তারা জানল তার সবগুলোতে রসায়নবিদের মালামাল, তারা বিরক্ত হল।

যুদ্ধের সেনাপতি রসায়নবিদের আসার সংবাদ পেয়ে তার সাথে দেখা করতে আসলেন। তিনি জানতেন রসায়নবিদের এসব আনার পিছনে কোন না কোন উদ্দেশ্য আছে, তাই রসায়নবিদকে জিজ্ঞাসা করলেন- এ মালামাল কিভাবে যুদ্ধে সাহায্য করবে?

রসায়নবিদ কোন কথা না বলে একজন তীরন্দাজের কাছ থেকে তীর-ধনুক নিল এবং তীরের মাথায় তার আবিষ্কৃত রাসায়নিক দ্রব্য মাখিয়ে তীরটি ছুঁড়ল। বাতাসের ঘর্ষণে তীরের মাথায় আগুন ধরে গেল।

সৈন্যরা অবাক হয়ে গেল। রসায়নবিদ জানালো এই তীর কারো শরীরে লাগলে, মুহূর্তেই তার শরীর আগুনে পুড়ে যাবে। এছাড়া বল্লমের ফলায় এই রাসায়নিক পদার্থ লাগালে বল্লমটিতে আগুনের কুন্ডলী সৃষ্টি হবে যা প্রতিপক্ষকে ছত্রভঙ্গ করতে কাজে লাগবে। রসায়নবিদের এই আজব কাণ্ডকারখানা সবাইকে মুগ্ধ করল। সেনাপতি নিশ্চিত নন যুদ্ধে এই নতুন কৌশল কতটুকু সফল হবে, তবে তিনি রসায়নবিদের প্রতি আশা রাখলেন।

পরদিন নতুন উদ্যমে আবার যুদ্ধ শুরু হল। রসায়নবিদ একদল সৈন্যেকে পরিচালনা করার ভার পেল। যুদ্ধ শুরুর কয়েক ঘন্টা পরই প্রতিপক্ষ আক্রমণে ও আতঙ্কে দিশেহারা হয়ে পড়ল এবং যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পলায়ন করল। তাছাড়া রসায়নবিদের সৈন্যদল যুদ্ধ জয়ে সবচেয়ে বেশী ভূমিকা রাখল। সেনাপতি রসায়নবিদের প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন। সৈন্যরা রসায়নবিদের প্রশংসা করতে করতে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে রাজধানীতে ফিরল।





যুদ্ধক্ষেত্রে রসায়নবিদের পারদর্শিতা এবং রাজকুমারীর অনবরত শোক এই দুটি বিষয় লক্ষ করে সভাষদদের কেউ কেউ বলতে লাগল, এবার আবার কীসের বাঁধা - রসায়নবিদ আর রাজকুমারীর সম্বন্ধ সাধায়।

রাজাও বুঝতে পারল, রসায়নবিদ তার অগাধ জ্ঞান দিয়ে ঠিকই রাজ্য চালাতে পারবে। তবে বাঁধা যে একটা আছে এটাও বুঝতে পারলেন তিনি। রসায়নবিদের প্রেমই সেই বাঁধা। রাজপ্রাসাদের সবাই বুঝতে পারল রাজার সম্মান রেখেই রসায়নবিদের প্রেমে ভাঙন ধরাতে হবে। রসায়নবিদের বন্ধু-বান্ধব থেকে শুরু করে রাজপ্রাসাদের সবাই রসায়নবিদের প্রেমের বিপরীতে গেল এবার। একে একে সবাই গেল রসায়নবিদকে বোঝাতে।

কেউ বলে, ‘তোর মত এই সুশ্রী চেহারার সাথে মানায় না আনন্দাকে।’

‘বাবা, দেখে আসছি ছোটবেলা থেকে। এরকম প্রেম হবে না সফল।’

‘আনন্দার ভিতর কি পেলেন, সে নয় সুন্দর নয় গুণবতী!’

‘তোমার মাথাটা একেবারেই গেছে দেখছি।’

এই সময় রসায়নবিদ প্রথমবার জানতে পারল, রাজকুমারী তাকে প্রচণ্ড ভালোবাসে। এ সংবাদেও রসায়নবিদের প্রেম টলে না। কোনভাবেই রসায়নবিদকে বোঝানো যায় না। তবু চেষ্টা চলতেই থাকে।
যত দিন যায় রাজকুমারীর চোখের জলই শুধু বাড়তে থাকে। রাজকুমারীর চোখের জল দেখে রাতের আকাশের তারারা খসে পড়ে, জোনাকিরা আলো নিভিয়ে শোক পালন করে।

কিন্তু নিয়তিতে যা থাকে তাই ঘটে, তাই সবকিছু একই রকম রইল না। একদিন সকালে রসায়নবিদ যখন গবেষণাগার থেকে বের হল- বাগানের সব ফোটা ফুল বুজে গেল, আশে-পাশের পাখিরা উড়ে গেল, সূর্য তার মুখ লুকালো আর সবশেষে যে তাকে ছেড়ে গেল সে হল আনন্দা। যে তাকে এতদিন ভালবাসত সেও চলে গেল।

আসল ঘটনা হল- নানা জনে তার আর আনন্দার রূপের পার্থক্য নিয়ে দিনের পর দিন কটাক্ষ করে চলছিল, যা রসায়নবিদকে অস্বস্তিতে ভোগাত। তাই সে গবেষণা শুরু করে একটি রাসায়নিক পদার্থ আবিষ্কারের জন্য। যা দিয়ে সে চিরস্থায়ীভাবে কৃষ্ণবর্ণ ধারন করতে পারে। সে আনন্দাকে সুন্দর করার জন্যও গবেষণা করতে পারত, কিন্তু সে এক ঢিলে দুই পাখি মারতে চেয়েছিল। সে রাজপ্রাসাদের শান্তির কথাও চিন্তা করত। সে ভাবল, সে যদি কৃষ্ণবর্ণ হয় তবে রাজকুমারীও তাকে পছন্দ করবে না।

সেদিন সকালে রসায়নবিদ বের হয়েছিল তার আবিষ্কৃত সেই রাসায়নিক তরল দিয়ে স্নান করে, যা তার ত্বকের ক্ষতি না করেই তাকে বানিয়ে দিয়েছে কৃষ্ণবর্ণ। আর এতেই যত বিড়ম্বনা। কোন বিড়ম্বনা তাকে বিচলিত করত না, যদি না আনন্দা তাকে ছেড়ে যেত। আনন্দা তাকে বিদায় বেলায় বলেছে, ‘যে তোমাকে আমি ভালোবেসেছি, এ তো সেই তুমি নও। তবে কিভাবে তোমাকে ভালোবাসি?’

আসলে আনন্দা তাকে ভালবাসলেও তার প্রেম ছিল সুশ্রী রসায়নবিদের প্রতি, এই কৃষ্ণবর্ণ রসায়নবিদের প্রতি নয়।

রাজা এ সংবাদে স্তম্ভিত হয়ে যায়। রসায়নবিদের বোকামীর জন্য তাকে কেউ কেউ পাগলও বলতে লাগল। আর প্রেমিক-প্রেমিকেরা একে মহান প্রেমিকের করুণ পরিণতি হিসেবেই দেখতে লাগল। আনন্দা এক ছলনাময়ী সুযোগ সন্ধানী নারীর নাম হয়ে গেল।





যে প্রেমের জন্য রসায়নবিদ বিসর্জন দিল নিজের সুশ্রী বর্ণ, সেই প্রেমই তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করল। এতে তার হৃদয় ক্ষত-বিক্ষত হল। প্রেমের প্রতি তার বিশ্বাস কমে গেল। তার বিশ্বাস ছিল সেই বিশিষ্ট সাহিত্যিকের মত। যিনি জীবনের দীর্ঘ সময় প্রেমের সংজ্ঞা উদঘাটন করতে ব্যর্থ হয়ে বলে বসলেন , ‘প্রেম স্বর্গীয় এবং এটিই প্রেমের একমাত্র পূর্ণাঙ্গ সংজ্ঞা।’

রসায়নবিদের সেই বিশ্বাসেও ছেদ পড়ল। সে তার মনকে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে গবেষণায় মনোযোগ দেয়। তবে কথায় আছে, যা ঠিক মত শেষ হয় না তার কিছু না কিছু বাকী থাকে।

একদিন বিকালে রসায়নবিদ উদাসীন মনে বসে ছিল নদীর পাড়ে। নদীর পানির সাথে আলোর খেলা দেখতে দেখতে তার মন হারিয়ে গিয়েছিল কোন অজানা জগতে। বার বার সেই জগতের আবয়ব আবিষ্কারের চেষ্টা করে ব্যর্থ হচ্ছিল রসায়নবিদ। তার মনে হয়, হয়তো রসায়নের ছকে মেলে না এই জগত। তাই সেই জগত আবিষ্কারের নেশায় আজকাল বিরহ সাহিত্য চলে আসে তার মনে।

উদাসীন ভাবেই বসে ছিল রসায়নবিদ, কিন্তু হঠাৎ একসময় আবির্ভাব ঘটে রাজকুমারীর। রসায়নবিদ চমকে উঠে তাকায়। দম বন্ধ হয়ে আসে তার। এই কৃষ্ণবর্ণ পেল কোথায় সে? রাজকুমারীর এই বিরাট ক্ষতি কি তার কারণেই? এরূপ নানা প্রশ্নের ঝড় তার মনে।

আড়ালের ঘটনা এই ছিল যে, রাজকুমারী রসায়নবিদকে দিনের পর দিন রাতের পর রাত ভালোবেসেছে। তার ভালোবাসায় কোন শর্ত ছিল না। তাই এই কৃষ্ণবর্ণ রসায়নবিদের প্রতিও তার ভালোবাসার তিল পরিমাণ কমতি ছিল না। রসায়নবিদের প্রেম বিচ্ছেদের পর, রাজকুমারী খুশি হয়।

রাজকুমারী বিপুল পরিমাণ স্বর্ণমুদ্রা দিয়ে এক রাজকর্মচারী নিযুক্ত করে রসায়নবিদের কৃষ্ণবর্ণ হবার রহস্য উদঘাটনের জন্য। কয়েক মাসের মধ্যেই রাজকর্মচারীটি তার কাজে সফল হয়। রাজকর্মচারী রসায়নবিদের গবেষণাগার থেকে কৃষ্ণবর্ণ হবার রাসায়নিক তরলের সূত্র চুরি করে। সূত্র অনুযায়ী তরল বানাতে এক প্রবীণ রসায়নবিদকে ব্যবহার করে রাজকুমারীকে। সেই রসায়নবিদও জানত না রাজকুমারীর এই পরিকল্পনার কথা। অথবা রাসায়নিক পদার্থটির কার্যক্ষমতার কথাও জানত না। কারণ সূত্রটি একদমই ব্যতিক্রমী ছিল। তাই সে বেশ আনন্দেই রাজকুমারীর কাজ করে দিল। রাজকুমারীও তাকে উপযুক্ত স্বর্ণমুদ্রা দিল।

রাজকুমারী সেদিন সকালেই হাতে পেয়েছিল রাসায়নিক তরলটি। দুপুরে তা দিয়ে স্নান করে, নিজের পোশাক পরিবর্তন করে ছদ্মবেশে সঙ্গোপনে রাজ প্রাসাদ থেকে বের হয় রাজকুমারী। তারপর রসায়নবিদের গবেষণাগারে খোঁজ করে, না পেয়েই সে খুঁজতে এসেছিল নদীর ধারে। কেননা সে জানত ইদানিং রসায়নবিদ নদীর ধারে একা একা বসে থাকে।
যাই হোক, রাজকুমারীর আবির্ভাবে রসায়নবিদের দৃষ্টি, মুখ কিছুই সরে না। কিভাবে কি হল, তা জিজ্ঞাসার ইচ্ছাও জাগে না তার হৃদয়ে। এভাবেই কিছু নীরব মুহূর্ত চলে যায়।

তারপর রাজকুমারী চোখে জল এনে রসায়নবিদকে প্রেম নিবেদন করে। আজ সাধ্য কার রাজকুমারীর এ প্রেম নিবেদন প্রত্যাখ্যান করে। রসায়নবিদও চোখে জল এনে তাকে আলিঙ্গন করে। রসায়নবিদ যেন তার কাঙ্ক্ষিত জগত আবিষ্কার করে ফেলে এ মুহূর্তে।

পশ্চিম আকাশে সূর্য ডোবার আগেই রাজার কানে কথাটা পৌঁছে যায়। এ সংবাদে রাজা ভীষণ রেগে গেলেন। সভাষদেরা রসায়নবিদের আবিষ্কারকে জঘন্য উল্লেখ করে, আর রাজকুমারীর স্পর্ধা সব কিছু ছাড়িয়ে গেছে বলে উল্লেখ করে। রাজ পেয়াদারা ছোটে রসায়নবিদ আর রাজকুমারীকে আটক করতে। রসায়নবিদ ও রাজকুমারী তখন নদী পার হয়ে অজানার উদ্দেশ্যে। কয়েকমাস পালিয়ে বেড়াল তারা। তবে শেষ রক্ষা হল না, বন্দী করা হল রসায়নবিদ ও রাজকুমারীকে।

তারপর দণ্ড ঠিক করতে আইনবিদদের নিয়ে বিশেষ সভা ডাকলেন রাজা। আইনবিদেরা আইনের পূজারী, মানবতার নয় এবং আইন কখনো কখনো নিষ্ঠুর। রাজ্যের উচ্চপদস্থ কর্মচারীরাও থাকলেন সে সভায়।

কেউ বলে, ‘রাজার নাক কেটেছে রাজকুমারী, মৃত্যুদণ্ড! মৃত্যুদণ্ড! মৃত্যুদণ্ড! আর কোন পথ নাই। দু’জনারই মৃত্যুদণ্ড।’

‘কলঙ্ক যদি মুছতে চান, মৃত্যুদণ্ড ছাড়া উপায় নাই।’

‘কুৎসিত হবে রাজকুমারী, এটা কি করে মানি?’

‘মাফ করবেন হুজুর, রাজ্য জুড়ে একি কথা, মৃত্যুদণ্ডই সঠিক রফা।’

এছাড়াও নানান কথা ওঠে সভায়। কেউ আবার বলেন, বনবাসের কথা।
অনেক চিন্তা-ভাবনার পর পরদিন মধ্যাহ্নে প্রজাদের সম্মুখে ঘোষণা করা হয় রসায়নবিদ ও রাজকুমারীর রাজদণ্ড- মৃত্যুদণ্ড। রাজ্যের অভিশাপ মোচনই রাজার কর্ম, তাই রাজা আজ নিষ্ঠুর। ওদিকে রাণী কেঁদে কেঁদে হয়রান। রাণী জ্ঞান হারিয়ে পড়ে থাকেন বিছানায়।

এরপর একদিন দিনের প্রথম প্রহরে সবার সম্মুখে রসায়নবিদ ও রাজকুমারীর গর্দান কেটে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হল। যার পাশেই ছিল একটি বড় পুরনো দিনের পাথর।

এই অবিচারে প্রেমিক-প্রেমিকেরা অঝোরে কাঁদল। আবার কেউ কেউ খুশীও হল। তবে প্রকৃতি থেমে থাকল না। মুহূর্তেই আকাশ কালো হয়ে উঠলো। শুরু হল প্রচণ্ড ঝড় বৃষ্টি। সতের দিন টানা তুফান চলল রাজ্যে। ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হল এতে। অনেক ঘর গেল চুরমার হয়ে, ক্ষেত-খামার গেল মাটির সাথে মিশে।

যখন তুফান শেষ হল, তখন দেখা গেল দু’টি রক্তবিন্দু সেই পাথর খণ্ডের গাঁয়ে, যেখান থেকে অঝোরে পড়ছে নোনা জল। এ জলের যেন শেষ নেই। রাজ্য জুড়ে রটে গেল এই আজব ঘটনা।

এখনও বিভিন্ন রাজ্য থেকে লোকজন পাথরটিকে দেখতে আসে। পাথরটিতে দু’টি রক্ত বিন্দু যেন কাঁদছে, আর বলছে, একই তো দেখতে ছিলাম আমরা। যখন শ্বেতবর্ণ ছিলাম তখনও, যখন কৃষ্ণবর্ণ হলাম তখনও। এই রক্তবিন্দু দু’টি যেন বর্ণবাদের বিরুদ্ধে নীরবে বিদ্রোহ করে চলছে বছরের পর বছর।

এভাবেই শেষ হল রসায়নবিদের প্রেমের গল্প।

***সমাপ্ত***
-------------------------


সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে আগস্ট, ২০১৪ বিকাল ৪:৩৮
৬টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

নেতানিয়াহুও গনহত্যার দায়ে ঘৃণিত নায়ক হিসাবেই ইতিহাসে স্থান করে নিবে

লিখেছেন ঢাকার লোক, ০৭ ই মে, ২০২৪ রাত ১২:৩৮

গত উইকেন্ডে খোদ ইজরাইলে হাজার হাজার ইজরাইলি জনতা নেতানিয়াহুর সরকারের পদত্যাগের দাবিতে বিক্ষোভ করেছে।
দেখুন, https://www.youtube.com/shorts/HlFc6IxFeRA
ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদ করার উদ্দেশ্যে নেতানিয়াহুর এই হত্যাযজ্ঞ ইজরায়েলকে কতটা নিরাপদ করবে জনসাধারণ আজ সন্দিহান। বরং এতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

খুন হয়ে বসে আছি সেই কবে

লিখেছেন জিএম হারুন -অর -রশিদ, ০৭ ই মে, ২০২৪ রাত ২:৩১


আশেপাশের কেউই টের পাইনি
খুন হয়ে বসে আছি সেই কবে ।

প্রথমবার যখন খুন হলাম
সেই কি কষ্ট!
সেই কষ্ট একবারের জন্যও ভুলতে পারিনি এখনো।

ছয় বছর বয়সে মহল্লায় চড়ুইভাতি খেলতে গিয়ে প্রায় দ্বিগুন... ...বাকিটুকু পড়ুন

জাম গাছ (জামুন কা পেড়)

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ০৭ ই মে, ২০২৪ সকাল ৯:০৩

মূল: কৃষণ চন্দর
অনুবাদ: কাজী সায়েমুজ্জামান

গত রাতে ভয়াবহ ঝড় হয়েছে। সেই ঝড়ে সচিবালয়ের লনে একটি জাম গাছ পড়ে গেছে। সকালে মালী দেখলো এক লোক গাছের নিচে চাপা পড়ে আছে।

... ...বাকিটুকু পড়ুন

অনির্বাণ শিখা

লিখেছেন নীলসাধু, ০৭ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৩১



রাত ন’টার মত বাজে। আমি কি যেন লিখছি হঠাৎ আমার মেজো মেয়ে ছুটতে ছুটতে এসে বলল, বাবা একজন খুব বিখ্যাত মানুষ তোমাকে টেলিফোন করেছেন।

আমি দেখলাম আমার মেয়ের মুখ উত্তেজনায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

=ইয়াম্মি খুব টেস্ট=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৭ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:১৪



©কাজী ফাতেমা ছবি
সবুজ আমের কুচি কুচি
কাঁচা লংকা সাথে
ঝালে ঝুলে, সাথে চিনি
কচলে নরম হাতে....

মিষ্টি ঝালের সংমিশ্রনে
ভর্তা কি কয় তারে!
খেলে পরে একবার, খেতে
ইচ্ছে বারে বারে।

ভর্তার আস্বাদ লাগলো জিভে
ইয়াম্মি খুব টেস্ট
গ্রীষ্মের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×