পরীমণি নামক পরীর মতো সুন্দর মেয়েটার একটা ছবি খুঁজতে গেছিলাম। অন্তরে আমার সুপ্ত বাসনা পরীর মতো সুন্দর এই মেয়েটার একটা ছবি লাইফ সাইজ বানায়ে ফ্রেমে করে বান্ধায়ে ঘরের দেয়ালে টাঙায়ে দিব। তো কাঙ্ক্ষিত ছবির তরে গুগল ঘাঁটতেছি। ছবি একটা দেখে মনে হলো এইটারে ফ্রেমে বান্ধালে মানাবে। শাড়ি পরা পরীমণি। তবে বুকের আঁচল হেথা-হোথা না, বুকেই আছে। ফ্রেমে বান্ধায়ে দেয়ালে টাঙায়ে রাখলে কেউ দৃষ্টিতে সন্দেহ লয়ে আমার পানে তাকাবে না। আঁচলের বিষয়টা বোঝা যায় নাই, ঠিক না?
একটা ঘটনা বলি। '৯৫-'৯৬ সালের ঘটনা। সন্ধ্যার পর গেছি এফডিসিতে। এক্কেরে শেষ মাথাটা খুব আলোকিত হয়ে আছে। জায়গাটা অনেকটা পার্কের মতো। নায়ক-নায়িকাদের রোমান্টিক গান-বাজনার দৃশ্যায়ন সাধারণত ওইখানেই হয়। কাছে যাওয়ার পর দেখা গেল সেদিনও গানের দৃশ্যর শুটিং চলতেছে। গান বাজলেই নায়িকা নাচে। নায়িকার পেছনে অনেকগুলা মেয়ে। তারাও নাচে। এক লাইন গাওয়া হলেই থেমে যায়। নৃত্যছন্দ কিংবা ঠোঁট নড়াচড়ার সমস্যা। স্পুল টেনে ওই লাইন আবার বাজানো হয়। এভাবে চলতে থাকে। আমি গিয়ে ডিরেক্টরের পিছনে দাঁড়ায়ে পড়লাম, 'ভাই, সিনেমার নাম কি?'
ডিরেক্টর চেয়ারে হেলান মেরে বসা। তাকায়ে ইশারা করল পরে কথা বলবে। নায়িকারে নৃত্যর মুদ্রা দেখায়ে দিতে থাকা লোকটারে ডাক দিল। সে লোকে নায়িকা থুয়ে খিঁচে দৌড় মেরে কাছে আসতে বলল, ওই মেয়ে আঁচল দিয়ে পুরা বুক ঢেকে রাখছে ক্যান? বোরকা এনে দিব? জিগাও তো বোরকা পিনবে কিনা?
নায়িকা মেয়েটা এবারে শাড়িটার আঁচল নামায়ে ফেলল যেন বুক ঢেকে না ফেলে।
শাড়ির আঁচল দিয়ে যে বুক ঢেকে রাখা যাবে না- এই খবর তো পরীমণি মেয়েটা পরীমণি হওয়ার আগে জানত না। আমার মতো করেই এফডিসি গিয়ে জেনে ফেলছে।
পরীমণি মেয়েটা যে এখন এই দেশের চলচ্চিত্রর নায়িকা, এই কথা জানাতে গেলে লোকেরা আমারে মারবে। বর্তমান বাংলাদেশের কানার ভাই অন্ধও জানে যে পরীমণি নামক পরীর মতো সুন্দর মেয়েটা সিনেমার নায়িকা। নায়িকা হওয়ার ক্ষেত্রে অলিখিত কিছু শর্ত আছে। শর্ত হলো, খালি পরীর মতো সুন্দর হলে হবে না। নৃত্য করতে জানতে হবে। বিশেষ নৃত্য। এই নৃত্যরে বলে আবেদনময়ী। এই নৃত্য না জানলেও সমস্যা নাই, সিনেমাঅলারা শিখায়ে নিবে। এবং আরও গুরুত্বপূর্ণ হলো, সে যে পরীর মতো সুন্দর সেইটা দেখাতে জানতে হবে। আরও আছে, যে বুকের জন্যে নির্মিত শাড়ির আঁচল, সে আঁচলরে বুকে থাকতে দেয়া যাবে না। নাইলে হবে না।
তো যে ছবিটা ফ্রেমে বান্ধানের জন্য পছন্দ হলো সে ছবিতে পরীমণির গাঢ় সবুজ রঙা একটা শাড়ি পিন্দে নৃত্যর মুদ্রা টাইপ একটা ভঙ্গি করে হাসতেছে। এই হাসির নাম বুকে বিন্ধে যাওয়া হাসি। আমার অবশ্য বুকে বিন্ধে নাই। বুকে বিন্ধে যাওয়া হাসি হাসতে পারা লোক আমার আছে।
তো সেই ছবির সঙ্গে যে খবরটা আছে, সে খবরের শিরোনাম হলো, ‘লকডাউনে কেমন আছেন পরীমণি?’ রিপোর্টার একলা জানতে চান নাই। আরও হাজারে হাজারে, লাখে লাখে লোকেরা জানতে চেয়েছেন।
বিষয় হলো, শাড়ির আঁচল যদি নায়িকার বুক ঢেকে ফেলে তাহলে ওই রিপোর্টার লোকে 'লকডাউনে পরীমণি মেয়েটা কেরম আছে' -জানতে যাবে না। হাজারে হাজারে, লাখে লাখে লোকেরাও রিপোর্ট পাঠ করে জানতে আসবে না- 'লকডাউনে পরীমণি মেয়েটা কেরম আছে।'
আমার এক ভাগ্নেকে কোলে করে তার বাবার লাশ দেখাতে নিয়ে গেছিলাম। পরীমণি মেয়েটা ঠিক ওই ভাগ্নেটার সমান বয়সি।
আমার বন্ধুভাগ্য নিয়ে আমার অহংকার আছে। পরীমণি মেয়েটা বাংলাদেশের পিরোজপুর জেলার। পিরোজপুরেও আমার বন্ধুবান্ধব আছেন। আছেন ভাইও। তেমনি এক ভাই জানালেন, পরীমণি মেয়েটা গাঁয়ের মানুষ। বেড়ে উঠছে নম্র, ভদ্র আর ধর্মীয় অনুশাসন লয়ে। লেখাপড়া তার গাঁয়েই। ছেলেবেলায় মেয়েটার মা আগুনে পুড়ে মরে গেল। আগুনে পোড়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি মরে যান নাই, দুটা মাস অসহ্য যন্ত্রণায় ভুগছেন। তারপর মরে গেছেন। এরপরে মরে গেল পরীমনির বাপটাও। মরে যান নাই আসলে। ব্যবসায়িক প্রতিপক্ষ লোকেরা মেরে ফেলছে।
কাদামাটি আর ধর্মীয় অনুশাসনের মতো পরীমণি মেয়েটা অভিভাবকশূন্য হয়েও বেড়ে উঠছে। মেয়েটার একমাত্র আপনজন তার মায়ের পিতা। তার নানা। যে স্কুলে পরীমণি পড়ত, সেখানে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়েছিল। ওই প্রথম। ও স্কুল থেকে এর আগে আর কেউ বৃত্তি পায় নাই। স্কুল শিক্ষকরা বলছেন, লেখাপড়ার দিকে মেয়েটার খুব করে আগ্রহ ছিল। কিন্তু একমাত্র আপনজন বৃদ্ধ নানা কৈশোরেই পরীমনিরে ওই গ্রামেরই এক ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে সংসারী করতে চাইল। আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় বিত্তহীন পরিবারে পরীর মতো সুন্দর একটা মেয়ে তো অনেকটা একটা অভিশাপের মতো। কিন্তু নানার চেষ্টাটা সফল হয় নাই। পরীমণির সংসারটা দুই বছরের বেশি টিকে নাই। না টেকার দায়টা পরীমনির না। মেয়েটার স্বামী পরিচয় বহন করতে থাকা যে ছেলেটা, সেই ছেলে পরীমণির নানার কাছে দু লাখ টাকা যৌতুক দাবি করে বসল। নানা টাকাটা দিতে পারেন নাই। তাই রাগে স্বামী পরিচয়ের ছেলেটা পরীমণিকে তালাক দিয়ে দিল।
এরপর কালের পরিক্রমায় পরীমণি মেয়েটা নায়িকা হয়ে গেল। নায়িকা হওয়ার কিছু শর্ত আছে। খালি পরীর মতো সুন্দর হলেই হবে না। সে যে পরীর মতো সুন্দর সেইটা দেখাতে জানতে হবে। আবেদনঅলা নৃত্যকলা করতে জানতে হবে। আর বুকের আঁচল বুকে থাকতে দেয়া যাবে না…
এখন পরীমণি নামে এই মেয়েটার ছবি বান্ধায়ে রাখতে চাওয়ার রহস্য বলি। দেখেন তো, গাঁয়ের নম্র, ভদ্র আর ধর্মীয় অনুশাসনের মধ্যে বেড়েওঠা পরীর মতো সুন্দর বিত্তহীন পরিবারের এই মেয়েটা এখন টক অব দ্য কান্ট্রি। তারে ধরে ফেলতে র্যাব ত্রা পুরা বাড়ি ঘেরাও করে ফেলে। দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যাংকের এমডি আর সিইও তারে সাড়ে তিন কোটি টাকা দামের গাড়ি উপহার দেয় বলে খবর হয়। তারপরে ব্যাংকের হেড অব কোর্ট অপারেশন থানায় জিডি করে বলে- এই মেয়েরে আমাদের বস লোকে এই জীবনেও দেখে নাই। এই মেয়ে মামলা করতে গেলে গোয়েন্দা কর্মকর্তার লগে প্রেম হয়ে যায়। যাদের লগে প্রেম হয় না তারা দুঃখে মাথার চুল ছিঁড়ে। পুরান নায়িকাগুলা ঢলে পড়া সূর্যর মতো জ্বলজ্বলে হয়ে অকথা-কুকথা কয়। দেশের মাথা মাথা লোকেরা সুচিন্তিত মতামত দেয়। ফেসবুকের লাখ লাখ লোকের লোলুপ চোখে এই মেয়েরে দেখে আর বোরকা হেজাব পিন্দে ফেলতে বলে পরামর্শ দেয়। তো যারে নিয়ে একটা পুরা দেশের নির্বিশেষে নারীপুরুষ, সাংবাদিক, অলোক-কুলোক, সকলের ঘুম হারাম -তার ছবি বান্ধায়ে ঘরের দেয়ালে টাঙায়ে রাখা দায়িত্ব ও কর্তব্য।
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই আগস্ট, ২০২১ সকাল ৯:১৮