বিষয়টা অনেকটা অন্ধের হাতি দর্শনের মত হয়ে যাচ্ছে। যে যার অবস্থান থেকে কথা বলছেন। দেশের বেশিরভাগ মানুষ বলছে- ত্রিশ লাখ। মুক্তিযুদ্ধে আমাদের ত্রিশ লাখ মানুষই শহীদ হয়েছে। আবার কেউ কেউ বলছে, নাহ অতো হবে না। অত হবে না তো কত হবে? এই প্রশ্নের কোন জবাব আবার তারা দিচ্ছেন না।
আচ্ছা, প্রশ্নটা যখন উঠেছেই, তখন বিষয়টার দিকে একবার না হয় তাকানোই যাক। প্রথম প্রশ্ন- এই ত্রিশ লাখ ফিগারটা এলো কোথা থেকে? সহজ উত্তর- এটা বঙ্গবন্ধু বলেছেন। উনি কি হাওয়ার উপর বলেছেন? আমি তা মনে করি না। তবে এটা যে একেবারে চুলচেরা হিসাব, আমি সেরকম কিছুও দাবি করছি না। ইংরেজিতে একটা কথা আছে, ‘এস্টিমেটেড ফিগার,’ এটা অনেকটা সেরকম কিছু। উইকেপেডিয়াতে গেলে দেখা যায়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে জার্মান কর্তৃক দখলকৃত ইউরোপে এককোটি দশ লাখ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। ইউরোপ তো অনেক আগে থেকেই খুব গোছানো অঞ্চল, ওখানকার মানুষেরা শিক্ষিত। অনেক ক্ষেত্রেই তারা আমাদের জন্য উদাহরণ। আচ্ছা, ওরা কি এই এককোটি দশ লাখ মানুষের হিসাব দিতে পারবে? গুণে গুণে মিলিয়ে দিতে পারবে এককোটি দশ লাখ নিহত মানুষকে? আসলে ওরা যে ফিগারটার কথা বলছে, এটাই এস্টিমেটেড ফিগার। এরকম এস্টিমেটেড ফিগার রয়েছে আর্মেনিয়ান জেনোসাইড, অটোমান জেনোসাইড, গ্রীক জেনোসাইড, কম্বোডিয়ান জেনোসাইডসহ গত শতাব্দির প্রতিটি গণহত্যার ক্ষেত্রেই। সংখ্যাটা এমন হতেও পারে, আবার নাও হতেও পারে। এই ফিগারটা প্রথমে কে বলেছেন, সেটাও কিন্তু কেউ বলতে পারবে না। মানুষের মুখে মুখেই এসব ছড়িয়ে যায়। এখানে আসলে সংখ্যাটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ঘটনার নৈতিকতাটা।
তারপরও নাহয় কিছুটা সময়ের জন্য গণিতের আশ্রয়ই নেয়া যাক। আত্মসমর্পনের পর ৯০ হাজার পাকিস্তানী সেনাকে বন্দি হিসাবে ভারতে নিয়ে যাওয়া হয়। এই ৯০ হাজার সৈন্য তো এই ভূখন্ডেই বিচরণ করেছে পুরো নয়টি মাস। মাস বাদ দিয়ে যদি দিনের হিসাব করি তাহলে বলতে ২৬০ দিন তারা আমাদের এই দেশে তাণ্ডব চালিয়েছে। হ্যাঁ, তাণ্ডব চালিয়েছে, শন্তির বাণী প্রচার করেনি। হেন অপকর্ম নেই তারা করেনি। তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে রাজাকার, আলবদর আর শান্তিবাহীনি। দেশীয় এই জল্লাদদের সংখ্যা ছিল ৫০ থেকে ৬০ হাজার। সবমিলিয়ে দাড়ালো দেড় লাখ। এই দেড় লাখ হায়েনার প্রত্যেকে গড়ে মাসে যদি দুইজন করে মানুষকেও হত্যা করে থাকে, তাহলেও সংখ্যাটি গিয়ে ৩০ লাখে দাড়ায়। পাকবাহিনী, রাজাকার, আলবদরদের কর্মকাণ্ড যারা চর্মচক্ষে দেখেছেন, তারা জানেন ওদের হত্যাক্ষমতা ছিল আরও অনেক বেশি।
পাকিস্তানীদের একটা হিসাব আছে। তাদের দাবী- ওই ২৬০ দিনে এখানে নাকি ২৬০০০ মানুষ মারা গেছে। সহজ গানিতিক হিসাবে প্রতিদিন ১০০ জন! সাড়ে সাত কোটি মানুষের এই দেশে প্রতিদিন একশ’জন করে মানুষ হত্যা করেছে দেড় লাখ হায়েনা মিলে- এটাও বিশ্বাস করতে হবে? তাহলে তো ওদের দক্ষতা আর যোগ্যতা নিয়েই প্রশ্ন ওঠতে পারে।
আসলে প্রত্যেকে যে মাসে দু’জন করেই হত্যা করেছে, সেটা হয়তো প্রমাণিত নয়। কেউ হয়তো পুরো নয় মাসেই কোন হত্যা করেনি। আবার কেউ হয়তো প্রতি সপ্তাহেই করেছে। লুণ্ঠন, ধর্ষণ, এমনকি মানুষ হত্যার জন্য যখন কোন জবাবদিহিতা থাকে না, তখন এসব অপকর্ম সাপ্তাহিক ভিত্তিতে কেন, দৈনিকও হতে পারে। কিন্তু তারপরও বলবো, হিসাবটা কেউ একেবারে গুণে গুণে করে রাখেনি, সেটা সম্ভবও নয়। পৃথিবীর কোথাও সম্ভব হয়নি, আমাদের এই দেশে যে হওয়া সম্ভব ছিল, সেটাও বলা যাবে না। যদি সম্ভবই হতো, তাহলে আজ যারা প্রশ্ন তুলেছেন, তারা যখন ক্ষমতায় ছিলেন, তখন সেটা করতে পারতেন। কিন্তু সে পথে তারা যাননি।
আগেই বলেছি, আসলে সংখ্যাটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। সংখা গুরুত্বপূর্ণ বিজ্ঞানের জন্য, গবেষণার জন্য। নৈতিকতার জন্য সংখ্যা গুরুত্বপূর্ণ নয়। কেউ কি জানতে চাইবেন- হিটলার খারাপ ছিলেন, নাকি ইয়াহিয়া? নাৎসী ক্যাম্পে যে ইহুদি নির্যাতিত হয়েছেন, তার সঙ্গে কি হিটলারের কোন ব্যক্তিগত শত্রুতা ছিল? তিনি জীবনে হয়তো কখনো হিটলারকে দেখেনওনি। বাংলাদেশে যখন একটি গ্রামে আগুন দিয়ে ভষ্ম করা হয়েছে, পিতামতার সামনে কন্যাকে ধর্ষণ করা হয়েছে, নিষ্পাপ শিশুকে হত্যা করা হয়েছে, সেগুলো কি খোদ ইয়াহিয়া করেছে, নাকি তার সাঙ্গাতরা করেছে? এর চুড়ান্ত দায়টা কি ইয়াহিয়াকেই নিতে হয়নি? গণহত্যার জল্লাদ কিন্তু হিটলার, ইয়াহিয়া- দু’জনেই। কে বড় জল্লাদ ছিলো- তা নিয়ে বিতর্ক অর্থহীন নয়, সেটা আসলে একধরনের মতলববাজী।
আচ্ছা, এই বিতর্কটা ঠিক এখনই ওঠলো কেন? যিনি বা যারা-এ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, তিনি বা তাদের কাছে কেউ কি জানতে চেয়েছেন? যদি চেয়েও থাকেন, তাহলেও তারা এই বিষয়ে কোন অথরিটি? তাদের কি এই বিষয়ে কোন গবেষণা আছে? নাকি সবকিছুই ঘটেছে মাসটা ডিসেম্বর বলে? ডিসেম্বর আমাদের বিজয়ের মাস। এই মাসেই আমরা পাকিস্তানী বাহিনীকে চুড়ান্তভাবে পরাজিত করেছিলাম। দর্প চূর্ণ হয়েছিল নিজেদের শক্তি আর সামর্থ্য নিয়ে অহংকারী পাক সেনাবাহিনীর। আমাদের বিজয়ের আনন্দটিকে কোন না কোন বিতর্কিত কথার মাধ্যমে একটু হলেও থমকে দেয়ার মিশন কি কেউ নিয়েছেন? আমি খেয়াল করেছি, প্রায় প্রতিবছরই এই মার্চ কিংবা ডিসেম্বর এলেই এধরনের একটা বিতর্ক কিভাবে যেন আলোচনায় চলে আসে। গত দু’দশকেরও বেশি সময় ধরে আমি মিডিয়াতে কাজ করি। এই দীর্ঘ সময়ে দেখেছি ফেব্রুয়ারি, মার্চ আর ডিসেম্বরে মিডিয়াগুলো বিশেষ আয়োজন করে। পত্রিকাগুলো পুরো মাস জুড়েই ৫২’র ভাষা আন্দোলন, একাত্তরের মার্চের ও ডিসেম্বরের ঘটনাবলী প্রকাশ করে থাকে। টেলিভিশনে আসার পর দেখলাম এখানেও এই মাসগুলো বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে পালন করা হয়। আসলে জাতি হিসাবে আমাদের গর্ব করার মত ঘটনা তো এগুলোই। এগুলোর ওপর ভিত্তি করেই আমরা বেঁচে আছি। আমাদের গর্বের মাসগুলো যেই না আসে, তখনই, প্রতিবছরই প্রায় অবধরিতভাবে দেখতে পাই এরকম কিছু বিতর্ক উস্কে দেয়া হয়। বলা হয়, বাংলাভাষার জন্যই যদি ওরা জীবন দিয়েছিল, তাহলে সেটা পালনের তারিখ ৮ ফাল্গুন না হয়ে ২১ ফেব্রুয়ারি কেন হবে? মার্চে বলা হয়, শেখ মুজিব তো পাকিস্তানের সঙ্গে আঁতাত করতে চেয়েছিলেন, জিয়া যেয়ে স্বাধীনতার ঘোষণা না দিলে মুক্তিযুদ্ধই হতো না। তাহলে স্বাধীনতার ঘোষক কেন জিয়া হবে না? ডিসেম্বরে যেয়ে তোলা হয়, আত্মসমর্পন ও শহীদ নিয়ে বিতর্ক। বলা হয়, ১৬ তারিখে পাকিস্তানী বাহিনী আত্মসমর্পন তো মুক্তিবাহিনীর কাছে করেনি, করেছে ভারতীয় বাহিনীর কাছে। কই, ওই খানে তো মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি ওসমানী ছিলেন না। কাজেই পাকবাহিনী মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত হয়নি, পরাজিত হয়েছে পাক-ভারত যুদ্ধে। বেদনাদায়ক বিষয় হচ্ছে, ভারতের কিছু তথাকথিত ঐতিহাসিকও ১৯৭১ এর ঘটনাবলীকে প্রথমে পাকিস্তানের পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলের মধ্যেকার গৃহযুদ্ধ এবং পরবর্তীকালে ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের যুদ্ধ হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন।
ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলো একাত্তরের ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে। তাহলে মার্চ থেকেই সারাদেশে তারা যে লাগাতার মার খাচ্ছিলো, সেটা কার হাতে? পুরো নয়টা মাস তারা তাহলে কাদের সঙ্গে যুদ্ধ করলো?
এর পাশাপাশি বিতর্ক তোলা হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের শহীদ আর ক্ষতিগ্রস্তের সংখ্যা নিয়ে। মুক্তিযুদ্ধে নাকি ৩০ লাখ মানুষ শহীদ হয়নি, তিন লাখ মা বোনও ইজ্জত হারাননি। এদের কাছে সংখ্যাটিই আসল, ঘটনাটি নয়। ধর্ষণটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, কতজন ধর্ষন করলো- সেটা গুরুত্বপূর্ণ।
আসলে বিতর্কগুলোর অবতারণা করা হয়েছে কিছু লক্ষ্যকে সামনে রেখে। বিতর্কের আওতা ধীরে ধীরে বাড়ানো হচ্ছে। মানুষের কানে এগুলোকে সইয়ে নেয়ার প্রচেষ্টা দেখা যাচ্ছে। আত্মসমর্পণ নিয়ে প্রথমে প্রশ্ন, তারপর যুদ্ধ ভারতের সঙ্গে হয়েছে, এরপর হয়তো বলা হবে- ১৯৭১ সালে এখানে কোন মুক্তিযুদ্ধই হয়নি। আর মুক্তিযুদ্ধ না হলে, গণহত্যা হবে কি করে? গণহত্যা হয়নি, যুদ্ধাপরাধ হয়নি, ধর্ষণ হয়নি, মানুষের বাড়িঘরও পোড়ানো হয়নি। একাত্তর সালে পাকিস্তানের রেডিওতে যেমন বলা হতো, সেটাকেই প্রতিষ্ঠিত করা হবে, বলা হবে- ‘দৃস্কৃতকারী ও ভারতীয় অনুপ্রবেশকারীরা’ গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছে, মানুষ মেরেছে, ধর্ষন করেছে। আর ‘দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী’ তাদেরকে হটিয়ে দিয়েছে।
দেশে এখন এসব কি শুরু হয়েছে? তারও চেয়ে আগে বলবো- কেন এসব শুরু করতে দেয়া হচ্ছে? বিতর্ক করতে চাইলে তো করাই যায়, তাই বলে সবকিছু নিয়ে বিতর্ক করতে হবে? প্রতিটি মানুষের অপরিহার্য বিতর্ক হতে পারতো তার পিতৃপরিচয় নিয়ে। কেউ কি বলে অমুক যে আমার পিতা, তার কি প্রমাণ আছে? প্রতিটি মা কে তাহলে এই প্রমাণের মধ্যে দিয়ে যেতে হবে? মা’র স্বীকারোক্তিই কি যথেষ্ট নয়। আমরা কি সন্দেহ প্রকাশ করে মা’কে বলি, নাহ আমাকে জন্ম দেয়ার সময় তোমার তেমন একটা কষ্ট হয়নি? কষ্ট কতটা হয়েছে, সেটা তো মা-ই ভালো জানেন। আমার জন্মের সময় তাঁর প্রসব ব্যথা দশমিনিট ছিল নাকি দশঘন্টা, তার উপর কি আমার জন্মের যথার্থতা প্রমাণ হবে? তাহলে শহীদের সংখ্যা নিয়ে বিতর্কের অবকাশটা কোথায়?
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে ডিসেম্বর, ২০১৫ বিকাল ৫:৫৪