somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সারামাগো

৩০ শে অক্টোবর, ২০১০ সন্ধ্যা ৭:৪৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সারামাগোর সাহিত্য
এক অভিনব প্রায়শ্চিত্তের কাহিনী

আত্মকথন
আমার দাদামশাইয়ের অনেকটাই বয়স হয়েছিলো। তার সেই প্রাচীন বয়সে তিনি বুঝতে পারছিলেন যে তিনি হয়ত আর বেশিদিন বাঁচাবেন না। গভীর রাত্তিরে যখন সবাই ঘুমে অচেতন তখন তিনি বাড়ির উঠোনে যে গাছগুলি ছিলো সেগুলিকে জড়িয়ে আদর করতেন, আর চোখের জল ফেলতেন। তখন হয়ত বা জ্যোৎস্নার ঢল বহে যাচ্ছে চরাচর জুড়ে, কিংবা হয়ত রাতের অন্ধকারে তারাদের আলোয় আলোকিত হয়ে আছে স্তব্ধ বিশ্ব সংসার। সেই রকম সম‍‌য়ে আমার হঠাৎই ঘুম ভেঙে গেলে হাত বাড়িয়ে তাকে খুঁজতে গিয়ে দেখতাম আমার পাশে শুয়ে থাকা দাদামশাই বিছানায় নেই। দেখতাম আলো অন্ধকারে উঠোনের গাছগুলিকে জড়িয়ে ধরে তিনি আদর করছেন, অঝোরে কাঁদছেন। হয়ত তিনি ভাবতেন যে ইহ জীবনে গাছগুলোর সঙ্গে তার আর দেখা হবে না, তাই।
এমন অনেকদিনই হতো যখন দাদামশাই রাতের খাওয়া শেষ হলে আমাকে ডেকে বলতেন,— ‘চল হোসে, চল আমরা আজ খোলা আকাশের নিচে, গাছের তলায় ঘুমোই। আমাদের বাড়ির উঠোনে ৩টি ডুমুর গাছ ছিলো। তার মধ্যে সবচেয়ে বড় যে গাছটা তার তলায় আমি অতি উৎসাহে বিছানা পাততাম। খড় বিছিয়ে তার ওপরে কম্বল পেতে তৈরি করতাম আমাদের বিছানা। সেই বিছানায় শুয়ে দাদামশাই গল্প বলতেন যতক্ষণ না আমি ঘুমিয়ে পড়ি। দাদামশাই বলতেন বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের রহস্যের গল্প, ভূত প্রেত দৈত্য দানোর গল্প, রূপকথার কাহিনী। বলতেন আমাদের পূর্বপুরুষদের ইতিহাস, কত রকমের যুদ্ধবিগ্রহের কথা। আমি সেইসব গল্প শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়ার ঠিক আগে দেখতে পেতাম একটা উজ্জ্বল নক্ষত্র যেন হঠাৎই গাছের মগডালে নেমে এল। তারপর আবার গাছের ডালপালার আড়ালে লুকিয়ে পড়ল। নক্ষত্রটিকে খুঁজতে গিয়ে আমার চোখে পড়ত দিগন্তে বিস্তৃত এক আকাশগঙ্গার স্রোতা সেই রুপোলি আকাশগঙ্গার স্রোতকে দেখিয়ে দাদামশাই বলতেন, ‘বুঝলি হোসে, ওটাই হলো সানটিয়েগোতে যাওয়ার পথ। তখন চারপাশ শুনশান। এক নিশ্চিন্ত নিস্তব্ধতার মধ্যে এই আকাশগঙ্গার স্রোতা আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে যেত। সেই রুপোলি স্রোতের মধ্যে ভাসতে ভাসতে আমি একটা সময় ঘুমিয়ে পড়তাম। ঘুমের মধ্যে আমি স্বপ্ন দেখতাম। দাদামশাইয়ের বলা গল্প কাহিনীর ভেতর থে‍‌কে ভূত প্রেত, দৈত্য, দানো, রূপকথার রাজকন্যা, পক্ষীরাজ ঘোড়া সব আমার স্বপ্নের শরীরে এসে ভিড় করত।
যত সকালেই আমার ঘুম ভাঙুক না কেন, ঘুম থেকে উঠে দেখতাম দাদামশাই তার একমাত্র সম্বল ৬টি শুয়োরকে চরাতে নিয়ে গেছেন। আমি তখন কম্বল আর খড়ের বিছানা গুটিয়ে নিয়ে উঠোন ছেড়ে ঘরের ভেতরে চলে যেতাম। যত সকালেই উঠি না কেন দেখতাম দিদিমা তারও আগে উঠে পড়েছেন। সংসারের কাজকর্মে লেগে পড়েছেন। আমি যখন বাড়ির ভেতরে যেতাম তখনও আমার চুলে দু’এক টুকরো খড়কুটো লেগে থাকত। ঘরে ঢোকা মাত্র দিদিমা আমাকে গরম কফি আর রুটি খেতে দিতেন। আমি কফি খেতে খেতে দিদিমাকে আমার দেখা স্বপ্নের কথাগুলো বলতাম। বলতাম ওইসব স্বপ্ন দেখে কিরকম ভয় পেয়েছি। দিদিমা সব শুনে বলতেন। — ‘দূর হোসে, স্বপ্নের ছবি নিয়ে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। স্বপ্ন কখনও সত্যি হয় না রে।’ আমি কিন্তু দাদামশাইয়ের বলা গল্পগুলো বিশ্বাস করতাম। আমার স্বপ্নের ভেতরে দেখা ছবিগুলোকে বিশ্বাস করতাম। ভয় পেতাম। আমার সবসময়েই মনে হতো দাদামশাই কতকিছু জানেন। তার তুলনায় দিদিমা কত কম জানেন।
আর একটু বড় হওয়ার পর বুঝতে পেরেছিলাম যে, দিদিমাও কম জানেন যে তা ঠিক নয়। আর তখনই বুঝতে পারতাম যে দিদিমাও স্বপ্ন দেখেন। কোনও কোনও দিন সন্ধ্যার আকাশে যখন একটা একটা করে তারা ফুটে উঠত তখন আমাকে ডেকে বলতেন, — ‘দেখ দেখ হোসে, পৃথিবীটা কত সুন্দর। এই সুন্দর পৃথিবীটা ছেড়ে আমার, জানিস তো, মরে যেতেও ইচ্ছে করে না। দাদামশাই মারা যাওয়ার পর দিদিমা খুবই একলা হয়ে গিয়েছিলেন। তখন তো তার বয়সও কম হয়নি। দারিদ্র্য যেন আরও বেশি বেশি করে চেপে বসছিলো। সংসারের দারুণ অভাব অনটন। অনাহার অর্ধাহার, আর সেই সঙ্গে উদয়াস্ত পরিশ্রম। দাদামশাই যেসব কাজগুলো করতেন, সেইসব কাজগুলো দিদিমাকেই একা হাতে করতে হতো। খুব ভোরে উঠে মাঠে গিয়ে শুয়োর চরানো। জল বয়ে আনা, কাঠ কাটা, উনুন ধরানো। রান্না করা, বাসন মাজা, কাপড় কাচা, এরকম সব কাজ। তার পরেও ছিলো বাজারে গিয়ে শুয়োরের ছানা বিক্রি করে পয়সা জোগার করা, তারপর সেই পয়সা পেলে বাজার থেকে জিনিসপত্র কিনে মাথায় করে বাড়িতে বয়ে আনা, তারপর রান্না করা — সব কাজ দিদিমাকে একা হাতেই করতে হতো। তাকে সাহায্য করার মতন দ্বিতীয় কোনও প্রাণী ছিলো না। এতসব সত্ত্বেও দিদিমাকে কখনও জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা, এমনকি কোনও রকমের অনীহা পোষণ করতে দেখিনি। জীবনকে ভালবাসা তার একচুলও কমেনি। আর তাই জীবনকে এতটাই ভালবাসতেন যে মরে যেতে চাইতেন না। আমি পরে বুঝেছিলাম যে এটা তার , লোকে যাকে সাধারণ মৃত্যুভয় বলে অভিহিত করে থাকে, সেরকমটি ছিলো না। যেটা ছিলো তা হলো জীবনকে তীব্রভাবে ভালবাসার যে অপার আনন্দ, সেই আনন্দ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার যে বেদনা, যে আকুতি তারই প্রকাশ মাত্র। আর তার সেই অপার্থিব ভালবাসাই তাকে সুন্দরতর করে তুলেছিলো। আমার দিদিমা ছিলেন অসামান্যা রূপবতী। যতই তার বয়স বেড়েছে। ততই যেন তার ভালবাসাও বেড়েছে। আর সেই ভালবাসাই গাঢ়তর হয়ে তাকে আরো রূপসী করে তুলেছিলো।

শৈশবে ‍কৈশোরে
১৯২২ সালের ১৬ নভেম্বর তারিখে এক ভূমিহীন চাষী পরিবারে তার জন্ম। আলমোন্ডা নদীর দক্ষিণ পারে রিবাতেছো জেলার আজিনহেনা গ্রামে। গ্রামটি পর্তুগালের রাজধানী লিসবঁ থেকে মাত্র ১০০ কিলোমিটার দূরে। সারামাগোর পিতা ছিলেন হোসে দা সুসা, মা মারিয়া দা পিয়েতেত। কিন্তু ওদের পরিবারের অন্য একটি পরিচয় ছিলো। আসলে ওই অঞ্চলে এক ধরনের জংলি উদ্ভিদ প্রচুর পরিমাণে জন্মাত। অত্যন্ত গরিব যারা দু’বেলা দু’মুঠো খেতে পায় না তারা ওই উদ্ভিদ খেয়ে জীবনধারণ করে থাকে। আমাদের দেশে শালুক, কলমি, মেটে আলু, সজনে ইত্যাদি খেয়ে জীবনধারণ করে থাকে অসংখ্য মানুষ। কতকটা সেইরকম আর কি। পর্তুগালের কন্দ জাতীয় উদ্ভিদটির নাম সারামাগো। যারা এই উদ্ভিদটি খেয়ে জীবনধারণ করে থাকে, তাদেরই স্থানীয় ভাষায় ‘সারামাগো’ নামে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। হোসে দা সুসা-র পরিবার গ্রামে ‘সারামাগো’ নামেই পরিচিত ছিলো। পুত্র সন্তান জন্মগ্রহণ করার পর জন্মবৃত্তান্ত লিপিবদ্ধ করার সময় যিনি লিপিবদ্ধ করেন সেই রেজিস্ট্রার ভদ্রলোকটি স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে পুত্র সন্তানটির নাম লিপিবদ্ধ করেছিলেন হোসে দা সুসা সারামাগো। বিষয়টি প্রথমে কেউই খেয়াল করেননি। খেয়াল হয়েছি‍‌লো যখন ছেলেটি স্কুলে ভর্তি হতে গেল। তখনই ছেলেটি প্রথম জানতে পেরেছিলো যে আসলে তার নাম হোসে সারামা‍গো। তখন তার বয়স সাত।
১৪ বছর বয়স পর্যন্ত সারামাগো তার দাদামশায়, দিদিমার সঙ্গে দূর অন্তর্বর্তী ভিন্ন একটা গাঁয়ে আশ্রিত থেকেছেন। দাদামশাই জেরেনিমো মেরিনহো আর দিদিমা জোসেফা চেকিসনাদের জমি জিরেত বলে কিছুই ছিলো না। ছিলো সম্বল বলতে ৬টি শুয়োর। সেই শুয়োর‍‌ কটি প্রতিপালন করেই তাদের সংসার চলত। তা ছাড়া অন্য কোনও জীবিকা তাদের ছিলো না। শুয়োরগুলির প্রজনন ক্ষমতার ওপরেই পুরোপুরি নির্ভরশীল ছিলো তাদের সংসার। শুয়োরের ছানাগুলি একটু বড় হলেই সেগুলো বাজারে নিয়ে গিয়ে অথবা গাঁয়ের লোকজনদের কাছে বিক্রি করে দেওয়া হতো। তাই শুয়োরগুলোর যত্নআত্তি যাতে ঠিক মতন হয় সেই ব্যাপারে তাদের তীক্ষ্ম নজর থাকত সর্বক্ষণ। শীতকালে বাইরে যখন অঝোরে তুষারপাত হচ্ছে, যখন ঘরের মধ্যে এনে রাখা পানীয় জলও জমে বরফ হয়ে যেত। তখন সারামাগোর দিদিমা শুয়োরগুলোকে ঘরের ভেতরে ঢুকিয়ে আনতেন, তাদের বিছানায় তুলে শুইয়ে দিতেন। তারপর তাদের ওপরে কম্বল চাপা দিয়ে দিতেন, তাদের জড়িয়ে ধরে ঘুমোতেন। প্রচণ্ড শীতের মধ্যে দিদিমা আর তার প্রিয় শুয়োরগুলো পরস্পর পরস্পরের শরীরের ওম দিয়ে নিজেদের বাঁচিয়ে রাখত। হাড়কাঁপানো শীতে তারা এভাবেই শরীর ধারণ করতেন। এই বিচিত্র ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে সারামাগো অবশ্য তির্যক ভঙ্গিতে কটাক্ষ করতেও ছাড়েননি যে, নেহাৎই পশুপ্রীতির জন্যই দিদিমা দাদামশাই যে শুয়োরগুলোকে ভালবাসতেন, নাকি বেঁচে থাকার খুদকুঁড়োটুকুও রক্ষা করার কারণে সেটা বলা কঠিন। শুয়োরগুলোর কিছু হলে, ওগুলোর মধ্যে একটাও মরে গেলে তাদের কপালে যে আরও কষ্ট লেখা হবে, দিদিমার রান্নাঘরে হাঁড়ি চড়বে না সেই দু‍‌শ্চিন্তা তাদের ব্যতিব্যস্ত করে রাখত সর্বক্ষণ। আর এর বাইরে অন্য কিছু ভাবার অবকাশ তাদের খুব কমই ছিলো।
সারামাগো অত্যন্ত মেধাবি ছাত্র ছিলেন। প্রথম জীবনে স্কুলে ডবল প্রোমোশনও পেয়েছিলেন একবার। কিন্তু পড়াশুনার খরচ চালানো তার পরিবারের পক্ষে অসম্ভব ছিলো। ফলে ইস্কুলের গণ্ডী পেরোনোর আগেই তাকে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশুনায় ইতি টানতে হয়েছিলো। অভিভাবকদের তখন একমাত্র চিন্তা ছিলো কীভা‍‌বে সে দু’পয়সা রোজগার করে রোজ দু’বেলা দু’মুঠো খাবার জোগাড় করতে পারবে। অনেক ভাবনা চিন্তা করে তারা ঠিক করলেন যে, সারামাগোকে কোনও একটা টেকনিক্যাল স্কুলে ভর্তি করে দিতে পারলে, তার অন্তত খাওয়া পরার চিন্তা করতে হবে না। ফলে সারামাগোকে একটা মোটর মেকানিকের স্কুলে ভর্তি করে দেওয়া হলো। সেখানে সে হাতের কাজ শিখতে শিখতেই কিছু কিছু রোজগার করতে পারবে। তাকে আর অন্যের গলগ্রহ হয়ে জীবনধারণ করতে হবে না। পাঁচ বছর সারামাগো সেই টেকনিক্যাল স্কুলে মোটর মেকানিকের কাজ লিখলেন। ১২ বছর বয়সে তিনি টেকনিক্যাল স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন, শেষ করলেন যখন তখন তার বয়স ১৭। টেকনিক্যাল স্কুলের পাঠ সাঙ্গ করার সঙ্গে সঙ্গে তিনি একটি গ্যারেজে মোটর মেকানিকের কাজ পেলেন। শুরু হলো তার কর্মজীবন। ততদিনে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ জোর কদমে গোটা ইয়োরোপের আকাশ বাতাস তছনছ করে দিচ্ছে। এবারে তিনি যে চাকরিটা পেলেন সেটি একটি সোস্যাল ওয়েলফেয়ার সারভিসে অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভের সিভিল সারভেন্টের কাজ। তাকে মোটর গ্যারেজের চাকরিটা ছাড়তে হলো। ১৯৪৯ সালের সেই সময়টিতে কিছুটা থিতুও হয়েছিলেন তিনি। কিছুদিনের মধ্যে বিয়েও করলেন রেলওয়ে অফিসের একজন টাইপিস্ট ইলডা রেইইস-কে। বছর তিনেক পরে তাদের এক কন্যা সন্তান ভায়োলানতে-রা ভায়োলানতেই সারামাগোর একমাত্র সন্তান। কিন্তু বিয়েটা শেষ পর্যন্ত টিকল না। চাকরিটাও চলে গেল ১৯৪৮ সালে। তখন তার বয়স ২৬।
১৯৫০ সাল নাগাদ সারামাগোর জীবনে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ আসে। তিনি চাকরি পেলেন একটি প্রকাশনা সংস্থা ‘Estidious Cor এর প্রোডাকশন ম্যানেজার হিসেবে। সেই চাকরিটি করতে করতে কিছু বেশি পয়সা রোজগার করার জন্য তিনি অনুবাদের কাজ করতে শুরু করেন। তবে শুধুমাত্র পয়সা রোজগার করার জন্য তিনি অনুবাদের কাজ করছিলেন তা নয়। অন্যান্য চাকরির মতন সেই প্রকাশনা সংস্থার চাকরিটিও তেমন মজবুত ছিলো না। ফলে রোজগারের জন্য একটা বিকল্প ফ্রন্ট খোলার চেষ্টা করছিলেন। তা ছাড়াও ছিলো অনুবাদের কাজ করার মধ্যে তার চারিত্রিক স্ফূর্তি। সেই সূত্রে অতি অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি অনুবাদ করলেন- Collette, jean cassou, Maupassant, Andre Barrard, Tolstoy, Baudelaire. Hegel ইত্যাদি অনেকেরই রচনা। সেইসঙ্গে গ্রন্থ সমালোচনার কাজও তিনি করছিলেন। এই প্রকাশনা সংস্থাটিতে কাজ করার সময়েও সারাক্ষণ অনিশ্চয়তা তাকে তাড়া করে বেরিয়েছে। আবারও তাকে চাকরি খোয়াতে হয়। টেকনিক্যাল স্কুলে ছাত্রাবস্থাতেই, যখন তার বয়স সবেমাত্র ১২ পেরিয়েছে। ইউনিয়ন ইলেকশনে ‍‌তিনি জেতেন এবং কোষাধ্যক্ষ নির্বাচিত হন। তারপর থেকেই তিনি সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন এবং পর্তুগাল কমিউনিস্ট পার্টির হয়ে সেই বিপ্লবে অংশগ্রহণ করেছিলেন। এবং ধীরে ধীরে পার্টির প্রথম সারির নেতৃত্বে উন্নীত হন।
এই সময়ে আবার একটি চাকরি পেয়ে গেলেন। এবারে একটি বামপন্থী পত্রিকা — Dianico de Noticias এর সম্পাদক ও ম্যানেজার নিযুক্ত হলেন। ইতিমধ্যে পর্তুগালের রাজনৈতিক পালাবদলের ফলে রাতারাতি তাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়। শেষমেশ তার সাংবাদিকতার চাকরিটাও চলে গেল।’ অবশ্য বারবার চাকরি বদল করা। চাকরি থেকে বরখাস্ত হয়ে যাওয়া, এবং চাকরির নিরাপত্তাহীনতায় তিনি হাঁপিয়ে উঠছিলেন। তিনি এটাও বুঝতে পারছিলেন যে, আর কোনও চাকরি পাওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। এবারে তাই তিনি ঠিক করলেন যে, সবরকমের কাজ থেকে নিজেকে সরিয়ে নেবেন। আর সর্বক্ষণের জন্য কেবল সাহিত্যেরই সাধনা করে যাবেন। এবারে আর হতাশা নয়। এমন চিন্তা নয় যে, তার আর নতুন করে কিছু বলার নেই, লেখার জন্য নির্দিষ্ট কোনও বিষয় নেই। এবারে তিনি নিজের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বুঝতে চাইলেন যে, লেখক হিসেবে তার ক্ষমতা কতটুকু। সব দ্বিধা দ্বন্দ্ব ফেলে রেখে তিনি যেন সাহিত্যের মূলমঞ্চে প্রবেশ করার জন্য প্রস্তুত হলেন।
ইতিমধ্যে ১৯৭০ সালে লিডার সঙ্গে তার বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে গেল। ওই বছর থেকেই পর্তুগিজ লেখিকা ইসাবেলা দা নোবেগা-র সঙ্গে তার একটা সম্পর্ক স্থাপিত হয়। সেই সম্পর্ক চলে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত। ১৯৮৬ সালে তার সঙ্গে পরিচয় হয় একজন স্প্যানিশ সাংবাদিক পিতোরো ডেল রিও-র সঙ্গে ১৯৮৮ সালে তারা বিয়ে করেন। পর্তুগিজ ভাষা থেকে সারামাগোর সব রচনাই পিতোরা অনুবাদ করেছেন স্প্যানিশ ভাষায়।

সাহিত্যের আকর্ষণ, প্রেরণা, অনুভব
দাদার অকস্মাৎ মৃত্যুর পর সারামাগো পরিবার গ্রামাঞ্চল থেকে সরে এসে লিসবঁ শহরে বসবাস করতেন। সারামাগো মনে করতেন, বলেছেনও বহু জায়গায় যে গ্রাম থেকে শহরে চলে আসার ঘটনাটি যদি না ঘটত, তাহলে হয়ত তার পক্ষে কোনদিনই লেখক হয়ে ওঠা সম্ভব হতো না।
দূর শৈশবে দাদামশাইয়ের কাছে নানারকম গল্প কাহিনী যেমন— ভূত, প্রেত, দৈত্যদানো, রাজা-রাজড়া, যুদ্ধ বিগ্রহ, পৌরাণিক গল্প, অলৌকিক কাহিনী। তাদের পারিবারিক ইতিহাস ইত্যাদি যখন শুনতেন, তখন অবশ্যই সেগুলো অত্যন্ত বিশ্বাসযোগ্য বলেই তার মনে হতো। সেইসব কাল্পনিক যাত্রার মধ্য দিয়েই তার কল্পনার বিকাশ ঘটেছিলো। সাহিত্যের উন্মেষ না হলেও স্ফুরণ তো তখন থেকেই। যে টেকনিক্যাল স্কুলে তিনি পড়াশুনা করেছেন, সেই স্কুলটিতে একটি পাঠাগার ছিলো। টেকনিক্যাল স্কুল হলেও, সেই পাঠাগারে সাহিত্যের গ্রন্থও ছিলো বিস্তর। সারামাগোর সাহিত্যপিপাসু মন সেই সাহিত্যের ভাণ্ডার থেকে অনায়াসে রসগ্রহণ করতে শিখেছিলো। তাছাড়া, সক্রিয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করার ফ‍‌‍‌লে রাজনৈতিক পুস্তকপাঠেও তার অবহেলা থাকেনি। যে প্রকাশনা সংস্থায় তিনি কাজ করছিলেন, যে সান্ধ্য দৈনিকে তিনি কাজ করছিলেন, সব জায়গাথতেই তার সুযোগ হয়েছিলো নামকরা লেখক লেখিকাদের সঙ্গে পরিচিত হওয়ায়। সাহিত্যের প্রতি তার আকর্ষণ সম্পূর্ণ হতে পেরেছিলো এদের সকলের বা এইসব কিছুর পরোক্ষ অথবা প্রত্যক্ষ প্রভাবেই।
১৯৪৭ সাল নাগাদ সারামাগো তিন তিনটি উপন্যাস লিখতে শুরু করেছিলেন। তার মধ্যে একটি ‘The widow ’ ভিন্ন একটি নামে ‘The Land of sin’ প্রকাশিত হয়েছিলো। বাকি দুটো — ‘The Skylight’ এবং ‘Honey and the Gall’ বা ‘may be Louis, son of Jadius’ কয়েক পাতা লেখার পরই আর শেষ পর্যন্ত লিখে উঠতে পারেননি বা লেখেননি। কারণ তখন তার মনে হয়েছিলো যে তার আর নতুন করে কিছু বলার নেই। নতুন করে বিষয় ভাবনা তিনি ধরতে ছুঁতে পারছেন না। ফলে ১৯৪৭ সালে ‘The Land of sin’ প্রকাশিত হওয়ার পর দীর্ঘ ১৯ বছর অর্থাৎ ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত তিনি সাহিত্যের জগৎ থেকে স্বেচ্ছা নির্বাসন নিয়েছিলেন। স্বেচ্ছা নির্বাসন এই কারণে যে পর্তুগালের প্রকাশক আর পত্রিকাওয়ালার তাকে ত্যাগ করেননি। তিনি তাদের কাছ থেকে দূরে সরে গিয়েছিলেন। দু এক বছরের মধ্যেই তাকে ভুলে গিয়েছিলো পর্তুগালের তথাকথিত সারস্বত সমাজ। তার এই দীর্ঘকালীন অনুপস্থিতি পর্তুগালের সাহিত্যের জগতে তেমন কোনও নজর কাড়েনি। দীর্ঘ ১৯ বছর পর সারামাগো দ্বিতীয়বার আত্মপ্রকাশ করলেন তার একটি কাব্যসংকলন ‘Probably Joy’ গ্রন্থটি প্রকাশের মধ্য দিয়ে। ১৯৬৬ সালে। তখন তার বয়স ৪৫। তারপর থেকে অবশ্য তিনি ক্রমাগত লিখেছেন। আর থেমে থাকেননি। একের পর এক উপন্যাস তার প্রকাশিত হতে থাকে।
১৯ বছর পর, ৪৫ বছর বয়সে, যখন সারামাগো সত্যি সত্যি সাহিত্যের জগতে পা রাখলেন, খুবই আশ্চর্যের বিষয় যে, তাকে আর কেমন করে বড় কোনও বাধার সম্মুখীন হতে হয়নি। অচিরেই তার উপন্যাস পাঠক পাঠিকাদের মধ্যে সাড়া জাগাতে শুরু করেছিলো। বিগত ১৯টি বছর যারা তার সম্পর্কে একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি, কিংবা করলেও তীব্র কটাক্ষ করা ছাড়া আর কিছুই করেননি, তাদের সকলকে অবাক করে দিয়ে। শুধু অবাক করে দিয়ে নয়, প্রায় হাতে মাথা কাটতে থাকা ম্যাটিনি আইডল পর্তুগিজ লেখকদের এক ধাক্কায় পিছনে ফেলে। তিনি ঝড়ের মতন এগিয়ে চলেছিলেন।
৪৫ বছর বয়সে সারামাগো যখন দ্বিতীয়বার আত্মপ্রকাশ করবেন তখন তিনি পর্তুগালের সাহিত্য জগতে সম্পূর্ণ রকম ভাবে বিস্মৃত। নিঃসন্দেহে ব্রাত্যও তো বটেই। কিন্তু ১৫ বছরের মধ্যেই অর্থাৎ ষাট বছরে পা দেওয়ার আগেই দেশে এবং বিদেশে খ্যাতির আনন্দধারায় স্নাত হচ্ছিলেন। কিশোর বয়স থেকেই পর্তুগাল কমিউনিস্ট পার্টির সক্রিয় সদস্য ছিলেন সারামাগো। ১৯৬৯ সালে তিনি পার্টির সদস্য হন এবং আমৃত্যু তিনি কমিউনিজমে বিশ্বাস রেখেছিলেন। তবে তাকে সকলেই নাস্তিক আর নিরাশাবাদী বলেই জেনেছিলো। পর্তুগালে তার লেখা নিয়ে বিতর্কের ঝড় উঠেছিলো। শুধু পর্তুগালে নয়। গোটা ইয়োরোপে, এমনটি ভ্যাটিকানেও তাকে ঘিরে বিবাদ বিসংবাদ কম হয়নি। তার বিরুদ্ধে নাস্তিকতার আর নিরাশাবাদের অভিযোগের তর্জনী উত্থিত হয়েছিলো প্রায় সর্বত্রটা এই অভিযোগের মূল কেন্দ্রে ছিলো রক্ষণশীলতা, ভেদাভেদের দ্বন্দ্ব আর সংকীর্ণতার দম্ভ। সারামাগোর বিরুদ্ধে রক্ষণশীলদের আক্রমণ এতটাই চরম আকার ধারণ করে যে, যখন সারামাগোর রচনা ইয়োরোপের সাহিত্য পুরস্কারের (European Literary Award) জন্য মনোনীত হচ্ছিল তখন রক্ষণশীল মৌলবাদীরা তার তীব্র বিরোধিতা করতে থাকেন। সেই বিরোধিতায় পর্তুগাল সরকারও শামিল হয়েছিলো। ফলে সারামাগো সেই পুরস্কারটি থেকে বঞ্চিত হয়েছিলেন।
বিংশ শতাব্দীর ষাটের দশকে কমিউনিস্ট পার্টির সক্রিয় সদস্য হিসেবে সারামাগোকে বহু নির্যাতন, অবহেলা অপমান সহ্য করতে হয়েছিলো। তার কারণ পর্তুগালে তখন কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ বলে ঘোষিত হয়েছিলো নব্বই-য়ের দশকে সারামাগোর ‘Gospel according to Jesus Christ’, প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গ্রন্থটি নিষিদ্ধ বলে ঘোষিত হয়। কারণ হিসেবে বলা হয়েছিলো যে সারামা‍‌গো ধর্মীয় বিশ্বাসে আঘাত করেছেন, তিনি ধর্মদ্রোহী। গ্রন্থটিতে যীশুখ্রিষ্টকে সত্যিকারের মানবপুত্র হিসেবেই সারামাগো দেখতে বা দেখাতে চেয়েছেন। বলা বাহুল্য বিষয়টি মৌলবাদীদের ক্রোধের উদ্রেক করেছিলো। ভ্যাটিকান সিটি থেকেও সারামাগোর তীব্র সমালোচনা করা হয়। আর তখন পর্তুগালে চরম দক্ষিণপন্থীদের সরকার। সেই সরকার সারামাগোকে প্রকাশ্যে অপদস্ত করে। সারামাগো নিজে অত্যন্ত অপমানিত বোধ করেন। এবং কালবিলম্ব না করে পর্তুগাল ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নেন। পর্তুগালের সীমারেখার বাইরে স্পেনের ভৌগোলিক সীমায় স্থিত লানজারোডি দ্বীপে সস্ত্রীক চলে যান। সমুদ্রে ঘেরা নির্জনতম এই দ্বীপে তিনি নির্জনতাকে আস্বাদন করতে থাকেন। গত দু’দশকেরও বেশি সময় তিনি এই দ্বীপে সস্ত্রীক বাস করেছেন। বহুদিন আগে সাহিত্যের জগৎ থেকে তিনি স্বেচ্ছা নির্বাসন নিয়েছিলেন। তখন তিনি ছিলেন অখ্যাতনামা। দারিদ্র্যপীড়িত সাহিত্য পিপাসু একজন লেখক মাত্র। তার তিন দশক পরে তিনি যখন স্বদেশ ত্যাগ করে স্পেনের ভূখণ্ডে স্বেচ্ছানির্বাসনে চ‍‌লে গেলেন তখন কিন্তু তিনি একজন খ্যাতনামা লেখক। তার রচিত সাহিত্য তখন দেশে বিদেশে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। সারামাগো অত্যন্ত কাতর কণ্ঠেই একবার বলেছিলেন যে, — ‘.... দুঃখের পাত্র যখন কানায় কানায় পূর্ণ হয়। তখন নিজেকেই কঠিন হয়ে উঠতে হয়। আর সেইরকম সময়েই মানুষকে কঠিন থেকে কঠিনতর সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হতে হয়। যেমন আমাকেও নিতে হয়েছে স্বেচ্ছায় দেশ ছেড়ে নির্বাসনে চলে যে‍‌তে।...’ জন্মভূমির মায়া অবশ্য তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছিলো। তাই বছরে অনেকবারই তিনি ছুটে চলে যেতেন লিসবঁ শহরে। তার নিজের স্বদেশ পর্তুগালে। তবে আর কোনদিন দেশে ফিরে যেতে পারবেন কি না সে বিষয়ে তার যথেষ্ট সন্দেহ ছিলো।
তার সেই সন্দেহ অবশ্যই অমূলক ছিলো না। স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের তার আন্তরিক আশা পূর্ণ হয়নি। বর্তমান বছরের ১৮ জুন তারিখে ক্যানারি দ্বীপপুঞ্জের লানজারোতে দ্বীপে তার জীবনাযাপন ঘটে গেল। তখন তার বয়স হয়েছিলো ৮৭ বছর। বেশ কয়েক বছর ধরেই তিনি লিউকোমিয়া দ্বারা আক্রান্ত ছিলেন। ১৮জুন সকালে তার স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতে বলতেই তিনি অত্যন্ত অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। সেই দিনই তার মৃত্যু হয়। তার প্রিয়, অতিপ্রিয় সেই দ্বীপে, যে দ্বীপে স্বেচ্ছা নির্বাসনের বছরগুলিতে তিনি কেবলই প্রকৃতির মধ্যে অবগাহন করেছেন। নির্জনতার পরিমণ্ডলে তার স্ত্রী ছাড়া কেউ যখন তার পাশে থাকেনি। যখন মানব ধর্মের সার্বিক চিন্তায় তিনি মগ্ন থেকেছেন, সেই দ্বীপে নিজের বাড়িতেই তার কর্মময় জীবনের অবসান ঘটে গেল।
সারামাগোর মৃত্যুতে শোকের ছায়া নেমে এসেছে সারা পৃথিবীতে। যেখানেই মানবধর্ম সম্পর্কে সচেতন মানুষজন রয়েছেন। যেখানেই অত্যাচার, অপমান, নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন বুভুক্ষু কোটি কোটি মানব সন্তান। যেখানেই যুক্তিহীন মৌলবাদীদের ছলচাতুরিতে সজ্জিত মুখোশের প্রতারণায় বিভ্রান্ত হয়েছেন, হচ্ছেন মানুষ। সেখানেই এই লেখকটির মৃত্যু কঠিন আঘাত হেনেছে। তার কারণ সারামাগোর জীবন দর্শনের মধ্যে এক নতুন বিপ্লবের সুর ধ্বনিত হয়েছে। সেই ধ্বনি কিন্তু আশাহীনতার নয়। নয় হেরে যাওয়ার পদশব্দ। সেই ধ্বনিতে বারবার উন্মোচিত হয়েছে মানব সভ্যতার এক তীব্র সম্ভাবনার ইঙ্গিত। সেই ইঙ্গিত অবহেলা করার অবকাশ নেই। অবহেলা করার অর্থই সেখানে স্বখাত সলিলে আত্মহনন মাত্র।

নোবেল সাহিত্য পুরস্কার-১৯৯৮
১৯০১ সালে সাহিত্যের বিভাগে নোবেল পুরস্কারের সূচনা হওয়ার পর সারামাগোই প্রথম পর্তুগিজ যিনি পুরস্কারটি পেলেন ১৯৯৮ সালে, ৭৬ বছর বয়সে। ইউরোপীয় ভাষার তিনিই পরপর চতুর্থ জন যিনি এই পুরস্কারটি পেলেন।
বেশ কয়েক বছর ধরেই নোবেল পুরস্কার প্রাপকদের সম্ভাব্য তালিকায় সারামাগোর নাম শোনা যাচ্ছিল। ১৯৯৮ সালের সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার প্রাপকদের সম্ভাব্য তালিকায় আর ৪ জন লেখকের নাম শোনা যাচ্ছিল। তারা হলেন সলমন রুশদি, মিগুয়েল তোরোগা, আন্তনিও লোবো আলতুলিস এবং হোসে সারামাগো। শেষের তিনজন পর্তুগীজ ভাষার লেখক। প্রসঙ্গত মনে রাখাটা জরুরী যে, পর্তুগালের প্রকাশনা সংস্থাগুলি খুবই তৎপর এবং শক্তিশালী। তাদেরই অক্লান্ত চেষ্টায় ১৯৯৮ সালের ফ্রাঙ্কফুট বইমেলার ফোকাল থিম হয়েছিল পর্তুগাল। পর্তুগালের লেখক সমাজ এবং প্রকাশকরা সবাই রীতিমতো উঠে পড়ে লেগেছিল যাতে সেবছর পর্তুগালের কোনও লেখক এই পুরস্কারটি করায়ত্ত করতে পারে। তাদের সকলের সম্মিলিত প্রয়াস ব্যর্থ হয়নি। ফ্রাঙ্কফুট বইমেলার ফোকাল থিম সে বছর নির্বাচিত হয়েছিল পর্তুগাল। টাইমস পত্রিকার লিসবঁ সংবাদদাতা এলিসন রবার্টস তো আদা জল খেয়ে ক্রমাগত লিখছিলেন যে, সে বছর যেন পর্তুগিজ কোনও লেখককে পুরস্কার দেওয়ার কথা বিবেচনা করা হয়। টাইমস-এর আর একজন সাংবাদিক এরিকা ওয়াগনার তো রীতিমতো ভবিষ্যদ্বাণী করে দিচ্ছিলেন যে, ১৯৯৮ সালের নোবেল পুরস্কার পর্তুগালের ঘরেই উঠছে। সব মিলিয়ে পর্তুগালের মিডিয়া ওয়ার্লড, লেখক ও প্রকাশক সমাজ পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে খেয়োখেয়ি না করে প্রায় একজোট হয়ে এই ব্যাপারে গোটা ইউরোপ জুড়ে একটা আন্দোলনের আবহাওয়া সৃষ্টি করে দিয়েছিল। ইতোমধ্যে সেই বছরই লন্ডনের ‘দি ইন্ডিপেনডেন্ট’ পত্রিকার বিদেশ দপ্তরের সাহিত্য পুরস্কারটি দেওয়ার জন্য হোসে সারামাগোকে নির্বাচিত করলো তার ‘The year of the death of Ricardo Ruis’ গ্রন্থটির জন্য। বলা বাহুল্য এই পুরস্কার প্রাপ্তি সারামাগোকে তার নোবেল প্রাপ্তির দৌড়ে অনেকটাই এগিয়ে দিল। এবং নেবেল পুরস্কারটি পেলেন হোসে সারামাগো। তখন তিনি ৭৬ বছর অতিক্রম করছেন।
প্রত্যেক বছরই অক্টোবর মাসের প্রথম দিকে যখন সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারটি ঘোষণা করা হয় তখনই সারা পৃথিবী জুড়ে বিতর্কের ঝড় ওঠে ১৯৯৮ সালেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। সেই বছর পুরস্কারটি ঘোষিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যথারীতি চাপান উতোর চলতেই থাকলো। ইউরোপের পত্র-পত্রিকাগুলি সারামাগোর নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করতে শুরু করেছিল। একটি দৈনিক তো সরাসরি সুইডিশ নোবেল কমিটিকে কটাক্ষ করে লিখতেই থাকলো যে, ‘বেছে বেছে সুইডিশ নোবেল কমিটি শুধু কমিউনিস্টদেরই পুরস্কার দিয়ে চলেছে। যেন সাহিত্যের বিচারকরা নন, কোনও ক্ষমতাসম্পন্ন মিডিয়াই ঠিক করবে কাকে পুরস্কার দেওয়া উচিত, কাকে নয়। এই ধরনের একদেশদর্শিতার বিপরীতে সুস্থ সাহিত্য বিচারই শেষ পর্যন্ত জিতে‍‌ গিয়েছিল। সব রকমের বাধা বিপত্তি কাটিয়ে, ব্যর্থকামদের সমালোচনা উপেক্ষা করে নোবেল কমিটি হোসে সারামাগোকে ১৯৯৮ সালের নোবেল পুরস্কার প্রাপক হিসেবে ঘোষণা করে দিল। তবে সেই পুরস্কার প্রাপ্তির আগেই সারামাগো দেশ বিদেশের পাঠক-পাঠিকাদের মন জয় করে নিতে পেরেছিলেন।
নোবেল পুরস্কার প্রাপকদের নিয়ে একটি চমকপ্রদ উপন্যাস ‘The prize’ লিখেছিলেন আরভিং স্টোন। পুরস্কার ঘো‍‌ষিত হওয়ার সময়ে প্রাপকরা কে কোথায় ছিলেন। কি করছিলেন তার বিশদ বিবরণ রয়েছে এই উপন্যাসটিতে। সারামাগের ক্ষেত্রেও অনুরূপ একটি গল্প রয়েছে। অক্টোবর মাসে বি‍‌শ্বের বৃহত্তম বইমেলা ফ্রাঙ্কফুট বইমেলাতে অংশগ্রহণ করতে সারামাগো লিসবঁ থেকে ফ্রাঙ্কফুটে এসে‍‌ছিলেন। কারণ পর্তুগাল ছিল ঐ বছরের ফ্রাঙ্কফুট বইমেলার ফোকাশ থিম। বইমেলা শেষ হবার আগেই তিনি লিসবঁ-তে ফেরার জন্য বিমানবন্দরে এসে পৌঁছে‍‌ছিলেন। সেখানে এমনকি বোর্ডিং পাস নিয়ে বিমানে উঠতে যাবেন। সেই সময়ে একটি ঘোষণা তার কানে আসে। ঘোষক বলছিলো — হোসে সারামাগো আপনি এই মুহূর্তে ফ্রাঙ্কফুট বইমেলায় ফিরে আসুন। বইমেলার সকলেই আপনাকে সংবর্ধনা দেওয়ার জন্য অপেক্ষা করছেন। তার কারণ, এবছরের সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার আপনাকেই দেওয়া হয়েছে। অগত্যা লিসবঁ-র বিমান ছেড়ে দিয়ে সারামাগো বইমেলায় ফেরত গেলেন। সেখানে তাঁকে সংবর্ধনা জানানো হলো। বি‍‌শেষ করে সুইডিশ আকাদেমির প্রতিনিধিরা তাঁকে সংবর্ধনা জানালেন। সে বছর নোবেল পুরস্কারের মূল্য ছিল ৯,৫০,০০০ ডলার। সারামাগোকে অভিনন্দন জানাতে‍‌‍‌ গিয়ে সুইডিশ আকাদেমির প্রতিনিধিরা বলেছিলেন, .... এই বছর সাহিত্যের বিভাগে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার জন্য আপনাকে আমরা অভিনন্দন জানাচ্ছি। নোবেল কমিটি আপনার সাহিত্য সাধনা এবং আপনার রচিত উপন্যাসগুলির মধ্যে খুঁজে পেয়েছে এক অতুলনীয় রচনাশৈলী। আর তার সঙ্গে এক অভিনব বাস্তবতার সন্ধান, এক অমোঘ অথচ তির্যক দৃষ্টিভঙ্গিমার ইঙ্গিত। আপনার রচনার পরিমণ্ডলে যেমন বিধৃত হয়েছে বহমান ঐতিহ্যের মোহহীন বিবরণ। স্বীকৃতি তেমনি তারই পাশাপাশি আপনি আপনার তীক্ষ্ণ বিশ্লেষণের মাধ্যমে স্পষ্টভাবে মনোযোগ দিয়েছেন বর্তমান সময়ের যাবতীয় প্রেক্ষিতকে। আর এইসব কিছুর মধ্য দিয়ে এক বিশ্বাসের ভূমি তৈরি করেছেন। যে ভূমিতে জীবনের কাঙ্ক্ষিত জয়গান ধ্বনিত হয়। আর সেই সঙ্গীতময়তা ফিরিয়ে আনে মায়া, মমতা, ভালোবাসা আর সত্যের অনুসন্ধান। আর সর্বোপরি এক স্বপ্নের রূপায়ন কামনার জন্য তীব্র আকুতি। কল্পনার পিঠে সওয়ারি হয়ে আপনি স্বপ্ন আর বাস্তবের সীমান্তরেখা মুছে দিতে চেয়েছেন। মুছে দিতে চেয়েছেন সর্বাধিক ভৌগোলিক ও ঐতিহাসিক ব্যবধানের রেখাচিহ্ন। ....
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে অক্টোবর, ২০১০ সন্ধ্যা ৭:৪৭
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমাদের দাদার দাদা।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৫৫

বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী।

আমার দাদার জন্মসাল আনুমানিক ১৯৫৮ সাল। যদি তার জন্মতারিখ ০১-০১-১৯৫৮ সাল হয় তাহলে আজ তার বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন

জেনে নিন আপনি স্বাভাবিক মানুষ নাকি সাইকো?

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:১৮


আপনার কি কারো ভালো সহ্য হয়না? আপনার পোস্ট কেউ পড়েনা কিন্তু আরিফ আর হুসাইন এর পোস্ট সবাই পড়ে তাই বলে আরিফ ভাইকে হিংসা হয়?কেউ একজন মানুষকে হাসাতে পারে, মানুষ তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

খুলনায় বসবাসরত কোন ব্লগার আছেন?

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:৩২

খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় তথা কুয়েট-এ অধ্যয়নরত কিংবা ঐ এলাকায় বসবাসরত কোন ব্লগার কি সামুতে আছেন? একটি দরিদ্র পরিবারকে সহযোগীতার জন্য মূলত কিছু তথ্য প্রয়োজন।

পরিবারটির কর্তা ব্যক্তি পেশায় একজন ভ্যান চালক... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। মুক্তিযোদ্ধা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১



মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি রয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে যাচাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি করাটা প্রফেসরদেরই ভালো মানায়

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৩


অত্র অঞ্চলে প্রতিটা সিভিতে আপনারা একটা কথা লেখা দেখবেন, যে আবেদনকারী ব্যক্তির বিশেষ গুণ হলো “সততা ও কঠোর পরিশ্রম”। এর মানে তারা বুঝাতে চায় যে তারা টাকা পয়সা চুরি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×