গুজব পৃথিবীর সবখানেই ছড়ানো হয়। কিন্তু বাংলাদেশে সেটা একটু বেশিই ছড়ায় চেইন বিক্রিয়ার মত এবং বিশ্বাস করার লোকেরও অভাব হয় না। এজন্য গুজব এবং প্রোপাগান্ডা ছড়ানোর জন্য আমরা জাতিগতভাবে একটা নোবেল আশা করতেই পারি...
পোলাপান সব ফোন দিয়ে বলে, "আজ সবুজ চাঁদ উঠবে। তুই দেখবি না?"
ফেসবুকে ঢুকে দেখি এইটা গুজব এবং বাঙালি গুজবকে বিশ্বাস করে বেশ জোরে লাফাচ্ছে।
দুইদিন আগেই তো ফেসবুকে দেখলাম যে আটদিন চাঁদ উঠবে না। চাঁদমামা তার মামার বাড়িতে বেড়াতে যাবে
এজন্য বুঝি চিলে কান নেওয়ার কবিতা লেখা হয়েছিলো। ছোটবেলা থেকে এই আঠারো বছরের জীবনে বহু গুজব আর প্রোপাগান্ডা শুনেছি। আমাদের গর্বের জায়গা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে এমনকি বঙ্গবন্ধু এবং তার পরিবারকে নিয়েও অনেক অপপ্রচার আর গুজব শুনেছি এবং শুনছি।
আমার শোনা গুজব আর অপপ্রচারের মধ্যে কিছু তুলে দিলাম।
.
সেই সময় চতুর্থ বা পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ি। সেজো আন্টির বিয়ে হয়েছে। বিয়েতে কেউ একজন একটা "কোরআন শরীফ" দিয়েছিলো।
তো কিছুদিন পরে একটা গুজব উঠলো যে, "কোন হসপিটালে নাকি একটা বাচ্চা হয়েছে যে হওয়ার পরেই ডাক্তারদের সালাম দিয়েছে। তার ভ্রু আর মাথায় কোন চুল নাই। ডাক্তারদের সে বলছে তার ভ্রু আর মাথার চুল কোরআন শরীফের ভিতরে আছে। তারপরে একদিন হঠাৎ করে সে হসপিটাল থেকে অদৃশ্য হয়ে যায়।"
শুরু হয়ে গেল খোঁজ খোঁজ। যারা কুরআন শরীফ খোঁজে তারাই দেখি চুল পায় আর সেই চুল পানিতে ভিজিয়ে পানি খায়! তো এবার আম্মু আমাকে আন্টির বিয়েতে পাওয়া নতুন কোরআন শরীফটা দিলো চুল খুঁজতে আর আম্মু নিজের পুরাতনটা নিল। তো দেখা গেল আম্মুর পুরাতনটাতে সেই মহান ব্যক্তির কেশ পাওয়া গেল কিন্তু নতুনটাতে কোন চুল টুল পাওয়া গেল না।
রাত্রে আব্বু বাসায় এসে চুলের কাহিনী শুনে আমারে বললো,
→ নতুনটাতে পেয়েছিস?
না।
→ তোর আম্মুরটাতে?
হ্যা, আম্মু পেয়েছে।
→নতুনটাতে তো জীবনেও পাবি না। কারণ নতুনটা তো এখনো কেউ পড়ে নি। পড়লে হয়তো পড়ার সময় মাথার থেকে মাঝে মাঝে যে চুল পড়ে তার দুই একটা পেইজের ভিতরে ঢুকে থাকতো আর আমরা সেই চুলকে আজ মহান ব্যক্তির চুল হিসেবে শনাক্ত করতে পারতাম যে গুলো পুরাতন কোরআন শরীফের সাথে হয়েছে।
.
খুব সম্ভবত ছয় বা সাত বছর আগে সকালে একদিন ঘুম থেকে উঠে দেখি আমাদের চারটা বাঁশঝাড়ের প্রত্যেকটাতে অনেকগুলো কঞ্চির মাথা কাঁটা! কাহিনী কি? আমাদের বাসার কেউ জানে না।
পরে শুনি গ্রামের সবাই কঞ্চির মাথা কেঁটে "কোন পীর কর্তৃক ওহী দ্বারা" কঞ্চির মধ্যে নাযিলকৃত কুদরতি পানি পেট ভরে গলা পর্যন্ত পান করেছে। পরেদিন থেকে অবশ্য অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়েছিল ঐ নোংরা কুদরতি পানি খেয়ে!
.
একদিন স্কুল থেকে এসে বসে আছি। হঠাৎ দেখি এক মহিলা আরো কিছু মহিলা আর একটা অর্ধেক আলু নিয়ে আম্মুর কাছে আসছে।
আমিও দেখতে গেছি।
তো মহিলা আম্মুকে বলতেছে, "দেখেন ভাবি, আলু রান্না করার জন্য কাটতেছিলাম হঠাৎ দেখি আরবী লেখা!"
আমি আলুটা হাতে নিয়েই ফিক করে হেঁসে ফেলছি।
আম্মু বলতেছে সেই মহিলাকে, "এই আলু যদি না খাও তাহলে ফেলে দিচ্ছি। কোন আরবী টারবী নাই। আলুতে দাগ ধরে এমন ডিজাইন হয়েছে।"
.
একসময় লিফলেট আর এসএমএস পেতাম। মহানবী (স.) কে কেউ স্বপ্নে দেখেছে অথবা তাকে কোন কবর থেকে উঠে আসতে দেখেছে। এই খবর কয়েকজনের কাছে না পাঠালে দুঃসংবাদ শুনতে হবে আর পাঠালে সুসংবাদ আসবে। যদিও কাউকে কোনদিন পাঠালাম না তবুও কিছুই হলো না!
ছোটবেলায় ২০০১-২০০৫ সালে যখন বিএনপি ক্ষমতায় ছিল তখন শুনতাম আওয়ামীলীগের লোকেরা বিভিন্ন জায়গায় কুকুরের মাথায় টুপি পরিয়ে দিচ্ছে। আওয়ামীলীগের লোকেরা মালাউন কেউ সহীহ মুসলিম নয়। যদিও আজ পর্যন্ত সেই টুপি পরানো একটা ছবিরও প্রমাণ পেলাম না।
আমার এই উনিশ বছর বয়সের মধ্যে চৌদ্দ বছর ধরে শুনছি শেখ হাসিনা ভারতের কাছে বাংলাদেশকে বেঁচে দিয়েছে বা দেবে। সবকিছু ঠিক করা আছে। বাংলাদেশ দখল করবে ভারত। যদিও আজও পর্যন্ত আমরা ভারতবাসী হতে পারলাম না।
.
সাঈদীকে চাঁদে দেখা নিয়ে আম্মু এক পরহেজগার মহিলারে বলেছিলো, "আমরা তো কেউ দেখতে পেলাম না। আপনারা দেখলেন কেমনে?"
সেই মহিলা উত্তর দিয়েছিলো "যাদের ইমান ঠিক নেই তারা ওসব দেখতে পায় না।"(বত্রিশটি দাঁত বের করা হাসির ইমো গপে)
যদিও মহিলা বলে নি সে সাঈদীরে নিজে চাঁদে দেখছে না দেখে নি।
.
বাঙালীর পিছনে বাঁশ না ঢুকলে এরা একই গুজব ছড়িয়েই যায়। যেমন সাঈদীরে চাঁদে দেখে লাফালাফি করে সহিংসতা করার পরে যখন পুলিশের সাথে সংঘর্ষে ওদের খানিকটা লাশ পড়লো তখন থেকে ওরাও সাঈদীরেও চাঁদে দেখা বন্ধ করে দিছিলো
.
আর কতকাল চিলের পিছনে দৌড়াবে বাঙালি! কবে কানে হাত দিয়ে দেখতে শিখবে যে কান, কানের জায়গাতেই বহাল তবিয়তে আছে।
সহজ সরল মানুষগুলোর ধর্ম ভীরুতা আর বিজ্ঞান সম্পর্কে অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে অপপ্রচার আর গুজব বেশ ভালোভাবেই ছড়ানো হয়।