[দৈনিক ইনকিলাব: ২৫/০৪/২০১৪ ইং]
উবায়দুর রহমান খান নদভী:
সংবাদপত্রে খবরটি দেখেই
মনটা খুশি হয়ে গেল। রাজধানীর
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে দুই দিন
ব্যাপী তাফসীরুল কুরআন
মাহফিল, জিকির ও মুনাজাত।
দেশের অন্যতম প্রখ্যাত পীর
সাহেব মুফতী সৈয়দ রেজাউল
করীম এতে প্রধান
অতিথি ছিলেন।
কাগজে প্রকাশিত
ছবিতে দেখা যায় বিশাল
জনসমাবেশের দৃশ্য আমার
চিকিৎসা কাজে নিয়োজিত
জনৈক সেবাকর্মী চরমোনাইয়ের
ভক্ত তিনি মাহফিলে দু’দিনই
শরিক হয়েছেন বলে জানালেন
এবং তার
চোখে দেখা পরিস্থিতি ও মনের
উচ্ছ্বাস আমার
সামনে তুলে ধরলেন।
তিনি যা বুঝাতে চাইলেন
তা অনেকটা এমন, আল্লাহ ও রাসূল
সা.-এর কথা আলোচিত হওয়ায়
ঐতিহাসিক এ
জায়গাটিতে আশ্চর্য এক পবিত্র
আবহ বিরাজ করছিল। পীর
সাহেবের সুশৃংখল লক্ষ লক্ষ মুরিদ
ভক্ত ও সাধারণ মানুষে উদ্যানের
সভাস্থলটি ছিল কানায় কানায়
পূর্ণ। বিশেষ করে পবিত্র নামের
জিকির যখন লাখো আশিকের
কণ্ঠে উচ্চারিত হচ্ছিল, তখন এর
মধুমাখা অনুরণন
গোটা এলাকটিতে ছড়িয়ে দিচ্ছিল
এক অভূতপূর্ব প্রাণচাঞ্চল্য ও
ঐশী সজীবতা। তার
কথাগুলো শুনে আমার শ্রান্ত-
ক্লান্ত পীড়িত দেহ মনেও
ফিরে এলো অদ্ভুত এক সতেজতা।
মনে মনে ভাবতে লাগলাম, এই
সে উদ্যান
যেখানে দাঁড়িয়ে ইতিহাসের
অন্যতম
সেরা ভাষণটি দিয়েছিলেন
বাংলাদেশের শহীদ স্থপতি। এই
জিকির দোয়া ও মুনাজাতের
প্রভাবে তার আত্মাও আজ বিশেষ
প্রশান্তি লাভ করছে নিশ্চয়ই।
আল্লাহর রহমত ও মাগফিরাত
পাচ্ছে স্বাধীনতা ও
মুক্তিসংগ্রামে নিহত
লাখো শহীদের রূহ। এই জিকির
তিলাওয়াত তাফসীর ও দুরুদ
মিশে গেছে বাংলার ইথারে।
রাজধানীর এই ফুসফুস এবার সঞ্চয়
করে নিল নতুন অনেক
ঐশী অক্সিজেন। বাংলাদেশ
রহমত বরকত ও নাজাতের সমৃদ্ধ
ভারে পরিণত
হতে পারে মহানবী সা.-এর উপর
দরুদ ও সালাম পাঠের মধ্য দিয়ে।
রাজপথ থেকে সংসদ, সচিবালয়,
গণভবন ও বঙ্গভবন পর্যন্ত
আলোকিত হতে পারে আল্লাহর
দরবারে তওবা, ইস্তিগফার ও
নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের মাধ্যমে।
এ জিকির যেনো জারি থাকে। এ
তিলাওয়াত যেনো সচল থাকে।
সারাদেশের মতো এ উদ্যানেও
যেনো অব্যাহত থাকে আল্লাহর
প্রিয় বান্দাদের পদচারণা।
প্রতিবছর
হাক্কানী রাব্বানী পীর
মাশায়েখ, আলেম-উলামা ও
ধর্মপ্রাণ
জনতা যেনো এখানে আসেন
তাফসীর ও তালীমের নামে।
জিকির ও তিলাওয়াতের নামে।
তাসবীহ তাহলীল দোয়া ও
মুনাজাতের নামে। রাজধানীর
প্রধান শানে রিসালাত
সম্মেলনটি যেনো এখানেই হয়।
দলমত নির্বিশেষে সকল উলামা-
মাশায়েখের মূল ঐক্য সম্মেলনটিও
হতে পারে ঐতিহাসিক এ
উদ্যানেই। এখানে সবকিছু
হতে পারলে উল্লিখিত মহৎ ও
পুণ্যময় কাজগুলোও হতে পারবে।
এখানে থেকেই তো শুরু সভ্য
বাংলাদেশের যাত্রা।
রাজধানী ঢাকার দ্বিগুণ
বয়সী শায়খ শরফুদ্দীন চিশতী রহ:
এর কবর তো বাঙালি মুসলমানের
আধুনিক সভ্যতার প্রথম দিককার
মাইলফলক। আজ জিকিরের
ধ্বনি প্রতিধ্বনি তো তাঁর
আত্মায়ও নতুন শান্তির পরশ
বুলিয়ে দিল। খুশি আজ নাম
না জানা অসংখ্য মুমিন হৃদয়,
যারা সাড়ে আটশ বছর
আগে থেকে আজকের সময় পর্যন্ত
গোটা রমনা, শাহবাগ, নিমতলী ও
সচিবালয় এলাকায় সমাহিত।
আনন্দে উদ্বেলিত
ভিনদেশি সওদাগর
হাজী শাহবাজ ও তার
সঙ্গীসাথীর আত্মা। মোগল
রাজধানী ঢাকায় যিনি ছিলেন
আধ্যাত্মিক সাধনার অন্যতম
প্রতীক। প্রাসাদ বানিয়েছিলেন
টঙ্গীর কাছে, নামাজ
পড়তে আসতেন শাহবাগে। তিন
নেতার কবর, হাইকোর্ট ও শিশু
একাডেমির মধ্যখানে তার
অমরকীর্তি শাহবাগ মসজিদ
এবং বিশেষ ধ্যান মোরাকাবা ও
জিকিরের কামরা। কবরও তার
এখানেই।
হাজী শাহবাজ ও আমাদের
জাতীয় নেতাদের রুহেও আজ
খেলে যাচ্ছে ঐশী আনন্দের
নতুনধারা। বাংলার মুসলমানের
অধিকার আদায়ের দরদি পথিকৃৎ
নবাব পরিবারের বাগানে আজ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাদুঘর,
কেন্দ্রীয় পাবলিক লাইব্রেরী,
শিখদের গুরুদুয়ারা, মা আনন্দময়ীর
আশ্রম ও মন্দির। সকল ধর্মের
সহাবস্থান ও সকল ধর্ম-মত
আদর্শের মাঝে উদার মানবিক
সম্প্রীতি তো মুসলমানেরই দান।
বাঙালি জাতির অধিকার
আদায়ের সংগ্রামে জয়ী হয়ে এ
দেশটির নতুন পরিচয় নতুন পতাকা এ
উদ্যান থেকেই এসেছে। আল্লাহ
নামের শক্তি এবার এ
অঞ্চলে ছড়িয়ে দেবে নতুন শুদ্ধতা,
নতুন প্রাণ। মহানবী সা.-এর দরুদ ও
সালামের উসিলায়
বেড়ে যাবে দেশ, জাতি ও
রাষ্ট্রের সম্মান। ধর্মপ্রাণ
লাখো মানুষের হৃদয়
নিংড়ানো কান্না ও মুনাজাত
রুখে দেবে সকল আজাব গজব অন্যায়
ও অশান্তি। সবাই নিজ নিজ
অবস্থান
থেকে তওবা করে ছাড়তে হবে শঠতা,
অনাচার, মিথ্যা, জালিয়াতি,
দুর্নীতি অপসংস্কৃতি ও পাপাচার।
নাস্তিকতা, খোদাদ্রোহিতা,
রাসূলবিদ্বেষ, যেমন
ছাড়তে হবে তেমনি বের
হয়ে আসতে হবে পশু-পাখি, গাছ-
মাছ সাপ-বিচ্ছু, হাঙ্গর-কুমির,
পেঁচা-ময়ূর আর প্রকৃতির পূজা-
অর্চনা থেকে। যেখান
থেকে তলে আনতে আটশ, হাজার,
বারশো, চোদ্দশো বছর
আগে থেকেই ইসলাম
প্রচারকরা প্রেম ও পুণ্যের
পিয়ালা হাতে ছুটে এসেছিলেন এই
ঢাকায়, এই বাংলায়।
ভালোবাসা ও অপার মানবিকতাই
ছিল যাদের একমাত্র অস্ত্র। এসব
হাতিয়ার নিয়ে দিনরাত কাজ
চালিয়ে গেলে আবার উদিত
হবে পুণ্যের অরুণ আলো।
সম্পাদক সাহেবের ফোন
এলে আমি ভাবনা থেকে রোগশয্যায়
ফিরে এলাম। মনে কেনো আজ
এতো কথা? কেনো আমি আজ
এতো আবেগ আপ্লুত? চোখে আজ
অশ্রু কেনো? আমার এডিটর
যথারীতি বললেন, যেনো বিশ্রাম
ভঙ্গ না করি। ডাক্তারের
কথা যেনো অমান্য না করি।
যেনো ছুটির এ ক’দিন
লেখালেখি ও উদ্বেগ
দুশ্চিন্তা থেকে দূরে থাকি।
আমি সুবোধ বালকের
মতো জ্বি জ্বি বলে চলমান। তার
ফোন শেষ হলে ভাবলাম,
তিনি তো আমাকে আল্লাহর
নামের জিকির শুনে খুশির অশ্রু
ঝরাতে নিষেধ করেননি।
বাংলাদেশের ইসলাম ও
মুসলমানের বহু
রক্তঝরা স্বাধীনতা, নিরাপত্তা,
ঈমানী সুরক্ষা, উন্নতি ও
সাফল্যের জন্য আল্লাহর
দরবারে দোয়া আর
কান্নাকাটি করতে তো মানা করেন
নি তিনি। এবার আমি ক্লান্ত ও
নিস্তেজ হয়ে নিজেই লেখা বন্ধ
করে দিলাম। আর লম্বা শ্বাস
নিতে নিতে দীর্ঘ সময় পর
একটি কল রিসিভ করলাম।
কাকতালীয়ভাবে অপরিচিত প্রথম
যে ফোন কলটি আমি রিসিভ
করলাম এটি ছিল আমার
আলোচ্যবিষয় নিয়েই। একজন
নিজেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের
শিক্ষক পরিচয় দিয়ে কথা বললেন
অপর প্রান্ত থেকে।
জানতে চাইলেন,
আমি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে দুই
দিন ব্যাপী তাফসীরুল কুরআন
মাহফিলে আলোচনা করতে গিয়েছিলাম
কিনা? বললাম, মাস দুয়েক
আগে চরমোনাইয়ের মরহুম পীর
সাহেব হুজুরের
সাহেবজাদা মুফতী সৈয়দ
মোহাম্মদ ফয়জুল করীম ভাই
আমাকে এতে যোগদানের দাওয়াত
করেছিলেন। আমি আসার জন্য
প্রস্তুতও ছিলাম কিন্তু হঠাৎ করেই
গত ১৯ এপ্রিল কিছু শারীরিক
সমস্যা, অন্ত্র থেকে পাথর
অপসারণ ও কিডনির পাথর বিচূর্ণ
করা উপলক্ষে অস্ত্রোপচার
করানোয় আমাকে এখন
পরবর্তী চিকিৎসা ও পূর্ণ
বিশ্রামে থাকতে হচ্ছে।
যিনি ফোন করেছিলেন বিষয় ও
তথ্য জেনে রোগমুক্তির
দোয়া করে ফোন রাখলেন।
এরপর জমে থাকা অধরা কলের
তালিকায় দেখলাম
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ
ঢাকা মহানগর সভাপতি হাফেজ
মাওলানা অধ্যাপক এটিএম
হেমায়েত উদ্দীন সাহেবের
নাম্বার। ফিরতি কলেরও যোগ্য
হইনি তখনও আমি। তখনও
এনেসথেসিয়ার ঝিমুনি কাটেনি,
মাথা ধরে আছে, জ্বর
এবং সারা গায়ে প্রচ- ব্যথার
অবশিষ্ট রেশ। যারা মাহফিলের
নিউজ কাভার করতে গিয়েছেন
তাদের কাছে পরে শুনলাম
অসাধারণ সুন্দর সুশৃংখল ও
অকল্পনীয় বিপুল উপস্থিতির এই
তাফসীর মাহফিলের সাফল্যের
কথা। ভাবলাম আরো কিছু
লিখবো কি এ বিষয়ে। কিন্তু
শক্তি বা সাহস কোনটাই পেলাম
না। শরীর বেশ দুর্বল আর ডান
হাতে ওষুধ ও স্যালাইন পুশ করার
ক্যানোলা এখনো যুক্ত।
তাছাড়া সম্পূর্ণ
সেরে না উঠা পর্যন্ত অকারণ
নড়াচড়া ও কোনরূপ
লেখালেখি মাননীয় সম্পাদক
মহোদয়ের মানা। ডেপুটি এডিটর ও
অন্যান্য সিনিয়র সাংবাদিক
মোবাইলে অনুরোধ করেছেন,
আমি যেনো মন ও মস্তিষ্ককেও
বিশ্রাম দিই। কাজের
কথা চিন্তা করাও এখন নিষেধ।
কিন্তু মনকে তো আর
বেঁধে রাখা যায় না।
শরীরকে বিছানায়
ফেলে রাখা গেলেও চিন্তা ও
আবেগের পায়ে শেকল দেয়া যায়
না। মন আমার ঘুরে বেড়ায়
সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, হাইকোর্ট,
শিশু একাডেমী, রমনা ও
শাহবাগে। চিন্তা সচল
থাকে সাংস্কৃতিক বলয়,
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও কাকরাইল
মসজিদ নিয়ে। আবেগ কাজ
করতে থাকে সাতই মার্চের ভাষণ,
লাখো মুসল্লির কণ্ঠে আল্লাহ
নামের জিকির, স্বাধীনতা স্তম্ভ,
শায়খ চিশতীর মাজার,
হাজী শাহবাজ মসজিদ আর
জাতীয় কবির শেষ
আরামগাহকে ঘিরে। পৃথিবীর
ইতিহাসে ইসলাম গৌরব,
আল্লাহপ্রেম ও নবী প্রশস্তির
উপর এতো জীবন্ত জাগ্রত কাজ
বোধ হয় আমাদের জাতীয়
কবি কাজী নজরুল ইসলাম
ছাড়া আর কোনো কবির নেই। তার
এ গানটি যেমন নজিরবিহীন,
গানের মধ্যকার প্রার্থনা কবুল
হওয়ার এমন নমুনাও বিরল।
যেখানে কবি তার স্বপ্ন
তুলে ধরেছিলে।
তিনি যা বলেছিলেন এর ভাব
অনেকটা এ রকম। হাতের
কাছে কোনো বই-পুস্তক না থাকায়
নিখুঁত উদ্ধৃতি দেয়া গেল
না বলে দুঃখিত।
কত পীর আওলিয়া ফকির দরবেশ
নবীজির উম্মত
দিবানিশি করে সেথা কুরআন
তিলাওয়াত
তাদের তিলাওয়তের মধুর ধ্বনি
যেনো এ বান্দা শুনতে পাই।
কত আল্লাহর বান্দা নবীর ভক্ত
মসজিদের আঙ্গিনাতে
আল্লাহর নাম জিকির করে
নিশীথ গভীর রাতে
আমি কেঁদে কেঁদে তাদের সাথে
নাম জপতে চাই,
আল্লাহর নাম জপতে চাই।
মসজিদেরই পাশে আমার কবর দিও
ভাই
যেনো গোরে থেকেও মুয়াজ্জিনের
আজান শুনতে পাই।
মৃত্যুর তিন যুগ পরে হলেও
তিনি সেদিন উচ্চকণ্ঠে আল্লাহর
নামের জিকির শুনতে পেয়েছেন।
যদিও বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদের
আজান নামাজ খুতবা তিলাওয়াত
ও জিকির তার প্রতিদিনই
শোনা হয়।
http://www.dailyinqilab.com/2014/04/
25/174804.php#sthas
h.qDSAPeHu.dpuf