শেক্সপিয়ার বলেছিলেন, এ জগতে কেউ কেউ জন্মগত ভাবে মহান, কেউ মহত্বের লক্ষণ নিয়ে জন্মগ্রহণ করেন, আবার কেউ স্বীয় প্রচেষ্টায় মহানুভবতা অর্জন করেন৷ এই ৩টি বৈশিষ্ট্যই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছিলো। তার অন্যতম একটা গুণ তিনি অনলবর্ষী বক্তা। তার বক্তব্যের মধ্যে রয়েছে যাদুকারী শক্তি। যদি কোন তরুণকে প্রশ্ন করেন আপনার জীবনের শ্রেষ্ঠ অনলবর্ষী বক্তা কে ? এক বাক্যে উত্তর বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমান।
শুনুন লিঙ্কে https://www.youtube.com/watch?v=tJo88n6uyZM
এমাজিং, একটা ভাষন একটা আন্দোলন, একটা বিপ্লব, একটা দেশের ইতিহাস,একটা সংগ্রাম হতে পারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চে ভাষন জলন্ত প্রমান । এখন পর্যন্ত ভাষন আন্দোলিত করে, লড়তে শেখায়, প্রতিবাদ করতে শেখায়, সাহস আনে।
তাই তো কিউবার প্রেসিডেন্ট বিপ্লবী ফিদেল কাস্ত্রোর কথাই ধরুন৷ তিনি ১৯৭২ সালের এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘‘আমি হিমালয় দেখিনি, আমি শেখ মুজিবকে দেখেছি৷''।
খ্যাতনামা ব্রিটিশ সাংবাদিক সিবির ডান ১৯৭২ সালে লিখেছেন, ‘তিনি সুদর্শন, প্রবল ব্যক্তিত্বের অধিকারী, অনলবর্ষী বক্তা এবং শ্রোতাদের মনমুগ্ধ করে রাখার মতো ক্ষমতা রাখেন।’ ঘুমন্ত জাতিকে তিনি করেছিলেন ‘ইতিহাস রচনাকারী দুর্জয় বীর’।
যে কয়টি হাতে গোণা ভাষণ চিরস্থায়ী আসন অলংকৃত করে বিশ্ব ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করেছে। যুগ যুগ ধরে মানব জাতি, দেশ, সামাজ, রাজনীতিকে প্রভাবিত করেছে। মানব মুক্তির পথ নির্দেশনা দিয়ে স্বাধীনতাকে অর্থবহ করে তুলতে অবদান রেখেছে তার মাঝে সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চে ১৯৭১ ভাষণ অন্যতম।
কুরআনের আল্লাহ বলেন-
A Goodly word like a goodly tree, whose root is firmaly fixed and branches (reach) to sky . It brings forth its fruit at all times” ( al Quran ।
“ একটি ভালো কথা একটি ভালো গাছের মতো , মাটিতে যার বদ্ধমূল শিকড়, আকাশে যার বিস্তৃত শাখা , সব সময় সে দিয়ে যার ফল আর ফল। ” ( আল কুরআন ১৪ : ২৪ - ২৫)
আল্লাহর কী অনুপম উদাহরণ ! একটি ভালো কথা একটি ভালো গাছের মতো ! সেই ভালো গাছটির মতো , মাটির গভীরে যার শিকড় , হালকা বাতাসে তো দূরের কথা , তুফানেও সে টলেনা । শাখা বিস্তার করে দিয়ে সে মানুষের জন্য ছায়া ঘেরা নিসর্গ তৈরি করে রেখেছে। বারো মাস সে সরবরাহ করে যায় ফল।
বঙ্গবন্ধু ভাষন এমনি একটা গাছের মতো ছিলো। যার ছায়ায় সারা বাংলার মানুষ মুক্তি খুঁজে পেয়েছিলো। আর ফল হিসাবে আমরা পেয়েছি আজকের স্বাধীনতা। একটি দেশ বাংলাদেশ।
৭ই মার্চের ভাষণটি এক কথায় অনবদ্য, অসামান্য ও অনন্য। ভাষণটি হয়ে উঠেছে একজন ক্ষনজন্মা নেতার সারা জীবনের লক্ষ, উদ্দেশ্য, আদর্শ ও সফল নেতৃত্বের শ্বেতপত্র। ভাষণটি বাঙালি জাতিকে একটি প্লাটফর্মে দাঁড় করিয়ে দেয়। সে সময়ে অত্যাচারী শাসকের সাম্রাজ্যবাদী বঞ্চনার বিরুদ্ধে একাত্রিত হয়ে জীবন বাজি রেখে সশস্ত্র প্রতিরোধে ঝাঁপিয়ে পড়ার অনন্ত প্রেরণা, অদম্য সাহস ও শক্তির উৎস। সমগ্র বাঙালি জাতিকে জাগ্রত করতে এর কোন তুলনা নেই।
তাই আমেরিকার বিশ্ববিখ্যাত ‘নিউজ উইক’ সাপ্তাহিক ৫ এপ্রিল, ১৯৭১ সংখ্যার কভার স্টোরি করে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের মূল্যায়নে তাঁকে অভিনন্দিত করে রাজনীতির কবি বা The poet of politic .' অভিধায় ভূষিত করেছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের মধ্যে এমন সব রাজনৈতিক গুণাবলী ছিল, যা সচরাচর কোন রাজনীতিবিদের মধ্যে দেখা যায় না। বঙ্গবন্ধু ছিলেন দুরদর্শী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, স্বভাবসূলভ মেধা ও প্রজ্ঞা, অতিশয় দক্ষ সংগঠক, অনলবর্ষী বক্তা, অসামান্য জনপ্রিয়, অসীম সাহসে বলীয়ান একজন দূরদর্শী রাজনৈতিক নেতা।
তিনি সভা সমাবেশে মানুষকে আকৃষ্ট ও প্রভাবিত করতে পারতেন গভীবভাবে। অক্লান্ত পরিশ্রম করতে পারতেন বঙ্গবন্ধু। দিনের বেলা সাংগঠনিক কাজ আর রাতের বেলা রাজনৈতিক পাঠ গ্রহণ করেছেন দিনের পর দিন।
ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্ট বঙ্গবন্ধুকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘‘আপনার শক্তি কোথায়?'' বঙ্গবন্ধু সে প্রশ্নের উত্তরে বলেন, ‘‘আমি আমার জনগণকে ভালোবাসি৷'' ‘‘আর আপনার দুর্বল দিকটা কী?'' বঙ্গবন্ধুর উত্তর, ‘আমি আমার জনগণকে খুব বেশি ভালোবাসি৷''
এই হলেন বঙ্গবন্ধু৷ জনগণের অন্তর্নিহিত শক্তির ওপর অপার আস্থা-বিশ্বাস, মানুষের প্রতি নিঃশর্ত ভালোবাসা, মমত্ববোধ, সহমর্মিতার বিরল দৃষ্টান্ত সমৃদ্ধ মানুষ।
ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ ক্যালি ড্রেজার বলেছিলেন, ‘প্রায় ১২শ’ বছর পর বাঙালি জাতির পুনর্জন্ম হয়েছে এবং হাজার বছর পরে বাংলাদেশ এমন নেতা পেয়েছে, যিনি রঙে-বর্ণে, ভাষায় এবং জাতি বিচারে প্রকৃতই একজন খাঁটি বাঙালি।
বঙ্গবন্ধু স্বাধিকার আদায়ের জন্য ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ভাষণের পটভূমি এই ভাষণে মেলে। ‘প্রয়োজনে বাঙালি আরও রক্ত দেবে, জীবন দেবে, কিন্তু স্বাধিকারের প্রশ্নে কোনো আপস করবে না। বাংলার মানুষ যাতে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার নিয়ে বাঁচতে পারে, বরকত-সালাম-রফিক-শফিকরা নিজেদের জীবন দিয়ে সেই পথ দেখিয়ে গেছেন।
বাহান্ন সালে রক্তদানের পর বাষট্টি, ছেষট্টি, ঊনসত্তরে বারবার বাঙালিকে রক্ত দিতে হয়েছে। কিন্তু আজও সেই স্বাধিকার আদায় হয়নি। আজও আমাদের স্বাধিকারের দাবি বানচাল করে দেবার ষড়যন্ত্র চলছে। এই ষড়যন্ত্র প্রতিহত করার জন্য বাংলার ঘরে ঘরে প্রস্তুত হতে হবে।
এবার চূড়ান্ত সংগ্রাম। আর এই সংগ্রামে আমরা গাজী হয়ে ফিরে আসতে চাই। চরম ত্যাগের এবং প্রস্তুতির বাণী নিয়ে আপনারা ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ুন। বাংলার প্রতিটি ঘরকে স্বাধিকারের এক-একটি দুর্ভেদ্য দুর্গে পরিণত করে দেখিয়ে দিন- বাঙালিকে দাবিয়ে রাখার শক্তি পৃথিবীতে কারও নেই।’ বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে যার নাম উজ্জল নক্ষত্রের মতো দীপ্য মান তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবার বহমান।
রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু তাঁর অবিনাশী মহাকাব্য শেষ করলেন-
‘‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম,
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম৷''
এই ঐতিহাসিক ভাষনের পর তিনি আর শুধুমাত্র তাঁর রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের নেতা রইলেন না৷ তিনি হয়ে গেলেন গণমানুষের শেখ মুজিব, ইতিহাসের পাতা থেকে উঠে আসা এক মহানায়ক৷ ৭ই মার্চের ভাষণের মধ্যে দিয়েই বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠলেন মহাকাব্যিক মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত ৫৬ হাজার বর্গমাইলের বাংলাদেশের একজন অনলবর্ষী বক্তা বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমান ।
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা আগস্ট, ২০১৭ রাত ১০:৫১