অলসতা আর নিজের অজান্তেই রুমের কোনাটা ভরে গেছে সিগারেটের খালী প্যাকেটে। প্রথম দিকে কয়েকদিন পর পর হলেও পরেরদিকে ঘন ঘন রুম পরিস্কার করে দেয়। এক পর্যায়ে সকালে কর্মক্ষেত্রে যাবার সময় প্রতিদিনই রুম পরিষ্কার করে দে’য়ার বায়না ধরে। আমিও আর ‘না’ বলতে পারিনা তার মলিন মুখের দিকে তাকিয়ে। বিনিময়ে পান-তামাক খাওয়ার জন্য কিছু দেই। এগুলোই তার দিনের বাড়তি আয়।
নিয়মিত-অনিয়মিত প্রতিদিন রুমটা পরিষ্কার করলেও কোনক্রমেই সিগারেটের ঐ খালী প্যাকেটগুলোর একটাও ফেলতে দেইনা। নিজেই সাজিয়ে গুছিয়ে রাখি। কিছু একটা করার জন্য। ওগুলো দিয়ে কী করবো ভাবতে ভাবতে প্রায় গুছিয়ে এনেছি পরিকল্পনা।
অনেকদিন কেটে গেছে। তাই প্যাকেটও জমা হয়েছে অনেক। কিন্তু কিছু করছিনা বলে লোকটি প্রায়শঃই আমাকে জ্বালাতন করে।
স্যার,
এইল্যা দিয়ে কী করবেন ?
এইল্যা কি বেছবেন ?
কেঠায় কিনবো এইল্যা ?
ফালায়া দেই ?
না অইলে আমারে দিয়া দেন বউ জ্বাল দিয়া বাত চড়াবো...
মনে মনে বলি এবার বলেছ আসল কথা। তাইতো বলি ফেলে দিতে চাও কেন ?
মুচকি এককোনা হাসি দিয়ে বললাম-
ফেলেতো দিতেই চাই কিন্তু একটু সমস্যা আছে।
কী সমেস্যা, সার !
বললাম- কয়েকদিন আগে এখানে কোন প্যাকেটের মধ্যে যে ১ টা ১০০ টাকার নোট রাখলাম তা মনে করতে পারছিনা। খোঁজাও হয়না আর প্যাকেটগুলো ফেলেও দে’য়া হয়না।
সার কন কী ! ১০০ ট্যাকা ! আমারে আগে কন্নাই ক্যান ? আমি উইটক্যায়া দিতাম !
বললাম তাই ? তাহলে দাও। খুঁজে দাও।
বলল- আমি ১০০ ট্যাকা পায়া দিলে আমারে কী দিবেন ?
বললাম- ১০০ টাকা বের করে দিলে আমি তোমাকে ২০০ টাকা দেব।
সার, এরকী না। আমি পায়া দিলে আফনের আধা আমার আধা। দুইজনে আধা-আধি। তায়লে কন। আমি ব্যাকটি (সবগুলো) বাইত্তে (বাড়ীতে) নিয়া যাই।
হেসে বললাম- বাড়ী গিয়ে টাকাটা পেয়েও যদি অস্বীকার কর যে টাকা পাওনাই? তাই একটা শর্ত- তুমি টাকা পেলেও আমাকে ২০ টাকা দিবা না পেলেও ২০ টাকা দিবা। আর শোন- একটা প্যাকেটও কিন্তু ছেঁড়া যাবেনা।
আইচ্ছা। বলে চলে গেল।
কিছুক্ষণ পর একটা প্লাস্টিকের ছালা আর তার ছোট মেয়েটিকে নিয়ে কর্মক্ষেত্রে হাজির।
সার, খোলডি নিতে আইছি। এখন দিবেন ?
ধমক দিয়ে বললাম- ধুরর মিয়া। আর টাইম পাইলা না ? যাও ছুটির পর বিকালে যাবার সময় নিয়া যাইও।
ছুটির পর রুমে এসে দেখি তার ছোট্ট মেয়েটা আমার রুমের সামনে ছালা নিয়ে বসে আছে।
বললাম- কী ব্যাপার ?
লোকটি বলছে- সার, আফনে যুদি খোলডি কাউরে দিয়া দেন, তাই মেয়েরে বসায়া রাখছি বিয়ানা (সকাল) থিক্যা...।
বললাম তুমি কী পাগল না-কী ? ও খাইছে কিছু ?
বলল- না। টাইম পায়নাই।
গিজগিজ রাগতঃ স্বরে ধমক দিয়ে বললাম- যাও এক্ষুনি নিয়ে যাও। তাড়াতাড়ী বিদায় হও।
একটা বস্তায় ভওে, বাকীগুলো লুঙ্গীতে করে হাঁটা ধরল। দরজা দিয়ে বেরুবার সময় বলে গেল-
সার, না পাইলে কিন্তুক আফনেরে কিছুই দিবার পামুনা।
সাহরী’র একটু আগে আগে। লোকটির গ্রামের আমার এক কলীগের ফোন পেয়ে ঘুম ভাঙল। রিসিভ করতেই-
সার, আসলামু...। এত উইটক্যাইলাম একটা খোলের মদ্দেও ট্যাকাডা পাইলাম না। দুইব্যার কইরা উইটক্যাইছি। আমার বউ, মেয়ে সপটি মিল্যা উইটক্যাইলাম হারা রাইত ধইর্যা...
আমিতো রীতিমতো টাস্কী ! আধ ঘুম। চোখ জ্বলছে। তবুও হাসতে হাসতে আমার দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। বললাম তুমি এতো রাতে কামরুল স্যারের বাড়ীতে কেন?
বলছে- সার বিশ্বেস করেন। ট্যাকা পাইনাই এইড্যা আফনেরে কবার নিগা শাহীন সারের দিয়া মোবাইল করছি...
বললাম- আচ্ছা। বিশ্বাস করলাম। সকালে আবার ভালো করে খুঁজে দেখো। এখন বাড়ী যাও।
কামরুল স্যারকে অনুরোধ করে বলে দিলাম- স্যার, ওকে সাহরীটা খাইয়ে দেন।
শফি। এই হচ্ছে আমাদের শফিক। আমার কর্মক্ষেত্রের একজন। না চতুর্থ শ্রেণীরও বলা যাবেনা। তারচে’ও নীচের কেউ। বেসরকারী, অস্থায়ী ভাবে নিয়োগকৃত। ওর কাজটা মূলত দুপুরের টিফিন বানাতে সাহায্য করা। ফুট ফরমায়েশ খাটা। বিনিময়ে আমরা কলিগরা সবাই মিলে আর বেসরকারী ফাণ্ড থেকে যা দেই তাই দিয়ে কোন মতে টেনেটুনে চলে ওর পাঁচ সদস্যের সংসার ।
এছাড়াও আমরা প্রতিদিনই ওর কোন না কোন বিষয় নিয়ে হাসাহাসি করি। বোকা। বোকাসোকা গোবেচারা লোকটি। অভাবের সংসারে পুষ্টিহীনতার কষাঘাতে শরীরটাও জীর্ণশীর্ন। গা চলেনা। সমাজ সংসার থেকেও প্রায় বিচ্ছিন্ন। দিনের সারাটা সময় প্রায় কর্মক্ষেত্রেই কাটিয়ে দেয়। ওকে দিয়ে কোন ছোট খাট কাজ দিয়েও কেউ নিশ্চিত থাকতে পারেন না।
দীর্ঘ ছুটির পর প্রথম কর্মদিবসে কর্মক্ষেত্রে আসলাম। এসেই প্রথমে ঢুঁ মারলাম বসের কক্ষে। তাঁর সামনে বসতে বসতেই একজন পিয়ন এসে বলল-
স্যার, খবর শুনেছেনে ? শফি’র খবর ?
আমি আশ্চর্য হলামনা। ভাবলাম আজ হয়তো এমন কোন বোকামী করেছে, যা বলার মতো না। আমি কিছু বললামও না। বস সামনেই আছে তাই রীতি অনুযায়ী চুপ করেই আছি।
ইতোমধ্যে অন্য একজন ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে জানতে চাইলেন-
কেন?
কী হয়েছে শফি’র ?
বসই মুখ খুললেন। দোষতো শফি’রই। এমন বোকামী কেউ করে ? তিনি শফি’র দোষ সহ বিস্তারিত বর্ণনা দিতে লাগলেন। আমি চলে এলাম। ভাবলাম বসের কাছে সত্য ঘটনা পাওয়া যাবেনা। কারণ তিনি তাঁর দায়িত্ব এড়াতে শুধু তাঁর নিজের সাফাই গাইবেন। যা আগে অনেকবার হয়েছে।
ফোন দিলাম শফি’র এক প্রতিবেশীকে। তিনি বললেন বিকেলে সব বিস্তারিত বলবেন। বিকেলে বৃষ্টির কারণে আর দেখা হলোনা।
আজ তার পরদিন। সন্ধ্যায় নাইট গার্ড মারফত জানলাম শফি ছাড়া পেয়েছে বিকেলে। জানতে চাইলাম খবর কী তার ?
নাইট গার্ড আজাদ বলল-
স্যার, আর কইয়েন না। শফি’র জীবনটা শেষ।
বললাম- কেন ?
কেন আবার স্যার ? বুঝেন না?
জানতে চাইলাম ঘটনা। খুলে বলোতো।
আজাদ বললো- স্যার কোমরের নীচের অংশটুকু শেষ। ও আর জীবনে কিছু করে খেতে পারবে বলে মনে হয়না। এমন পিটান পিটাইছে কোমরের নীচের অংশ থেঁতলে দিয়েছে। শরীর হাত পা ফুলে কলাগাছ হয়ে আছে।
বললাম তাই না-কি ? এখন কী অবস্থা ?
বলল- বাড়ী আসলে তাকে হাসপাতালে, ডাক্তার কিংবা ঔষধ কেনার মতো টাকা তার কাছে ছিলোনা। শফির বউ বার বার মূর্ছা যায়। এমতাবস্থায় আমি আর ওর গ্রামের এক ইউপি সদস্য দুজনে মিলে ভ্যানে করে নান্দিনা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছি। ওখানেই সে আছে।
বললাম- কাল একবার যাব দেখতে।
পরদিন আর যাওয়া হলোনা। তারপর দিন গেলাম শফি’কে দেখতে। সন্ধ্যায় গিয়ে দেখি। টাকার অভাবে শফি’র চিকিৎসা হচ্ছেনা। তাকে রিলিজ দে’য়া হয়েছে। ও বাড়ী চলে যাচ্ছে। কয়েকশ’ টাকা হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললাম- বাড়ী যাও। দেখি কী করা যায়।
পরদিন কর্মক্ষেত্রে এসে বিষয়টা জানিয়ে, আমরা সহকর্মী আর অন্যান্যরা মিলে কিছু টাকা জোগাড় করে সন্ধ্যায় দেখা করলাম শফি’র সাথে। ওর বউ বলল-
স্যার, ৩ দিন হয় ছেলে-মেয়ে সহ কেউ মুখে কোন দানা পানি দেইনাই।
টাকাগুলো শফি’র বউ’র হাতে দিয়ে, জানতে চাইলাম ঘটনাটা কী ? বলোতো শফি ?
শফি যা বললো তা এরকম-
গতরাতে র্যাব এসেছিলো শফি’র বাড়ী। উদ্দেশ্য- শফি’র এক ভাগ্নে থাকে ঢাকায়। যে একটা অপহরণ মামলার আসামী। শফি’র দারিদ্রতার কারণে, যে বোন-ভাগ্নের সাথে শফি’র কোন সম্পর্ক নাই আজ প্রায় ১২/১৩ বছর যাবত। শফি জানেওনা তারা ঢাকার কোথায় থাকে। র্যাব এসে রাত ৩টার দিকে শফি’কে ডেকে তুলে ভাগ্নের নাম-ঠিকানা বলে জিজ্ঞেস করে একে চিনে কি-না।
ঢুলুঢুলু ঘুমের চোখ কচলাতে কচলাতে, আপাদমস্তক কালো কাপড়ে আবৃত র্যাবের চেহারা দেখে শফি’র আত্মারাম খাঁচা ছেড়ে পালাবার অবস্থা। ভয়ে জুবুথুবু হয়ে র্যাবকে বলে তাদেরকে শফি চিনে না। অপরদিকে শফি’র এক দিনমজুর ভাইকে জিজ্ঞেস করলে সে বলে তাকে সে চিনে কিন্তু তাদের সাথে এখানকার কাউরো যোগাযোগ নাই। একথা শোনার পরই র্যাব গর্জে উঠে হামলে পড়ে শফি’র উপর। সঙ্গে সঙ্গে একজন এসে শফি’র বুকে একটা লাথি মারে। শফি মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। শুরু হয় র্যাবের তাণ্ডব। লাঠিদিয়ে পিটাতে পিটাতে নিয়ে যায় কয়েক কিমি দূরে শফি’র বোনের গ্রামের বাড়ী। তার আগে শফি’কে বেধড়ক পেটানো হয় অদূরে রেল লাইনের উপর ফেলে। শফি’র চিৎকারে গ্রামের ঘুমন্ত মানুষগুলো জেগে যায়। সেখানে গিয়ে তারা পেয়েযায় তাদের কাঙ্খিত আসামীকে। শফি সহ সবাইকে ধরে নিয়ে যায়। কোথায় নিয়ে গেছে শফি তা জানেনা-চিনেনা।
জানতে চাইলাম তুমি আসলা কীভাবে ?
শফি বললো-
“আমারে আজ দুফুরে মারনের পর হইস করছে (জিজ্ঞেস করছে), তুই কী করিস ? আমি কইছি একটা সরকারী চাকরী করি (যদিও শফি নিজেই বুঝেনা সে সরকারী না বেসরকারী চাকরী করে)। এইকথা শোনার পর র্যাব আমার উপর নির্যাতন বন্ধ করে। ৪টার সময় আমারে মুরগীর গোস্ত দিয়া ভাত খাওয়ায়া কালা কাফরে চোখ বাইন্ধা (শহরের বাইরে শেরপুর ঘাট) বিরিজ -এর নীচে গাড়ী থিকা ধাক্কা দিয়া নামায়া যায়। সেখান থিকা মাইনসেরা আমারে বাড়ী নিয়া আহে। আমি তাগরে চিনিনা।”
শফির জীবন আজ বিপন্ন। কথা সেটা নয়। আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে, শফির মতো একটা নিরীহ মানুষকে এভাবে নির্যাতন করার মানে কী ? কারণই বা কী ? অনেকেই বলতে পারেন, শফি কেন মিথ্যা কথা বলতে গেল ? সত্য কথা বলতে তার কী দোষ ছিলো ? মানলাম। এমনত্বরাবস্থায় আমি আপনি হলে কী বলতেন ? যেখানে শফি’র মতো একটা গোবেচারার কথা বলছি ?
Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে আগস্ট, ২০১২ দুপুর ১:২৩