এরপর মেয়েটি একটু আধটু কথা বলতে শিখেছে। বুউউউউউ অথবা দাআআদা, অথবা বাআআবা। কেউ এসে মুখটা টিপে দিয়ে জরিয়ে ধরেনি। মুখে, ঠোটে বা কপালে কেউ চুমু দিয়ে বলেনি, কিউটের ডিব্বাটা। শুধু মা বলেছিল, সোনা মানিক আমার। আর বাবা সারাদিনের কাজ শেষে বাড়ি ফিরে তাকে বুকের ভিতর জরিয়ে ধরে একটু অক্সিজেন এর সন্ধান পেয়েছিল।
প্রথম স্কুলে ভর্তি থেকে ভার্সিটি শেষে করা পর্যন্ত গল্পটুকু বলতে চাইনা। এটা বলা উচিৎনা বলেই আমার মনে হয়েছে। শুধু বিয়ে প্রসঙ্গে বলতে চাই। মেয়েটির বাবা মেয়েটির জন্য একটি বাড়ি বরাদ্দ রেখেছে। যে মেয়েটিকে বিয়ে করবে সে আর তার মেয়ে ঐ বাড়ির মালিক হবে। বাবা তার মেয়েকে বড্ড বেশী রকমের ভালবাসে। তার মেয়েটা কালো এজন্য মেয়েটার হাসব্যান্ড যেন তাকে অসুখি না রাখে সে কারনে এই ব্যাবস্থা। ব্যাপারটা যেন যত্নে রাখা আবর্জনা অন্য কারো কাছে যত্নে রাখার বিনিময়ে এই পারিশ্রমিক।
এরকম ঘটনা আমাদের চারপাশে সবসময়ই ঘটে চলেছে। এই ঘটনাগুলো আমাদের সবারই পরিচিত। এই ঘটনাগুলোর আয়োজকদের কাছে প্রশ্ন, ঐ মেয়েটি কালো হয়ে জন্ম নিয়ে যে অপরাধ করেছে সে অপরাধের জন্য কে দায়ি? কার শাস্তি পাওয়া উচিৎ এই অপরাধের অভিযোগে? মেয়েটি জন্মের আগে জানেনি যে জন্মের কিছুক্ষন পরেই তার কারনে তার মাকে কথা শুনতে হবে। সে জানেনি পৃথিবি তার জন্য এরকম আয়োজন করে রেখেছে। এগূলো আগে জানতে পারলে হয়ত সে কখনোই পৃথিবিতে আসতে চাইতনা।
এজন্যই নেলসন ম্যান্ডেলা বর্ণবাদের বিরুদ্ধে আন্দলন করেছিলেন। সবাই নেলসন ম্যান্ডেলার মত ভাবতে পারলে হয়ত সমাজে এমন বাজে একটা বৈশ্বম্য থাকতনা। তার বিখ্যাত উক্তিটা আজো স্মরণীয় হয়ে আছে, "আমি সাদাদের আধিপত্যের বিরুদ্ধে লড়াই করেছি এবং আমি কালোদের আধিপত্যের বিরুদ্ধে লড়াই করছি। আমি আদর্শিক গণতন্ত্র এবং মুক্ত সমাজের প্রশংসা করি, যেখানে সকল ব্যক্তি শান্তিপূর্ণভাবে সহাবস্থান করবে এবং সমান সুযোগ লাভ করবে। এটি হচ্ছে একটি আদর্শিক অবস্থান, যার মধ্যে দিয়ে বাঁচা দরকার এবং আমি তা অর্জনের আশা করি, কিন্তু এটি এমন এক আদর্শ, যদি প্রয়োজন পড়ে, তার জন্য আমি জীবন দিতেও প্রস্তুত"।
আর এই কারনে সে আজ পুরো পৃথিবির কাছে নেলসন ম্যান্ডেলা।
সোফিয়া লরেন এর নামতো কম বেশী সবাই শুনেছেন। এই জনপ্রিয় অভিনেত্রির ভয়ংকর রকমের সত্য একটি উক্তি আছে সৌন্দর্য নিয়ে। তিনি বলেছেন, "সেক্স এ্যাপিল হচ্ছে সৌন্দর্যের পঞ্চাশ শতাংশ, যা তোমার আছে। আর বাকী পঞ্চাশ শতাংশ হচ্ছে লোকের ভাবনা, যা তারা মনে করে তোমার আছে"।
অর্থাৎ প্রথম পঞ্চাশ শতাংশ সবারই আছে আর বাকি পঞ্চাশ শতাংশ ব্যাক্তি অভিরুচি, স্থান, সময়, অর্থবৃত্ত আর ক্ষমতার উপর নির্ভর করে এক একজনের অথবা এক এক গোষ্টি বা জাতির কাছে এক এক রকম"।
হ্যা ব্যাপারটা আসলেই তাই। আমরা আমাদের চারপাসের বস্তু সমুহকে ভোগের পন্য
হিসেবে দেখি। এমনকি মানুষকেও। একারনে আমরা মানুষের শারিরিক অবস্থা অনুযাই এবং নিজেদের উপোভগ্যোতার সাথে ক্যালকুলেশান করে তার একটা মান দিয়ে দেই যে সে কম সুন্দর বা বেশী সুন্দর অথবা সুন্দর না। বৈশ্বিক ভাবে চিন্তা করলে আপনি আপনার একক মন্তব্যে কাউকে অসুন্দর বলতে পারবেননা। এক্ষেত্রে আপনার কাছে যে অসুন্দর পৃথিবির অন্য কোথাওর অন্য আরেকজনের কাছে সে বিউটি কুইন আবার আপনি যাকে সৌন্দর্যের রানী ভাবছেন আরেকজনের কাছে সে অসুন্দর। সুতরাং সৌন্দর্যের বিচার করার ক্ষমতা আপনার নেই। এ ক্ষমতা শুধুমাত্র সৃষ্টিকর্তারই আছে। সে সব মানুষকে তার নিজের খুশি মত করেই বানিয়েছেন।
আচ্ছা একবার কি ভেবে দেখেছেন আমরা সবসময় ফর্সা মানুষকে সৌন্দর্যের কাতারে কেন ফেলি? সৌন্দর্যের বর্ণনা দিতে গিয়ে আগে কালো কথাটা কেন বলিনা? ফর্সা না বলে কালোওতো বলতে পারতাম। কিন্তু কেন কালো বলিনা? হুম এই ব্যাপারেও বলছি। খেয়াল করে দেখবেন সমাজে ক্ষমতাবানদের কথাই বেশী প্রতিষ্ঠিত হয়। যুগে যুগে ক্ষমতা আর দেহের রঙের সঙ্গে মানুষিক সৌন্দর্যের সংজ্ঞাও পাল্টেছে। একট উদাহরন দেয়া যাক। ছয়শ বছর আগে যখন যখন যখন কালো দেহের মানুষের হাতে ক্ষমতা ছিল তখন তাদের উপন্যাসের চরিত্রগুলোর গায়ের রঙও কালো ছিল। মা তার বাচ্চাকে যে গল্প বলত সে গল্পে পরির গায়ের রঙও কালো ছিল। তখন পৃথিবিতে সৌন্দর্যের বর্ণনা দিতে গেলে আগে কালো শব্দটা আসত।
এরপর যখন শ্বেত বর্ণের মানুষেরা ক্ষমতায় এল তখন সৌন্দর্যের বরননাতে ফর্সা কথাটা প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেল। উদাহরন স্বরূপ বলতে পারি মাইকেলেঞ্জেলোর নিজ হাতে তৈরি শিল্পকর্মের সবথেকে বিখ্যাত শিল্পকর্ম "ডেবিড' নামের মূর্তি। ১৭ ফুট উচু এই মূর্তির মাধ্যমে সাদা চামরা, সুঠাম দেহ আর ব্যাক্তিত্তকে সৌন্দর্য সংজ্ঞা ধরা হয়েছে। আগেই বলেছি ক্ষমতা আর বৃত্তবানদের কথাই সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়।। আর হলোও তাই। সেই থেকে আজ পর্যন্ত আমরা মনের মধ্যে একটা জিনিসই পুষে যাচ্ছি, সুন্দর মানেই ফর্সা। সালার ফর্সা দেশের মানুষ এটাই ভুলে যায় যে কালো বর্ণের দেশের মানুষগুলোও প্রেমে পরে, ভালবাসে, বিয়ে করে সারাটা জীবন কাটিয়ে দেয়।
এতক্ষনে হয়ত প্রশ্ন চলে আসছে, তাইলে সার্বজনীন সৌন্দর্যটা কি? আচ্ছা ব্যাপারটা বোঝাচ্ছি। মনে করা যাক পৃথিবির সমস্ত মানুষের শরিরের রঙ একটাই। হলুদ রঙ। আর সবার চেহারাও দেখতে একই রকম। একই রকম চোখ, মুখ, নাক, ঠোট, চুল, হাত, পা সবকিছু। শুধু এক একজনের চিন্তা চেতনা এক এক রকম। এদের দেখে চেনার জন্য এক এক জনের মুখের বাম সাইডে এক একটা করে নাম আর নিচে একটা কোড নাম্বার দিয়ে দেয়া হল। এরপর তারা তাদের প্রয়োজন মত তাদের বাড়ি ঘর, পোষাক, খাবার এবং সৌন্দর্য চর্চার জিনিসপত্র দেয়া হল এবং বলা হল এগুলো তোমরা তোমাদের মত করে ব্যাবহার করো। এ ক্ষেত্রে আপনি কাকে সুন্দর বলবেন? এক্ষেত্রে আমার ব্যাক্তিগত বক্তব্য হল, যেহেতু সবার অবয়ব এবং দেহের রঙও এক শুধুমাত্র চিন্তা চেতনা এক এক রকম সে এখানে সেই বেশী সুন্দর যে নিযেকে যত সুন্দরভাবে উপস্থাপন করতে পারে। আর সুন্দর ভাবে উপস্থাপনার জন্য সুন্দর মানুষিকতা লাগে। ভাল মানুষিকথার চিন্তা করলেই চলে আসে ভাল মনের কথা।
হেলেন কেলার বলেছিল, "এ অবনীর সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ এবং সুন্দর জিনিষটি আজ পর্যন্ত কেউই দেখেনি, পারেনি স্পর্শ করতে। কিন্তু এটাকে অনুভব করতে পেরেছে। আর তা হলো, হৃদয়"।
এতেই স্পষ্ট পৃথিবির সকল সৌন্দর্য নিজের মনের মাঝে। সৌন্দর্য পরিপাটিতে, নিজেকে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করার মাঝে। সর্বোপরি ভাল একটা মানুষিকতার মধ্যে।
এই বর্ণ বিষয়ক পোষ্ট দেয়ার কারন স্বরূপ আরেকটা গল্প বলি। গল্পটা আমার সামনেই ঘটে যাওয়া। কিছুদিন আগে ফরিদপুরের একটা রেস্টুরেন্টে আমি, এক বন্ধু, এক বড় ভাই আর তার স্ত্রি বসে খাওয়া দাওয়া আর আড্ডা দিচ্ছিলাম। কিছুক্ষন বাদে বড় ভাইয়ের পরিচিত এক মহিলা আসল আমাদের টেবিলের কাছে। বয়ষ পঁয়তাল্লিশ বা পঞ্চাশ হবে। প্রাথমিক কুশল বিনিময়ের পর ভাই তার স্ত্রির সাথে ভদ্র মহিলাকে পরিচয় করিয়ে দিল। এরপর ভদ্র মহিলার কথা শুনে আমরা কিছুক্ষনের জন্য নিস্তব্ধ হয়ে গেছিলাম। উনি মুখের উপরই বলে দিল, তুই এত ফিটেষ্ট ছেলে তুই কালো মেয়ে বিয়ে করছিস কেন? ওনার এই প্রশ্নের জবাব নিরবতাই ছিল আমাদের। অবশেষে ভাবিই হাসিমুখে সুন্দরভাবে উত্তরটা দিলেন, "আন্টি আসলে আমাকেতো আল্লাহ্ কালো বানাইছে আর আল্লাহই ওর সাথে আমার বিয়ে ঠিক করে রাখছে। এখানেতো ওর বা আমার কোনো হাত নাই"। ভাবি সেদিন শুধু একটি হাসি দিয়েই সব কষ্ট আড়াল করে ফেলেছিল কিন্তু আমরা যারা উপস্থিত ছিলাম তারা ভালভাবেই টের পেয়েছিলাম ভাবির মনের অবস্থা।
ভাই সেদিন ভাবিকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে আমার সাথে বের হয়েছিল কিছু কেনাকাটার উদ্দেশ্যে। আমি একা সাথে। আমি কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছি ঐ মহিলার কথা সোনার পর থেকেই। অবশেষে বড় ভাই বলল, তোর ভাবি কালো এতে আমার আসলে কোনো সমস্যা নাই। কারন আমি জানি ওর মানূষিকতা আর দশটা মেয়ের মতনা। আর এজন্যই আমরা সংসার জীবনে এত সুখি। তোর ভাবি আজ খুব কষ্ট পাইলরে।
আমি চুপ করে আছি। সত্যি তাদের মত সুখি পরিবার সচারাচর দেখা যায়না। দুইজনের চলাফেরা দেখে মনে হয় দুই বন্ধু। আসলেই মানুষের সকল পরিশ্রম সুখের জন্য। যদি পরিবারে সুখই না থাকে তবে সুন্দর মেয়ে দিয়ে কি হবে?
সমাজের কাছে বদলে দেয়ার দাবি!!! মানুষের গায়ের রঙ সৌন্দর্যের প্রতিক হতে পারেনা। এটা কেবল একটা রঙ মাত্র। আমরা কখনো চিন্তা করিনি এই কালো মেয়েটি জন্মের পর থেকেই অবহেলিত শুধুমাত্র তার গায়ের রঙের জন্য। এই কালো দেহটি হাজারবার খুন হয়। এবার একটু চিন্তা করুন। সে নিজে ইচ্ছায় কালো হয়ে আসেনি তাকে সৃষ্টিকর্তা কালো করে সৃষ্টি করেছেন। আমাদের এই মনভাবের কারনে সে হয়তো একদিন সৃষ্টিকর্তার কাছে তার রঙ বৈষম্যের জবাব চাইবে।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ সকাল ৭:৫৬