গত জানুয়ারিতে থানচির দুর্গম পাহাড়ে একযোগে লিলি ব্যোমের প্রেমে পড়ার পর আমাদের পরবর্তী গন্তব্য ঠিক করা ছিল সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওর। কিন্তু আজ-কাল-পরশুর ঝামেলায় পড়ে আমাদের নিয়মিত ট্যুর মেম্বারদের সময় সহযোগ না ঘটায় সেটা আর হয়ে উঠছিল না। সবার সময় না হওয়ায় কয়েকজনকে রেখেই আমাদের সুনামগঞ্জ যাবার দিনক্ষণ ঠিক হলো- সেপ্টেম্বরের ২২ তারিখ দিবাগত রাত।
ট্যুর হবে, আর ঝামেলা হবে না- তা তো আর হয় না। তাই এবার ট্যুর শুরুর আগেই ঝামেলাটা আমি-ই বাঁধিয়ে দিলাম। অবস্থা এমন আমি যাবো না এই ট্যুরে। কিন্তু নিজের লোকদের সাথে রাগ করে আর কতক্ষণ-ই বা থাকা যায়? শেষমেষ রাগ চাপা দিয়ে আমিও ট্যুরের জন্য তৈরি হয়ে নিলাম।
অন্যবারের মত এবার আর আমাদের ট্যুর একযোগে শুরু হয় নি। এবার ভেঙে ভেঙে সবাই সায়েদাবাদ এসে মিলিত হই। আমাদের ম্যানেজার পিয়াস আলাদাভাবে আগেরদিন আরেকটা গ্রুপের সাথে সুনামগঞ্জ যেয়ে মাস্তি করছিল। ট্যুর কো-অর্ডিনেটর সাইফ ওদিকে ফার্মগেটে ওদিকে একটা কাজে ছিল। মাস দু'য়েক আগে বাইক অ্যাক্সিডেন্ট করে সিফাতের ট্যুর হবে না বলেই ভেবেছিলাম। তবে শেষ মূহুর্তে আন্টির অনুমতি পেয়ে সিফাতও ডাক্তারের চেক আপ করতে ধানমন্ডি অবস্থান করছিল।
ওদিকে শিক্ষক রাতুল তার ক্লাস করিয়ে বাসায় ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা। তাই আমি আর তুহিন একটু আগেভাগেই বের হয়ে গাবতলী থেকে টিকেট সংগ্রহ করে সায়েদাবাদ রওনা হলাম। আর আমাদের ট্যুরের নতুন সংযোজন বিশিষ্ট ভ্যাম্পায়ার গোষ্ঠী বাঁধন এর সাবেক প্রেসিডেন্ট হাসান মনি, সিফাতের বাসা থেকে সিফাতের সামগ্রী নিয়ে রওনা হয় সায়েদাবাদের উদ্দেশ্যে।
রাত ১১.৪৫ এর শ্যামলি এন.আর. এর বাস ১২.১৫ তে ছেড়ে গেল। পথিমধ্যে 'উজান-ভাটিতে' যাত্রাবিরতিতে নাস্তা সেরে নিয়ে বাসে উঠেই চমক! আমাদের মাস্টার সাহেবের আমাদেরকে "গরীবের রেডবুল" বুলডোজার দিয়ে আপ্যায়ন করা। গরীবের হলেও স্বাদ মাশাআল্লাহ!! আমরা সবাই একমত।
বাস চলতে চলতে সিলেটের বাইপাসে চলা শুরু করলো। ততক্ষনে শেষরাত। হালকা চাঁদের আলোয় একের পর এক হাওর উপভোগ করতে লাগলাম। বেশ কিছুটা পথ চলার পর ফযরের আযান দিয়ে দিল। আরও আশ্চর্য্য করে দিয়ে হঠাৎ করেই হাওরজুড়ে আলো ফুঁটে উঠলো। বেশ কয়েকটা জেলে নৌকা বের হয়ে পড়েছে ততক্ষণে হাওরজলে, জীবিকার আহ্ববানে। অনেকটা পথ রাস্তার দু'ধারে জলাধার। আঁধো আলো-আঁধো ছায়ায় মায়াবী পরিবেশ। এভাবে চলতে চলতে সুনামগঞ্জ শহরে এসে পৌঁছালাম- ভোর তখন ৫.৩০টা। তখন আমাদের ম্যানেজার পিয়াসের জন্য অপেক্ষা ছাড়া আর কোন কাজ নেই। ম্যানেজার সাহেব ৩০ মিনিটের কথা বলে এসে পৌঁছলেন ঠিক ১ ঘন্টা পর, মানে সাড়ে ৬ টায়! বাঙালি সময় বলে কথা।
এবার সবাই একসাথে। আলোচনা করে পরবর্তী পরিকল্পনা করে ফেলা হলো। ৭ জনের জন্য একটা লেগুনা ঠিক করে উঠে পড়লাম। যাব তাহিরপুর সদর। বেশ উঁচুনিচু (বাম্পি) পিচের রাস্তায় দুলতে দুলতে আর একপাশে মেঘালয়ের বিশাল বিশাল পাহাড় দেখতে দেখতে আমরা দেড় ঘন্টার মধ্যে পৌঁছে গেলাম তাহিরপুর সদর। ৫ মিনিট হেঁটে গেলাম বাজারে। সেখানে নাস্তা করে ঠিক করা হলো একটা মাঝারি নৌকা। এই নৌকাই আমাদের পরবর্তী আবাস। কিছু শুকনো খাবার কিনে আর ৭ জনের জন্য ৬ টা লাইফ জ্যাকেট ভাড়া নিয়ে নৌকায় উঠতে উঠতে প্রায় ১২ টা। ইঞ্জিনের নৌকা ভেসে পড়লো সুবিখ্যাত টাঙ্গুয়ার হাওরে। ঘন্টা দেড়েক নৌকা চলে আমরা ভিড়লাম ওয়াচ টাওয়ারের গায়ে। সেখানে দু'টো ডিঙি নৌকায় ভাগ হয়ে আমরা ৬ জন একটু ঘোরাঘুরি করলাম। সিফাত রয়ে গেল বড় নৌকাতেই। খোঁড়া পা নিয়ে তো হাওরে দাপাদাপি করা যায় না!
লাইফ জ্যাকেট গায়ে চাপিয়ে আমরা হাওরের থৈ জলে নেমে ঘন্টা ব্যাপী জলকেলি করলাম। জলে দাঁড়িয়েই ভাসমান দোকান থেকে গরম গরম চাও ভালোই লাগলো। এখানে ডিঙি নৌকার মাঝি দু'টো বয়স দশ পাড় হয় নি। কিন্তু খিস্তীতে কেউ বড় মানুষের থেকে কম নয়। অন্য মাঝিদের সাথে সমানতালে গলা চলে এদের। আবার এদের গলায়ই শুনলাম, "আমি তো ভালা না, ভাল লইয়াই থাকো" আর হালের জাতীয় গান "অপরাধী'। গানের কথায় এদের কিছু নিজস্বতা কানে বাঝলো না।
কড়া রোদে ঘন্টার উপর পানিতে ভিজে গায়ের চামড়া পুড়ে লাল। ফিরে এলাম আমাদের বোটে। বোটে এসে ভেজা জামা-কাপড় বদলে নিলাম। কাপড়গুলো মেলে দিলাম নৌকার গলুইয়ের উপর। এরপর অনেকটা সময় বিশ্রাম নিয়ে আমরা রওনা হলাম আমাদের গন্তব্য ট্যাকেরঘাটের উদ্দেশ্যে। বাজে প্রায় ৩ টা। আমাদের ইঞ্জিন নৌকা চলছে। সবাই ক্লান্তিতে ঢুলুঢুলু। শুয়েই আছে। এর মাঝে আমি আর বন্ধু হাসান নৌকার ভেতর থেকে উপরে উঠে এলাম। রোদ ছিল বেশ। কিন্তু হঠাৎই আমাদের অবাক করে দিয়ে মেঘালয়ের পাহাড় থেকে ধেঁয়ে আসতে দেখলাম কালো ঝড়। আমরা তখন বৃষ্টির কবলে প্রায়। ঘনঘন বিজলী চমকাচ্ছে টাঙ্গুয়ার হাওর জুড়ে। ভয় হচ্ছিল বজ্র আবার না নৌকায় পড়ে! পড়লে ভবলীলা সাঙ্গ সেখানেই। ভাগ্য ভালো ছিল।
ততক্ষণে ভেজা কাপড় শুকিয়ে কটকটে। কাপড় আর লাইফ জ্যাকেট ভেতরে নিয়ে এলাম। বৃষ্টি আর আমাদের নৌকার প্রতিযোগিতা লেগেছে। বৃ্ষ্টি আমাদের ছুঁতে চায়, নৌকা ধরা দেবে না। মাঝি আমাদের জানালো যে, এখন হাওর উত্তাল। আমরা নিরাপদে আছি, কারণ তখন আমরা হাওর পেরিয়ে খাল বেঁয়ে নদীর বুকে-পাতলাই নদী। পেছনে দেখা গেল অপরূপ দৃশ্য! কয়েকশ গজ দূরে মেঘালয়ের পাহাড়ের সাড়ি, আর আমাদের চারপাশে জলরাশি। দূরে হাওরের জল তখন উত্তাল, সাগরের বুকে যেন বিশাল বিশাল ঢেউ। চারপাশ অদ্ভুৎ এক সবুজ-কালো।
বৃষ্টি বাড়লো বেশ। আর বাইরে থাকতে পারলাম না। ভেতরে এসে নৌকার সবগুলো জানালা বন্ধ করে দিয়ে শুয়ে রইলাম। বৃষ্টি ছাঁড়তে সময় নিলো না। আমরা তখন ট্যাকেরঘাটে। নৌকা পাড়ে ভেড়ানো হলো। আমরা নৌকার ভেতর থেকে একে একে বের হয়ে এলাম। বৃষ্টিশেষে পাহাড়ের পাদদেশে অদ্ভুৎ সুন্দর পরিবেশ ট্যাকেরঘাটে তখন। পাড়ে দাঁড়িয়ে চারপাশে চোখ বুলিয়ে নিলাম আমরা। ঝিড়ি ঝিড়ি বৃষ্টির মধ্যেই বেরিয়ে পড়লাম আমরা। নৌকা থেকে নেমেই চোখে পড়লো শহীদ মিনার।
আরেকটু সামনে এগুতেই দেখা গেল ট্যাকেরঘাট চুনাপাথর খনির সাইনবোর্ড। চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে খনির বিভিন্ন মেশিনপত্রের পরিত্যাক্ত অংশবিশেষ। বোঝা গেল বসতিটা গড়ে উঠেছিলো এই খনিকে কেন্দ্র করেই।
ট্যাকেরঘাট মধ্য বাজারে পৌঁছে গেলাম হেঁটে হেঁটেই। ঠিক সামনেই বসতি। বেশ সুন্দর। আমি আর হাসান বাদে বাকি সবাই আ. রাজ্জাক সাহেবের "রবিন রেস্টুরেন্ট" পেয়ে খেতে বসে গেল। আমরা খুধা না থাকায় পাড়ায় হাঁটতে বের হলাম। এগুতে এগুতে গার্লস স্কুল, কলেজ, হাই স্কুল আর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠ পেরিয়ে চলে এলাম মেঘালয়ের পাহাড়ের পাদদেশে। দুঃখের বিষয় আমাদের কোন পাহাড় নেই। যা আছে দু'একটি টিলা। অধিকাংশ সুন্দর টিলাই নো ম্যানস ল্যান্ড এ। আমরা সেখানেই বেশ কিছু ছবি তুলে নেই।
আমরা ফিরছিলাম। কিন্তু ওদিকে দলের বাকি সবাই আবার অন্য পথে আমাদের রেখে যাওয়া স্থানেই চলে আসে। আমি আর হাসান ওদের সাথে যোগ দেই। বেশ কিছুক্ষণ ইন্ডিয়াকে খিস্তি-খেউড় করে আমরা রওনা হলাম ট্যাকেরঘাটের জনপ্রিয় পর্যটন স্পট নীলাদ্রি। নীলাদ্রি আসলে একটা কৃত্রিম লেক। বছর বিশেক আগ পর্যন্ত সেখানে ছিল "চুনাপাথর খনি"। সেই খনির খননে এই লেকের সৃষ্টি। বেশ কিছুক্ষণ ছবি তুলে আমরা বসে রইলাম সেখানে বাঁধানো বেঞ্চে। বিকেলটা পুরোটা সেখানেই কাটালাম। চাঁদনির সৌন্দর্য্যও সেখানেই বেশ লাগছিল।
নীলাদ্রিতে বসে বসেই রাত প্রায় নয়টা বেজে যাওয়ায় বাজারে ফিরে আসি। রাতের খাবারের অর্ডার দিলাম সেই রবিন হোটেলেই। মেনু হাঁসের মাংস। ১০ টাকার বিনিময়ে মোবাইল ফোনের চার্জ দেবার ব্যবস্থাও আছে পাওয়ার ব্যাংকের অভাবী লোকদের জন্য। বাজারে এদিক-সেদিক ঘোরাঘুরি করে, চা খেয়ে বেশ কাটলো সময়। বাংলাদেশ-আফগানিস্তান ম্যাচের বাংলাদেশ অংশের শেষ দু'ওভার দেখলাম। বাংলাদেশের ইনিংসের শেষে খেতে বসলাম। হাঁস সাধারণত আমি খাই না। তবে রবিন হোটেলের হাঁসের মাংসের স্বাদ সত্যিই অতুলনীয় লেগেছে। এমন প্রত্যন্ত সীমান্তবর্তী গ্রামের বাজারে এমন সুস্বাদু খাবার কল্পনায় ছিল না।
খেয়েদেয়ে আরো কিছুক্ষণ ট্যাকেরঘাট বাজারে ঘুরে আমরা নৌকায় ফিরে আসলাম রাত ১১ টার দিকে। এরপর নৌকার ছাঁদে বসে চললো আমাদের চন্দ্র দর্শন। যদিও পূর্ণিমা হতে তখনও ১ দিন বাকি ছিল, তবে জ্যোছনার অভাব ছিল না। মোবাইলে গান শুনলাম কিছুক্ষণ। কিন্ত নীরবে আকাশ আর চারপাশে তাকিয়ে থাকাতেই বেশি ভালোলাগা কাজ করেছে আমার। নৌকা তখন হাওরের মাঝে, তীর থেকে খানিকটা দূরে এনে নোঙর করে রাখা। চারপাশে আরো বেশ কয়েকটা নৌকা আমাদের মতই নোঙর করা ছিল। ওদিকে মেঘালয় পাহাড়ে ভারতীয় সীমান্তের কাঁটাতাড়ের সাড়ি সাড়ি ফ্লাডলাইটের আলো এসে পড়ছে চারপাশে। আরেকপাশে চাঁদ তার আলো বিলিয়ে যাচ্ছে সবকিছু ভেঁদ করে।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৮ রাত ৮:২৩