আলতাফ মাসুদ, ৫ এপ্রিল (শীর্ষ নিউজ ডটকম): পুঁজিবাজারের সাম্প্রতিক উত্থান-পতন ও কারসাজির ঘটনায় আলোচিত কয়েকজন শীর্ষ কারসাজিকারক রেহাই পেলেও অন্তত ৩শ' ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অনৈতিকভাবে অর্থ হাতিয়ে নেয়ার সুস্পষ্ট প্রমাণ পেয়েছে তদন্ত কমিটি। এ ছাড়া পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিকিউরিটিজ এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (এসইসি) চেয়ারম্যান ও কয়েকজন নির্বাহি পরিচালকের বিরুদ্ধে বুক বিল্ডিং, ফিক্স প্রাইস, প্রেফারেন্স শেয়ার, মূলধন বৃদ্ধি, প্রাইভেট প্লেসমেন্টসহ বিভিন্ন ধরণের অনিয়ম ও দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত থাকায় তাদের অপসারণের সুপারিশ থাকছে তদন্ত প্রতিবেদনে। পুঁজিবাজারে বিপর্যয়ের কারণ ও এর সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করতে গঠিত তদন্ত কমিটি বৃহস্পতিবার অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের কাছে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেবেন।
প্রতিবেদনে পুঁজিবাজারে অনিয়ম, দুর্নীতি ও কারসাজির সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ ছাড়াও এসইসি পুনর্গঠনের সুপারিশ করা হবে বলে নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে। এছাড়া সব ধরণের কারসাজির সঙ্গে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সম্পৃক্ততা পাওয়ায় দ্রুত স্টক এক্সচেঞ্জ ডি-মিউচ্যুয়ালাইজেশন করার সুপারিশ থাকছে তদন্ত প্রতিবেদনে।
নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, তদন্ত কমিটি তাদের কাজের শুরুতেই পুঁজিবাজার অতি মূল্যায়নের কারণ অনুসন্ধান করেছে। এ জন্য প্রাইমারি মার্কেটের প্রত্যেকটি ইস্যু বিস্তারিত অনুসন্ধান ও পর্যালোচনা করা হয়েছে। এতে দেখা গেছে, গত দু'বছরে ফিক্স প্রাইস, বুক বিল্ডিং ও সরাসরি তালিকাভুক্তির মাধ্যমে পুঁজিবাজারে আসা বেশ কিছু কোম্পানি অতি মূল্যায়িত হয়েই বাজারে প্রবেশ করেছে। এ কারণেই সেকেন্ডারি মার্কেটে শেয়ারের দর অযৌক্তিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। একই সময়ে শেয়ারের অভিহিত মূল্য পরিবর্তন, রাইট শেয়ার, সম্পদ পুনর্মূল্যায়নসহ বেশ কিছু মূল্য সংবেদনশীল পদক্ষেপ নেয়া হয় এসইসির সহযোগিতায়। ফলস্বরূপ পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত অধিকাংশ শেয়ার অতি মূল্যায়িত হয়ে পড়ে। তদন্ত রিপোর্টে প্রাইমারি মার্কেটে শেয়ার অতি মূল্যায়িত হওয়ার জন্য সরকারি বিশেষ নির্দেশনার পাশাপাশি এসইসির অনুমোদনকে দায়ী করা হয়েছে। প্রাইমারি মার্কেটের অনিয়মের জন্য ১৮ জনকে শনাক্ত করা হলেও শেষ পর্যন্ত এসইসির কর্মকর্তাদের ছাড়া কারো বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য কোন সুপারিশ করা হচ্ছে না বলে জানা গেছে। তদন্ত কমিটি সবচেয়ে বেশি অনিয়ম দেখতে পেয়েছে প্লেসমেন্টের ক্ষেত্রে। প্লেসমেন্ট অনিয়মে জড়িত থাকার দায়ে প্রায় ১শ' জনকে শনাক্ত করেছে তদন্ত কমিটি। এর মধ্যে ডিএসইর সাবেক সভাপতি রকিবুর রহমান ছাড়াও এনইউএম অলিউল্লাহ (ড্রাগন সিকিউরিটিজ), মো. শাহজাহান (জাহান সিকিউরিটিজ), জামালউদ্দিন আহমেদ, মো. আজিজুল হক (বিএনবি এন্টারপ্রাইজ লি, এএস শহুদুল হক বুলবুল (বুলবুল সিকিউরিটিজ), আনোয়ার হোসেন (আনোয়ার সিকিউরিটিজ), মোশতাক আহমেদ সাদেকী (আইপিএস লিমিটেড), এম. কামাল উদ্দিন (মার্চেন্ট সিকিউরিটিজ), আল মারুফ খান এফসিএ (সিএমএসএল সিকিউরিটিজ), সাইফুল ইসলাম চৌধুরী (সিউকিরিটিজ ব্রোকিং এন্ড ম্যানেজমেন্ট সার্ভিসেস লিমিটেড) ও লিয়াকত আলীসহ ডিএসই'র লিস্টিং কমিটির অধিকাংশ সদস্যের নাম রয়েছে বলে জানা গেছে। এছাড়া সরকারি প্রভাবশালী প্রায় ৫০ জন কর্মকর্তার প্লেসমেন্ট ব্যবসায় জড়িত থাকার তথ্য রয়েছে তদন্ত কমিটির কাছে। এসব কর্মকর্তাদের শনাক্ত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সরকারকে বলা হবে বলে সূত্রে জানা গেছে।
এছাড়া আইপিও পূর্ববর্তী প্লেসমেন্ট বাণিজ্যে সালমান এফ রহমানের সংশ্লিষ্টতার বিষয়ও তদন্ত রিপোর্টে উল্লেখ থাকবে বলে জানা গেছে। তবে এসইসির অনুমোদন নিয়ে তা করায় তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের কোন সুপারিশ থাকছে না বলে জানা গেছে। তদন্ত প্রতিবেদনে বিভিন্ন কোম্পানির প্লেসমেন্ট শেয়ার বাণিজ্যে সহযোগিতার দায়ে এসইসি চেয়ারম্যান জিয়াউল হক খন্দকার ও নির্বাহি পরিচালক এটিএম তারিকুজ্জামানকে অপসারণের সুপারিশ করা হয়েছে বলে জানা গেছে। একই সঙ্গে মিউচ্যুয়াল ফাণ্ডের অনিয়মের জন্য আনোয়ারুল ইসলামের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ থাকছে বলে নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে। এছাড়া কয়েকটি বিধি তৈরির মাধ্যমে কারসাজিকারকদের সহযোগিতার দায়ে নির্বাহি পরিচালক ফরহাদ আহমেদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ থাকছে বলে জানা গেছে।
এদিকে সেকেন্ডারি মার্কেটের কারসাজির তদন্ত করতে গিয়ে অনেক চমকপ্রদ তথ্য পেয়েছে তদন্ত কমিটি। নতুন নতুন পদ্ধতিতে শেয়ারের দর বাড়িয়ে শত শত কোটি টাকা অবৈধভাবে মুনাফার সাথে জড়িতদের চিহ্নিত করা হয়েছে প্রতিবেদনে। এ ক্ষেত্রে বহু লোকের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেলেও উল্লেখযোগ্যদের সম্পর্কেই সর্বাধিক তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করা হয়েছে। এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য সুপারিশ করা হবে। এবারের মূল্য কারসাজির সঙ্গে '৯৬ সালের জড়িত চক্রটির পাশাপাশি নতুন কয়েকটি চক্রের সন্ধান পাওয়া গেছে। সেকেন্ডারি মার্কেটে ডিএসইর সাবেক সভাপতি রকিবুর রহমান, মোসাদ্দেক আলী ফালু, লুৎফর রহমান বাদল, তার স্ত্রী সোমা বাদল, এয়াকুব আলী খন্দকারসহ অন্তত ৩০ জনের শেয়ার কারসাজির সঙ্গে জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে। তবে শেয়ার কারসাজির সাথে ২ শতাধিক লোক জড়িত রয়েছে বলে তদন্ত কমিটি বিভিন্ন সূত্রে প্রমাণ পেয়েছে। প্রাথমিকভাবে উক্ত ৩০ জন বড় কারসাজিকারক বলে তদন্তে চিহ্নিত হয়েছে। এদের মধ্যে কয়েকটি ব্যাংকের উদ্যোক্তা, পরিচালকও রয়েছেন। এছাড়া শেয়ার কারসাজির সঙ্গে স্টক এক্সচেঞ্জের সদস্য প্রতিষ্ঠানগুলোর পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান আইসিবি ও বেশ কয়েকটি মার্চেন্ট ব্যাংকের জড়িত থাকার প্রমাণ রয়েছে তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে। এ ছাড়া রুবেল নামে এক তরুণ বিনিয়োগকারীর গত এক বছরে শেয়ার কারসাজির মাধ্যমে ২৫০ কোটি টাকা মুনাফার তথ্য প্রতিবেদনে থাকছে। তবে অবাক করা তথ্য হচ্ছে, পুঁজিবাজারে সবচেয়ে বেশি আলোচিত সমালোচিত ব্যক্তি এবং '৯৬ সালের পুঁজিবাজার কেলেঙ্কারির নায়ক সালমান এফ রহমানের সেকেন্ডারি মার্কেটে সরাসরি কোন যোগসাজশ খুঁজে পায়নি তদন্ত কমিটি। প্রাইমারি মার্কেট অর্থাৎ আইপিও'র ক্ষেত্রে তার সংশ্লিষ্টতা খুঁজে পেয়েছে কমিটি। কারণ, প্রতিটি কাজই এসইসির অনুমোদন সাপেক্ষে সম্পন্ন করা হয়েছে। অপরদিকে এসইসির কর্মকর্তাদের সেকেন্ডারি মার্কেটে লেনদেনের তথ্য পেয়েছে তদন্ত কমিটি। এসইসির নির্বাহি পরিচালক আনোয়ারুল কবীর ভূঁইয়ার স্ত্রীর বিও হিসাবে গত বছরে প্রায় ১৫ কোটি টাকার লেনদেনের হিসাব পাওয়া গেছে। সূত্র জানায়, তদন্ত কমিটি সেকেন্ডারি মার্কেটে লেনদেন করা কয়েকজন রাঘববোয়ালদের একাউন্টে তল্লাশি চালিয়েছে। এদের বিও হিসাবেও অনেক গরমিল পাওয়া গেছে। এদের লিস্ট তৈরি করা হয়েছে, যা তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ থাকবে। এছাড়া পুঁজিবাজারে সেনাবাহিনীর অনেক সদস্যের বড় ধরনের বিনিয়োগ সংশ্লিষ্টতা তদন্ত কমিটি পেয়েছে বলে জানা গেছে। অর্থ মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটির সভাপতি আহম মোস্তফা কামালের বিরুদ্ধে পুঁজিবাজারের অনিয়মে যুক্ত থাকায় প্রতিবেদনে তার নাম থাকছে বলে জানা গেছে। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কয়েকটি কোম্পানির চেয়ারম্যান, পরিচালকের বিরুদ্ধে শেয়ার কারসাজিতে জড়িত থাকার প্রমাণ রয়েছে প্রতিবেদনে।
পুঁজিবাজারের কারসাজিতে সম্পৃক্ততার বিষয়ে তদন্ত কমিটির প্রধান খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি কোন মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানান।
পুঁজিবাজার সংক্রান্ত বিভিন্ন অনিয়ম ও কারসাজি দূর করতে তদন্ত কমিটি স্বল্পতম সময়ের মধ্যে নিয়ন্ত্রক সংস্থা এসইসি ও দেশের উভয় স্টক এক্সচেঞ্জের ডি-মিউচ্যুয়ালাইজেশন সম্পন্ন করার জন্য সরকারের কাছে সুপারিশ জানাবে বলে জানা গেছে। এ ক্ষেত্রে এসইসির চেয়ারম্যানসহ কয়েকজন নির্বাহি পরিচালককে অপসারণ করে প্রতিষ্ঠানটি পুনর্গঠন করার সুপারিশ থাকছে প্রতিবেদনে। কমিশনের দক্ষতা ও ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য চেয়ারম্যান ছাড়া চার সদস্য রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। এ ছাড়া বেশ কয়েকটি নতুন বিভাগ সংযোজন ও কারসাজি প্রতিরোধে গোয়েন্দা বিভাগ গঠনেরও প্রস্তাব করা হয়েছে। একইসাথে এসইসির বিধি বিধান সংস্কারের মাধ্যমে ভবিষ্যতে পুঁজিবাজারের বিপর্যয় রোধের জন্য বেশ কিছু সুপারিশ করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
উল্লেখ্য, গত ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে পুঁজিবাজারে একের পর এক বিপর্যয়ের প্রেক্ষিতে এর কারণ উদঘাটন ও কারসাজির সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করতে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত একটি তদন্ত কমিটি গঠনের ঘোষণা দেন। এরপর গত ২৬ জানুয়ারি অর্থ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী এসইসির পক্ষ থেকে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি এবং এর কার্যপরিধি ঘোষণা করা হয়। কৃষি ব্যাংকের চেয়ারম্যান খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদকে প্রধান করে গঠিত তদন্ত কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন- বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের মহাপরিচালক ও বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাধারণ সম্পাদক ড. তৌফিক আহমেদ চৌধুরী এবং আইসিএবির সাবেক সভাপতি মোহাম্মদ আবদুল বারী এফসিএ। এরপর গত ২২ ফেব্রুয়ারি অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার নিহাদ কবিরকে অন্তর্ভুক্ত করে তদন্ত কমিটি পুনর্গঠন করা হয়। ওই প্রজ্ঞাপনে কার্যপরিধি অপরিবর্তিত রাখা হলেও এর মাধ্যমে কমিটির কার্যক্রম এসইসির পরিবর্তে মন্ত্রণালয়ের আওতায় ন্যস্ত হয়।
সূত্র: (শীর্ষ নিউজ ডটকম)